হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মশাইএর বৌদ্ধিক
কাজের প্রায় প্রতিটি অংশে বৌদ্ধবাইএর ছোঁয়া ছিল এ মিথ কিন্তু মিথ্যা নয় - বলেছেন
অনেকভাবুকই - বিশেষ করে বিনয় ঘোষমশাই। পশ্চিমবঙ্গ
সরকারের প্রকাশন বিভাগ, পশ্চিম
বঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ শাস্ত্রীমশাইএর যে রচনাবলী প্রকাশ করেছেন তার ছত্রেছত্রে
এই তত্বের প্রকাশ এবং তাঁর এই অন্তর্দর্শণ অসম্ভব সত্য।
দশাবতার তাস খেলা, অঙ্কণরীতি, মুদ্রা, রংএর
পদ্ধতি দেখলে পাল যুগেরই কথা সর্বাগ্রে মনে আসে। এদের
ঐতিহ্য আজ বহন করছেন শীতল ফৌজদার তাঁর এই যৌবন বয়সে তাঁর কাকা ভাষ্কর
ফৌজদারের ছেড়ে যাওয়া কাজটি বহন করতে নিয়ে চলেছেন একই ভালবাসায়, শ্রদ্ধায় আর জ্ঞানে,
বাংলার নিজস্ব প্রযুক্তি প্রয়োগে – মনে রাখবেন পট তৈরি আর দশাবতার তাস তৈরির
পদ্ধতি প্রায় এক। তাসের যে কাগজ সেটি তৈরিও অসম্ভব দক্ষতার, ধৈর্যের
প্রয়োজন হয়।
মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, রাম (রঘুনাথ), ভৃগুরাম (পরশুরাম), বলরাম, জগন্নাথ (বুদ্ধ) ও কল্কী এই দশ অবতারকে নিয়েই দশাবতার তাসের মূল পরিকল্পনা।এঁদের মূর্তি আঁকা দশটি তাস থাকে। প্রত্যেক অবতারের ছবি আঁকা তাসের অধীনে একটি করে ‘উজীর’-এর ছবি আঁকা তাস। প্রত্যেক ‘উজীর’-এর অধীনে দশটি করে তাস আর
তাদের প্রত্যেকের প্রহরণ(মানে অস্ত্র – মনে করুণ দশপ্রহরণ ধারিনী) নিয়ে প্রত্যেক
আবতারের জন্য আরও ১২টা করে, মোট ১২০ টা তাস। দশাবতার তাস ছাড়াও নিতে পারেন নকশা
তাস।
হাত নিশপিশ করছে লিখতে, কিন্তু এই ছোট্ট পরিসরে
খুব বেশি বলার নেই, তবুও কয়েকটি স্তবকে ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি, বাংলা তথা ভারতে
যেমন মূর্তিবিদ্যা রয়েছে – তা নিয়ে খুব আলোচনা হয়েছে – নিবেদিতা করেছেন শ্রীলংকার
ভাবুক আনন্দ কুমারস্বামী করেছেন খুব বিশদে, তেমনি কিন্তু রঙের ব্যবহারের তত্ত্ব
নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয় নি – অথচ গ্রামের ছোট্ট ছোট্ট শিশুরা সে তত্ত্ব জানে –
মুখোশের রং পাল্টে গেলে একই ছাঁচের মুখের দেবতাও পাল্টে যান – হলুদ রঙে হন কৃষ্ণ,
আবার সেই মুখোশে সবুজ রং করে দিলে সেই মুখই হয়ে যান রাম। অনুরোধ করব
শীতলের সঙ্গে বা কোনও পটুয়ার সঙ্গে যখনই কথা বলবেন, তাদের কাজ দেখবেন, অবশ্যই এই
বিষয়টি নজর করবেন, আর তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় রং ব্যবহারের ইঙ্গিতময়তার যে
ব্যপ্তি ঘটেছে তাঁদের শিল্পে তাও বোঝার চেষ্টা করবেন।
শীতলই আজ একমাত্র দশাবতার তাসের শিল্পী। সে যেমন
লড়াই শেষ করে নি, আর যেখানে তার কাকা ছেড়ে গিয়েছিলেন, সেখানেই শেষ করে নি। শিল্পের
প্রতি একই শ্রদ্ধায় নিজের ছোট ছোট আত্মীয়কে শেখাচ্ছে এই কলা। আপনারা যে কেউ বিনয়
ঘোষের পশ্চিম বঙ্গের সংস্কৃতির চার খণ্ডএর একটির জোড়াপাতায় (এনেক্স) পড়লে বুঝবেন এই তাস খেলার পদ্ধতি। সব
কিছু এই ছোট্ট পরিসরে লেখায় না। আমার আনুরোধ হবে, বিষ্ণুপুরে যারা গিয়েছেন, তাঁরা নতুন করে
একবার যান শীতলের বাড়ি, ঐতিহ্যমণ্ডিত শাঁখারি পাড়ায়।
দেখুন তাঁর কাজ। কথা বলুন তাহলেই বিষ্ণপুরের একটা বড় ঐতিহ্যের সঙ্গে নিজেদের জুড়তে
পারবেন।
আর এই পুজো সংখ্যায় লিখছি বলে আর একটি তথ্য না
বলে পারছি না, বাংলার দুটো রাজবাড়ির পুজোয় বাংলার দুর্গা মূর্তি পুজোর
বিবর্তনটি আজও চোখে দেখা যায়, সেটি হল বিষ্ণুপুর রাজবাড়ি
আর কৃষ্ণগর রাজবাড়ি। আজও বিষ্ণুপুর রাজবাড়িতে কিছুটা ঘটে পটে কিছুটা মূর্তিতে পুজো
হয়। কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের হাত ধরে যে মূর্তি পুজো বাংলায় চলে আসছে, যার রমরমা শুরু হয়েছে উলাবীরনগরের বারোয়ারি পুজোয়, সেই সময়ের আগের পুজো পদ্ধতি দেখতে পাবেন।
রাজবাড়ির এই পট কিন্তু যায় শিতল ফৌজদারের বাড়ি
থেকে। জানি পটের দাম এখন প্রচুর, দুই বা আড়াই হাজারের কমে হবেনা,
কিন্তু আমার আবার আনুরোধ যদি সম্ভব হয়, শীতলের
কাছে যদি লক্ষ্মীবিলাস পট যদি পেয়ে যান তাহলে দরাদরি না করেই কিনে নেবেন। বাংলার
প্রাচীন অঙ্কন পদ্ধতি আর তার শৌর্য এই পটে ফুটে উঠেছে –
সেটি নিজের কাছে রেখে দেওয়ার মর্যাদা গর্ব আনন্য।
বাংলার এমন প্রচুর শিল্প রয়েছে যে শিল্পে মাত্র
একটি পরিবার বেঁচে। তাঁরা ছেড়ে দিলে সমগ্র কাজটিই বিশ্বের ঐতিহ্যের ইতিহাস থেকে
মুছে যাবে। কিন্তু শীতল তাঁর শীতলতর প্রজ্ঞায় যেভাবে জুঝছেন চকচকে মোড়ক স্বর্বস্ব বাজার, নতুন সময়ের ক্রেতা – এবং নিজে নিজে শিখছেন ঐতিহ্য ধ্রুব রেখে কিভাবে
মোড়ক করা যায় নিজের পণ্য, সব কিছুর সঙ্গে শীতল আদতে টিকে
থাকতে চায় এই নশ্বর বিশ্বে, তা নিজের চোখে না দেখলে
বিশ্বাস করা যায় না। শীতল ভাবছে নিজের মত করে।
তার পাশে দাঁড়ান, তার সঙ্গে
কথা বলুন, তার দশাবতার তাস কেনার প্রয়োজন নেই। একজন
শিল্পী তাঁর শিল্পের সমঝদার চায়। সেটি বিক্রি হলে তো ভালই লাগে। কিন্তু সেটা তার
কাছে বোধ হয় খুব একটা বড় বিচার্য বিষয় নয়। তার সঙ্গে কথা বললে সে বোঝে প্রায় নিভে
যাওয়া শিল্পটি সামনে যে মানুষটি বসে আছেন, তিনি বুঝতে চান; আরো একজন মানুষ সেই
শিল্পের সমঝদার হয়ে উঠতে চান। তার পাশে দাঁড়াতে চান; আমার ধারণা
তার নতুন ভালবাসা পেলে তার বেঁচে ওঠার আর সঙ্গে সঙ্গে আপনারও নতুন করে বাঁচার
আনুভূতি হবেই হবে।
আরও একটা কথা শীতলের মত বিষ্ণপুর সমঝদার কিন্তু
আমি এখোনো কাউকে দেখিনি। তাকে গাইড হিসেবে নিলে পস্তাবেন না, বরং বেশ লাভও হবে।
No comments:
Post a Comment