পাঁশকুড়া বা বালিচক স্টেশন থেকে সবংএর দিকে গেলে পড়ে দশগ্রাম, সবং, তেমোহানি, কুচবসান, সারতা, খাজুরি, বালিচক প্রভৃতি অঞ্চল। অঞ্চলে যে একহারা মাদুর বোনা হয়, তাতে একটি মাত্র টানায় সামনাসামনি দুজন
কারিগর বসেন প্রতি কাঠি বোনার পর শানা মারেন। কাঠি যে যার বাঁদিক থেকে বোনা আরম্ভ করেন। বোনার শেষে কাঠির ডগা টানার শেষে যে দড়ি
থাকে সেই দড়িতে পেঁচিয়ে রেখে গিয়ে পরে শানা মারার সময় ডগা মুড়ে গাঁট দিয়ে যান। তাই বুননের সঙ্গে সঙ্গে বাঁধাও শেষ হয়। তাই মাদুর চিকন হয়,
মসৃণ থাকে, আরক ধার সোজা বাঁধার ফলে দেখতেও সুন্দর
হয়।
আর মাদুর তৈরি হয় কলকাতা-দীঘার পথে রামনগরে। এখানে একজন শিল্পী ৩-৫-৭ করে কাঠি বুনে শানা মারেন। আর বোনার সময় বাঁধাও হয় না। সামনা সামনি বসে একজন বিজোড় কাঠি বোনেন
এবং শানা মারেন। ফলে মাদুরের জমি প্রায়শঃই মসৃণ হয় না। ফলে মাদুরের ধার অসমান হওয়ার সুযোগ থেকে যায়।
কাঁথি-খড়্গপুর বা মেচেদা-বাজকুল-দীঘা রাস্তায় পড়ে এগরা– এ অঞ্চলেও রামনগর অঞ্চলের একহারা বুননের রীতি অনুসরণ করা হয়। এখানে রঙিন মাদুর কম হয়। সবংএর দোহারা মাদুরের বুনন পদ্ধতি অন্যান্য অঞ্চলের মতই।
সবংএর মোহাড়ে এক বিশেষ মাদুর তৈরি হয় – নাম চালা মাদুর যা দোহারা মাদুরের মধ্যে
সর্বশ্রেষ্ঠ। প্রথনে দুই তিন ইঞ্চি বোনার পর বোনা অংশের কাঠিগুলিকে নখ দিয়ে শিল্পীরা পেছনের
দিকে চালিয়ে মাদুরকে যতসম্ভব খাপি করার চেষ্টা করেন। তাই জমিন ঘন হয়,
বেশিদিনও ব্যবহার করা যায়। রামনগর অঞ্চলে দোহারা মাদুর কম হয়,
এগরায় বেশি হয়। তৈরি হয় মাদুর আর আসন।
সবং আর রামনগরে মসলন্দ মাদুর তৈরি হয়। কাঠির মান অনুযায়ী মসলন্দ মাদুরের মসৃণতার হেরফের হয়। সবং অঞ্চলের শিল্পীরা এই মাদুর বোনার সময়
কাঠি দাঁত দিয়ে চিরে নেন। আর মাদুর বোনার সময় ধার বেঁধেও যান। প্রকৃতিক রং ব্যবহারের জন্য রং পাকা হয়। সবং এলাকার কাঠি সবুজাভ তাই দেখতে অনেক
সুন্দর। রামনগরের কাঠি অনেকটা হলদেটে – মাদুরের কাঠি থেকে পিথি অংশটা বাদ
দেওয়া হয় – তাই স্থায়িত্ব বেশি।
আজকাল চিন থেকে সরাসরি আসছে
প্লাস্টিকের মাদুর। দাম কিছুটা কম, রংচঙে। প্রথমের দিকে দেদার বিকোলেও কিছুদিন পরে
বিক্রি বেশ কমে গিয়েছে। প্লাস্টিকের কাঠির আঁশ উঠে শোয়াতো দূরস্থান, বসারও
অযোগ্য। আদতে মাদুরের সৌন্দর্য তার গ্রাম্য নম্রতায়; যত দিন যাবে মাদুর যত ব্যবহার হবে
সে ততই মোলায়েম হবে – বসে শুয়ে আরাম। মাঝে মধ্যে ধুয়ে দিতে হয়।
ইদানিং শহরে প্রচুর বাতানুকূল যন্ত্র
বিক্রি হওয়ায় শহর এলাকায় মাদুরের চাহিদা বেশ কমে গিয়েছে। মাদুর শিল্পীরা শুধু
মাদুর না বুনে মাদুর কাঠি দিয়ে নানান রকমের ব্যবহার্য দ্রব্য তৈরি করছেন। সেগুলির
চাহিদাও ক্রমশ তৈরি হচ্ছে শুধু শহরেই নয় গ্রামেও। টেবল ম্যাট, জানলা দরজার
ভাঁজ করা নানান রঙের পর্দা ইত্যাদি তৈরি করছেন। আদতে গ্রাম বাংলার মানুষেরা নানান
বাধা বিপত্তি সয়ে কিন্তু গ্রাম বাংলার শিল্পগুলির পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। শহরের
মানুষেরা আরেকটু উদ্যমী হয়ে গ্রাম বাংলার উৎপাদনের পাশে দাঁড়ালে দেশের অর্থনীতির
চেহারাটাই পাল্টে যেতে পারে।
No comments:
Post a Comment