শঙ্খ শিল্প
বিগত হাজার বছরের রাঢ় বাংলার বিষ্ণুপুরের শঙ্খ
শিল্প নিয়ে বৃহতবঙ্গে যা বলে গিয়েছেন দীনেশ্চন্দ্র সেন তার পরে যা বলা হবে তা সবই
পুনরুক্তি দোষে দুষ্ট। ফলে আজ যা বলব পুরোন কথা তা সমঝদারেরা জানেন। কিন্তু
আধিকন্তু ন দোষায়ঃ তাই এই নিয়ে নম নম করে কলম পাত করে চলে যাব আজকের অবস্থা বর্ণনে।
বাংলার যে কটি হাতে গোণা শিল্প নিজের এলাকার
ওপাদান নিয়ে কাজ করে না, সেগুলোর মধ্যে বাংলার শঙ্খ শিল্প আন্যতম। কয়েক হাজার
বছরের পুরোনো ইতিহাসে পাই বিষ্ণুপুর আর ঢাকা শহরের শাঁখারিদের সুনাম বাংলা, ভারত
ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। বাংলার প্রায় প্রত্যেক শহরেই শাঁখারি
পাড়া থাকলেও, তার মধ্যে একদা প্রখ্যাত মেদিনীপুর, ডোমকল, কলকাতার বাগবাজার বা শ্রীমানী
মার্কেটের কাছের দোকানগুলো আজও তাদের স্বমহিমায় বজায় থাকলেও বিষ্ণুপুর এই ভেঙে পড়া
বিশ্বায়নের বাজারে তার নিজ ঐতিহ্যেই ভাস্বর।
বাংলার অদম্য পণ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল শঙ্খ
এবং শঙ্খ বিষয়ক নানান দ্রব্য। শাঁখারি পাড়ার নন্দীরা ছিলেন আন্যতম প্রধান শিল্পী।
শাঁখ আসত মাদ্রাজ, মলদ্বীপ বা শ্রীলঙ্কা থেকে। শাঁখের ওপরে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কাজ
করার জন্য মাহির নন্দীরা। আপনাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবার ইচ্ছে ছিল রবি নন্দীর।
আফশোসের কথা, কয়েক মাস আগে তিনি প্রায় আনাবশ্যকভাবে দেহ রেখেছেন। তাঁর কাজ ছিল
প্রবাদ প্রতীম। দেশ বিদেশ ঘুরেছেন বলে নয়, তিনি ছিলেন সবার থেকে আলাদা, কিন্তু
নিজের শেকড়ে দাঁড়ানো এক শিল্পী। যিনি পরম্পরাকে নিজের দায়ের চামড়া করে নিয়ে তার ওপরে
নিজস্বতার জামাকাপড়ের পরত চড়ান।
শাঁখের ওপর যে কোনও কাজ পাথরের ওপরের কাজে মতই
শক্ত। কেননা নীরস একটি তলের ওপরে মূতির মুখের নানান আবেদন তৈরি কতদূর যেতে পারে
তার নিদর্শন আজন্তা ইলোরা বা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা হাজারো পাথরের মূর্তি। কেননা সেই
পাথরের ওপর একটুকরো অন্য আঁচড় পড়ে গেলেই চিত্তির। গোটা পাথরকেই ফেলে দিতে হয়। ফলে
যখন একজন শিল্পী গোটা পাহাকেই নিজের ভাষ্কর্যের পাত্র হিসেবে ধরে নিয়েছে,
সেক্ষেত্রে আরও বিপদ। আলাদা আলাদা পাথরে কাজ ভাল না হলে তাঁকে ফেলে দেওয়া যায়।
কিন্তু গোটা পাহাড়ের চাঙড় ধরে কাজ হচ্ছে সেখানে ভুল করার সুযোগ থাকে না বললেই চলে।
ঠিক এক কথা বলা চলে শঙ্খ শিল্পীদের কাজে। গোটা শঙ্খের
ওপর যখন তিনি দশাবতার, বিষ্ণুর বিশ্বরূপ বা এ ধরণের কিছু করছেন, তখন তার কাছে
বিন্দুমাত্র ভুল করা মানে গোটা দামি শঙ্খটি বরবাদ হয়ে যাওয়া, সঙ্গে সময়টিও। ফলে একটি
শঙ্খের কাজে সময় লাগে পনের দিন থেকে তিন মাস কখনো ছয় মাসও। দাম
বেড়ে চলে। বিক্রিও কমে গিয়েছে। জীবিকা নির্বাহ করা
কঠিন।
এ বাবদে আপনারা যোগাযোগ করতে পারেন নিতাই নন্দীর
সঙ্গে। নিতাই প্রখ্যাত শঙ্খ শিল্পী জাতীয় পুরস্কার বিজয়ী পিতার পুত্র। নিজে রাজ্য
পুরস্কার জিতেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্নের বিশ্ববাংলা প্রকল্পে শাঁখ সরবরাহ করছেন।
কিন্তু শাঁখের কারুকাজে আর তার জীবন চলেনা। তাই
তিনি সম্প্রতি নারকেল মালা আর তাল কাঠ নিয়ে নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন। তার জীবন
নতুন খাতে প্রবাহিত হচ্ছে। শাঁখের ধূপদানি, মোমদানি, জল শঙ্খ ছাড়াও তিনি তৈরি
করছেন আপূর্বসব মালা, কানের দুল। নিতাই নন্দী এ ছাড়াও করছেন নারকেল মালার টি সেট,
স্যুপ খাবার নানান ধরণের কারুকার্যময় পাত্র, তাল আর পেয়ারা কাঠের হাতল দেওয়া
নারকেল মালার ডাবু ওয়ালা হাতা, কাঁটা-চামচ, আসম্ভব সুন্দর দেখতে পেয়ারা কাঠের নুন
মরিচ দানি, মাথার কাঁটা আরও কত কী। যা বলা হল না, তাঁর কাছে পাবেন বিভিন্ন
কারুকাজময় পুজোর ঘরের বা নিজের বসার ঘরের শোভা কারুকার্যময় শঙ্খ। দাম আঁকার
অনুযায়ী দেড়াজার হাজার দু হাজার থেকে বিশ পঁচিশ তিরিশ হাজার পর্যন্ত।
শঙ্খের কাজ বাংলার শিল্পীদের নিজস্ব সম্পদ। নিতাই
নন্দীর সঙ্গে কথা হলে আবশ্যই দেখতে ভুলবেন না শাঁখের করাত। ছোটবেলা থেকে নিশ্চই
শুনে আসছেন প্রবাদটি। চোখে দেখা হয় নি? বাংলার কামারদের তৈরি করা নিজের দেশের আন্য
এক শিল্পীদের কাজের জন্য বানিয়ে দেওয়া উপহার। এ এক অত্যাশ্চর্য যন্ত্র। বিশ্বের
ইতিহাসে মেল পাওয়া ভার। সঙ্গে ১৭৯২ সালে বাংলায় ভাগ্যান্বেষণে আসা ডাচ শিল্পী
সলভিনসের আঁকা একটি ছবি জুড়ে দিলাম। সে সময় তিনি কলকাতার নানান পেশার মানুষদের ছবি
এঁকে ছিলেন। ছিলেন শঙ্খ শিল্পীরাও। তিনি হাতে শাঁখের করাত নিয়ে দাঁড়িয়ে।
No comments:
Post a Comment