Monday, October 2, 2017

মুঘল মুদ্রাব্যবস্থা -ওম প্রকাশ১

মুঘল ভারতে তিন ধরণের ধাতুমুদ্রা ছিল সোনার মোহর, রূপোর টাকা এবং তামার দাম বা পয়সা। মূলত রূপো টাকাই চলত বাজারে। আর সোনার মোহর মূলত উপহার দেওয়ার জন্য বা সঞ্চয় করার জন্য ব্যবহার হত। মুঘল আমলের ধাতু মুদ্রায় ঐ ধরণের ধাতুর শুদ্ধতা অসাধারণ ছিল। ১৬৯ গ্রেনের সোনার মোহরে সোনার শুদ্ধতার হার ছিল খুব বেশি। রূপোর মুদ্রার ওজন ছিল ১৭৮ গ্রেন, ঔরঙ্গজেবের সময় বেড়ে হয় ১৮০ গ্রেন। তামার দামের ওজন ছিল ৩২৩ গ্রেন ১৬৬৩-৬৪ পর্যন্ত, তারপরে তার ওজন ২/৩ ভাগ করে ফেলা হয়(তপন রায়চৌধুরী, ইরফান হবিব, কেম্ব্রিজ ইকনমিক হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া, প্রথম খণ্ড)।

সাম্রাজ্য জুড়ে শাহী টাঁকশালগুলিতে মুদ্রাগুলি ছাপাই হত। যে কোন ব্যক্তি নির্দিষ্ট সময় পরে মেয়াদ উত্তীর্ণ মুদ্রা টাঁকশালে নিয়ে গেলে সেগুলির বদলে নতুন মুদ্রা দেওয়া হত। কতগুলি নতুন মুদ্রা বাহককে দেওয়া হবে বিনিময়টা নির্ভর করত পুরোনো মুদ্রার শুদ্ধতার ওপর। এই সিদ্ধান্ত টাঁকশাল নিত। মুদ্রা ছাপাইয়ের জন্য যে ধাতু নষ্ট হয়, অন্যান্য কাঁচামালগুলির খরচ, শ্রমের মূল্য ধরে একটা সেবামূল্য নেওয়া হত। একটি মুদ্রার সঙ্গে অন্য মুদ্রার বিনিময়মূল্য সরাসরি বাজার দরের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এবং নির্ভর করত সেই মুদ্রার বাজারে উপস্থিতি, চাহিদার ওপরে।

নতুন রূপোর মুদ্রার নাম ছিল সিক্কা টাকা। মুদ্রায় উপস্থিত রূপোর দাম, তৈরির খরচ এবং তার seigniorageকে ধরেই। মুদ্রার মানের অবনমনের মানটি নির্ভর করত নানান জটিল অঙ্কের ওপর। পুরোনো সিক্কা টাকার প্রত্যেক বছরের বাজারদাম নির্ণয় করা হত অভিজ্ঞ শ্রফেদের জটিলভাবে অঙ্কের ওপর নির্ভর করে। পুরোনো সিক্কা টাকার ব্যবহার বা ধরে রাখার জন্য তার মূল্যমান যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস ঘটত, সেই পুরোনো মুদ্রা নতুন করে ছাপানোর জন্য নিয়ে আসা হত টাঁকশালে। সরকার এই প্রতিস্থাপনকে খুব উৎসাহ দিত, কারণ এতে সরকারের খাজাঞ্চিখানায় বিপুল অর্থ ঢুকত। এগুলো যেহেতু বাস্তবিক(intrinsic) মুদ্রা, ছলন(token) মুদ্রা নয়। গোটা সাম্রাজ্যে মুদ্রার অবমূল্যায়ন(debasement) নিয়ে মুঘল সাম্রাজ্যকে ভাবতে হয় নি। একইসঙ্গে নকল মুদ্রাও খুব বেশি বাজারে ছিল না(J.Ovington, জে অভিঙ্কটন, আ ভয়েজ টু সুরাট ইন দ্য ইয়ার ১৬৮৯)।

মুঘল রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা খুব সীমিত ছিল। বাজারে থাকা ধাতুর সরবরাহ আর টাঁকশালের মুদ্রা তৈরির ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে সরাসরি জনগন নির্ধারণ করত বাজারে মুদ্রার উপস্থিতির পরিমান কত হবে(যে সময় হাতে ছাপাই হত। টাঁকশালের টাকা তৈরির ক্ষমতা কিছুটা হলেও বাড়ানো যেত। বিশেষ করে এটা সত্য সেই টাঁকশালে। যেখানে টাকা তৈরি আর ব্যবস্থাপনার অনেকটা স্বশাসিত ছিল)। এ বিষয়ে সরকারের ভূমিকা সে সময়ের যে কোন জনগণের অধিকারের সমান ছিল। শুধু একটাই পার্থক্য ছিল যে সরকারের সম্পদ সংগ্রহে ভূমিকা যে কোন জনগনের তুলনায় অনেক বেশি ছিল এবং টাঁকশালে তার টাকা সবার আগে ছাপানো হত। সরকারের আরেকটা ভূমিকা থাকত, মুদ্রায় ধাতুর ব্যবহার কতটা করা হবে সেটা সে ঠিক করত।

১৬৫৭ সালে সুরাটে তামার পয়সা(বা দাম)র চাহিদা বাড়ায় টাকা-পয়সার হার ১ঃ৪০ হল, ১৬৪২ সালে এটা ছিল ১ঃ৫৬। সে সময় সুরাটের মুতাসাদ্দি(বন্দর আধিকারিক) একটা নির্দেশিকা জারি করে জানায় যে সুরাট বন্দরে আমদানি করা সব তামা সরাসরি টাঁকশালে নিয়ে যেতে হবে। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি(সে সময়ে ভারতে জাপান তামার একমাত্র এবং সবথেকে বড় আমদানিকারক) থেকে যে সব ব্যবসায়ী তামা কিনে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করত, তাদের ব্যবসা সেই সময়ের জন্য নিষিদ্ধ করা হল। পর পর দুবছরের জন্য নিষিদ্ধ থাকল। ১৬৬২ সালে নতুন সম্রাটের কাছে সে সময়ের ভারতে ডাচ নির্দেশক ভন এড্রিচমেনএর নেতৃত্বে একটি দল সনদ নবীকরণের জন্য গেলে, তারা একটা বড় ছাড় পেল। কোম্পানি যে পরিমান তামা সুরাটে নিয়ে আসছে, তার থেকে একটা বড় অংশ তামা সওদাগরেরা শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি। অর্থাৎ যে নিষেধাজ্ঞাটা বলবৎ হয়েছিল, সেটি তুলে নিল কেন্দ্র। তবে তাদের প্রতি আদেশ হল তাদের বিপুল পরিমান তামা ভারতে আমদানি করতে হবে। এই ফরমানটা শেষ পর্যন্ত সরকার মানে নি, তারা কোম্পানির আমদানি করা বিপুল পরিমান তামা, পুরোটাই সরকারি টাঁকশালে নিয়ে নিত(H.W. van Santen, De Verenigde Oost-Indische Compagnie(VOC) in Gujarat en Hindustan, 1620-1660 এবং W. Foster (ed.), The English Factories in India, Oxford, 1906-1927, volume for 1662)।


মন্তব্যঃ VOC ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ছোট নাম

No comments: