Wednesday, January 9, 2019

ফ্রম প্রস্পারিটি টু ডিক্লাইন – এইটিনথ সেঞ্চুরি বেঙ্গল সুশীল চৌধুরী১১৪

আমরা যে সময়টি নিয়ে আলোচনা করছি, সেই মধ্য অষ্টাদশ শতাব্দেও বাংলা থেকে মুল পণ্য রেশম এবং সুতি বস্ত্রের এশিয় বণিকদের রপ্তানি ইওরোপিয়দের থেকে অনেক বেশি ছিল(H.T.Colebrooke, Remarks on the Husbandry, p.· 105)অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে বাংলা সুবায় স্থানীয়ভাবে ব্যবহার্য বস্ত্রের মোট পরিমান ছিল ৬ কোটি টাকার। এই তথ্যের আলোকে আমরা বলতে পারি অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে এক ছিল, হয়তবা বেশিই ছিল (১৭৭০এর মন্বন্তর এবং তার পরের সময়ে উচ্চ মৃত্যু হারের কথা মাথায় রেখেই(এই মন্বন্তরে বাংলার এক তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা বিলুপ্ত হয়ে যায়, BPP, XXIX, 37, quoted in D.B.Mitra, Cotton Weavers, p.212))। সম্ভবত এশিয়দের বস্ত্র রপ্তানির পরিমান ছিল ৯০ লক্ষ থেকে ১ কোটি টাকার মধ্যে এবং ইওরোপিয়দের ৫০-৬০ লক্ষ টাকা। আমরা দেখলাম ইওরোপিয় বস্ত্র রপ্তানি ছিল মোট উৎপাদনের মাত্র একটা ছোট অংশ, যে বৃদ্ধি উৎপাদন ব্যবস্থায় মৌল পরিবর্তন না ঘটিয়েই করা গিয়েছিল। যদি সুবার মোট উৎপাদনের তুলনায় ইওরোপিয় চাহিদা বেশি হত তাহলে বাংলার উৎপাদন ব্যবস্থার সরবরাহ দিকে ব্যাপক চাপ পড়ত, তাহলেই চাহিদার চাপে প্রযুক্তি বা উৎপাদন ব্যবস্থা পরিবর্তনের দাবি জোরদার হত। কিন্তু তারা যা চাহিদা সৃষ্টি করল তা মোট উৎপাদনের ক্ষুদ্র এক ভগ্নাংশ। ব্যাপক, প্রভূত ইওরোপিয় বস্ত্রের চাহিদার দাবি অযৌক্তিক এবং সেই ক্ষুদ্র চাহিদা মেটাতে ব্যবস্থা বা প্রযুক্তির পরিবর্তনের দাবি অনাবশ্যক।
কিন্তু যদি আমরা যৌথভাবে এশিয় এবং ইওরোপিয় রপ্তানির চাহিদা দেখি তাহলে আরেকটি দৃষ্টিভঙ্গী পাব এবং ব্যাপক সংখ্যার মুখোমুখি হতে হয়। বলাহয় ১৫৭৫ সালে মুঘলেরা বাংলা দখল করার পর থেকেই এবং মুঘল রাজত্বের স্থায়িত্ব এবং শান্তিশৃঙ্খলার জন্যে বহর্বিশ্ব বাংলায় এসেছে, বাংলা বহির্বিশ্বে গিয়েছে(J.N.Sarkar, ed., History of Bengal, vol.II, p. 188)। যদিও অত্যুক্তি মনে হবে তবুও বলি, অস্বীকার করার উপায় নেই ব্যবসা বাণিজ্য পরিবেশ বাড়ানোর জন্যে মুঘল আমলের শান্তির প্রয়োজন হয়েছিল। সপ্তদশ শতের প্রথমের দিকে উত্তরভারতের সঙ্গে বাংলার বাণিজ্য বিপুল আকার ধারণ করে। ১৬৮০র পর থেকে বাংলায় ইওরোপিয় বাণিজ্যে বিপুল গতি আসে। এই পরিবেশে যদি আমরা এশিয় বণিকদের রপ্তানির পরিমানটা ধরি, তাহলে রপ্তানির পরিমান মোট উৎপাদনের একটা বড় অংশ হয়। এই প্রেক্ষিতে প্রযুক্তির বদলের প্রশ্নটা উঠতেই পারে।

এই তথ্য সত্য যে প্রাযুক্তির বিকাশের পথ রুদ্ধ করার বেশ কিছু চলক বাংলায় সক্রিয় ছিল সেই সময়। এই শিল্পে প্রযুক্তির উদ্ভাবনের পথ কোন কোন চলক রুদ্ধ করে রেখেছিল, সেই বিষয়টা আমাকদের আলোচনায় আনা অতীব জরুরি। এখানে এটাও বলা দরকার, বস্ত্র শিল্পের উদ্ভাবনের দ্বার সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকে খুব বেশি রুদ্ধ ছিল না(এই বিতর্কটা বুঝতে Morris et al, Indian Economy বইটা পড়তে পারেন)। প্রযুক্তির পরিবর্তন তেমন না ঘটলেও, অতীত থেকে বিচ্যুত না হয়েও কিছুটা উতপাদকেদের সাঙ্গঠনিক স্বরূপের পরিবর্তন আসে। প্রযুক্তি খুব সাধারণ এবং পুঁজি বিনিয়োগের জায়গা প্রায় ছিলই না বলা চলে তবুও দাদনি বণিকদের সাহায্যে, স্থানিকতা বাড়িয়ে(increased localization), দক্ষতা এবং বিশেষজ্ঞতা বাড়িয়ে আর শ্রমের সূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটিয়ে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করে তাঁতিরা বিপুল উৎপাদন বাড়াতে সক্ষম হয়। বর্ধিত চাহিদা পূরণে উৎপাদনের সঙ্গঠনগুলি অসামান্য দক্ষতা প্রদর্শন করে। এটি চলতি আঙ্গিকের গুণগত বিকাশ এবং এই উৎপাদন ব্যবস্থা কোনও ভাবেই পরম্পরা ব্যবস্থাপনা থেকে বিচ্যুত হয় না। কিন্তু প্রযুক্তির পরিবর্তনের তুলনায় সাঙ্গঠনিক পরিবর্তন অনেক বেশি মৌলিক।

Tuesday, January 8, 2019

ফ্রম প্রস্পারিটি টু ডিক্লাইন – এইটিনথ সেঞ্চুরি বেঙ্গল সুশীল চৌধুরী১১৩

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে উৎপাদন এবং অন্যান্য ব্যয় বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল ১৭৪৭ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে এবং এই সময়ের মধ্যে তাঁতিদের রোজগার খুব বেশি বাড়ে নি। খাদ্যশস্যের দাম বিপুলভাবে বাড়ায় আমরা আন্দাজ করতে পারি, তাঁত থেকে তাঁতিদের রোজগার দিয়ে তার পরিবারের নিত্যদিনের খরচ চালানো মুশকিল হয়ে পড়ে(Hatneeda Hossain, Company Weavers, p. 61)। ঢাকা কুঠির সমীক্ষায় তাঁতিদের জীবনের দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা উঠে এসেছে প্রভূতভাবে। ঢাকার একটি বিখ্যাত আড়ং তিতবাড়ির এক তাঁতি মারা যাওয়ার পরে দেখা গেল সে তার স্ত্রী আর তার সন্তানদের জন্যে রেখে গিয়েছে কিছু কাপড়, তার সামান্য কিছু যন্ত্রপাতি, ঢাকাওয়ালা একটা পাত্র, কাঁসার জলপানপাত্র, চরকা কাটনি আর চাকর(শিক্ষানবিশ?)এর কাছে ধার এবং মোট বাজারে ধার ১৩টাকা ৫০ পয়সা(Beng. Mss. 1.0. 4046, f 100 উল্লেখ্য এই নথিতে বলা হয়েছে সেখানে একটা রীতি ছিল প্রয়োজনে নফরকে বিক্রি করা যেত)। মসলিন উৎপাদনের আরেকটি আড়ং সোনারগাঁওএর এক তাঁতি তার স্ত্রী এবং তিন বছরের কন্যাকে রেখে যখন মারা গেল তারা বাজারে ধার ছিল ১৪১ টাকা ৫০ পয়সা(Beng. Mss. 1.0. 4045, ff. 146-47)। অষ্টাদশ শতকের শুরুতে তাঁতিদের এ ধরণের দারিদ্র্যর কোন উদাহরণ পাওয়া যায় না। মোটামুটিভাবে বলা যায় কারিগর আর তাঁতিরা অষ্টাদশ শতকের শুরুতে, অষ্টাদশ শপ্তকের শেষ সময়ের তুলনায় অনেক ঈর্ষনীয় অবস্থায় ছিলেন।
৬.৪ প্রযুক্তির সমস্যা
ঐতিহাসিকেরা তাঁত শিল্পে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের অভাবের কারণের সমস্যার নানান ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কেউ একে লো-লেবেল ইকুইলিব্রিয়াম ট্র্যাপ বলেছেন যেখানে প্রভূত পরিমানে উদ্বৃত্ত শ্রম থাকে যার ফলে যন্ত্রপিছু উৎপাদন ক্ষমতা না বাড়িয়েই উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায় এবং একই সঙ্গে শিল্পে অতিরিক্ত বিশেষী করণের ফলে সেখানে very great incentiyes to introduce any change in technology। কেউ কেউ বলেছেন কোটি কোটি কারিগর খুব কম শ্রমের মূল্যে কাজ করতে ইচ্ছুক ছিল যার জন্যে শ্রম-প্রতিস্থাপনকারী যন্ত্রের উদ্ভাবনের প্রয়োজনীয়তা দেখা যায় নি। আরও কিছু মানুষ বলেছেন এর জন্যে জাতিবাদের রূঢ়তা এবং এককেন্দ্রিক একনায়কোচিত প্রশাসনিক অত্যাচার দায়ি যারা কোনও ধরণের উদ্ভাবনের পুরষ্কার দিতে ইচ্ছুক নয়(K.N. Chaudhuri, Trading World, pp. 274-275; T. Raychaudhuri, Cambridge Economic History of India, vol. I, 'p, 295; Irfan Habib, 'The Technology and Economy of Mughal lndia',JESHR, vol. XVII, no. 1, pp. 32-33)। মনেহয় এই সব তত্ত্ব মূলত তৈরি করা হয়েছে এই ধারণা থেকে যে মূলত সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকের শুরুর দিকে ইওরোপিয় বস্ত্রের চাহিদা আগের সময়ের তুলনায় আকাশ ছোঁয় এবং তার ফলে গবেষকেরা ধারনা করতে থাকেন বাংলার বস্ত্র উতপাদনে প্রাযুক্তিক পরিবর্তন জরুরি ছিল। তারা মনে করলেন, উৎপাদন ব্যবস্থার মৌলিক কোন পরিবর্তন না করেই বাংলা এই উৎপাদনের পরিমান বৃদ্ধির সমস্যা সামলালো, অর্থনীতিকে আরও সবল করে - অতিরিক্ত কর্মসংস্থান তৈরি করে, আংশিক সময়ের কর্মীদের আরও দক্ষ করে তুলে পূর্ণ সময়ের কর্মী বানিয়ে এবং কিছু ক্ষেত্রে তাঁতগুলির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে(S. Chaudhuri, Trade and Commercial Organization, p. 234; Om Prakash, Dutch 9ompany, p. 10 I)।

সত্যই আমাদের অস্বীকার করার উপায় নেই যে সপ্তদশ শতকের শেষ পাদে এবং অষ্টাদশ শতকের প্রথম পর্বে বাংলায় ইওরোপিয় বস্ত্র চাহিদা বেশ ভাল রকমের বৃদ্ধি পায়। এই প্রেক্ষিতে আমাদের প্রশ্ন হল দেশের মোট উৎপাদনের ত্তুলনায় বা এশিয় বণিকদের দেশিয় এবং এশিয় ব্যবসা হেতু বাংলায় কাপড় কেনার তুলনায় কতপরিমান বেশি ছিল। সাম্প্রতিককালে আমরা দেখিয়েছি এবং এখানেও সেই যুক্তি বিস্তার করে বলছি বাংলার ব্যবসার পরিমণ্ডলে ইওরোপিয় ব্যবসা খুব বড় ভূমিকা পালন করে নি এমন কি মধ্য অষ্টাদশ শতকেও(S. Chaudhury, 'Asian Merchants and Companies in Bengal's Export Trade, circa. mid-18th Century', revised version of the paper presented at the International Seminar oh 'Merchants, Companies and Trade', M.S.H., Paris, 30 May - 1 June 1990. Also see chapters 7 and 8)।   

ফ্রম প্রস্পারিটি টু ডিক্লাইন – এইটিনথ সেঞ্চুরি বেঙ্গল সুশীল চৌধুরী১১২

দ্বিতীয় শ্রেণীর তাঁতিরা, চাষী-তাঁতির মত চরম দরকারেও সহজে অন্য পেশায় চলে যেতেন না। হয়ত এই ধরণের তাঁতিদের গরীব দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁতির দারিদ্র আদতে বাস্তব কি না, তা জানা না গেলেও এটা হতে পারত এক শ্রেণীর তাঁতি দালাল এবং পাইকারদের থেকে অগ্রিম নেওয়ার সময় তাদের কাছে ঋণী হয়ে পড়তেন। তাদের অবস্থা ঘোরালো হয়ে যেত(Fact. Records, D~cca, vol. 3, Annex. to Consult., 17 'l':lov. 1754; 30 Nov. 1757)।
একই সময়ে বহু সময় তাঁতিদের লভ্যাংশ মধ্যশ্রেণী ব্যবসায়ী বা অন্যান্য দালাল চুরি করে নিত। বস্ত্র তৈরির সময় ব্যবসায়ীর পক্ষ থেকে দালাল মার্ফত তাঁতিদের সঙ্গে যে চুক্তি করা হত, সেই চুক্তি বহু সময় দালালেরা মান্য করত না। তাঁতি যেহেতু গ্রাম্যপরিবেশে থাকে তাকে দালালেরা অগ্রিম অথবা লভ্যাংশ দেওয়ার ব্যাপারে সহজেই বোকা বানাত। অনেক সময় আমলারাও তার লভ্যাংশ খেয়ে নিত। জন টেলর বলছেন সরকারি কারখানাতেও প্রশাসনিক আমলারা তাঁতির লভ্যাংশের ২৫% কেড়ে নিত, তাঁতি পেত চুক্তির মাত্র ৭৫% অর্থ (Home Misc., vol. 456F, f. i37)। তাঁতিদের দরকষাকষির শক্তিটা ততটা ছিল না, কারণ তাঁতিরা শোষকের বিরুদ্ধে গোষ্ঠীবদ্ধভাবে দরকষাকষি করত না। তবুও বলব অবস্থা সাধারণ বছরগুলোয় খুব খারাপ ছিল না। ওরমের বয়ানেই বলা যাক his natural indolence ... is satisfied in procuring by his labour, his daily bread' (Orme, Military Transactions, vol. II, Sect. I, p. 9)। তাঁতি খারাপ দিনের ভাবনা ভেবে কাজ করত এরকম কোন নিদর্শন পাওয়া যায় না। ডেনদের সূত্র থেকে কারিগরদের এই মনোভাব জানতে পারছি, In Bengal...the spinner and,the weaver require and expect no more than is necessary to pay for the material, procure enough to eat and to have a little leisure; when times are good they even flourish in this way(Ole Feldbaeck, 'Cloth Productiol). in Bengal', BPP, vol. XXXVI, p. 126)।  

তথ্য যাই হোক না কেন এই তথ্য পরিষ্কার, আমাদের আলচ্য সময়ে তাঁতিদের অবস্থা পলাশী পরবর্তী অবস্থা থেকে বেশ ভাল ছিল। স্বাধীনতার পূর্বে সে যতটুকু দরকষাকষি করার সুযোগ পেত অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সে সেইটুকুও হারিয়ে ফেলে। অত্যাচারী এবং শোষক কোম্পানির আমলাদের এই কাজে সাহায্য করত গোমস্তারা। সাম্প্রতিক বেশ কিছু গবেষণায় প্রায় ছবির মত করে দেখানো হয়েছে অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কিভাবে তাঁতিদের ওপর অমানবিক অত্যাচার অমিত শোষণ নামিয়ে আনা হত( N.K. Sinha, Economic History of Bengal, vol. I, pp. 157-181; D.B. Mitra, Cotton Weavers, pp. 49-87; Hameeda Hossain, Company Weavers, pp. 108-39)। উনবিংশ শতকের অনামা এক রাজনৈতিক চটিবইএর রচয়িতার থেকে আমরা এই চিত্রটি হুবহু পাচ্ছি The whole inland trade of the country and the provision of  the company's investment ... became one continued scene of oppression, the baneful effects of which was felt by every weaver and manufacturer in the country, every article produced being made a monopoly in which the English arbitrarily decided what quantities of goods each manufacturer should deliver, and the prices he should receive for them .... Generally a number of weavers are registered in .the books of the company's gomastahs, and not permitted to work for any other persons, being transferred from one gomastah to another as so many slaves, subject to the tyranny and roguery of every succeeding gomastah. The English with great strictness monopolized the weavers; their hardship is scarcely to be describe(Mss. Eur. D.'283. ff. 37-38. নজরটান সুশীলবাবুর)।

Tuesday, January 1, 2019

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা - দেশিয় জ্ঞানচর্চা, দেশিয় বাস্তবতা - বিদ্যালয় নির্ভর জ্ঞানচর্চা বনাম শ্রুতিনির্ভর দক্ষতা ও জ্ঞানচর্চা - চোখে না পড়াটাই তার জোরের জায়গা কারণ ক্ষমতা তাকে পাত্তা দেয় না

আমার এক গুরুস্থানীয় লিখেছেন, 'এডামস রিপোর্ট' মন দিয়ে পড়লে দেখা যাবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কল্যানে ও বিদেশী শাসকদের বদান্যতায় কি ভাবে গত ২০০ বছরে 'কাবাব' রা বাংলার এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে 'অশিক্ষিত','প্রান্তিক' মানুষে পরিণত করেছে'। তাঁর অদৃষ্টবাদিতার বিপক্ষে মত প্রকাশ করা গেল।আজও বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠের শিক্ষা ব্যবস্থা শ্রেণীকক্ষ ভিত্তিক হয়ে ওঠে নি।বাংলার চাষী কারিগর হকার মধ্যবিত্তের মত হয় তো ক্ষমতার কাছাকাছি কোনদিন ছিল না, কিন্তু আজও তারা উৎপাদন ব্যবস্থা নির্ণায়ক এবং বাংলা অর্থনীতির ধারক।
একথা দুর্নিবার ঠিক যে দ্বারকানাথ, রামমোহন, বিদ্যাসাগর ইত্যাদির হাত ধরে দেশজ বিদ্যালয়গুলির শ্মশানযাত্রা ঘটিয়ে দিয়েছিলেন নব্য ইংরেজি শিক্ষিত কর্পোরেট নবজাগরিত বাঙ্গালিরা(চেহারায় বাঙালি, মননে ইওরোপিয়, দর্শনে মেকলিয়) মেকলের তত্ব অনুসারে। পরম পত্রিকায় ব্রিটিশপূর্ব শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে সংখ্যায় বিদ্যালয় ধ্বংস নিয়ে হাহুতাশ বা এডামের শিক্ষা সমীক্ষা নিয়ে আলোচনায় বার বার বিদ্যালয় পাঠক্রিয়া পদ্ধতি ধ্বংসের ধুয়ো তুলি - আদতে সেই কাজটা মন দিয়ে করি পশ্চিমি কেন্দ্রিভূত শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিভূ হিসেবে তার দার্শনিক প্রভাব এড়াতে না পেরে। এর কিছুটা যে সত্য তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই - কেননা গ্রামীন পাঠশালাগুলির পাঠ্যক্রম তৈরি হয়েছিল আজকে যাকে প্রান্তিক সমাজ(কেন প্রান্তিক?) বলা যায় তাদের জন্য, তাদের দর্শন নিয়ে, তাদের ব্যয়ে, তাদের বাড়ির কাছের পরিবেশ সেবার জন্য, সাগরপারের লুঠেরা সওদাগরি অর্থনীতি সেবার জন্য নয়।
কিন্তু সেই তথ্যটাই সম্পূর্ণচিত্র নয় বলে আমরা মনে করি - এটাও মনে করি শিক্ষিতরা যাকে কারিগর অর্থনীতি বলছেন, তার ভিত্তি শুধুই লিখিত জ্ঞান-শিক্ষাচর্চার ওপরে নির্ভর করে ছিল না, আজও নেই। কারিগর অর্থনীতির বিপুল অংশ নির্ভর করে পরম্পরার শ্রুতি, হাতে হাতে দক্ষতা প্রবাহিত জ্ঞান, প্রজ্ঞা আর দর্শন প্রবাহের বাস্তবতায়। বিদ্যালয় এই ব্যবস্থার একটা অংশ ছিল ঠিকই, কিন্তু সবটাই নয় - বাঙলার কারিগরী ব্যবস্থায় থাকা মোট জনগণের সংখ্যার মধ্যে কত অংশ বিদ্যালয়ে যেত বা আজও যায় এই অনুপাতটা দেখলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়। আলোচনার সুবিধার জন্যে আজকের হিসেবই নিলাম।
আজও গ্রাম অর্থনীতি ২৫০ বছরের কর্পোরেট অর্থনীতির থেকেও বড় - আজও জ্ঞান-বিদ্যাচর্চা প্রাতিষ্ঠানিক মেকলিয় বিদ্যাচর্চা থেকে যে বড় - তাঁর শ্রেয় যায় এই জ্ঞান-দক্ষতা প্রবাহনের পরিকল্পনা, ব্যবস্থা সুচারুরূপে অন্তত বিপুল শক্তিমান কর্পোরেটদের ধ্বংসক্রিয়ার সমান্তরালভাবে নিজের দর্শনে বয়ে নিয়ে যেতে পারা মানুষের দক্ষতায়। সেটা বিদ্যালয় ব্যবস্থার বাইরে দাঁড়িয়েই এই মানুষেরা করে চলেছেন। ১০+ কোটি মানুষের বাংলায় মাধ্যমিক দেয় ১২-১৩র কাছাকাছি লক্ষ পড়ুয়া, স্নাতক স্তরে পরীক্ষায় বসে মাত্র ৮০০০০ মোট জনসংখ্যার কোন শতাংশতেই আসে না। ঔপনিবেশিকদের কাজ করমে পাঠশালা ব্যবস্থা উঠে যেতে বসলেও পরম্পরার মৌখিক জ্ঞানচর্চা কমে নি।
বিপুল, বিশাল, কারিগর, অভিকর শিল্পীরা তাদের জ্ঞানচর্চা, প্রযুক্তি চর্চা, শিল্প চর্চা করতে সামাজিক/পারিবারিক জ্ঞানের সর্ব্যব্যাপী অস্তিত্বের পরিবেশের মধ্যে। তাই পরম্পরার বিদ্যালয়গুলি উঠে গেলেও গ্রামে জ্ঞানের, প্রজ্ঞার, শিক্ষার এবং এগুলি ব্যবহার করে দক্ষতা অর্জনের পরিবেশের ঘাটতি আজও নেই। ঠিক এই কাঠামোর ওপর নির্ভর করে দাঁড়িয়ে আছে বাংলার কারিগর কৃষ্টি-আর্থব্যবস্থা। ভারতজুড়ে যেমন বিভিন্ন রাজা, জমিদার বা সংগঠনের দ্বারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা জ্ঞানচর্চার প্রবাহ গড়ে উঠেছিল, তেমনি মাঠে ঘাটে অপ্রথাগত পরম্পরার জ্ঞানের সমাহারে গড়ে উঠেছিল চাষ, ঝিল কাটা, জল সংরক্ষণ, সেচ ব্যবস্থা, সহ হাজারো কারিগরি উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি, তার হাতিয়ার, তার জ্ঞানচর্চার ধারা - যার ধারকবাহক ছিলেন কারিগরেরা, যারা আজও আছেন সাধারন মুখ না চেনা, নাম না জানা মানুষ হিসেবে, যাদের আমরা ভদ্রবিত্তরা এককথায় অশিক্ষিত বলতে ভালবাসি। এই জ্ঞানচর্চায় রাজা রাজড়ার পৃষ্ঠপোষকতা কিছুটা থাকলেও এটি আদতে সামাজিক কর্ম ছিল, আছে থাকবে। তাই রাজছত্র ভেঙ্গে পড়লেও সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নির্বাহের প্রযুক্তি ইত্যাদি উদ্ভাবন এবং প্রয়োগ করতে কোন বাধা ছিল না। এখানে ছিল না কোন গ্রন্থাগার, ছিল না পুঁথি, ছিল না কোন গবেষণাগার। শুধু পরম্পরারর জ্ঞান, দক্ষতা প্রজ্ঞা, চাহিদার তথ্য কাজে লাগিয়ে পুরুলিয়া বা রাজস্থানে গড়ে উঠেছিল বিশাল বিপুল সেচ ব্যবস্থা(বাঁধ নামক হ্রদ আজও রাঢ বাংলায় আছে কিন্তু হতোদ্যম), শাঁখারিদের জন্যে শাঁখের করাত, তাঁতিদের জন্যে মসলিনের তাঁত, বিভিন্ন ভৌগোলিক এলাকার জন্যে ভিন্ন ভিন্ন আকারের পুকুর, নানান ধরণের মাটির বাড়ি, চাষের জন্যে ভিন্নভূপ্রকৃতির জন্যে ভিন্ন ভিন্ন হাল, নানান প্রকৃতির জন্যে নানান ধরণের মাছ ধরার জাল, খাওয়ার জন্যে ভিন্ন ভিন্ন ভূপ্রকৃতি অনুসারে খাদ্যব্যবস্থা, মহিলাদের কাঁথা সেলাই বা আলপনা দেওয়া যা আদতে তাঁদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ধারণার প্রতিফলন এবং চরমতম দক্ষতার নজির। আজ যখন আমরা প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞান আর জ্ঞানচর্চা নিয়ে আলোচনা করছি, তখন রাজছত্রের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা, বিপুল বিনিয়োগের বাইরে চলমান জ্ঞানচর্চার ধারক এই নাম না জানা সামাজিক মানুষ, যাদের কল্যানে বাংলা তথা উপমহাদেশের সভ্যতা আজও বহাল তবিয়তে টিকে আছে, তাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। অকৃতজ্ঞতা হয়ে যাবে। তাঁরা আর আজও ক্রিয়াশীল রয়েছেন। আমাদের চারপাশে রয়েছেন সদা উদ্ভাবনশীল কারিগর, গত কয়েক দশকে যাদের উপহার ইঞ্জিন রিক্সার মত জটিল প্রযুক্তিগত কাজ।
কর্পোরেট এককেন্দ্রিক জ্ঞানচর্চার ধ্বংসক্রিয়ার তুলনায় আজও এই ভেঙে পড়া সময়কে ধরে, গ্রামীন কৌম অর্থনীতি, দর্শন, সমাজ, তাঁর বিপরীতে যে নির্মান করে চলেন, তার চরিত্র অনেক জটিল, বর্ণিল, প্রভাবী এবং চোখে না দেখতে পাওয়ার।
সেই বয়ে চলা দক্ষতাটাই চোখে পড়ে না, যতটা পড়ে বিপরীত শিবিরের ধ্বংস ক্রিয়া।
চোখে না পড়াটাই তার জোরের জায়গা।

মধ্যবিত্তিয হিংসক প্রগতিশীলতা

তার সমাজের বাইরে সব কিছুই মিথ্যা
বাংলার অধিকাংশ শৈশব ঔপনিবেশিক ইওরোপমন্য কলকাত্তিয়া ভদ্রবিত্তিয় আনন্দবাজারী প্রভাব মুক্ত