পট শব্দের অর্থ ছবি আঁকার কাপড় - যেটা এখন ক্যানভাস নামে পরিচিত। সহজ কথায় পটচিত্র বলতে আমরা পটের উপর অংকিত কোন ছবিকে বুঝি। অবশ্য পরবর্তীতে কাগজ কিংবা মাটির তৈরী বড় থালার উপর চিত্র তৈরী হলে তাকেও
পটচিত্র বলা হয়েছে – যার নাম সরা।
তবে পটের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে পটগান। শুধু বৌদ্ধ কিংবা হিন্দু কাহিনী নিয়েই পট গান তৈরী হয়নি, মুসলিম কাহিনী নিয়েও পটগান তৈরী হয়েছে যেমন গাজী কালুর পটগান। গাজীপীরকে মনে করা হতো বাঘের দেবতা। পূর্ববঙ্গে বেশী প্রচলন ছিলো এই গাজী কালুর পট। এক গবেষক পূর্ববঙ্গের গাজীর পট নাচানোর বর্ননায় এক স্থানে একটি চিত্রের উল্লেখ করেছেন, গাজী সাহেব ব্যাঘ্রের উপর সমাসী ও চারিদিকে ঊর্দ্ধপুচ্ছ
ব্যাঘ্রাদির পালায়ন। এছাড়াও গাজী-কালু-চম্পাবতীর জীবনকে কল্পনা করে তাদের জীবনের ধারাবাহিকতার উপর বিভিন্ন পটগান তৈরী হয়েছে। এ ছাড়াও মঙ্গলকাব্যের সঙ্গে যে নানান সামাজিক বিষয়ে গান বাঁধছেন তাঁর
উল্লেখ করা হয়েছে আগেই।
বাংলার পটচিত্র রীতির দুইটি আকৃতি। একটি জড়ানো এবং অন্যটি চৌকো। জড়ানো পট ১২ থেকে আসীম লম্বা হতে পারে এবং ১ থেকে ৩ ফুট চওড়া হতে পারে – মণিমালা একসময় ১০০ফুট জড়ান পটে
রামায়ণ এঁকেছিলেন । সকল জড়ানো পটই কাহিনী নির্ভর। এক একটি ছবি দেখানো হতো এবং সমবেতভাবে গীত-বাদ্য-নৃত্যের মধ্য দিয়ে তা পরিবেশিত হতো।
চৌকো পটের সার্থক কলকাতার কলীঘাটে। এখানে পটুয়ারা নানান আঙ্গিকে পট অঙ্কন করেছেন, বিভিন্ন সামাজিক বিষয়ে তাঁদের মতামত
প্রকাশ করেছেন। বিভিন্ন উৎসবের সময় বাঙালিরা তীর্থ ভ্রমণ করতে এসে এই পটচিত্র নিয়ে ঘরে ফিরতেন।
পট অঙ্কনের কয়েকটি রীতি দেখা যায়। বিশেষ করে পটের গানের জন্য যে পট ব্যবহৃত হতো সেগুলো প্রধানত কাপড়ে আঁকা হয়। কখনো কখনো কাপড়ের উপর কাগজও লাগানো থাকে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাপড়ের পটই ব্যবহৃত
হয়। কাপড়ের উপর লাল মাটির প্রলেপ বা গোবর মিশ্রিত মাটির প্রলেপ দেওয়া হতো। মাটির প্রলেপের পর তেঁতুল বিচি জ্বাল দিয়ে এক প্রকার আঠা তৈরী করে তার উপর লাগানো হতো। তেঁতুল বিচির আঠা লাগিয়ে পট তৈরীর উপযুক্ত জমিন তৈরী করে নেওয়া হতো। পটুয়ারা নিজস্ব পদ্ধতিতে গাছের পাতা, বাঁকল, ইত্যাদির রস-আঠা ব্যবহার করে রঙ তৈরী করতেন। এর সঙ্গে মেশানো হতো তেঁতুল বিচির তৈরী আঠা। বিভিন্ন আখ্যান অনুযায়ী এক একটি পট অঙ্কন করতে এক একজন পটুয়ার এক থেকে ছয় মাস লাগে।
No comments:
Post a Comment