সত্যের অনুসন্ধান করে, যদি দ্বারকানাথ দোষী হয়েন, তাঁহাকে দোষী বল তাহাতে
কাহারও কোনও রূপ আপত্তি হইতে পারে না। কিন্তু আজ হইতে বঙ্গবাসী ভ্রাতৃগণ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হও যে – যে সকল মহাপুরুষ তোমাদের মুখোজ্জ্বল করিয়াছেন, যাঁহাদের জন্য তোমরা রাজার
জাতির নিকট প্রতিষ্ঠালাভ করিয়াছ, স্বদেশ গৌরবমন্ডিত হইয়াছে, বিনা অনুসন্ধানে, বিনা
বিচারে তাঁহাদের নামে অপবাদ রটাইয়া দুর্ণাম ঘোষণা করিয়া নিজেদের সঙ্গে কলঙ্ক লেপন
করিও না, আত্মহত্যায় প্রবৃত্ত হইও না - ক্ষিতীন্দ্রনাথ
ঠাকুর দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনী।
রামমোহন রায়ের পৌত্তলিক শিষ্য দ্বারকানাথ ঠাকুরের সাম্রাজ্যবন্ধুত্ব
সর্বজনবিদিত। ভারতের সর্বপ্রথম শিল্পদ্যোগীরূপে
তাঁর পরিচয় দিতে বাঙালিরাতো শ্লাঘা বোধ করেই। সর্বভারতীয়স্তরেও সেই তথ্য নতুন নয়। ১৮১২তে পূর্বজ রামলোচনের
থেকে উত্তরাধিকার বুঝে নিচ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গে
দ্বারকানাথ জমিদারির আইনগত নানান দিক বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। উদ্দেশ্য শুধু নিজের জমিদারিই নয়, অন্য জমিদারদের থেকে আয়ের ব্যবস্থা তৈরি করা। ১৮১৫ বাঙলার জমিদারির ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ বছর। কর্নওয়ালিসের দাওয়াই হিসেবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলার জমিদারদের পথ চলা
শুরু হয়। ১৮১২তে, বাঙলার প্রায় অর্ধেক জমিদারি
নিলামে ওঠে। যশোরে, ১৭৯৩তে ১২২টি জমিদারি ছিল। ১৮০০তে যশোরে ৫,০৪৪টি ছোট জমিদারি তৈরি হয়েছে। রানী ভবানীর জমিদারির খন্ডীকরণে কলকাতার প্রখ্যাতরা তাদের জমিদারির শখ মেটান। সেই সব প্রখ্যাতদের মধ্যে দর্পনারায়ণ ঠাকুর আর গোপিমোহন ঠাকুর অন্যতম। ঠাকুরবাড়ির যে সব প্রখ্যাতরা জমিদারিত্বকে ব্যবসাররূপ দিয়েছিলেন
তাদেরমধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। ১৮৩০ নাগাদ দ্বারকানাথ ঠাকুর কলকাতার জমিদারি সমাজে, সাহেবদের ব্যবসা মহলে
গুরুত্বপূর্ণ নাম।
দুই প্রখ্যাততম উত্তরপুরুষ দেবেন্দ্রনাথ আর
রবীন্দ্রনাথের কাছে সরাসরি প্রত্যাখ্যাত হয়েও বাঙলার অন্যতম প্রধাণপুরুষ
দ্বারকানাথ। রবীন্দ্রনাথ এবং কিছুটা দেবেন্দ্রনাথ তাঁর
সম্বন্ধে হিরন্ময় নীরবতা অবলম্বন করে প্রায় তার কর্মউদ্যমবিরোধিতা করেছেন। দেবেন্দ্রনাথ পুড়িয়েদিয়েছেন তাঁর ব্যবসা সংক্রান্ত নানান নথিপত্র। এই দুই বাঙালি যাকে আস্তাঁকুড়েয় ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে, সেই রাজার জাতির
নিকট প্রতিষ্ঠালাভ করা উদ্যমী তিনি এই নতুন সহস্রাব্দেও নাকউঁচু মধ্যউচ্চবিত্ত
বাঙালির অন্যতম প্রধাণপুরুষ, এমন সৌভাগ্য শুধু দ্বারকানাথ ঠাকুর ছাড়া বোধহয় অন্য
কোনও প্রখ্যাত বাঙালির জীবনে দেখা মেলা ভার।
দ্বারকানাথ যে উদ্যমী পুরুষ ছিলেন তা আজ নানান লেখায়
প্রমাণিত, তথ্যভারে ভারাক্রান্ত। সমকালীন
অনেকগুলি ব্যর্থতায় শিক্ষা নিয়ে একচক্ষু হরিণেরমত চাকরি ও ব্যবসায় ইংরেজ কোম্পানির
নানান আমলার ব্যবসায় সংক্রান্ত তথ্যসম্ভার সংশ্লেষ ঘটিয়েছিলেন অমিত দক্ষতায়। একা হাতে গড়ে তুলেছিলেন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির একটি একটি করে
ভিত্তিপ্রস্তর। আজকের কর্পোরেট প্রভুদেরমত ব্যবসার
মুনাফা লাভে, কোনও বাধাকেই তিনি বাধা বলে মনে করতেন না। বাগনাপাড়া গোস্বামীদের অনুগামী জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির নিরামিষভোজী কর্তা
ছিলেন দ্বারকানাথ। তিনি একটু একটু করে মদ্যপান করতে আর নিষিদ্ধ মাংস খেতে শিখলেন
গুরু রামমোহনের হাত ধরে। এই অভ্যেস তাকে ইংরেজ সংসর্গ, চাকরি
আর ব্যবসাকর্মে অনেকটা এগিয়ে দেয়। নুন থেকে নীল,
আফিম থেকে রাম, কয়লা থেকে জাহাজ, বিনিয়োগ থেকে বেশ্যাখানা, যে কোনও ব্যবসায় তাঁর
উত্সাহ আজকেও বিষ্ময়কর। জমিদারি থেকে আফিম ব্যবসা, নীল
উত্পাদন আর ব্যবসা থেকে রাম আর চিনি তৈরি, জাহাজের মালিকানা সবকিছুতেই তার সাফল্য
মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ারমতই।
আমরা যেন মনে রাখি, তিনি এই খ্যাতি, সম্পদ, জমিদারির
অংশিদার হয়েছেন তারই প্রজাদের শোষণ করে। জমিদারি গড়ে
তুলেছেন ঘুষের অর্থে, কলোনাইজেশন তত্ব সমর্থন করেছেন নীল আর জমিদারির ব্যবসা
বাঁচাতে, কাজ হারানো দাসব্যবসায়ীদের ভারতে জমি কেনার আইন তৈরি করতে গুরু রামমোহনের
সঙ্গে জোরদার আন্দোলন করেছেন, জাহাজে কোম্পানির আফিম পৌঁছেদিয়েছিন চিনে, মালঙ্গী আর
জমিদারির প্রজাদের সঙ্গে নানান বিষয়ে বিবাদে জড়িয়েছেন, স্ত্রী বিবাহ বিচ্ছেদ চেয়ে
না পেয়ে আলাদা থেকেছেন, ১৪৩টাকা ভাড়ায় বৌবাজারে ৪৩টা ঘরের বেশ্যাখানা(সময়ের
তুলনায় বেশ বেশি) চলিয়েছেন পরিবারের কোনও সদস্যকে দিয়ে (বলাহয়েছে দ্বারকানাথের
পরিবার এই টাকাটা পেতেন) এসব নানান অস্বস্তিকর তথ্য আজও তার জীবনীকারেরা
উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে উহ্যরেখে যান। এই প্রশ্নেগুলোর
কয়েকটি বাঙলার সাধারণ রায়তদের দিন আনি দিনখাইএর ইস্যুর সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে রয়েছে। সেই উদ্দেশ্যে এই রচনাটি উত্সর্গীকৃত।
No comments:
Post a Comment