টাঁকশালে মুদ্রা ছাপানো এবং ধাতুর শুদ্ধতার ওপর কড়া নদরদারির ফলে সারা ভারতে কোথাও মুঘল মুদ্রা, তার মূল মূল্যে গ্রহণ করার সমস্যা হয় নি। নিয়মিতভাবে বাজারে মুদ্রার সরবরাহ ক্রমশ বাড়তে থাকায় বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়ে, উৎপাদন এবং ব্যবসাপাতির পরিমান বাড়তে থাকে। মুঘল টাঁকশাল সারা সাম্রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে ছিল। তারমধ্যে অনেকগুলোর ভৌগোলিকতা, মুদ্রা উৎপাদন ইত্যাদির গুরুত্ব অন্যগুলোর থেকে কোথাও বেশি ছিল কোথাও কম ছিল।
যদিও মনে রাখা দরকার টাঁকশালগুলির অন্যতম কাজ ছিল পরিশ্রুত ধাতু থেকে মুদ্রা তৈরি করা, এই কাজটা কড়া নজরদারিতে, চুক্তিতে, প্রযুক্তিতে বেশ কিছু সময়ে অন্যান্য উদ্যমীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হত। বেসরকারি মুদ্রা উৎপাদনের দুটি মডেল ছিল, প্রথমটি হল মুঘল আধিকারকরা নিজেরা ব্যক্তিগতস্তরে কাজটা করত। দ্বিতীয়ত, সরাফেরা(স্রফ) তাদের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, উদ্যম কাজে লাগিয়ে মুদ্রা ছাপানোর কাজ করত। তবে এই দুটো ব্যবস্থাতেই রাষ্ট্রীয় কড়া নজরদারি ছিল। প্রতিটা মুদ্রা সরকারি নিয়ম মেনে বাজারে আসার জন্য উত্তীর্ণ হতে হত।
এক ধাতু মুদ্রাসমাজে ছোট মুদ্রাগুলি ছিল সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ মুদ্রা হয়ে ওঠত এবং সমাজের সঙ্গে তার একটা নির্দিষ্ট সম্পর্ক থাকত। এটা বহুধাতু মুদ্রাবিশিষ্ট সামাজিক ব্যবস্থাতেও কার্যকর, অবশ্যই সেখানে প্রত্যেকটা ধাতু মুদ্রার সঙ্গে অন্য ধাতু মুদ্রার নির্দিষ্ট সম্পর্কটাও জরুরি ছিল। এই সব সমাজে বিভিন্ন ধাতুর, বিভিন্ন মানের মুদ্রা উৎপাদন নির্ভর করত ধাতুর সরবরাহ এবং সামাজিক উপযোগিতা আর ব্যবহারের ওপর। ধাতুগুলির মধ্যে স্থায়ী সম্পর্কের ওলটপালট হয়ে গেলে যে ধাতু মুদ্রার দাম বাড়তে থাকে, সেটিকে গলিয়ে ফেলার প্রবণতা বাড়তে থাকে। মুঘল ভারতের মুদ্রা ব্যবস্থা এই জটিলতার থেকেও অনেক বেশি জটিল ছিল। সেই সমাজে মুদ্রা শুধু যে বহু ধাতুর(সোনার মোহর, রূপোর টাকা আর তামার দাম/পয়সা) ছিল তাই নয়, জনগণ দামি ধাতু বা পুরোনো মুদ্রা টাঁকশালে নিয়ে গিয়ে নতুন মুদ্রা বানানোর অধিকারী ছিল। বিভিন্ন ধাতুর মুদ্রার মধ্যে কোন স্থায়ী সম্পর্ক ছিল না।
আগেই বলেছি সোনার মোহরের উপযোগিতা ছিল উৎসব বা উপহারের জন্য। তবে তার ব্যাপক ব্যবহার ছিল সঞ্চয় করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু সাধারণ দৈনন্দিনের লেনদেনে রূপোর সিক্কা টাকা বা তামার দাম বা পয়সার যে গুরুত্ব ছিল, মোহরের সেই ব্যবহার ছিল না। ফলে বিশেষভাবে বলা না হলে টাকা শব্দটা বলা থাকলে বুঝতে হবে এটা সেই বছর বা তার আগের বছরে তৈরি হওয়া রূপোর সিক্কা টাকার কথা বলা হয়েছে। দুবছরের আগের ছাপা মুদ্রা, যার নাম ছিল চালানি না খাজানা টাকা, তার পেমেন্টের ওপর বাজার নির্ধারিত একটা বাটা ধরে নেওয়া হত। বাস্তবে এই বাটাটির হার মোটামুটি নির্ধারিতই ছিল। এটা খুব বেশি কমত বা বাড়ত না। কিন্তু সিক্কা টাকা আর তামার দামের পয়সায় হারটা বেশ বাড়া কমা করত। আইনিআকবরি সূত্রে জানছি এর হার ছিল ৪৮ঃ১। এটা নির্ণিত হয়েছিল ১৫৭৫এ সরকারি খরচের উদ্দেশ্যে। কিন্তু বাস্তবিক বাজার দর এর থেকে অনেক আলাদা ছিল। দামের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ঃ১, ১৫৮৩র আগেই এবং তখন নতুন বিনিময় স্থির হয় ৪০ঃ১। আইনিআকবরি বলছে এই হারটা ১৫৯৫-৯৬ সালের জন্য, যে বছরে এটি লিখিত হয়। এর ফলে সমাজের একটি স্তরে বেশ বিশৃঙ্খলা এবং তকলিফ দেখা দেয়।
আকবরের মনসবদারদের সেনাদের মাইনে দেওয়া হত দামে। ১৫৭৫ সালে রূপিতে ৫০%, ২৫% মোহরে এবং বাকি ২৫% দামে বা পয়সায় মাইনে মেটানো হল। সেনাদের হাতে রূপি আর দামের মধ্যে বিনিময় করতে পাদশাহ নির্দেশ দিলেন দামের আর রূপি(সিক্কা)র তুলনা হবে ৪০ঃ১(Irfan Habib, ‘A System of Trimetallism in the Age of the ‘Price Revolution’: Effects of the Silver Influx on the Mughal Monetary System’ in J.F. Richards (ed.), The Imperial Monetary System of Mughal India)।
মন্তব্যঃ মনসবদার - মুঘল সাম্রাজ্যে সব সেনা আর প্রশাসনিক পদের নাম ছিল মনসবদার। এদের দু ধরণের পদ ছিল জাট আর সওয়ার। জাট পদ নির্ধারিত হত প্রশাসনিক শৃঙ্খলে সরকারিভাবে ওঠাপড়ার জন্য, সেখানে তিনি সাম্রাজ্যকে বছরের সেবা দেওয়ার মাইনে পেতেন। আর সওয়ারে তাকে কিছু সঙ্খ্যক সেনা, ঘোড়সওয়ার এবং তোপখানা(গোলাবারুদ) পালতে হত সাম্রাজ্যের যুদ্ধের জন্য। তিনি বাৎসরিকভাবে এই বিশাল সেনাবাহিনী পালনের একটা আর্থিক বরাদ্দ পেতেন। এগুলো তাকে নগদে দেওয়া হত না। তার জন্য তাকে একটা ভৌগোলিক এলাকা দিয়ে দেওয়া হত, যাকে বলা হত জায়গির, সেখানকার রাজস্বে তিনি সব ব্যয় মেটাতেন। প্রথম দিকে আকবর মনসবদারদের অর্থে মাইনে মেটাতেন। পরের দিকে গোটা বেতনটাই জায়গির থেকে তুলতে হত। আওরঙ্গজেবের সময় সারা দেশের রাজস্বে জমির ৪/৫ অংশই বরাদ্দ ছিল মনসবদারদের অর্থ মেটানোর জন্যে
No comments:
Post a Comment