ইতিহাস সাক্ষী, কয়েকশ বছর আগেই মগেরমুল্লুক, সুন্দরবন হার্মাদদের অত্যাচার
এবং প্রবল সুনামির ধাক্কায় জনশূণ্য এলাকায় পরিণত হয়। ইংরেজ আমলের শুরু থেকেই অগম্য সুন্দরবন আবাদের চেষ্টা হয়। জমিদারেরা বনের বিভিন্ন এলাকা ইজারা নিতেন, ত্রশ পঁয়ত্রিশ বছরের জন্য। প্রত্যে জমিদারই চাইতেন তাঁর এলাকার সীমান্ত আরও একটু বেশি বাড়ুক। সীমানা নিয়ে জমিদারদের মধ্যে ঘোরতর ঝগড়া আরম্ভ হল। ১৮২৮এর সীমানা আইনে প্রত্যেক জমিদারের জমিদারির এলাকা ঠিক করে দেওয়া হল। সেই আইন অনুসারে সুন্দরবন বিভিন্ন লটে বিভক্ত করে সেই লট বিভিন্ন জমিদারকে
দেওয়ার কাজ শুরু হয়।
১৮৪৮তে মাসেস মরেল সুন্দরবনের কিছু এলাকা তাঁর ছেলেদের
জন্য ইজারা নেন। ছেলেরা বছর দশেকের মধ্যে ৬৫হাজার
বিঘা বন হাসিল করে, সেই এলাকা চাষের জন্য প্রস্তুত করে ফেলে। ফলে জমিরদাম বেড়েচলে আকাশমুখী, এই জমিদারির জাম দাঁড়াল ১০ লক্ষ টাকা। সতীশ চন্দ্র মিত্রর, যশোর খুলনার ইতিহাসএ পাই এই জমিদারেরা বাজার হাট
দেকান বসিয়ে নদিতীরা একটি গঞ্জ তৈরি করতে সক্ষম হল, যার নাম মরেলগঞ্জ। এই প্রাক্তণ জঙ্গলময় এলাকায় ইংরেজ জমিদারভাইদের কথাই আইন। বাইরের কোনও আইনই তারা গ্রাহ্য
করে না।
স্বেচ্ছাচারী জমিদারদের কর্মচারীরাও যে আরও দুর্বীনীত আর
স্বেচ্ছাচারী হবে এ কথা নতুন করে বলার দরকার পড়ে না। এই জমিদারদের মধ্যে একটি জমিদারির ম্যানেজার ডেনিস হিলির অত্যাচারের
মাত্রা স্বাভাবিকতা ছাড়িয়ে যায়। তার
পীড়নব্যবস্থা কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। প্রত্যেকটি জমিদারির মধ্যে সংযোগ ছিল না, ফলে জমিদারিগুলির মধ্যে চাষী
ঐক্য খুবএকটা গড়ে না উঠলেও, বাবুইখালি এলাকায় কৃষকেরা এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে
পুখে দাঁড়ান।
বারুইখালি গ্রামের মোড়ল ছিলেন রহিমউল্লা। তিনিই গ্রামবাসীদের একমাত্র স্বান্ত্বনা। গ্রামবাসীরাও রহিমউল্লাকে প্রাণদিয়ে ভালবাসতেন। হেলির লাঠিয়ালরা গ্রামের পর গ্রাম সন্ত্রস চালাতে চালতে একদিন রহিমউল্লা
প্রতিবাদ জানান। যেখানেই হিলির লাঠেয়ালরা সমবেতহয়ে
গ্রামের মানুষদের ওপর অত্যাকার করছে, সেখানেই রহিমউল্লা গিয়ে বুক পেতে দাঁড়াতেন। রহিমউল্লা নিজে একজন জাঁদরেল লাঠিয়াল। তাঁর লাঠির প্রতাপে জমিদারদের লাঠিয়ালগুলি খুবএকটা সুবিধা করতে পারছিল না। হেলির সাঙ্গপাঙ্গরা রহিমউল্লাকে সাজাদেওয়ার ফন্দিফিকির খুঁজতে থাকে।
১৮৬১এর সুন্দরবনের বাঘ পালানো এক শীতে পত্তনিদার গুণী
মামুদ তালুকদারের সঙ্গে রহিমউল্লার জমির সীমানা নিয়ে বিবাদ বাধে। তালুকদার, মরেল জমিদারদের কাছ থেকে পত্তনি নিয়ে তালুক পত্তনি করেছিলেন। তিনি ছোট জমিদার। ফলে তার কথাই আইন। রহিমউল্লার সঙ্গে জমির বিবাদ মেটাতে জমিদারের সাঙ্গপাঙ্গরা এসে হেলির
নেতৃত্বে তালুকদারের পক্ষে রায়দেয়। রহিমউল্লা,
হেলির এই এক পোশে রায় মেনে নেয়নি, হেলি আর তার লোকজনকে অপমান করে চলে যেতে বলে।
যা ঘটার তা ঘটতে বাধ্য। কয়েকদিনের মধ্যে হেলির একদন লাঠিয়াল এসে রহিমের ওপর চড়াও হয়। দুই দলে প্রচন্ড সংঘর্য হয়। হেলির লাঠিয়াল
প্রধান রামধন মালো নিহত হয়। হেলির
লাঠিয়ালরা পশ্চাদাপসরণ করে। পরেরেদিন হেলি
নিজে এসে রহমতের ওপর চড়াও হয় একদল লাঠিয়াল আর বন্দুক বাহিনী নিয়ে। বিশাল সংখ্যক ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর সঙ্গে রহিম আর তার সঙ্গীসাথীরা সারারাত
লড়াই চালালেন। রহিমদেরও একটি বন্দুক ছিল। একটি ভিজে কাঁথার পেছন থেরে রহিম সারা রাত বন্দুক বাহিনীর সঙ্গে লড়াই
চালালেন। রহিমের সঙ্গীরা একে একে ভূমিশয্যা
নিলেন। পরেরদিন সকালে গুলি ফুরিয়ে গেলে
বাড়ির মেয়েদের রূপের গয়নাগুলে ভেঙে বন্দুকের ভেতরে পুরে গুলি চালান রহিম। শেষে রহিম রামদা হাতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন হেলির বাহিনীর ওপর। হেলির হাবিনীর গুলিতে রহিমের মৃত্যু হল। এই যুদ্ধে সতেরজন নিহত হয়, আহত অনেক বেশি। সতীশচন্দ্র বলেছেন হতাহতের সংখ্যা অধিকাংশ সাহেবের পক্ষের।
মৃতদেহগুলো জঙ্গলে পুড়িয়ে দেওয়া হল। যুদ্ধের দিন থেকেই গ্রামের পুরুষেরা পালিয়ে ছিলেন। মহিলাদের ওপর জমিদার বাহিনী অকথ্য অত্যাচার করতে শুরু করেন। শবগুলি জঙ্গলে লইয়াগিয়া পুড়াইয়া
দেওয়া হয়। পূর্বদিন হইতে গ্রামের লোক অনেক
পলাইয়াছিল, যাহা বাকী ছিল, সাহেবের লোকেরা পরেরদিন তাহাদের ঘরবাড়ী লুট করে, ঘর
জ্বালাইয়া দেয়, এমনকী স্ত্রীলোকেদের ধরিয়া লইয়া গিয়া অত্যাচার করিতেও ছাড়ে নাই। এই পাপে সাহেবদের সর্বনাশ হয়।
এই ঘটনার একটি সাহিত্যক পরিসমাপ্তি ঘটে। সমাপ্তির ঘটনাটি শতীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বঙ্কিম-জীবনী থেকে গৃহীত। বারুইখালি ঘটনার সময় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় খুলনার
ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। রহিমের খুনের দিন
তিনি ফকিরহাটে ছিলেন। দুদিন পর তিনি এই
মর্মন্তুদ ঘটনার সংবাদ পান এবং যশোর থানার পঞ্চাশ পুলিশ পাঠানোর নির্দেশ দিয়ে নিজে
মরেলগঞ্জের দিকে রওনা হয়ে যান। সেপাই আসার সংবাদ পেয়ে মরেলসমেত হেলি পালায়। যাদের পেলেন বঙ্কিম তাদের খুলনা সদরে চালান করলেন। মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিম, এক বিশদ রিপের্ট জেলা
ম্যাজিস্ট্রেটের দপ্তরে পাঠান। হেলি আর অন্যান্যদের গ্রেফতারি পরোয়ানা আর ধরে দেওয়ার
জন্য পুরস্কারের ইনাম জারি হল। বৃন্দাবন থেকে জমিদারির কাছারির এক নামভাঁড়ানো
কর্মচারীকেও গ্রেফতার করা হয়। এই ঘটনা চেপে যাওয়ার জন্য বঙ্কিমকে এক লক্ষ চাকা ঘুষ
দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়, নইলে প্রাণনাশেরও হুমকি দেওয়া হতে থাকে।দায়রার বিচারে জমিদার পক্ষের একজনের ফাঁসি চৌত্রিশজন
যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত হয়। হেলিকে কেউ সনাক্ত করতে না পারলে তার মুক্তি ঘটে,
কিন্তু কয়েক বছর পর বজ্রাঘাতে তার মৃত্যু হয়।
No comments:
Post a Comment