এইরকম অবস্থা এড়ানোর জন্য প্রয়োজন ছিল মুদ্রাগুলির মধ্যে সরকারিভাবে আন্তঃসম্পর্ক নির্দেশ কঠোরভাবে প্রয়োগ করা, এবং যখন লেনদেন হবে তখন যেন সেই সম্পর্ককে মান্য করা হয়, এটাও নির্দেশ দেওয়া। কর্মচারীদের মুদ্রার মানের সঠিক মূল্য পাওয়ার জন্য প্রয়োজন, দামঃটাকার মধ্যেকার সম্পর্ক নির্ণয়, এবং দামে বেতন দিলে সে সময় সে কত পেল তা যাতে সে বুঝতে পারে সেটা জানা এবং সেই মুদ্রার সাধারণ বিনিময় হার নির্নয় করা। এটা হয়ত হত, কিন্তু সবসময় করা যেত না। যদি রূপোর টাকায় কোন বড় পেমেন্ট হত, তাহলে তা যাতে ঠিকঠাকভাবে বিভিন্ন মুদ্রায় মূল্যায়িত হত তা নিশ্চিত করা জরুরি ছিল।
আইনিআকবরিতে দৈনিক বা পাক্ষিক বা মাসিক অর্থাৎ সময় নির্ধারিত বা পণ্যপ্রতি যে শ্রমের মূল্যের উল্লেখ পাচ্ছি, তা কিন্তু মূলত দামেই চোকানো হত। সে সময় সাপ্তাহান্তে বেতন চোকানোর রেওয়াজ ছিলই না বলা চলে, কারণ সেটা আইনিআকবরিতে বলা নেই। সপ্তদশ শতকে ১৬২০র পর থেকে অবস্থাটা পাল্টায়, যখন এক আনা, দু আনা, চার আনা, আট আনা(এগুলি সব রূপোর টাকার অংশ, এক আনা সমান এক রূপোর টাকার একের ষোল ভাগ) ছাপানো শুরু হল। তবে এগুলির বাজারে ছাড়ার পরিমান খুব বড় ছিল না। ষোড়শ শতে তামার দাম বাজারে সব থেকে বেশি দেখা যেত, চলত বেশি করে, কিন্তু পরের শতকে সেটা আর বলা যাচ্ছে না। উদাহরণ স্বরূপ, জন ডেয়েল দেখাচ্ছেন, আকবরের রাজত্বের শেষের দিকে তামার মুদ্রা আর প্রায় বাজারে পাওয়াই যাচ্ছে না৯। এর সময়ে শ্রমের উপাত্ত মূলত টাকার হারে দেখতে পাচ্ছি, যদিও তামার দামের প্রচলন তখনও কিন্তু খুব বেশি কমে নি।
অষ্টাদশ শতে যখন সাম্রাজ্যের পতন হতে শুরু করল, তখন আরেক দফা পরিবর্তন এল। সাম্রাজ্য জুড়ে সিক্কা টাকার পতন হতে শুরু করল। ১৭১২ সালের কলকাতার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কলকাতার কুঠিয়াল লিখছেন, ‘বাংলার সিক্কাগুলো অন্য এলাকায় যে ধরণের বাটা পায় অন্য এলাকার টাঁকশালের সিক্কাগুলোর ১০শতাংশ বাটা পায়, কিন্তু ঢাকা, পাটনা বা কটকের সিক্কাগুলি একই ওজন এবং ঔজ্জ্বল্যে বরাবর হলেও, মুকসুদাবাদের থেকে হুগলিতে ২ থেকে ৩ শতাংশ কম এবং যেখানে টাঁকশাল নেই, সেখানে কম বাটা পায়’১০। তবুও মুদ্রা ব্যস্থার অবস্থা তখনও মোটের ওপর স্বাস্থ্যকর ছিল, যতক্ষণ বাংলা ব্রিটিশদের হাতে যায় নি। এবং কোঁম্পানির প্রথম যুগে বাংলা বাজারে অনিশ্চয়তা এবং বিশৃঙ্খলা বেড়ে চলতে শুরু করে। আফসোস এই সময়ে গুরুত্ব দিয়ে এই বিষয়ে কোন বিশ্লেষণী লেখা কেউ লিখেছেন বলে জানা নেই।
বাজারী(humble) মুদ্রা
মুঘল আমলে প্রমিত মুদ্রার সঙ্গে বাজারজুড়ে সাধারণ অপ্রমিত মুদ্রাও চালু ছিল, যাকে আমরা বাজারী মুদ্রা বলতে পারি। এগুলি অমুঘল মুদ্রা আবার হয়ত পণ্য মুদ্রা। ১৫৭২ সালে গুজরাত মুঘল রাজত্বের আওতায় চলে এলেও, সুরাত, ভারুচ এবং বরোদায় সপ্তদশ শতএর মধ্য সময় পর্যন্ত মহমুদি নামক একটি অপ্রমিত মুদ্রা চলত। ১৬৩০ সালে সুরাটের মুতাসাদ্দিরা মহমুদিতে রাজস্ব নিয়ে, দিল্লীতে পাঠানোর আগে সেটিকে টাকায় রূপান্তরিত করেছে১১। সুরাট কুঠির হিসেবের খাতা থেকে দেখছি, বহু পণ্য লেখা হয়েছে টাকায় নয়, মহমুদিতে১২। মুঘল রাষ্ট্রের সাধারণ নীতি ছিল, যত তাদের রাজত্ব বহরে বাড়বে, তত স্থানীয় সমস্ত মুদ্রা বাতিল করে কেন্দ্রিয় মূলমানের মুদ্রা চালু করা হবে। তবে গুজরাটে এই ব্যতিক্রমের কোন ব্যখ্যা আজও পাওয়া যায় নি। তবে হ্যান্স ভন সান্তেনের ব্যখ্যাই হয়ত ঠিক, স্থানীয়ভাবে যে মুদ্রাগুলি জনপ্রিয়, সেগুলিকে বজায় রেখে কেন্দ্রিয় মুদ্রাগুলি উত্তরভারতে চলে যেত১৩।
পণ্য মুদ্রা হল নির্দিষ্ট ওজনের টিনের মুদ্রা, বা বাদাম(bitter almonds) ইত্যাদি ইত্যাদি। এই পণ্য মুদ্রাগুলি বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন মানে বিনিময় হিসেবে ব্যবহার হত। গুজরাতে সব থেকে জনপ্রিয় পণ্য মুদ্রা হল বাদাম, ১৬৩৬ সালে এক তামা মুদ্রার বিনিময়ে ৩৬টা বাদাম পাওয়া যেত।
তবে মুঘল ভারতে সব থেকে গুরুত্বপূর্ন বাজারী মুদ্রা হল কড়ি। সমুদ্র জাত কড়ি আমদানি করা হত মূলতঃ মলদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা এবং ভারত মহাসাগর থেকে। মুঘল ভারতের বাংলা বিহার ওডিসা মূলত এই দ্বীপগুলির সঙ্গে কড়ির বিনিময়ের জন্য বিপুল পরিমান ব্যবসা করত। এর বিনিময়ে দ্বীপগুলি বিপুল পরিমানে আমদানি করত পরিধেয়, চাল, তেল আর ঘি। পিপলি বালেশ্বর আর হুগলি বন্দর থেকে ওডিসি এবং বাঙ্গালি নাবিক আর সওদাগরেরা বিপুল পরিমানে কড়ি বহন করে আনত। বিশ্ব কড়ির বাজারে মালদ্বীপ সব থেকে বড় সরবরাহকারী ছিল। স্থানীয়ভাবে ব্যবসায়ীরা পুর্ব ভারতের তিন রাজ্য এবং দক্ষিণের মালাবার এবং দক্ষিণ পশ্চম উপকূলে কড়ি বহন করে নিয়ে আসত। এই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পাল্লা দিত ষোড়শ শতে পর্তুগিজ এস্তাদো দা ইন্দিয়া এবং সপ্তদশ এবং অষ্টদশ শতে ডাচ ভিওসি। তারা এগুলি জাহাজের খোলের মধ্যে ভরে(যাতে জাহজ ভারি হয়, ঝড়ে সহজে উল্টে/ডুবে না যায়) দেশে নিয়ে যেত। এগুলি আফ্রিকায় দাস কেনার জন্য ব্যবহৃত হত।
No comments:
Post a Comment