আমার এক গুরুস্থানীয় লিখেছেন, 'এডামস রিপোর্ট' মন দিয়ে পড়লে দেখা যাবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কল্যানে ও বিদেশী শাসকদের বদান্যতায় কি ভাবে গত ২০০ বছরে 'কাবাব' রা বাংলার এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে 'অশিক্ষিত','প্রান্তিক' মানুষে পরিণত করেছে'। তাঁর অদৃষ্টবাদিতার বিপক্ষে মত প্রকাশ করা গেল।আজও বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠের শিক্ষা ব্যবস্থা শ্রেণীকক্ষ ভিত্তিক হয়ে ওঠে নি।বাংলার চাষী কারিগর হকার মধ্যবিত্তের মত হয় তো ক্ষমতার কাছাকাছি কোনদিন ছিল না, কিন্তু আজও তারা উৎপাদন ব্যবস্থা নির্ণায়ক এবং বাংলা অর্থনীতির ধারক।
একথা দুর্নিবার ঠিক যে দ্বারকানাথ, রামমোহন, বিদ্যাসাগর ইত্যাদির হাত ধরে দেশজ বিদ্যালয়গুলির শ্মশানযাত্রা ঘটিয়ে দিয়েছিলেন নব্য ইংরেজি শিক্ষিত কর্পোরেট নবজাগরিত বাঙ্গালিরা(চেহারায় বাঙালি, মননে ইওরোপিয়, দর্শনে মেকলিয়) মেকলের তত্ব অনুসারে। পরম পত্রিকায় ব্রিটিশপূর্ব শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে সংখ্যায় বিদ্যালয় ধ্বংস নিয়ে হাহুতাশ বা এডামের শিক্ষা সমীক্ষা নিয়ে আলোচনায় বার বার বিদ্যালয় পাঠক্রিয়া পদ্ধতি ধ্বংসের ধুয়ো তুলি - আদতে সেই কাজটা মন দিয়ে করি পশ্চিমি কেন্দ্রিভূত শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিভূ হিসেবে তার দার্শনিক প্রভাব এড়াতে না পেরে। এর কিছুটা যে সত্য তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই - কেননা গ্রামীন পাঠশালাগুলির পাঠ্যক্রম তৈরি হয়েছিল আজকে যাকে প্রান্তিক সমাজ(কেন প্রান্তিক?) বলা যায় তাদের জন্য, তাদের দর্শন নিয়ে, তাদের ব্যয়ে, তাদের বাড়ির কাছের পরিবেশ সেবার জন্য, সাগরপারের লুঠেরা সওদাগরি অর্থনীতি সেবার জন্য নয়।
কিন্তু সেই তথ্যটাই সম্পূর্ণচিত্র নয় বলে আমরা মনে করি - এটাও মনে করি শিক্ষিতরা যাকে কারিগর অর্থনীতি বলছেন, তার ভিত্তি শুধুই লিখিত জ্ঞান-শিক্ষাচর্চার ওপরে নির্ভর করে ছিল না, আজও নেই। কারিগর অর্থনীতির বিপুল অংশ নির্ভর করে পরম্পরার শ্রুতি, হাতে হাতে দক্ষতা প্রবাহিত জ্ঞান, প্রজ্ঞা আর দর্শন প্রবাহের বাস্তবতায়। বিদ্যালয় এই ব্যবস্থার একটা অংশ ছিল ঠিকই, কিন্তু সবটাই নয় - বাঙলার কারিগরী ব্যবস্থায় থাকা মোট জনগণের সংখ্যার মধ্যে কত অংশ বিদ্যালয়ে যেত বা আজও যায় এই অনুপাতটা দেখলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়। আলোচনার সুবিধার জন্যে আজকের হিসেবই নিলাম।
আজও গ্রাম অর্থনীতি ২৫০ বছরের কর্পোরেট অর্থনীতির থেকেও বড় - আজও জ্ঞান-বিদ্যাচর্চা প্রাতিষ্ঠানিক মেকলিয় বিদ্যাচর্চা থেকে যে বড় - তাঁর শ্রেয় যায় এই জ্ঞান-দক্ষতা প্রবাহনের পরিকল্পনা, ব্যবস্থা সুচারুরূপে অন্তত বিপুল শক্তিমান কর্পোরেটদের ধ্বংসক্রিয়ার সমান্তরালভাবে নিজের দর্শনে বয়ে নিয়ে যেতে পারা মানুষের দক্ষতায়। সেটা বিদ্যালয় ব্যবস্থার বাইরে দাঁড়িয়েই এই মানুষেরা করে চলেছেন। ১০+ কোটি মানুষের বাংলায় মাধ্যমিক দেয় ১২-১৩র কাছাকাছি লক্ষ পড়ুয়া, স্নাতক স্তরে পরীক্ষায় বসে মাত্র ৮০০০০ মোট জনসংখ্যার কোন শতাংশতেই আসে না। ঔপনিবেশিকদের কাজ করমে পাঠশালা ব্যবস্থা উঠে যেতে বসলেও পরম্পরার মৌখিক জ্ঞানচর্চা কমে নি।
বিপুল, বিশাল, কারিগর, অভিকর শিল্পীরা তাদের জ্ঞানচর্চা, প্রযুক্তি চর্চা, শিল্প চর্চা করতে সামাজিক/পারিবারিক জ্ঞানের সর্ব্যব্যাপী অস্তিত্বের পরিবেশের মধ্যে। তাই পরম্পরার বিদ্যালয়গুলি উঠে গেলেও গ্রামে জ্ঞানের, প্রজ্ঞার, শিক্ষার এবং এগুলি ব্যবহার করে দক্ষতা অর্জনের পরিবেশের ঘাটতি আজও নেই। ঠিক এই কাঠামোর ওপর নির্ভর করে দাঁড়িয়ে আছে বাংলার কারিগর কৃষ্টি-আর্থব্যবস্থা। ভারতজুড়ে যেমন বিভিন্ন রাজা, জমিদার বা সংগঠনের দ্বারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা জ্ঞানচর্চার প্রবাহ গড়ে উঠেছিল, তেমনি মাঠে ঘাটে অপ্রথাগত পরম্পরার জ্ঞানের সমাহারে গড়ে উঠেছিল চাষ, ঝিল কাটা, জল সংরক্ষণ, সেচ ব্যবস্থা, সহ হাজারো কারিগরি উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি, তার হাতিয়ার, তার জ্ঞানচর্চার ধারা - যার ধারকবাহক ছিলেন কারিগরেরা, যারা আজও আছেন সাধারন মুখ না চেনা, নাম না জানা মানুষ হিসেবে, যাদের আমরা ভদ্রবিত্তরা এককথায় অশিক্ষিত বলতে ভালবাসি। এই জ্ঞানচর্চায় রাজা রাজড়ার পৃষ্ঠপোষকতা কিছুটা থাকলেও এটি আদতে সামাজিক কর্ম ছিল, আছে থাকবে। তাই রাজছত্র ভেঙ্গে পড়লেও সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নির্বাহের প্রযুক্তি ইত্যাদি উদ্ভাবন এবং প্রয়োগ করতে কোন বাধা ছিল না। এখানে ছিল না কোন গ্রন্থাগার, ছিল না পুঁথি, ছিল না কোন গবেষণাগার। শুধু পরম্পরারর জ্ঞান, দক্ষতা প্রজ্ঞা, চাহিদার তথ্য কাজে লাগিয়ে পুরুলিয়া বা রাজস্থানে গড়ে উঠেছিল বিশাল বিপুল সেচ ব্যবস্থা(বাঁধ নামক হ্রদ আজও রাঢ বাংলায় আছে কিন্তু হতোদ্যম), শাঁখারিদের জন্যে শাঁখের করাত, তাঁতিদের জন্যে মসলিনের তাঁত, বিভিন্ন ভৌগোলিক এলাকার জন্যে ভিন্ন ভিন্ন আকারের পুকুর, নানান ধরণের মাটির বাড়ি, চাষের জন্যে ভিন্নভূপ্রকৃতির জন্যে ভিন্ন ভিন্ন হাল, নানান প্রকৃতির জন্যে নানান ধরণের মাছ ধরার জাল, খাওয়ার জন্যে ভিন্ন ভিন্ন ভূপ্রকৃতি অনুসারে খাদ্যব্যবস্থা, মহিলাদের কাঁথা সেলাই বা আলপনা দেওয়া যা আদতে তাঁদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ধারণার প্রতিফলন এবং চরমতম দক্ষতার নজির। আজ যখন আমরা প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞান আর জ্ঞানচর্চা নিয়ে আলোচনা করছি, তখন রাজছত্রের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা, বিপুল বিনিয়োগের বাইরে চলমান জ্ঞানচর্চার ধারক এই নাম না জানা সামাজিক মানুষ, যাদের কল্যানে বাংলা তথা উপমহাদেশের সভ্যতা আজও বহাল তবিয়তে টিকে আছে, তাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। অকৃতজ্ঞতা হয়ে যাবে। তাঁরা আর আজও ক্রিয়াশীল রয়েছেন। আমাদের চারপাশে রয়েছেন সদা উদ্ভাবনশীল কারিগর, গত কয়েক দশকে যাদের উপহার ইঞ্জিন রিক্সার মত জটিল প্রযুক্তিগত কাজ।
কর্পোরেট এককেন্দ্রিক জ্ঞানচর্চার ধ্বংসক্রিয়ার তুলনায় আজও এই ভেঙে পড়া সময়কে ধরে, গ্রামীন কৌম অর্থনীতি, দর্শন, সমাজ, তাঁর বিপরীতে যে নির্মান করে চলেন, তার চরিত্র অনেক জটিল, বর্ণিল, প্রভাবী এবং চোখে না দেখতে পাওয়ার।
সেই বয়ে চলা দক্ষতাটাই চোখে পড়ে না, যতটা পড়ে বিপরীত শিবিরের ধ্বংস ক্রিয়া।
চোখে না পড়াটাই তার জোরের জায়গা।
No comments:
Post a Comment