রামমোহের কলোনাইজেশনতত্বের সমর্থনে কোলেট সুশোভন সরকারকে কলমা পড়িয়ে নেন। সুশোভন সরকার রামমোহনের তাত্বিক অবস্থান বর্ণনায় পার্টির তাত্বিক লাইন অনুসরণ
করেন। মার্ক্স উপনিবেশবাদ, দাসব্যবস্থাকে সমাজের অগ্রসর
কাঠামোর তাত্বিকভূমিকার চামড়া পরিয়েছিলেন। সেই পথ ধরে,
নীল চাষকে অগ্রগতির কৃষিকর্মরূপে বর্ণনা করলেন সুশেভন সরকারমশাই। তিনি দাবি করেন, নীলকরদের অত্যাচার সম্বন্ধে রামমোহনের ধরনা ছিল না। তাই রামমোহন নীলকরদের বিরুদ্ধাচরণ করেন নি। ব্যতিক্রম সুপ্রকাশ রায়। ভারতের কৃষক স্বাধীণতা সংগ্রাম ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, সুশেভন সরকারের পুস্তকটির কয়েক বছর পর (প্রথম প্রকাশ ১৯৬৬) প্রকাশিত হয়। সুপ্রকাশ রায় সরাসরি পার্টি লাইন থেকে বেরিয়ে এসে রামমোহন আর দ্বারকানাথ
সম্বন্ধেই বেশ কড়া ভাষায় সত্যগুলি প্রকাশ করেছেন। সুশোভন সরকারদেরমত বুদ্ধিজীবির কাজের উত্তরে আমাদেরমত তুচ্ছ কলমচির কথা
বলার অধিকারী কীনা তা দুবার ভাবতে হয়, তবুও বলি, তিতুমীর দক্ষিণ বাঙলার বিশাল
অঞ্চলে নীলকরবিরোধী বিশাল গণসংগ্রাম গড়ে তুলেছিল। কলকাতার সংবাদপত্রে সে বিষয়ে নানান প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে। সুশেভন সরকারের দাবি রামমোহন সে সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন না। এ তথ্য প্রমাণকরার দায় ছিল সরকার মশাইএর, যদিও সরকার মশাই আজ সমস্ত
বিতর্কের বাইরে।
আমরা শুধু বলতে চাই বেঙ্গল হরকরাতে রামমোহনের শিষ্য
দ্বারকানাথ নীলকরবিরোধী সংবাদের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন অপপ্রচার অভিধা দিয়ে। ভারতে কলোনাইজেশন আন্দোলনের শেকড় গড়েতে টাউন হলে সভাও করেছেন। যে ব্যক্তি, সংঘ নীলকর, কলোনাইজেশন বিরোধী, তাকেই দ্বারকানাথ দেশ বিরোধী
দেগেদিয়েছেন। কলোনাইজেশনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল
নীলকরদের ভারতে জমিকেনার আইনের দাবি। রামমোহন
নীলকরদের অন্যতম চারণভূমি রংপুরে চাকরি করেছেন। এই দুই প্রখ্যাত বাঙালি জমিদার ছিলেন। দুজনের জমিদারিতেই নীলকরদের রমরমা ছিল। এঁরা দুজন নীলকরদের অত্যাচার বিষয়টি অস্বীকার করতেই পারেন। সেটি তাদের দৃষ্টিভঙ্গী। কিন্তু নীলকরদের
অত্যাচার সম্বন্ধে রামমোহন অজ্ঞ ছিলেন বলাটা কষ্টকল্পিত হয়ে যায় না কী!
ফ্রান্সিস বুকানন ১৮০৮ সালেই নীলকরদের অত্যাচার সম্বন্ধে
বলেছেন। ১৮১০ সালেই গভর্নর-জেনারেল মিন্টো
জানান ইওরোপিয় নীলকরদের বিরুদ্ধে নানান ধরনের অত্যাচারের অভিযোগ জমা পড়ছে। সুপ্রিম কোর্টও অত্যাচারের বিরুদ্ধে রায় দিয়ে ৪জন ইওরোপিয়কে লন্ডনে ফেরত
পাঠায়। ১৮২২এর ১৮মে সমাচার দর্পণ নীলকরদের
সামনে রায়তদের অসহায়তার কথা সরাসরি জানাচ্ছে। এমনকী ১৮২৩এর ১০ অক্টোবর কলকাতায় আসা বিশপ হেব্বার ১৮২৫এর মার্চে লিখছেন, নীলকরদের
অত্যাচারে দেশিয়দের চোখে ইওরোপিয়দের চরিত্রে কলঙ্ক লাগছে। ভারত সভ্যতার কুচ্ছাগাওয়া ব্যাবিঙ্কটন মেকলেও অত্যাচারী নীলকরদেশওয়ালিভাইদের
বিরুদ্ধে কঠোরভাবে কলম ধরেছেন। এতসব অত্যাচারের
বর্ণনা জনসমক্ষেই প্রচারিত হয়েছে। তবুও রামমোহনের
পাশে দাঁড়িয়ে সুশোভন সরকারকে রামমোহনের অজ্ঞতা আর নীলচাষের প্রগতিশীলতা প্রমাণ
করতে হয়। বলতে হয় এই চাষে বাঙলা উন্নতির শিখরে
গিয়েছে।
রামমোহন স্বয়ং মনেকরতেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত রায়তদের
উপকারে লেগেছে। সিলেক্ট কমিটির সামনে দাঁড়িয়ে তিনি
এই দাবি পেশ করেন। তিনি নিজে এই ব্যবস্থাজাত মানুষ। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত তাকে জমিদারি দিয়েছে, দেওয়ানির চাকরি করে
অন্যান্যদেরমত অমিত অর্থ রোজগার করার সুযোগ দিয়েছে। নিজে ১৮৩৩এর কলোনাইজেশন সনদের অন্যতম তাত্বিক। আদর করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রাক্তণ দাস ব্যবসায়ীদের আহ্বান জানিয়েছেন বাঙলার
রায়তদের জীবন আরও দুর্বিসহ করে তুলতে। তাতে লুঠের
দরজা আরও বেশি হাট হয়। বাঙলা লুঠের অন্যতম অনুঘটক রামমোহন। সেই লুঠধংসকান্ডের বিরুদ্ধে সুশোভন সরকারেরমত মানুষ, স্বাধীণতার পরেও
দাঁড়াতে পারেননা। তিনিও শেষ পর্যন্ত রামমোহন-দ্বারকানাথেরমতই
সাম্রাজ্যের বন্ধু থেকে যান। আজ পর্যন্ত এই
দুইজন মানুষের বাঙলার সংস্কৃতিতে এতই পকড় যে এঁদের কাজ সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ
করা বাঙলার অন্যতম নিষিদ্ধকাজ। রামমোহনের
স্মৃতিতে দক্ষিণ কলকাতায় একটি উচ্চশ্রেণীর বিদ্যালয় রমরমকরে চলছে। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশ করেছে দ্বারকানাথের উত্তরসূরী,
ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনায় এই মানুষটির জীবনীগ্রন্থ। তার সেই পুস্তকের বিশদ পাওয়া যাবে দ্বারকানাথ পর্বে। আজও বামপন্থী, মধ্যপন্থী, দক্ষিণপন্থী সব ঐতিহাসিকই রামমোহন-দ্বারকানাথের
নামের অকলঙ্কে দারুন বিশ্বাসী।
আলালদের গুরুঠাকুরদের কমিউনিস্ট দলের সমর্থন
রামমোহন রায়এর সমর্থনে নামার সুশোভন সরকারের বাধ্যবাধকতা
বোঝা যায় প্রকাশ তারিখহীন, কমিউনিস্ট পার্টির মুম্বাই শাখা, বহুকালপূর্বে তাঁরই
ছদ্মনাম, অমিত সেনের নোটস অন বেঙ্গল
রেনেসাঁ শীর্ষক ৭৭পাতার একটি পুস্তিকা প্রকাশ থেকে। সেই পুস্তকে পি(পুরণ) সি(চাঁদ) জোশীর একটি ভূমিকা লেখেন। কোনও মন্তব্য ছাড়াই এই মুখপাত তুলে দেওয়া গেল-
This short pamphlet gives no more than the broad frame-work
for a study of the Bengal Renaissance from Rammohan Roy to Rabmdranath Tagore। The author himself an eminent Marxist intellectual- did not desire its
publication at this stage as it is in no sense a detailed study nor is the
frame-work indicated here necessarily final or complete।
He has
agreed to its publication for discussion because at the present crisis in
Indian life and thought, it is urgently necessary to uncover the roots of the
Bengal Renaissance which moulded the modern Indian mind much of that heritage
has been lost and forgotten। Much of it
has been repudiated and distorted। But it
still remains the most powerful influence in moulding current ideas of all
schools of social and political thought।
We are
therefore publishing this pamphlet as a contribution towards the efforts to
bring about a correct and common understanding of the ideas of our own past
ideological heritage so that we may successfully struggle towards new ideas
that will help to liberate our land and build a new life for our people।
Comments and
criticism of this draft will be very welcome and should be addressed to Amit
Sen c|o the Communist Party Headquarters, Raj Bhuvan, Sandhurst Road, Bombay 4। All contributions, together with the author's reply, will be printed
in the Marxist Miscellany which is brought out by the People's Publishing House।
P. C. JOSHI.
পুস্তকের সূচীপত্রটিও এখানে প্রয়োজন বোধে তুলে দেওয়া গেল। এই সূচীপত্রপাঠে বোঝা যাবে কোন কোন রেনেসাঁজাত ব্যক্তি, ঘটনা অথবা সংস্থা এই পুস্তকে ঠাঁই পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন-
Ram Mohan Roy 1772-1833 3
The Associates of Ram Mohan Roy 11
Conservative Critics of Ram Mohan Roy 13
The Rise of New Radicalism 15
1833-1857
The Derozians 17
Moderate Reformers 22
Iswar Chandra Vidyasagar 1820-1891 25
British Indian Association 1851 27
1857-1885
After the Mutiny 30
Creative Literature and Learning 32
Religious Reform and Revivalism 37
National Consciousness 41
1885-1905
National Conference and National Congress 47
Literature and Culture 53
1905-1919
Partition of Bengal 56
Extremism and Terrorism 59
Literature and Culture 64
বাঙলার রেনেসাঁর সময়কে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি পাঁচভাগে ভাগ করে,
1। 1814-1833 The easiest starting point is, of course, the date 1814, when Rammohan Roy settled down in Calcutta and took up seriously his life's work। His death in England in 1833, obviously ends the period of which he was, indisputably, the central figure।
2। 1833-1857 From the death of Rammohan to the outbreak of the Indian Mutiny।
3। 1857-1885 From the Mutiny to the foundation of the Indian National Congress।
4। 1885-1905 From the commencement of the Congress to the Partition of Bengal
5। 1905-1919 From the Partition and the great Swadeshi agitation to the coming of Non-Co-operation and the leadeiship of Mahatma Gandhi।
এই পুস্তকের প্রথম প্রবন্ধ, রামমোহন রায়। প্রথম প্রবন্ধেরই প্রথম স্তবকে লেখা রয়েছে The central characteristics in the life and thought of Rammohan Roy were his keen consciousness of the stagnant, degraded and corrupt state into which our society had fallen, his deep love of the people which sought their all-round regeneration, his critical appreciation of the value of modern Western culture and the ancient wisdom of the East alike, and his untiring many-sided efforts in fighting for improving the conditions around him। No contemporary ever approached him in the quantity and the quality of achievement or the range of activity। His writings themselves are the best proof of the life-giving spirit of new thought। Recent detractors of his deserved reputation have merely revealed their own failure to grasp the significance of the renaissance in our country।পাদ্রিরা, কোম্পানির চাকুরেরা ভারতের প্রতিমা আঁকার কাজ করছিলেন যে ভাষায়, স্বাধীণ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিও ঠিক সেই পথে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে একহাতে মদ আর অন্যহাতে বাইবেল ধরে বেশ্যাসক্ত সমাজধর্মসংস্কারে উদ্যমী এবং ব্রিটিশ রাজপুরুষদ্বারা পালিত, সাম্রাজ্যের সবথেকে বড় বন্ধু নবজারণের কর্ণধারদের ভাষায় কথা বললেন। রামমোহন অথবা দ্বারকানাথের সম্বন্ধে ভারতীয় বামপন্থীরা আগামীদিনে কি বলবেন, কী লিখবেন, তার নাট্যরূপ তৈরি হয়েগিয়েছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মুক্তপুরুষ পুরণ চাঁদ যোশীর আমলেই। এরপর থেকেই বামপন্থীদের বৌদ্ধিক-সামাজিক নিরাপত্তা পেয়ে এসেছেন এই দুই মহাতেজ। সাধারণভাবে বামপন্থী ভারতীয় লেখক, ঐতিহাসিকেরা পার্টির তৈরি ছকের বাইরে বেরোতে চান না। রেনেসাঁ সম্বন্ধে যদি কোনও বেয়াড়া পার্টি লাইন বিরোধী তত্ব-তথ্য প্রকাশ করতে হয়, তাহলে মার্ক্সীয় ছকে, কেটে দেওয়া লক্ষ্মণের গন্ডীর ভেতর থেকেই চিনির সিরা মাখিয়ে যতটা সম্ভব রেখে ঢেকে প্রকাশ করা যায় করেন। আশ্চর্যের কথা এই কমিউনিস্ট পার্টির এই বইতে বাঙলার জনজাগরণের সংগ্রাম সম্বন্ধে কোনও মন্তব্য নেই। কেন! যদিও ততটা বিখ্যাত নন এক বামপন্থী সুপ্রকাশ রায়, পার্টি লাইনের বাইরে বেরিয়ে সেই অধরা মহাকাব্য রচনা করেছেন। এবং এই বইটি প্রকাশ হওয়ার পরে। কেন! তিনিই একমাত্র ব্যতিক্রম। এতগুলো কেনর উত্তর কী কেউ চেয়েছেন! বাঙলার রায়তদের হয়ে কলাবতী মুদ্রা সেই উত্তর আজ চাইছে। খুব বেয়াদপি হল কী!
No comments:
Post a Comment