...শুনিয়াছি যে, তিনি বিলাত যাইবার কয়েক বত্সর পূর্ব পর্যন্ত্য মদ্যপান করা
দূরে থাক, তাহা স্পর্শও করিতেন না। তিনি মাংসাদিও
অধিক আহার করিতেন না। ক্রমে যখন
তাঁহার ব্যবসায়ের বিস্তৃতির সঙ্গে বিস্তর সম্ভ্রান্ত ইংরাজ পুরুষ ও মহিলাদিগের
সহিত আলাপ পরিচয় হইল, তখন বাধ্য হইয়া তাঁহাদের খাতির রাখিবার জন্য অল্প অল্প
মদ্যপান আরম্ভ করিয়াছিলেন। ক্রমে সাহেবী
খানাতেও যোগ দিতেন। ইহার যথার্থ্য
সম্বন্ধে ইঁহার সহধর্ম্মীণীর কার্য্যকলাপ যথেষ্ট সাক্ষ্য দিবে। যথন হইতে দ্বারকানাথ সাহেবদিগের সহিত খানায় যোগ দিলেন এবং মদ্যপান করিলেন
সেই দিন হইতে তাঁহার পত্নী নিজ সম্বন্ধে কার্য্যত বিচ্ছিন্ন করিয়া দিয়াছিলেন। ...আসল কথা এই যে, হয়তো কোন ইংরাজ মহিলা আসিয়া well
Dwarakanath বলিয়া হাতে একটা বিস্কুট গুঁজিয়া দিলেন, তখন তো আর তিনি
ফেলিয়া দিয়া তাহার অপমান করিতে পারেন না - ক্ষিতীন্দ্রনাথ
ঠাকুর দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনী
তো, দ্বারকানাথ ঠাকুরের ছয় সন্তানের মধ্যে বাঁচলেন চার পুত্র
সন্তান, দেবেন্দ্রনাথ(১৮২৬-১৯০৫), গিরীন্দ্রনাথ(১৮২০-৫৪), ভূপেন্দ্রনাথ(১৮২৬-৩৯)
এবং নগেন্দ্রনাথ(১৮২৯-৫৮)। দ্বারকানাথের সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির নানান আত্মীয় মহিলাদের সম্পর্ক খুব মধুর ছিল না। সে মা অথবা স্ত্রী অথবা অন্য আত্মীয়ই হোক। দ্বারকানাথের
মা অলকানন্দা ধর্মশীলা মহিলা। মৃতবৎসা অলকানন্দা, দ্বারকানাথকে দত্তক নিয়েছিলেন। পুত্রের ইংরেজসঙ্গ অলকাসুন্দরী যেমন নাপছন্দ ছিল, চাকরি, ব্যবসায় বাড়বাড়ন্তের জন্য বাধাও
দিতে পারেননি। তবে গোমাংসে কঠোর না ছিল। দ্বারকানাথের স্ত্রী দিগম্বরী দেবী নানান বিষয়ে শ্বাশুড়ি র থেকেও কঠোর। গৃহদেবতা লক্ষ্মীনারায়ণের
নিয়মিত সেবা করতেন। ঠাকুরবাড়িতে ইংরেজরা আসা যাওয়া করলেও দিগম্বরী ঘনিষ্ঠ হননি। দিগম্বরীর সম্বন্ধে ক্ষিতীন্দ্রনাথ বলছেন,
...দিগম্বরী দেবী যশেহরান্তর্গত নরেন্দ্রপুর গ্রামে
পীরালি বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পিতার
নাম রামতনু রায় এবং মাতার নাম আনন্দময়ী। আনুমানিক ১৮০৯ খ্রীষ্টাব্দে দ্বারকানাথের সঙ্গে তাঁহার বিবাহ নিষ্পন্ন হয়। সুতরাং দ্বারকানাথের বয়স ১৫ বত্সর। শুনিয়াছি যে দিগম্বরী দেবীর ৬ বত্সর বয়সে বিবাহ হইয়াছিল। ...দিগম্বরীদেবীকে লোকে লক্ষ্মীর অবতার বলিত। তাঁহার হাতের আঙুল চাঁপার কলিরমত ছিল। তাহার কেশদাম কোঁকড়া ছিল। প্রতিমার
পদযুগল যেরূপ সচরাচর গঠিত হয়, তাঁহারও পদযুগল সেইরূপ ছিল। তিনি নাতিহ্রস্ব নাতিদীর্ঘ এবং শরীরে দোহারা ছিলেন। আমাদের গোষ্ঠীতে প্রবাদ আছে যে আমাদের বাটীতে যে জগদ্ধাত্রী মূর্তি গঠিত
হইত, তাহার মুখটি নাকি দিগম্বরী দেবীর মুখের আদর্শে গঠিত হইত। সেখানের বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা যাঁহাকেই তাঁহার রূপের কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছি,
তাঁহাদের সকলেই একবাক্যে বলিয়াছেন যে, তাঁহার রূপের কী বর্ণনা করিব, সাক্ষাত
জগদ্ধাত্রী ছিলেন। নীলাম্বরী
কাপড় খুবই প্রিয় ছিল। তাঁহার যথেষ্ট
গাম্ভীর্য্য ছিল এবং তিনি খুব রাশভারী লোক ছিলেন।...তাঁহার নীরব শাসনের প্রতাপে গৃহ সুশাসিত ছিল। নীলমণি ঠাকুরের গোষ্ঠীই তখন জোড়াসাঁকোস্থিত ৬ নম্বর ভবনে একত্র বাস
করিতেন। দিগম্বরী দেবী বর্ত্তমান বাটীর
উত্তরপূর্ব্বাঞ্চলের গৃহে থাকিতেন। ...তিনি
প্রত্যুষে চারটার সময় উঠিয়া প্রাতঃকৃত্য এবং স্নান সমাধা করিয়া হরিনাম করিতে
বসিতেন। তাঁহার একটি লক্ষ হরিনামের মালা ছিল। তাহার অর্ধেক অংশ প্রাতে সমাপন করিয়া সামান্য আহার করিতেন – আহারের প্রধান দুগ্ধ ও ফল। পরাণ ঠাকুর তাঁহার পূজার ও রাঁধিবার উপকরণ সংগ্রহ করিয়া দিতেন। তাঁহার পূজা এবং রাঁধাবাড়া হইয়া গেলে দুপুর বেলায় রাসপঞ্চাধ্যায়,
শ্রীমদ্ভাগবত প্রভৃতি বাঙালা গ্রন্থপাঠে সময় অতিবাহিত করিতেন। আবার বৈকালে মুখ হাত ধুইয়া হরিনামের অবশিষ্ট অংশ সম্পাদিত করিয়া ফেলিতেন। দয়া বৈষ্ণবী আসিয়া প্রায়ই গ্রন্থপাঠ করিত। রাত্রে তিনি হরিনাম করিয়া অন্ন আহার করিতেন। একাদশীতে ফলমূল আহার করা তাঁর নিয়মিত অভ্যাস ছিল।
এবং ইংরেজদের সঙ্গে দ্বারকানাথের মাখামাখি
স্ত্রী দিগম্বরীর পছন্দ ছিল না।
...যতদিন দ্বারকানাথ প্রাচীণ ধরণের চালচলনে অভ্যস্ত
ছিলেন ততদিন তাঁহার ওজস্বিতার পরিচয় দিবার অবসর হয় নাই। জোড়াসাঁকো ঠাকুরগোষ্ঠী বৈষ্ণব ছিলেন এবং খড়দহের গোস্বামীদিগের শিষ্য
ছিলেন। পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরগোষ্ঠী শাক্ত
ছিলেন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরগোষ্ঠী পূর্ব্বে
মাংস বা পেঁয়াজ প্রভৃতি কোন প্রকার বৈষ্ণব বিরোধী দ্রব্য স্পর্শ করিতেন না। এই কারণে পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরেরা জোড়াসাঁকোর ঠাকুদিগেকে মেছুয়াবাজারের
গোঁড়া বলিয়া উপহাস করিতেন। ...শুনিয়াছি
যে প্রথম প্রথম যথন দ্বারকানাথ ও রমানাথ, রামমোহন রায়ের কথা মত মাংসাহারে প্রবৃত্ত
হইলেন, তখন উভয়ের শরীর অসুস্থ হইয়া পড়িল এবং উভয়েই বমি করিয়া পরিত্রাণ পাইতেন। ক্রমে যখন অভ্যাস হইয়া পড়িল, তখন বাটীর এক বহিঃপ্রান্তে মাংস রাঁধিবার
বন্দোবস্ত হইল। রামমোহন রায় বড়ই মুসলমানপ্রিয় ছিলেন। তাঁহারই অনুকরণে দ্বারকানাথও মুসলমান বাবুর্চী রাখিয়াছিলেন। ক্রমে দ্বারকানাথের সঙ্গে ইংরাজদিগেরও ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি হওয়াতে প্রকাশ্যেই
তাঁহাদের সঙ্গে বসিয়া আহারাদি করিতেন। রামমোহন রায়ের অনুকরণে তিনিও অতি অল্প পরিমানে সেরি মদ্য পান করিতেন। দ্বারকানাথপত্নী স্বীয় ভ্রাতৃজায়া পুত্রবধু সমবিব্যবহারে বৈঠকখানাবাটীর
একটি ঘরে যাইয়া যখন দেখিতে লাগিলেন যে, বিস্তৃত মধ্যকক্ষে তাঁহার স্বামী
সাহেবদিগের সঙ্গে একত্র পানাহার করিতেছেন তখন অবধি তাহার হৃদয় ভাঙিয়া গেল, কিন্তু
এই সূত্রে তাহার ওজস্বিতা প্রকাশ পাইল(ঐ)।
১৮১৮তে রামমোহন
গোস্বামীদের সঙ্গে ধর্মবিচার করেন। ১৮২৩এ পথ্যপ্রদান
গ্রন্থে বৈষ্ণব ধর্ম সম্বন্ধে বহু বিদ্বেষপূর্ণ কথা লেখেন রামমোহন। এই গুরুত্বপূর্ণ সময়েই রামমোহন মেছুয়ার গোঁড়াদের মাথা দ্বারকানাথকে
গোমাংস ভক্ষণ আর মদ্যপান শেখাচ্ছেন। শিষ্যকে আর তার
পরিবারকে উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে প্রভাবিত করতে! না এটি সম্পূর্ণ অপরিকল্পিত কাকতালিয়কর্ম!
জীবনীগ্রন্থের
সরাসরি ইঙ্গিত দ্বারকানাথ-দিগম্বরী মনোমালিন্য
চলছিল ইংরেজ সংসর্গ নিয়ে। এ নিয়ে হয়ত দুজনের মধ্যে কথা চালাচালিও হয়েছে। দিগম্বরী তাঁর মনেরভাব স্বামীকে জানিয়েছেন। স্ত্রীর মনোভাব ধর্তব্যের মধ্যে আনেননি। দ্বারকানাথ জানতেন কী করেছেন, আর করবেন। তিনি অঙ্ক কষেই ইংরেজদের সঙ্গে মিশছেন। গুরু রামমোহনের পদাঙ্ক অনুসরন করে, চাকরি পাওয়ার আগে থেকেই ব্রিটিশ সংসর্গ
করতে ধার দিতে শুরু করেছেন। বাড়িতে
মদ্যমাংস খাওয়ার সময় থেকেই বেলগাছিয়া ভিলা নিয়ে মেছুয়ার গোঁড়া মহিলাদের
মধ্যে ফিসফাস ছিল। দিগম্বরী বোধ হয় জনরবে বিশ্বাস করতেন
না। শোনাযায় তিনি বেলগাছিযা ভিলায় কী ধরণের
ইল্লুতে কান্ড সরজমিনে দেখতে যান, ক্ষিতীন্দ্রনাথ বলছেন এই ঘটনাটি জোড়াসাঁকোয় ঘটে। দ্বারকানাথ প্রযোজিত বেলেল্লাপনা বাঙলার নারীর শিরদাঁড়ার দাঢ্য নতুন করে
চেনাতে সাহায্য করল। দিগম্বরী নিশ্চিত হলেন স্বামীর ইংরেজ
সংসর্গে। মন বাঁধলেন দ্বারকানাথকে বর্জন করবেন। স্বামী-বিদ্রোহের
পাশে এসে পাশে
দাঁড়ালেন জোড়াসাঁকোর অন্য বধু আর মহিলারা। সে সময় ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের এই
অভূতপূর্ব একটি
পদক্ষেপ, যা সে সময়ের শহুরে মহিলাদের, ঠাকুরবাড়ির ব্যাতিক্রমী মহিলাদের নতুন করে
চেনাতে সাহায্য করবে।
এমন এক সময়ে তাঁরা এই কাজটি করবেন ঠিক করলেন,
সেই সময় নিয়ে
নারীমুক্তি গবেষণায় এমন একটা ধারণা চালু হয়েছে মধ্যবিত্ত মহলে, কলকাতার প্রগতিশীল সমাজে পতি পরম গুরুই
ছিল অন্দরমহলের ধ্যান জ্ঞাণ। মহিলাদের
স্মৃতি কথায় নাকী পরিস্কার তাঁরা স্বামীদের নির্দেশ শুনে চলতে অভ্যস্ত ছিলেন। সে যুগে, ইংরেজদের সঙ্গে একপাতে বসাটাই
ছিল সামাজিক মর্যাদাবোধের প্রতীক, ইংরেজদের সঙ্গে, ইংরেজি শিক্ষার পক্ষে
দাঁড়ানোটাই সামাজিক অগ্রগতির প্রধাণ স্তম্ভরূপে বিবেচিত হত(এবং আজও আরও বেশি বেশি করে)। সত্যেন ঠাকুরসহ
অন্যান্য পরিবারের পুরুষেরা কোন ফ্যাশানে জামা-কাপড় পরিয়ে স্ত্রীকে অন্তঃপুর থেকে
বার করে ইংরেজ মহলে পরিচয় করাচ্ছেন, ইংরেজি সংস্কৃতি বরণ করে নিচ্ছেন, সেইসব
উদ্যমে মধ্যবিত্ত বাঙালি আজও গদগদ। তার কিছু পূর্বেই ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য মহিলাদের নিয়ে দিগম্বরী দেবীর প্রতিবাদীরূপ
আজও বাঙলার নারী আন্দোলনের অন্যতম ভিত রূপে পরিগণিত হয়না। প্রগতিশীল লেখকেরা ঠাকুরবাড়ির এই কান্ডটি নিয়ে খুব বেশি আলোচনাও করেন নি।
বিদ্রোহী দিগম্বরীর নেতৃত্বে ঠাকুর বাড়ির মহিলারা দ্বারকানাথকে
তাঁর বসতবাড়ি থেকেই বহিস্কারের সিদ্ধান্তে অনড়। বিদ্রোহী এই নারী বাঙলার নানান এলাকা থেকে বাঘা বাঘা পণ্ডিতদের ডেকে সভা
বসালেন কলকাতায়। সভায় দিগম্বরী দেবী বিবাহবিচ্ছেদের
বিধান চাইলেন। তাঁর দাবির সামনে মাথা নামিয়ে পণ্ডিতেরা
মহাতেজাকে জানালেন ভারতীয় শাস্ত্রে স্বামীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের বিধান নেই। আলাদা হয়ে থাকার অনুমতি মিলতে পারেমাত্র। ইংরেজদের সঙ্গ করছেন এই অভিযোগে, দ্বারকানাথ আর তার আত্মীয় চন্দ্রমোহন
চট্টোপাধ্যায়কে দিগম্বরীর দেবীর নেতৃত্বে জোড়াসাঁকোর মহিলারা মূল বাড়ি থেকে
আলাদা করে দেন। দুজন অমিততেজ পুরুষ বৈঠকখানাতে থাকতে
শুরু করেন। আন্দাজকরা হয়ত অস্বাভাবিক হবে না, এই
বিদ্রোহে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেক মহিলাই জোড়াসাঁকোয় শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন। তাঁরা কিন্তু গোঁসা করে বাড়ির বাইরে আলাদা থাকেন নি, ঘরেও খিল দিয়ে
আত্মপীড়ণ করেন নি। তাঁরা মূল বাড়িটিতেই বসবাস করে
ইংরেজ সংসর্গে অভিযুক্ত পুরুষদের থেকে আলাদা হয়ে যান।
...দিগম্বরীদেবী ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতগণের নিকটে মতামত চাহিয়া
পাঠাইলেন যে, যদি স্বামী ম্লেচ্ছদিগের সহিত একত্ত পানভোজন করেন, তবে তাঁহার সহিত
একত্র অবস্থান কর্ত্তব্য কি না! তাঁহারা উত্তর দিলেন যে, স্বামীকে ভক্তি ও তাঁহার
সেবা অবশ্য কর্তব্য, তবে তাঁহার সহিত একত্র সহবাস প্রভৃতি কার্য্য অকর্ত্তব্য। এই বিধান অনুসারে দিগম্বরী তাঁহার উপযুক্তমত সেবাকর্ম্ম ব্যতীত আর
সর্বপ্রকার সম্পর্ক ত্যাগ করিলেন। এখম বাহিরের
লোকে তো আর ভিতরের সকল কথা জানিত না। তাহাদের
আত্মীয়া স্ত্রীলেকেরা মা ঠাকুরুণের আসিয়া নিজ নিজ আব্দার জানাইত- কন্যা পিতার, ভগ্নী ভ্রাতার, মাতা পুত্রের, এইরূপে সকলেই আপনার লোকের চাকরী
করাইয়া দিবার জন্য দিগম্বরী দেবীকে অনুরোধ উপরোধ করত। তাঁহাকেও কাজেই দ্বারকানাথের সহিত এই সকল বিষয়ে কথা কহিতে হইত। শুনিতে পাই যে, যতবার তিনি দ্বারকানাথের সহিত কথা কহিতে বাধ্য হইতেন,
ততবারই সাতঘড়া গঙ্গা জলে স্নান করিয়া নিজেকে পরিশুদ্ধ বোধ করিতেন। এ বিষয়ে তাঁহার দিনরাতের বিচার ছিল না(ঐ)।
এবং গ্রীষ্ম-শীতেরও বিচারছিল না। কাজ সেরে রাতে দ্বারকানাথ জোড়াসাঁকো এস্টেটে ফিরে এলে জোড়াসাঁকো
এস্টেটের দৈনন্দিনের পাইপয়সা হিসেবসহ নানান কর্ম বুঝিয়ে দিয়ে, দিগম্বরী
হাড়কাঁপানো শীতের রাতে সাতঘড়া গঙ্গাজলে স্নান করতেন। জোড়াসাঁকোর মহিলাদের অসম্ভব শিরদাঁড়ার জোর অনুভব করে, স্ত্রীর মৃত্যুর
পরে পরেই দ্বারকানাথ স্বউদ্যোগে দেশের মহিলাদের ইংরেজি পদ্ধতিতে শিক্ষাদেওয়ার
উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। তিনি জীবনদিয়ে অনুভব করেছিলেন ইংরেজি
শিক্ষাই দাসত্ব শেখায়। প্যারীচরণ মিত্রের ভাই কিশোরীচাঁদ
মিত্র মেমোয়ার অব দ্বারকানাথ ট্যাগোর পুস্তকে লিখছেন দ্বারকানাথ কলকাতার
আর্চ বিশপকে স্ত্রীশিক্ষার উদ্যোগের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে দেশের মানুষের এ বিষয়ে
উদাসীনতার জন্য খেদ প্রকাশ করেন। স্বামীর সঙ্গে দেখা হলেই সাতঘড়া
গঙ্গা জলে স্নান করতে করতে দিগম্বরীর নিউমোনিয়া হয়। ১৮৩৯এর জানুয়ারিতে দ্বারকানাথের ১৩ বছরের সন্তান ভূপেন্দ্রনাথের মৃত্যুর দু
দিন পর অসামান্য বাঙালি দিগম্বরী দেহত্যাগ করলেন।
ক্ষিতীন্দ্রনাথের লেখায় কিন্তু পাচ্ছি, দিগম্বরী
রক্ষণশীল ছিলেন, মালা জপতেন ইত্যাদি। এমত রক্ষণশীল
দিগম্বরী দেখছেন রামমোহন তাঁর স্বামীকে মদ্য মাংস সেবন করতে বাধ্য করতেন। প্রথম প্রথম দ্বারকানাথের শরীর খারাপ হতে শুরু করে, মদ্য মাংস সেবন করলেই
বমি করতে শুরু করতেন। নিজের উন্নতিতে কোনও বাধাকে, বাধা
বলে আমল দিতেন নয়া। নিজের ভবিষ্যত ভেবে দ্বারকনাথ রামমোহনের অনুগামী হন। রামমোহন মদ্যমাংস প্রবেশ করিয়েছেন এমন এক বাড়িতে, যেখানে পেঁয়াজ পর্যন্ত
প্রবেশ নিযেধ ছিল। সমগ্র পরিবার বাঘনাপাড়ার
গোস্বামীদিগের অনুগামী ছিলেন। বাঙলায়
উপেক্ষিত মহীয়সী নারীটি কিন্তু স্বামীর মাংস ও মদ্য সেবনে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন নি,
পরিবারের প্রধান পুরুষের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনেও প্রতিবাদ করেন নি।
পশ্চিমি সভ্যতা নির্দেশে ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি
মধ্যবিত্ত যে চিহ্ন আর কর্মগুলোকে রক্ষণশীলতাহিসেবে দেগে দিয়েছে, সেগুলো সসম্মানে
পালন করেই স্বামীর ইংরেজদের সঙ্গে মেলামেশায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি এবং জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির মহিলারা যে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন
সে যুগে, তা আজও অকল্পনীয় বললেও অত্যুক্তি হয় না। দ্বারকানাথের, ক্ষিতীন্দ্রনাথের জীবনী মন দিয়ে পড়লে বোঝা যাবে, মদ্য-মাংস
সেবন নয়, দেশভাঙার, লুঠের কারিগরদের সঙ্গে তার স্বামীর একত্রে পানাহার এবং মাখামাথি তিনি আর ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য
মহিলারা ভাল চোখে দেখছেন না। দুই পুরুষকে বহিস্কারেরমত, সঙ্গ ত্যাগকরে আলাদা
থাকারমত বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নিজেরা নিচ্ছেন, মহিলামহলের সমর্থনও পাচ্ছেন, তাদের
স্বামীর, পিতার ঠাঁই, জোড়াসাঁকো জমিদারিতে থেকেই। এই বৈপ্লবিক কর্মটি তিনি সে সময়ের কলকাতার আলালদের বালখিল্যতার মাধ্যেও
মাথাউঁচু রেখে করতে, করাতে পেরেছিলেন তা আজও অপার বিষ্ময়ের।
বাঙলার ঐতিহাসিকেরা দিগম্বরী অথবা ঠাকুরবাড়ির বিপ্লব
মনে রাখেননি। মনেরাখেন নি আধুনিক মহিলা আন্দোলনের
কর্তৃরাও। বেশ্যাপাড়া যাওয়া, মদপানে মাতলামি
করা, বিদ্রোহের নামে ধর্মবিশ্বাসীর বাড়ি গরুর হাড়সহ এঁটো কাঁটা ছোঁড়া, নিজের
ধর্ম-সংস্কৃতিকে অশ্রদ্ধা জানানো, স্বধর্ম পরিত্যাগ করার বাখিল্যতা, জীবনযাপনে ইংরেজ
হয়ে ওঠা চেষ্টারমত আরও অনেক কিছু রেনেসাঁজাত প্রগতিশীল বিদ্রোহের ছাপ্পাঅর্জন
করলেও, আজও গ্রামীণ স্বাধীণতা সংগ্রামের দিগম্বরীর নেতৃত্বে ঠাকুরবাড়ির বিপ্লবী মহিলারা
অচ্ছুত থেকে গিয়েছেন। ভারতের নারী আন্দোলনের পুরোধারা
বিশ্বাস করেন, ভারতে নারীরা ছিলেন অবগুণ্ঠিত, নিপীড়িত, শোষিত। পুরুষের হাতের খেলনা। ব্রিটিশ শাসনই এ
পোড়া বাঙলায় নারীমুক্তি ঘটিয়েছে। দিগম্বরী বাঙলার
নারীদের মুক্তি দেওয়া প্রগতিশীল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধাচরণ করছেন। সে অপরাধ তাঁরা মেনে নেন কি করে!
বর্তমান সময় ভুলে গিয়েছে প্রাচীণ কাল থেকেই বাঙলায়
নারীরা ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে থেকেও সমাজ গড়নে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেছেন। তন্ত্র, গাথাকাব্যে নারীরাই নিয়ন্ত্রক শক্তি, তাঁরাই অবোধ পুরুষদের পথ
দেখান। পুরুষেরা ক্ষমতার কাছাকাছি কিন্তু
কালের পুতুল। ধর্মমঙ্গলে, নাথ সাহিত্যে ডোম মহিলা
চরিত্রগুলোর তুলনা আজও পাওয়া কঠিন। সুলতানি আমলে বহু
নারী নিজস্বতায় দুর্মর। ইংরেজ আমলে ব্রজমণি দেব্যা, রাণী
ভবানী, দেবী চৌধুরাণী, রানী রাসমণি, হটু বা হটি বিদ্যালঙ্কার, কর্ণগড়ের রাণী
শিরোমণি, নীলকর দমনকারী প্যারীসুন্দরী অথবা আমাদের আলেচ্য দিগম্বরীরর পাশাপাশি
গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে থাকা হাজারো লৌকিক ধর্মের মহিলাদের দৃঢ়চেতা মানসিকতা, তাদের
সংগ্রাম-লড়াইএর কথা বর্তমান নারী আন্দোলনের কর্তৃরা শোনেন নি, শুনলেও পাতে দেবার
প্রয়োজন মনে করেন নি। এই চরিত্রেগুলোর কথা গবেষকেরা জানেনওনা,
জানলেও জানাতে চাননা।
এই মহিলাদের অনেকেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন,
কখোনো শাস্তি পেয়েছেন অত্যাচার সহ্যকরেছেন। অথচ দেশজ
সংস্কারের পথ ধরে দেশের কুকুর ফেলে বিদেশি ঠাকুরের জন্য নিজেরদের প্রাণ নিবেদন
করেন নি, নিজস্ব দর্শণ বিক্রি করেন নি, তাকে মিথ্যে প্রতিপন্ন করতে চান নি। দিগম্বরীর হাত ধরে স্বাধীণতাকামী ঠাকুরবাড়ির নারীরা প্রগতিশীলতা, সভ্যতার
প্রতীক ইংরেজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন দেশজ মাটির টানে। চরিত্র গঠণ করেছেন দেশের সংস্কৃতিতে দৃঢ়ভাবে পা রেখে, দেশের প্রচলিত
ব্যবস্থাকে মান্য করেই অন্য রকম থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ইংলন্ডীয় ব্যক্তিগণের সংসর্গে, বিদেশি সংস্কৃতির প্রতি
আদেখলেপনায়, বিদেশি সরকারের গাঁথা প্রতি ইঁটে মাথা ঠেকিয়ে দিলেই চরিত্র গজিয়ে ওঠে
না। দেশজ সংস্কৃতি দিয়ে তাকে ধারণ করতে হয়। পালন করতে হয়। চরিত্র দুর্লভবস্তু – পুরুষ নারী ভেদ করা যায় না। সময় এলে তাকে
নানান প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রয়োগ করতে হয়। এমনকী সে যদি
আপন থেকে আপনতর কেউ হয়, সেও চরিত্রানুগামী না হলেও তাকেও মূল্য চোকাতে হয়।
বাঙলা ভাষায় মহীয়সী নারী কথাটি ব্যবহারে ব্যবহারে
ধারটি ক্ষয়ে গিয়েছে। এছাড়া গিদম্বরীর চরিত্রের
জুতসই সম্বোধন খুঁজে পাওয়া ভার। সেই অসামান্যা নারীকে আজ আমরা এই হৃদয়ের আকুতি জানিয়ে
আভূমি প্রণাম জানালাম।
No comments:
Post a Comment