আদিবাসী মুন্ডাদের
জমির অধিকার, ভাতের অধিকার নিয়ে জমিদার, সামন্ত, দিকু আর এদের সবার
রাজা ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে স্বাধীণতা সংগ্রাম। কিন্তু অশিক্ষিত, ন্যাংটো মুন্ডাদের
স্বাধীণতা সংগ্রাম কে পরিচালনা করবে? গোত্রের বাইরে এসে এরা কি
পারবে জোট বাঁধতে,
ইংরেজি বাঙলাসহ তথাকথিত কোন সভ্য ভাষা না জেনে এরা কিভাবে আইনী লড়াই
চালাবে, অসম্ভব। সেই অসম্ভব সাধন
করল মুন্ডা স্বাধীণতা সংগ্রামের নায়ক, মুন্ডাদের ভগবান, ধরতী-আব্বা, 'বিরসা মুন্ডা'। মিশনারী স্কুলে পড়া বিরসা
খুব ভাল ছাত্র ছিল, মুন্ডাদের মাঝে এমনটা দেখা যায় না, ভগবান বলে হয়ত সে
ভিন্ন ছিল। দিকুদের ছেলেদের মত পড়াশোনা শেষ
করতে পারলে হয়ত কালে সাহেবের অফিসের কেরাণী হতে পারত, যেমন হয়েছিল তার
সহপাঠী একমাত্র দিকু বন্ধু বাঙালী ডেপুটি সুপার অমূল্যবাবু।
কিন্তু যার ভগবান হবার কথা তার কি পড়ালেখা
শিখে কেরাণী হওয়া সাজে। ১৮৭৮ সালের কথা , মুন্ডারা সরকারকে
আর্জি জানায়, ছোটনাগপুর তাদের
দেশ, সে দেশে তাদের অধিকার
কায়েম করা হোক। মিশনের ফাদাররা তাদের হয়ে লড়তে অস্বীকার
করে, ফলে দলে দলে
মুন্ডা মিশন ত্যাগ করে সর্দারদের লড়াইয়ে শামিল হয়। মুন্ডারা বলে, "খ্রীস্টান হয়েছি তা বলে কি বাপ-দাদার ধর্ম ছেড়ে দিব?" এতে ফাদাররা ক্ষেপে ওঠে, চিরকালের ঠান্ডা, নির্বিরোধী, সহজ-সরল মুন্ডাদের বলে 'মুন্ডারা বেঈমাণ, জোচ্চোর'। বিরসা এতে প্রচন্ড
ক্ষিপ্ত হয়, সাহেবরা ভাবতেও পারেনি এ
ছেলের শরীরে এত রাগ। ফাদারদের কথা ফিরিয়ে নিতে বলে, এতে ফাদাররা আরও
ক্ষিপ্ত হয় এবং সেখানেই বিরসার পাঠের সমাপ্তি । বিরসা বুঝতে পারে, " সাহেব-সাহেব এক টোপি। সরকার যা,
মিশন তা,
সব একসমান।"
এরপর বিরসা মুন্ডাদের একত্রিত করে তাদের মধ্যে কাজ করা শুরু
করে,মুন্ডাদের সব সমস্যার
সমাধানের দিক নির্দেশনা দেয়। ধীরে ধীরে সে হয়ে
যায় মুন্ডাদের ভগবান, ধরতি-আবা। প্রাচীন জড়তা, অন্ধ কুসংস্কার
থেকে মুন্ডাদের আধুনিক পৃথিবীতে নিয়ে আসতে চায়,জঙ্গলে মুন্ডাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে
চায়, আদিম খুটকাট্টি
গ্রামব্যবস্হা'র প্রতিশ্রুতি দেয়। মুন্ডারাও দলে দলে
ভগবানের
আশ্রয়ে এসে ধরা দেয়। বিরসার মতে, " ধর্মের অসার জাদু-রীতিনীতির বোঝা বুকে চেপে থাকলে মুন্ডারা মাথা তুলতে
পারবে না। তাই বিরসা ভগবান
হয়ে ওদের বিপ্লবে নামিয়েছে।"
ধীরে ধীরে মুন্ডারা বিভিন্ন আদিম মন্দির দখল করে নিতে লাগল, দখল নিয়ে আবার ফিরিয়েও দিল। তারপরে মুন্ডাদের
স্বাধীণতা সংগ্রাম 'উলগুলান' এর ডাক দিল। 'উলগুলান'!
'উলগুলান'
!
উলগুলানের দু'টি অধ্যায়, প্রথম অধ্যায়ে আগুন জ্বালিয়ে ভয় দেখাতে হবে। দ্বিতীয় ভাগে শুরু হবে সশস্ত্র সংগ্রাম। ২৪ ডিসেম্বর ক্রিশমাস ইভে শুরু হল প্রথম পর্ব। বড়দিনের ছুটিতে সব রাঁচির সরকারী দপ্তর বন্ধ এসময় মুন্ডারা রাঁচি শহরে তীর ধনুক নিয়ে ঝটিকা অভিযান চালিয়ে চলে যায়। সিংভুম সহ প্রতিটি থানায় সব জায়গা থেকে খবর আসে তীর ছুটেছে, আগুন জ্বলেছে।
ইংরেজরা এতে খুব বিচলিত হয়ে পড়ে, ছোটলাট
এমনকি বড়লাট পর্যন্ত খবর চলে যায়। বিরসা
এবং তার অনুসারী বিরসাইত মুন্ডাদের স্বাধীণতা সংগ্রাম দমন করতে ছোনাগপুরে সেনাবাহিনী
প্রেরণ করা হয়। মুন্ডারা গভীর জঙ্গলে
আত্মগোপন করে ফলে সরকার তাদের খোঁজে দিশেহারা হয়ে পড়ে।এরমধ্যে অনেক
মুন্ডা ধরা পড়ে জেলে যায় কিন্তু তাদের কাছ ঠেকে কোন তথ্য আদায় করা সম্ভব হয় না। এদিকে
সব পত্রপত্রিকায়
খবর ছাপা হচ্ছে, সামান্য
নেংটিপরা অশিক্ষিত মুন্ডাদের কাছে যদি ইংরেজদের হয়রান হতে
হয় তাহলে শহরে বন্দরে দিকে দিকে স্বাধীণতা সংগ্রাম জেগে উঠবে। ইংরেজ
সেনা, পুলিশ
সহ সরকারী সব বাহিনী তাই মুন্ডাদের হদিস নিতে জঙ্গলে ঢুকে
পড়ল এবং কিছুদিনের মধ্যে চরের মাধ্যমে খবর পেয়ে তারা মুন্ডাদের ঘেরাও করে
ফেলল । এরপরের ঘটনা সামান্য, গুলির
কাছে তীর-ধনুক বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি, ইংরেজরা
নারী শিশু নির্বিশেষে মুন্ডাদের নিধন করে। বিরসা
পালিয়ে বাঁচতে
পারে, কিন্তু
অপারেশন-বিরসা বন্ধ হয় না। শেষ
পর্যন্ত ভগবান যীশুর মত ভগবান বিরসাও বিশ্বাসঘাতকের কারণে ধরা পড়েন। ইংরেজ
জেলখানায় বিনাবিচারে বিষ প্রয়োগ করে তাকে হত্যা করা হয় এবং ১৯০০ সালের ৯
জুন মাত্র ২৫ বছর বয়সে বিরসা মুন্ডা দেহ রাখেন। মুন্ডাদের
মৃতদেহ কবর দেয়ার নিয়ম থাকলেও মেডিক্যাল পরীক্ষার
হাঙ্গামা এড়াতে ইংরেজ অফিসাররা তাকে দাহ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এতে
মুন্ডাদেরও বোঝানো যাবে বিরসা আসলে ভগবান নয়, সাধারণ মানুষের মত ওর
দেহ নশ্বর, তাদের
ধর্মবিশ্বাসে লাগবে এবং মনোবল ভেঙ্গে যাবে।
�� �(�)����w�uসনমানদের বাড়িও লুঠ হয়। উলগুলানের দু'টি অধ্যায়, প্রথম অধ্যায়ে আগুন জ্বালিয়ে ভয় দেখাতে হবে। দ্বিতীয় ভাগে শুরু হবে সশস্ত্র সংগ্রাম। ২৪ ডিসেম্বর ক্রিশমাস ইভে শুরু হল প্রথম পর্ব। বড়দিনের ছুটিতে সব রাঁচির সরকারী দপ্তর বন্ধ এসময় মুন্ডারা রাঁচি শহরে তীর ধনুক নিয়ে ঝটিকা অভিযান চালিয়ে চলে যায়। সিংভুম সহ প্রতিটি থানায় সব জায়গা থেকে খবর আসে তীর ছুটেছে, আগুন জ্বলেছে।
পুঁড়া আক্রমনের পর তিতুমীর ঘোষণা করলেন কোম্পানির লীলা সাঙ্গ হয়েছে, য়ুরোপিয়রা
অন্যায়ভাবে মুসলমান রাজ্য দখল করেছে। উত্তরাধীকার
সূত্রে মুসনমানই এদেশের রাজা। তিতুমীর নিজেকে
রাজা ঘোষণা করে জমিদারদের কাছ থেকে রাজস্ব দাবি করলেন। শুধু ওয়াহাবি আন্দোলনেই জমিদারি টলমল। জমিদারির সঙ্গে অনেক ইংরেজ নীলকুঠি তৈরি করতে গিয়ে বকলমে জমিদারিই তৈরি
করে ফেলছে, ইংরেজ শাসনের অবসান ঘোষণা করায় তাদেরও হৃদকম্প উঠল।
এ সময় গেবরডাঙার জমিদার ছিলেন লাটুবাবুর বন্ধু
কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়। তিতুমীরদের দমন করতে কলকাতা থেকে দুশ
হাবসি পাইক পাঠালেন আর জমিদারের নিজস্ব চারশ পাইক। কালীপ্রসন্ন খাজনা দিতে অস্বীকার করলেন। মোল্লারহাটির ডেভিস সাহেব তারও সড়কিওয়ালা আর বন্দুকবাজ নিয়ে তিতুর গ্রাম
আক্রমণ করলেন। ডেভিসবাহিনী ঢেকা মাত্রই তিতুর
বাহিনী তাদের ঘিরে ফেলে আর বাহিনী ছত্রখান হয়ে যায়। ডেভিস কোনও করম প্রাণ বাঁচিয়ে পালান, যে বজরায় এসেছিলেন সে বজরা টুরে
টুকরো করে কেটে ফিলা হয়। গোবরা-গেবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ
রায় ডেভিসকে সে যাত্রায় আশ্রয় দেন। দেবনাথের
সঙ্গে তিতুর বিবাদ বাধে। তিতু দেবনাথের গ্রাম আকেরমণ করেন। লাউহাটিতে এই যুদ্ধ হয়। দেবনাথ যুদ্ধ
করতে করতে প্রাণ দেন। দুই পক্ষেরই বহু হতাহত হয়।
এরপরই তিতুমীরের নাম ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় এক হাজার যুবক তার দলে নাম লেখাতে আসে। তিতুও তাদের যুদ্ধের জন্য তৈরি করতে থাকে। তিনি এবং তাঁর
অনুসারীরা তৎকালীন হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারের প্রতিবাদে ধুতির বদলে 'তাহ্বান্দ' নামে এক ধরনের
বস্ত্র পরিধান শুরু করেন। নির্বেশেষে সব জমিদারের কাছ থেকেই
তিনি রাজস্ব দাবি করলেন। প্রজাদের বললেন জমিদারদের খাজনা
দেওয়া বন্ধ করেদিতে। প্রজারা তিতুর কথামত খাজনা বন্ধ করে
দেয়। নদিয়া আক চব্বিশ পরগণা জেলার বহু জমিদার এলাকা থেকে
পালাতে থাকে। দেবনাথ রায়কে তিতুর বিরুদ্ধে
প্ররোচিত যে মুসলমান জমিদারটি করেছিল তার বাড়ি ১৮৩১ সালের ১৪ অক্টোবর তিতুমীর লুঠ
করে। বাহিনী রামচন্দ্রপুর আর হুগলীর ধনী মুসলমানদের বাড়ি
লুঠ করতে থাকে। নদিয়া আক চব্বিশ পরগণা জেলার বহু
জমিদারি এলাকা থেকে পুলিশ পালিয়ে যায়। এই এলাকাহুলোয়
তিতুর শাসন ব্যবস্থা চালু হয়। এ অঞ্চলের বহু
নীলচাষী নীলচাষ বন্ধ করে দেয়। তিতুমীরের
বাহিনীর দ্রুত কলেবর বৃদ্ধিতে শঙ্কিত স্বার্থান্বেষীরা কোম্পানি সরকারের কাছে
তিতুমীরের বাহিনী দমনে সেনা বাহিনী যাচ্ঞা করেন। এই আবেদনে সাড়া দিয়ে শাসক পক্ষ তিতুমীরের স্বাধীণতা সংগ্রাম দমন করতে
তোড়জোড় করতে শুরু করে।
বাঙলার গভর্ণরেরে(ছোটলাট) নির্দেশে কলকাতা থেকে এক বিশাল
সৈন্যবাহিনী যশোরের নিমক-পোক্তানে সমবেত হয়। প্রশাসন
বিষয়টিকে এতই গুরিত্বসহকারে দেখছিল যে, কলকাতার নির্দেশে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট,
আলেকজান্ডার এই সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগদান করেন। তিতুমীরের বাহিনীর সঙ্গে মহড়া নিতে ১২০জনের বন্দুকধারী সেনাবাহিনী
বাদুড়িয়ায় কুচ করে আসে। তিতুমীরও এই সংবাদে নিজ সৈন্যবহর
সাজিয়ে রাখে। নারকেলবেড়িয়া গ্রামে তিতুমীরের
ভাগনে গোলাম মাসুম তরবারি নিয়ে এই সৈন্যবাহিনী নিয়ে আক্রমণ করে। সরকারি সৈন্য ছারখার হয়ে যায়, ম্যাজিস্ট্রেট কোনও ক্রমে পালাতে পারে,
দারোগা কৃষ্ণদেব চক্রবর্তীর আত্মীয়, রামরাম চক্রবর্তী গ্রেফতার হয়। তাকে হত্যাকরা হয়। এবার আশেপাশের
গ্রাম, এলাকাগুলোর নীলকরেরা সকলে কুঠী থেকে পালিয়ে কলকাতায় আশ্রয় নেয়। বেশ কয়েককাল এলাকায় নীল চাষ বন্ধ থাকে।
সম্প্রদায়ের সিদ্ধান্তমত তিতুমীরকে বাদশাহ ঘোষণা করা হয়। এক জোলা, মৈনুদ্দিন প্রধাণমন্ত্রী আর ভাগনে প্রধাণ সেনাপতি নিযুক্ত হয়। তিতুমীর এবার আত্মরক্ষায় মনদিলেন। স্থির হল
নারকেলবেড়ে গ্রামে একটি দূর্গ তৈরি করতে হবে। এটিই ভারতের স্বাধীণতা আন্দোলনের প্রথম স্বাধীণতার লড়াই। তৈরি হল বাঁশেক কেল্লা। বিহারীলাল
তিতুমীরএ বাঁশের কেল্লারক যে বর্ণনা দেয়েছেল – কেল্লা বাঁশের হউক, - ভরতপুরের মাটির
কেল্লারমত সুন্দর, সুগঠিত, সুরক্ষিত, সুসজ্জিত না হউক, কেল্লার রচনা কৌশলময়, দৃশ্য
সৌন্দর্যময়। কেল্লার ভিতরে যথারূকি অনেক প্রকোষ্ট
রচনা হইয়াছিল। কোনও প্রকোষ্ঠ আহার্য দ্রব্য স্তরে স্তরে বিন্যস্ত ও
সজ্জিত ছিল, - কোন প্রকোষ্ঠ, সড়কি, তরবারি, বর্ষা, বাঁশের ছোটবড় লাঠি সংগৃহীত ও
সজ্জিত ছিল, - কোন প্রকোষ্ঠে স্তুপাকার বেল(কাঁচা), ও ইস্টকখন্ড সংগৃহীত হইয়াছিল। এই কেল্লার কৌশল-কায়দা তিতুর বুদ্ধি ও শিল্প চাতুর্যের পরিচায়ক। তিতুমীর ও তাহার অনুচরবর্গের দৃঢ় ধারণা হইয়াছিল, এই কেল্লা বাঁশের হইলেও
প্রস্তর নির্মিত দুর্গ অপেক্ষাও দুর্জয় ও দুর্ভেদ্য।
শুধু ইংরেজ বাহিনী দিয়ে হলনা দেখে জমিদার আর ইংরেজ সেনা
নিয়ে নারকেলবেড়িয়া আক্রমণের পরিকল্পনা হল। সাতক্ষিরা,
গেবরডাঙা, নদীয়াসহ নানান জমিদার একযোগে তিতুমীরকে আক্রমণের প্রস্তাব করেন। কোম্পানির ভারত প্রধাণ, গভর্নর জেনারেল বেন্টিঙ্কের নির্দেশে আর এক বাহিনী
হাতিসহ বহু সৈন্য নিয়ে নাকরেলবেড়িয়া অভিযান করে। জমিদারদের বরকন্দাজরাও এই সেনার সঙ্গে মিলিত হন। সেনাপতি গোলাম মাসুম বাঘারিয়ায় এক পরিত্যক্ত নীলকুঠি অধিকার করে সেখানে
সেনাবাহিনীর প্রতীক্ষা করতে থাকেন। সংবাদ
পাওয়ামাত্র কালেক্টারের নির্দেশে কোম্পানি-জমিদারজোট সেনা বাঘারিয়া আক্রমণ করে। তিতুমীরের সেনার ইট আর বেল আর অন্যপক্ষের গুলি বিনিময় হতে থাকে। আবার একবার বিহারীলালের বর্ণনায় মাসুমের
সৈন্যদল অন্তরালে অবস্থান করায়, গুলিবর্যণে তাহাদের বিশেষ ক্ষতি হয় নাই। কিন্তু জোটবাহিনীর বেশি ক্ষতি হয়। কালেক্টর
যুদ্ধ বন্ধ করার নির্দেশ দিয়ে পিছু হটতে থাকলে মাসুমের সৈন্যেরা চারিদিক হইতে ভীষণ
বেগে তাহাদিগকে আক্রমণ করে। এই আক্রমনে সাহেবের বহুলোকের ক্ষতি
হয়, এবং একটি হস্তী ও কয়েকটি বব্দুক মাসুমের হস্তগত হয়। এই জয়ের পর তিতুর প্রভাবপ্রতিপত্তি বেশ চাউর হয়। শোনা যায় ভূষণার জমিদার মনোহর রায়ও তিতুর
দলভুক্ত হন এবং তিতুর প্রভূত সাহায্য করেন।
১৮৩১এর ১৪ নভেম্বর, দুটি কামান নিয়ে একশ বিদেশি সৈন্য ও
তিনশ দেশি সৈন্য নারকেলবেড়িয়া আক্রণের জন্য প্রস্তুত হয়। রাতেই ইংরেজ সেনার ওপর আক্রমনের নির্দেশ দিন তিতু। ইটও বেল দিয়ে আক্রমণ করে ইংরেজ সৈন্যকে অনেকটা পিছুহঠতে বাধ্য করে ওয়াহবি
সেনা। সকালে কর্নেল কেল্লার সামনে গ্রেফতারি পরওয়ানা পড়ে
কেল্লায় কামানের গোলা বর্ষণের নির্দেশ দেন। পরপর কামানের
গেলা কেল্লায় আঘাত করলে একদেকে কেল্লা হেলে গেল। দুর্গের ওপর মুহুর্মুহু গোলা বর্ষণে তিতুর দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। তিতুর সেনারা নানান স্থানে আশ্রয় নিলেন। সবসমেত আটশ বন্দী গ্রেফতার হয়। বহুদিন মামলা
চলার পর গোলাম মাসুমকে ফাঁসির সাজা হয়, একশ চল্লিশজনের বিভিন্ন মেয়াদের কারাদন্ড
হয়।
�����?���I�F�র হয়ে এই বিফলতার কারণ খুঁজতে
গিয়ে কোম্পানির কর্মচারীদের সন্দেহ জমিদার দিকে পড়ে। চোয়াড় রেবেলিয়ন বইতে প্রাইস বলছেন, স্বাধীণতা
সংগ্রামীরা জানত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত লৈন্যবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে পেরে ওঠার
আশা নেই। সুতরাং তারা এমন আবস্থা তৈরি করল,
জমিদার অথবা অবস্থাপন্ন পরিবারে অথবা সরকারি কর্মচারীদের কাছথেকে সেনা বাহিনী
খাওয়ার সংগ্রহ করতে না পারে। তাহলেই খাদ্যের অভাবেই সরকরি
বাহিনীকে পালাতে হবে। ফলে তারা সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্ক করে
দেয় যাতে সেনী বাহিনীকে কেউ খাবার দিয়ে সাহায্য না করে। স্বাধীণতা সংগ্রামীরা একে রাণী শিরোমণির নির্দেশ রূপে প্রচার করে। ফলে বহু সেনা বাহিনীকে খাদ্যের অভাবে শহরে ফিরে আসতে হয়েছে।
প্রাইস
চোয়াড়দের শৃঙ্খলবোধের কথাও শ্রদ্ধায় উল্লেখ করেছেন। আনন্দপুর গ্রাম আক্রমণকালে সর্দার মোহনলালের অপরিসীম নীতিবোধ আর নিজেদের
সেনার ওপর প্রভাব দুটিরই উদাহরণ দিয়েছেন প্রাইস। এমতঅবস্থায় প্রচুর অত্যাচারিত প্রজাও এই বিদ্রেহে স্বইচ্ছায় যোগদানও করে
সে সংবাদও কালেক্টরের লেখা থেকে পাওয়া যায়। বোর্ অব
রেভিনিউকে লেখা চিঠিতে তিনি বলছেন, সমগ্র
মেদিনীপুর জেলাটি জনমানবহীন আর ধংসস্তুপে পরিণত হয়েছে।।। সংক্ষেপে বলাযায়, জঙ্গল অঞ্চলের সব জমিদারও চোয়াড়দের সঙ্গে মিলেছে। শাসকদের
সন্দেহ হয় জমিদারদের সরাসরি সাহায্য না পেলে চোয়াড়রা এতটা প্রাবল্যে আক্রমণ করতে
পারত না। রানি শিরোমণি সেই স্বাধীণতা সংগ্রামের
গোপন পরামর্শদাত্রী ছিলেন, তারা সন্দেহবশে রানী শিরোমণিসহ অনেক জমিদারকে অন্তরীণ
করে রাখে। কিন্তু কর্ণগড় অধিকার করার সঙ্গে
সঙ্গে সব সৈন্যও দুর্গত্যাগ করে পালাতে থাকে। মেদিনীপুরে আরও সৈন্য আসতে শুরু করে, ফলে মেদিনীপুরের ওপর আক্রমণের আশংকা
অনেকটা দূর হয়। কালেক্টর কিছুটা স্বস্তি পেয়ে
গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করতে থাকে। তার
প্রতিশ্রুতি যারা আত্মসমর্পণ করবে তাদের অভিযোগ বিচার করে দেখা হবে।
১৭৯৯এর জুনে
চোয়াড়-পাইকদের সঙ্গে পাশের রাজ্য মারাঠা অধিকৃত ওড়িশার পাইকরা এসে যোগ দেয়। এরপর রায়গড়, বীরভূম, শতপতি, শালবনী পরগণায় নতুন করে খন্ডযুদ্ধ শুরু হয়। বিদ্রেহ দমন করা যাচ্ছেনা দেখে রেভিনিউ বোর্ড ভুল বুঝতে পেরে চোয়াড়দের
বিষয়ে জমিদারদের সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু আক্রমণ আর লুঠ নিরবিচ্ছন্নভাবে
চলতেই থাকে। সেপ্টোম্বরে শিরোমণি গ্রামে সরকার
পক্ষের আটজনকে খুন করে চোয়াড় স্বাধীণতা সংগ্রামীরা। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে মানবাজার লুঠ হয়। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে বীরভূমের নানান অঞ্চলের ধনীদের বাড়ি লাল সিংএর
নেতৃত্ব লুঠ হয়। গ্রামের পর গ্রামে সরকারের
অনুপস্থিতির বহর বাড়তে থাকায় ১৮০০র জানুয়ারিতে পুরাবিত্রা আর আনন্দিনী দুটি
তালুকের চাষীরা খাজনা বন্ধকরে স্বাধীণতা সংগ্রামীদের সঙ্গে যোগ দেয়। ১৮০০র পর প্রাইসের লেখায় স্বাধীণতা সংগ্রামীদের কোনও সংবাদ পাওয়া যায় না, কিন্তু ওম্যালির রচনায়
আমরা পাচ্ছি যে এি স্বাধীণতা সংগ্রামের আগুন কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে দ্বলতে থাকে।
আশংকার ব্যাপার
হল ইংরেজদের আলোচনার প্রস্তাব। রেভিউনিউ
বোর্ডে ঠিক হয় পাইক আর চোয়াড় এবং জমিদারদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করতে হবে। সুপারিশ হল পাইকদের খাজনাহীন জমি ফিরিয়ে দেওয়া হবে। জঙ্গলমহলে সমস্ত শান্তিরক্ষার দায় থাকবে জমিদারদের ওপর। পাইকদের নানান সুযোগসুবিধে দিতে হবে। রাজস্ব বাকি পড়লে জঙ্গলমহলে জমিদারি নীলামে উঠবেনা। মেদিনীপুরের ম্যাজিস্ট্রেট নির্দেশ দিলেন পাইকদের, করদারদের থানার কাজে
নিযুক্ত করা হবে। হাড়ি, বাগহি প্রভৃতি যে সব অনুন্নত
সম্প্রদায়ের মনে ক্ষোভ আছে তাদের তালিকাভুক্ত করতে হবে এবং নিজের সম্প্রদায়ের
সর্দারদের অধীনে রাখতে হবে। এ ছাড়াও
আলাদা পুলিশ বাহিনীও মোতায়েন করা হবে।
প্রাইস বলছেন, অনুচরদের
ওপর চোয়াড় সর্দারদের প্রভাব অসাধারণ। একজন সর্দারের অধীনে
দুই থেকে চারশ চোয়াড় থাকেন। তারা বাসকরে জঙ্গলের গভীরতম অঞ্চলে। এর নাম কেল্লা। ।।এরা কোনও দিনই জমিদার বা ভূস্বামীদের সেবা করেনি,
সর্দারের নির্দেশ এদের কাছে চরমতম নির্দেশ। সেনাবাহিনী দিয়ে জয় করতে না পেরে কৌশলে এদের অনেক ক্ষোভ
প্রশমিত করে এদের স্বাধীণতা সংগ্রাম দমন করা হয়। তবে এই স্বাধীণতা
সংগ্রামের ফলে মেদিনীপুর বা বাঁকুড়ার সীমান্ত নতুন করে সাজানো হল। বাঁকুড়া, মেদিনীপুর আর মানভূম এঞ্চল নায়ে তৈরি হল
জঙ্গলমহল জেলা। এই জঙ্গলহমলই
বাঁকুড়া জেলা। ক্রমশঃ ইংরেজদের
সুকৌশলী শাসনে সর্দাররা নিস্তেজ হয়ে পড়েন এবং বাঙলার অন্যতম প্রধাণ বিদ্রেহ
ক্রমশঃ নির্বাপিত হল।
No comments:
Post a Comment