এনকাউন্টারিং ডেভেলাপমেন্টঃ দ্য মেকিং এন্ড আন্মেকিং অব দ্য থার্ড ওয়ার্লডঃ আর্তুরো এসকোবারএর বই থেকে
দ্বিতীয় অধ্যায়
THE PROBLEMATIZATION OF POVERTY – তিন বিশ্বের কথা এবং উন্নয়ন
আমাদের সময়ে দারিদ্র একটা গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। প্রত্যেকেই এই শব্দটিকে নিয়ে বিপুলভাবে ধর্ষণও করেছেন আবার ব্যবহারও করেছেন। দরিদ্রের নামে বিপুল পরিমান অর্থ খরচ হয়। গরীবদের সমস্যার সমাধান করতে হাজারে হাজারে বই ছাপা হয়, বিশেষজ্ঞরা তাঁদের বহুমূল্য রায় দিয়েই থাকেন নিয়মিত। মজার হল যাদের জন্য এই সব আয়োজন, সেই গরীব এবং তাদের সঙ্গে জুড়ে থাকা দারিদ্র দূরকরার মানুষজনও জানেন না আসলে দারিদ্র কাকে বলে। দারিদ্র বিষয়ে বিশ্বজোড়া যে সব সংজ্ঞা আজ চলছে সেগুলি অধিকাংশ ‘উনতা’ বা ‘অনটন’ – এই দুই বিষয়কে ঘিরেই আবর্তিত হয়ে চলছে। এটা আসলে দারিদ্র বিষয়ে ভাবনার দারিদ্র। প্রয়োজনটা আদতে কি এবং কার জন্যে? এবং কে এই বিষয়টি সংজ্ঞায়িত করার কাজে উপযুক্ত – এটা ভাবা দরকার?(Majid Rahnema, Global Poverty: A Pauperizing Myth, 1991)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের সব থেকে বড় যে পরিবর্তনটা ঘটে সেটা হল, প্রথম বিশ্ব এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকায় দারিদ্র্য খুঁজে পেল। তুলনামূলকভাবে অস্পষ্ট এবং বাস্তবিকতায় যুক্তিসম্মত এই আবিষ্কারে বিশ্বজোড়া সংস্কৃতি আর রাজনৈতিক অর্থনীতিতে ঘটে গেল বিপুল পরিবর্তন। যুদ্ধ নতুন সামাজিক বাস্তবতায় প্রবেশ করল এবং যুদ্ধ শুরু হল নতুন ভৌগোলিক এলাকায় – তৃতীয় বিশ্বে। পিছনে পড়ে রইল ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে লড়াই। বিশ্বায়িত আমেরিকার ক্ষমতায়ন নতুন সময়ে ঢুকে পড়ে, শুরু হল সারা বিশ্বজুড়ে নতুন এক লড়াই। তৃতীয় বিশ্বে দারিদ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এক্কেবারে বিশ্ব রঙ্গমঞ্চের সামনের সারিতে এসে বসল। নতুন যুদ্ধের সমর্থনে নানান ধরনের মনোলোভা তথ্য অস্ত্রশস্ত্ররূপে পরিবেশিত হতে থাকল, ‘১৫০০০০০ মিলিয়ন মানুষ, মোটামুটি বিশ্ব জনসংখ্যার দুইতৃতীয়াংশ, শনাক্তযোগ্য অপুষ্টির কবল আর অবর্ননীয় দারিদ্রের কবলে পড়ে আছে। এই ক্ষুধা হল দারিদ্র্য, ক্ষুধা আর দুঃখের কারণ ও প্রভাব(উইলসন, ১৯৫৩)’ ইত্যাদি।
গোটা চল্লিশ আর পঞ্চাশের দশক জুড়ে এই ধরণের এজাহারি চলতে লাগল(Orr 1953; Shonfield 1950; United Nations 1951)। নতুন জিগিরে বোঝা বোঝা যেতে শুরু করল যেন, বিভিন্ন দরিদ্র দেশে বাড়তে থাকা পৌনপুনিক দারিদ্র এবং তার ফলে উদ্ভুত সামাজিক হিংসা আদতে প্রথম বিশ্বের কাছে হুঁশিয়ারি স্বরূপ। এর ফলে গরীব এলাকার সমস্যাগুলি ক্রমশঃ আন্তর্জাতিক রঙ্গমঞ্চে ঠাঁই পেতে শুরু করল। রাষ্ট্রসংঘ ১৯৪৯ সালে আবিষ্কার করল আমেরিকার মাথাপিছু আয় ১৪৫৩ পাউন্ড আর ইন্দোনেশিয়ার ২৫ পাউন্ডও নয়। ভাবা হতে শুরু করল বিশ্বে স্থিতিশীলতা আর অসহনীয় হয়ে ওঠার আগেই নতুন কিছু উদ্যম নেওয়া দরকার। প্রথম বিশ্ব হাত বাড়িয়ে বলল, ধনী আর গরীব দেশগুলোর নিয়তি একসঙ্গে জুড়ে রয়েছে। ১৯৪৮ সালে বিশ্বের এক বিশেষজ্ঞ দলের মন্তব্য, ‘বিশ্বের সত্যিকারের সমৃদ্ধি অবিভাজ্য’। ‘বিশ্বের এক প্রান্ত যদি দারিদ্র আর অস্বাস্থ্যের মধ্যে ডুবে থাকে তাহলে সমৃদ্ধি অন্যপ্রান্তে বেশি দিন সমৃদ্ধ থাকতে পারে না(Milbank Memorial Fund 1948, 7; see also Lasswell 1945)’।
বিশ্বজোড়া দারিদ্র আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তোর সময়ের আবিষ্কার। স্যাক্স আর রাহেনমা সুত্রে আমরা জানতে পারছি, দারিদ্রের ধারণা আর তার নির্মূলীকরণের নিদান ১৯৪০এর আগে আলাদা রকমের ছিল। উপনিবেশ ভাবত নেটিভদের অর্থনৈতিক বিকাশের কোন লক্ষ্য নেই, এবং যতদিননা নেটিভেরা উপনিবেশের দ্বারা আলোকিত হচ্ছে, ততদিন তাদের অর্থনৈতিক দারিদ্র থেকে মুক্তি নেই। নেটিভদের বিজ্ঞানপ্রযুক্তির বিকাশ শূন্য ভাবা হত(Adas 1989)।
আদাস তাঁর Machines as the Measure of Men বইতে বলছেন, এশিয়, আফ্রিকিয় এবং লাতিন আমেরিকিয়ূ এমন কি অধিকাংশ ইওরোপিয় ইতিহাসে, পরম্পরার সমাজ দারিদ্রকে রুখত, সংযম, সামাজিকতা আর স্বনির্ভরতার সূত্রে। তাদের পরম্পরাকে আদর্শ হিসেবে নাও দেখে, বলা যায়, আধুনিক অর্থে বিপুল দারিদ্র বলতে যা বোঝায় সেটির উদ্ভব হয়েছিল বাজার অর্থনীতির বিস্তার, কোটি কোটি মানুষকে জীবন, জীবিকা, ভূমি, জল আর অন্যন্য সম্পদ থেকে বিচ্যুত করার পরেই। পুঁজিবাদের শেকড় চারিয়ে যাবার পর থেকেই মানুষের কাঙ্গালিকরণের সময়ের শুরু।
দারিদ্রের প্রত্নতত্ত্বে প্রবেশ না করে, রাহেনমা বলছেন, দারিদ্রের ধারনা আর ব্যবস্থাপনাকে ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে গেলে বুঝতে হবে, এটি প্রথমে শুরু হয়েছিল উনবিংশ শতকে ইওরোপে পুঁজিবাদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এবং তৃত্রীয় বিশ্বের ধারনাটির বিকাশের মাধ্যমে। রাহেনমা বলছেন উনবিংশ শতকে বিভিন্ন নৈর্বক্তিক সঙ্গঠনগুলি দারিদ্রের ধারনাটির ব্যবস্থাপনার মধ্যে দিয়ে। এই রূপান্তরের সময়ে লোকহিতৈষণা(Philanthropy) একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে(Donzelot 1979)।
গরীবকে গ্রাহক হিসেবে তৈরি করার মাধ্যমে বিশ্ব রাজনীতি আর অর্থনীতিতে বিপুল পরিবর্তন ঘটল। দারিদ্রের ‘আধুনিকতা’য় দেশিয় সম্পর্কগুলো শুধু ভেঙ্গে গেল তাই নয়, নতুন ধরণের নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাপনার সময় শুরু হল। ক্রমশ গরীবদের সামাজিক অসুবিধে হিসেবে দেখা হতে শুরু করল, এবং এটাও ভাবা হল যে সমাজে এর জন্য নতুন ধরণের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। দারিদ্র আদতে জীবন, অর্থনীতি, অধিকার এবং সামাজিক ব্যবস্থাপনাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করা শুরু করল। ‘কাঙ্গালপনা, রাজনৈতিক অর্থনীতি আর সমাজের আবিষ্কার পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত(Polanyi 1957)।’
No comments:
Post a Comment