বর্ধমান
শোলা – বনকাপাসি
বাংলায় মালাকারেরাই বংশ পরম্পরায় শোলার কাজ করে থাকেন।
শোলার কাজ সাধারণতঃ তিন ধরণের হয়ে থাকে, ১) বিভিন্ন দেব দেবী এবং তাদের মেঢ় সাজাতে
এক ধরণের শোলার কাজ হয়, সেগুলি মূলত জ্যামিতিক আকার, বাংলার আলপনা বা মন্দির
গাত্রের নানান কারুকাজ ভিত্তিক, ২) টোপোর সহ নানান ফুল, মালা, বিভিন্ন আচার
আনুষ্ঠানে প্রয়োজনীয় নানান জিনিস যেমন বলা হয়েছে দিনাজপুরের মধুমঙ্গল মালাকারের
লেখায়, ৩) বিভিন্ন মডেলের কাজ যেমন করেন খাগড়া, বা আমাদের আলোচ্য বনকাপাশির
কারিগররা যারা নানান ধরণের মুর্তি বা মুখাবয়ব বানান বা একই সঙ্গে ক্রেতার চাহিদা
অনুযায়ী নানান ধরণের ফরমায়েসি জিনিস বানান।
বর্ধমান কাটোয়া রেলরাস্তায় পড়ে বনকাপাসি। বাংলার যে সব
এলাকা শোলা শিল্পের জন্য বিখ্যাত, বনকাপাশি তাদের মধ্যে অন্যতম। এখানে প্রখ্যাত
আন্তর্জাতিক শিল্পী আশিস মালাকারের বাস। তিনই তাঁর বাবার পথ ধরে নানান ধরণের
কাজ করেন। আশিস কয়েকবারই বিদেশ গিয়েছে।
কাঞ্চননগরের ছুরি কাঁচি
বর্ধমানের ছুরি-কাঁচি শিল্প এক সময় ছিল জগৎ বিখ্যাত। ঊনবিংশ শতাব্দীর একটি লেখায় বলা হয়েছিল, ‘সম্প্রতি কাঞ্চননগরের জনৈক প্রেমচাঁদ মিস্ত্রি ভাল ছুরি ও অন্যান্য জিনিস
তৈরিতে সফল হয়েছে।’ অন্য একটি লেখায়, ‘কাঞ্চননগরের জনৈক প্রেমচাঁদ মিস্ত্রি সম্প্রতি ইউরোপীয় নির্মাতাদের সঙ্গে
পাল্লা দিয়ে ছুরি-কাঁচি তৈরি করছেন।
প্রেমচাঁদ
মিস্ত্রির পুত্র গদাধর এখানে ছুরি-কাঁচি শিল্পের আরও
উন্নতি করেন। তাঁর কারখানায় ২০-২৫ জন কারিগর কাজ করতেন। সে সব জিনিস উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, ঢাকা, ইংল্যান্ড ও
জার্মানিতে রপ্তানি হত। সে সময় কাঞ্চননগর একটি অন্যতম কুটির শিল্পাঞ্চল হিসেবে
খ্যাতি লাভ করেছিল। পরে এই কারখানার শ্রমিকরা আলাদা আলাদা কারখানা খোলেন। আর
কারিগরের অভাবে বন্ধ হয়ে যায় গদাই কারিগরের কারখানা।
সাধুরবাগান/দরিয়াপুর
বর্ধমান- বোলপুর রেল রাস্তায় গুশকরা স্টেশন থেকে যেতে
হয়। বাংলায় যে কটি ডোকরা গ্রাম রয়েছে তাদের মধ্যে গুসকরার কাছে সাধুর বাগান
অন্যতম। এখানে প্রায় ৪০টি পরিবার রয়েছে, তাঁরা অন্যান্য ডোকরা পরিবারের মতই লস্ট
ওয়াক্স পদ্ধতিতে কাজ করেন। মুশকিল দাঁড়ায় বিশেষজ্ঞদের ফতোয়ায়।
সম্প্রতি অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের গবেষণায় এক বিশেষজ্ঞর এই কাজকে বেল মেটালের কাজ বলে
নিরন্তর উল্লেখ করে গিয়েছেন। সেই লেখায় কোথাও এই কাজটি যে লস্ট ওয়াক্স পদ্ধতিতে
করা হয় সারা বিশ্বে সে বিষয়টি নিয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। সেই লেখায়
তিনি আক্ষেপ করেছেন যে এই কাজে কেন কোনও যন্ত্র ব্যবহার হয় না। আর সেই এলাকার
পুরুষেরা সারাদিন মদ খেয়ে কাটায়, আর মেয়েরাই কাজ করে। আমাদের ধারণা তিনি ডোকরা
কামারদের ঐতিহ্য না জেনেই এই কথাগুলো বলেছেন। বাংলায় পিতল-কাঁসা নিয়ে কাজ করার
পদ্ধতি আলাদা আর ধাতু নিয়ে লস্ট ওয়াক্স পদ্ধতিতে কাজ করার আঙ্গিকও আলাদা। তাঁর কাজ
ছিল গ্রামে তাঁদের জীবন আর কাজের অবস্থা দেখার। তিনি বললেন না এই সম্প্রদায় ছিল
যাযাবর। এদের স্বাধীনতার পর বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে যে মানুষটির সম্প্রদায় কয়েক
হাজার বছর ঘুরে বেড়িয়েছে, কোনও কিছু জমিয়ে না রাখার স্বাধীনতা ছিল যার, সে এখন
গৃহী হয়ে নিজেকে বেঁধে রাখতে পারছেন। জীবন সম্বন্ধে সেই গোষ্ঠীর সমস্ত ধারণাই
পাল্টে গিয়েছে। আদতে যিনি গবেষণা করছেন, বা যিনি শুধুই ঘুরতে গিয়েছেন, তাদের সকলকে
সেই মানুষদের একটু নতুন দৃষ্টিতে দেখা দরকার।
No comments:
Post a Comment