ভারতে আর্য অনুপ্রবেশের অতিকথাটির ফোলানো ফানুশ আজ চুপসে
গিয়েছে। খুব ছোট্ট একটা ধাতু প্রযুক্তির উদাহরনেই এই অতিকথাটি অপ্রমাণ করা যায়। সেটি হল লোহা।
প্লেইনার বলছেন,(Pleiner, R. The Problem of the Beginning
Iron Age in India. Acta
Praehistorica et Archaeologica 2 (1971): 5–76) খৃস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের দ্বিতীয় অর্ধ পর্যন্ত তথাকথিত
আর্যরা লোহার দ্রব্য তৈরি করতে পারত না। শুধু তাই নয়, যে এলাকায় সংস্কৃত ভাষায় কথা
বলা আর্যরা বাস করত, সে এলাকা থেকে অন্ততঃ পশ্চিমের দেশগুলোতে লৌহ দ্রব্য রপ্ততানি
হত না। তবে এর বহু পূর্ব থেকেই ভারতে লোহার দ্রব্যের প্রচলন যে ঘটেছে তার নির্দিষ্ট
তারিখ চিহ্নিত করছেন ভারতের নানান উৎখননের স্থানে বিকরিত কার্বন পরীক্ষা করে ডি কে চক্রবর্তী (Chakrabarti, D. K. The Early Use of Iron in India. Delhi: Oxford
University Press, 1992)। আগরওয়াল আর
খারাকওয়াল(Kharakwal. Outstanding Problems of Early Iron Age in India: Need
of a New Approach. Tradition and Innovation in the History
of Iron Making: An Indo European Perspective. Girija Pande, Jan
af Geijerstam. Nainital, India: PAHAR Parikrama, 2002. 3–20.)। তিনি বিকরিত কার্বন পদ্ধতিতে প্রাচীনতম লোহার চুল্লির
তারিখ নির্ণয় করেছেন, উত্তর প্রদেশের রাজা নল কা টিলায় ৩০৫০-৯০ খৃস্ট পুর্বাব্দে(Tiwari,
R. The Origins of Iron-Working in India: New Evidence From the Central Ganga Plain and
the Eastern Vindhyas. Antiquity 77
(2003): 536–45)। পি নিয়োগী, ডি কে চক্রবর্তী, এ কে বিশ্বাস, ভি ত্রিপাঠি এবং আর
বালাসুব্রমনিয়ামএর নানান যুক্তিপূর্ণ গবেষণা থেকে পরিস্কার, ইউরোপের বহু আগেই
ভারতে লৌহ ইস্পাত প্রযুক্তির উদ্ভব ঘটেছিল। ভারতের লোহা আর ইস্পাত তৈরির
ধাতুবিদ্যা আমরা এই প্রবন্ধে আলোচনা করব।
লৌহ নিষ্কাশন
রিডাকসন পদ্ধতিতে ভারতে বহু কাল ধরে লৌহ আকরিক নিষ্কাশন
করা হত। লৌহ আকরিকের তাল ব্যবহার করে নানান লৌহদ্রব্য প্রস্তুত করা হত। লোহার গলনাঙ্ক
১৫৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। যে সময়ের কথা আমরা আলোচনা করছি, সে সময়ে ভারতের গলন
চুল্লিগুলো এত তাপ উতপন্ন করতে পারত না। সে সময়ের ভারতের নানান লৌহ গলন
চুল্লির(একে ব্লুমারি পদ্ধতি বলা হত, কেননা লোহা গলিয়ে ব্লুম তৈরি হত) বিস্তৃত
বর্ণনা দিয়েছেন ভি ত্রিপাঠী(Tripathi, V. The Age of
Iron in South Asia: Legacy and Tradition. New
Delhi: Aryan Books International, 2001)। লৌহ কারিগরেরা নির্দিষ্টভাবে নির্দিষ্ট ধরণের লৌহ আকরিক আহরন করতেন। কি
ধরণের দ্রব্য উৎপাদন করা হবে, তার ওপর নির্ভর করে লৌহ আকরিক আহরন করা হত। লৌহ
চুরকে ভেঙ্গে গুঁড়ো করার জন্য চুল্লিতে দেওয়ার আগেই একবার তাপ দেওয়া হত। সেই তাপিত গুঁড়োতে
জল বা বাতাস বইয়ে মাটি বা অন্যান্য বর্জ্য থেকে লোহা আলাদা করা হত। উত্তপ্ত লৌহ আকরিক এবং চারকোল
পরপর স্তরে রেখে চুল্লিটি ক্রমশঃ কম থেকে বেশি তাপে জ্বালানো হত। তাপ উঠত
১০০০-১২০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত। একটু পরে আমরা নানান ধরণের চুল্লির গড়ন আলোচনা করব।
সেগুলর উচ্চতা ছিল ৫ থেকে ২০ ফিট পর্যন্ত।
চুল্লির তলায় হাওয়া দেওয়া বিশেষ ধরনের হাপর জোড়া থাকত।
সেগুলো দিয়ে প্রয়োজনমত হাওয়া দেওয়ার পরিমান কমানো বাড়ান যেত। লৌহ আকরিক হল লোহার
অক্সাইড। এগুলিতে পোড়া কয়লা(চারকোল) জ্বালিয়ে(কার্বন মনোকসাইড) ব্লুমি চুল্লিতে পোড়ান
হত। লৌহ আকরিকে মিশে থাকা সিলিকন
ডাইঅক্সাইড আলাদা করা হত। সম্ভবতঃ এই পদ্ধতিতে আয়রন সিলিকেট(FeSiO4) বা ফায়ালিটিক স্ল্যাগ (2FeO·SiO2) নামওয়ালা গলিত বর্জ্যকে আলাদা করা হত। ব্লুমারি চুল্লি
থেকে লৌহ আকরিক গলিয়ে লোহা তৈরি করে বের করার সময়ও কিছু এই ধরনের গলিত বর্জ্য
গড়িয়ে বেরিয়ে আসত যেমন, তেমনি আবার কিছু আধপতিত হয়ে পড়ে থাকত চুল্লিতে, কিছুটা
আবার লোহার সঙ্গে মিশে থাকত। ফলে ৬ থেকে ৮ ঘন্টা পরে চুল্লি থেকে তাতাল গলিত মন্ডগুলি
বের করে নেহাই দিয়ে পেটানো হত। এই লোহা পেটানোর মধ্যে দিয়ে প্রচুর বর্জ্য বেরিয়ে
যেত। তবে যতদূর সম্ভব হয়ত লোহাকে পুরোপুরি বর্জ্য মুক্ত করা সম্ভব হত না, কিছু রয়েই
যেত। এগুলির মধ্যে কিছু ফায়ালিটিক স্ল্যাগ রয়েছে তেমনি কিছু লৌহ অক্সাইডও(wüstite
FeO), কিছু কাঁচেরমত ক্যালসিয়াম
সিলিকেটও থাকত। ফলে চুল্লি থেকে বের করা লোহাতে বেশ কিছু বর্জ্য থাকে যেত বলে
তখনকার লোহার তুলনামূলক ভার শুদ্ধ লোহা (Fe)র থেকে কম হত।
পুরনো দিনের পাওয়া লোহায় যে বর্জ্য মিশে থাকত, তা খালিচোখে
দেখা যায় না। তার চরিত্র আণুবীক্ষণিক। কঠিন বর্জ্য বের করানোর পদ্ধতিতে রয়ে যাওয়া
বর্জ্যগুলো লোহায় সমান ভাবে ছড়িয়ে যেত। কেননা চাইলেও পিটিয়ে পিটিয়ে সব বর্জ্য বের
করা যেত না। লোহায় থেকে যাওয়া কিছু FeO এবং অন্যান্য বর্জ্য অসমানভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত, এরা
সমান দৈর্ঘ্যেরও হত না।
ধাতুবিদ্যার দৃষ্টিতে লৌহ আকরিক থেকে লৌহ আকরিক গুঁড়ো
করা, পাউডার কনসলিডেসন এবং সিন্টারিং(Sintering is a process in which solid
wastes are combined into a porous mass that can then be added
to the blast furnace. These wastes include iron ore fines,
pollution control dust, coke breeze, water treatment plant sludge,
and flux) পদ্ধতি এক বারেই
ধাপে ধাপে সম্পন্ন করত, বলছেন আর কে দুবে(Dube, R. K. Aspects of Powder Technology in
Ancient and Medieval
India. Powder Metallurgy 33 (1990): 119–25)।
গলন চুল্লি থেকে লোহা পিন্ডটি বের করে আনা হত। সেটি কখনো
সরাসরি, আবার কখনো নতুন করে তাপ প্রয়োগ করে লৌহ দ্রব্য তৈরির কাজে ব্যাবহার করা
হত। এদের মধ্যে একটি সফল ও নিয়ন্ত্রিত তাপীয় পদ্ধতিতে এই লোহার পিন্ডকে বিশেষভাবে
তৈরি একটি ক্রুসিবলএর মধ্যে রেখে কারবুরাইজেসন (কার্বন সংযুক্তি বা বিযুক্তি) করা
হয়। লোহার সঙ্গে কার্বনের মিশেলওয়ালা একটি সংকর ধাতু, ইস্পাতে কারবুরাইজেসনএর
বিপরীত ডিকারবুরাইজেসন পদ্ধতিতে, লোহায় কার্বনের পরিমান নিয়ন্ত্রন করা হয়।
ইস্পাতে কার্বনের পরিমান নিয়ন্ত্রনের প্রয়োজন কেননা ইস্পাতের ভৌত(মেকানিক্যাল)
ধর্ম নির্ভর করে কার্বনের পরিমানের ওপর। প্রাকৃতিক নিয়ম হল, লোহায় যত বেশি কার্বন
থাকবে ইস্পাত তত কঠিন হবে।
ব্লুমারি চুল্লিতে যে পরিমানে লোহা উতপন্ন হত, সেই লোহাই
হল নানান লৌহ দ্রব্য তৈরির প্রথম ধাপ। পিণ্ডগুলোকে আবার নতুন কিছু পদ্ধতির মধ্যে
ফেলে তৈরি হত কৃষির জন্য হাতিয়ার, গৃহস্থালির দ্রব্যাদি, ইমারতি দ্রব্য, শিল্পের
কাজে লাগা নানান কাজের হাতিয়ার এবং যুদ্ধের জন্য নানান হাতিয়ার।
লোহায় কার্বন মেশানোর পদ্ধতি আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে
চতুর্দশ খৃস্টপূর্বাব্দে, ভারতে উচ্চ মানের কার্বন ইস্পাত তৈরির গৌরবময় অধ্যায়ের
সুচনা হল। পরবর্তী কালে এই ইস্পাতের নাম হল উজ় ইস্পাত। উজ় ইস্পাত যুদ্ধ ব্যাবসায়ীদের
ভীষণ প্রিয় হয়ে উঠল। কেননা, ঊজ় ইস্পাত ব্যাবহার করলে যুদ্ধ করতে করতে যুদ্ধাস্ত্র
ভেঙে যাওয়ার আশংকা থাকে না, কেননা ঊজ় স্টিল যেমন অসম্ভব নমনীয়, তেমনি, শক্তও। ফলে
তরোয়াল, শিরস্ত্রাণ এবং অঙ্গবস্ত্র তৈরি হতে থাকল এই ঊজ় ইস্পাত দিয়ে।
শ্রেণীভবন
ইংরেজরা ভারতে ক্ষমতা দখলের আগে পর্যন্ত লোহা এবং ইস্পাত
প্রযুক্তিতে ভারতের ধাতুবিদেরা দক্ষতো ছিলেনই, বিশ্বের কোনও দেশ, এই প্রযুক্তিতে
ভারতের পাশে দাঁড়াতে পারত না। লৌহ আকরিক থেকে রট লোহা তৈরির কালক্রম চলেছে অষ্টাদশ
শতক পর্যন্ত। বিশ্বের অন্যান্য দেশএর আগেই ভারত লোহায় কার্বন সংকর মিশিয়ে শক্ত
লোহা তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল। কার্বন সংকরের সবথেকে পুরনো প্রত্নতাত্বিক কাল
পাওয়া গিয়েছে ৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ(Ghosh, A. L. and P. K. Chattopadhaya. Masca
Journal 2 (1982): 63)। প্রত্নতত্ববিদেরা
বলছেন গঙ্গার অববাহিকাজুড়ে যে দ্বিতীয় শহরিকরনের উদ্যম গড়ে উঠল, সেটি তৈরি হওয়ার
বড় সহায় ছিল এই সংকর ইস্পাতএর তৈরি হাতিয়ার।
কাবন সংকরকে তিনটি শ্রেনিতে লোহাকে ভাগ করা যায়। এগুলিকে
আবার তাদের গড়ন এবং পরিমান অনুসারে আবার উপবিভাগে ভাগ হতে পারে। অষ্টাদশ থেকে
দ্বাদশ শতের(যথা রস রত্ন সমুচ্চয়) সংস্কৃত সাহিত্যে লোহাকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা
হয়েছে কান্তা লোহা(Kanta Loha) বা রট আয়রন, তিক্ষণ লোহা(Tikshna
Loha) বা কার্বন স্টিল,
এবং মুন্ড লোহা(Munda Loha) বা কাস্ট আয়রন। রাসেন্দ্রসার সংগ্রহে এই তিন প্রকার
লোহার কথা বলাহচ্ছে, তবে কিছু বিস্তৃত মন্তব্যের মধ্য দিয়ে – মুন্ড আয়রন রাস্টএর তুলনায়
১০ গুণ ভাল, তিক্ষণ লোহা মুন্ডর তুলনায় ১০০০ গুণ কাজের, কান্ত লোহা ১০ লক্ষ গুণ
ভাল তিক্ষণএর তুলনায়। এছাড়াও কার্বনের পরিমান, তাপ প্রয়োগের পরিমান এবং ব্যবহারের
নিরিখে লোহাকে আবার নানান উপবিভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। মুন্ড তিন ভাগে বিভক্ত মৃদু,
যা সহজে গলে কিন্তু সহজে ভাঙ্গে না এবং চকচকে, কুন্ঠা নেহাই দিয়ে পেটানোর সময় খুব
সহজে বিস্তৃত হয় না এবং কাদরা, যা হাতুড়ির ঘায়ে সহজেই ভেঙে যায়। তিক্ষণএর উপবিভাগ
করা হয়েছে – খর(khara), সর(sāra), হৃন্নল(hrinnāla), তারাবত্ত (tārābatta), বাজিরা(bājira) এবং কালৌহ(kālaauha)। কান্তর পাঁচটি বিভাগ করা হয়েছে – ভ্রমক(bhrāmaka), চুম্বক(chumbaka), কর্ষক(karshaka), দ্রাবক(drāvaka), এবং রোমকান্ত (romakāntā)। যে লোহাদিয়ে যে কোনও লোহাকে টেনে নেওয়া যার তার নাম
ভ্রমক, যেটি অন্য লোহাকে চুম্বন করে তার নাম চুম্বক, যেটি অন্য লোহাকে টানে তার
নাম কর্ষক, যে লোহায় সব ধরণের লোহা গলে যায় তার নাম দ্রাবক,রোমকান্ত এমন লোহা, যা ভাঙলে
সরু চুলের মত তন্তু বেরিয়ে আসে।
প্রাচীনকালে গলন চুল্লিগুলিতে, লোহা গলানোর সময়
নির্দিষ্ট, নিয়ন্ত্রিত পরিমানে কার্বন মিশেল দেওয়া হত। জং ছাড়া লোহায় ফসফরাস মিশেল
দেওয়া হত, এবং এই ধরনের ইস্পাত তৈরির সময় ব্লুমারি চুল্লিতে ক্যালসিয়াম অক্সাইড বা
কলি চুন দেওয়া হত না। অর্থাৎ প্রাচীনকালের ধাতুবিদেরা লোহার ব্যাবহার অনুযায়ী
নির্দিষ্ট পরিমানে নানা ধরণের দ্রব্য মিশেল দিয়ে বিশেষ পরিমানে বিশেষ ধরণের সংকর লৌহ
তৈরি করতে পারতেন।
ভারতীয়রা বহুকাল ধরেই ফোরজ ওয়েল্ডিং পদ্ধতিতে লোহা তৈরি
করত। ষোড়শ শতকে ইয়োরোপ কাস্ট আয়রন পদ্ধতি আপন করে নিলেও, ভারত বহুকাল এর থেকে দূরে
ছিল। তাঁরা পূর্বোক্ত পদ্ধতিতেই বিশাল বিশাল কামান তৈরি করেছে। সারা ভারতে এধরনের
বহু কামান এবং লোহার কাঠামো দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই বিকাশ মুঘল আমল পর্যন্ত ঘটে চলেছিল।
পুর বিষয়টি ওলটপালট হয়ে যায় ১৭৫৭র পরে ভারতে ব্রিটিশেরা কব্জা করার পরে। এই শিল্পকে
মারার জন্য প্রথম যে কাজটি তারা করল, সেটি হল আকাশ চুম্বি কর আরোপ এবং বিদেশে লোহা
রপ্তানি বন্ধ করা।
আর বালাসুব্রামনিয়ামএর মেটালারজ়ি অব এন্সিএন্ট ইন্ডিয়ান
আয়রন আন্ড স্টিল প্রবন্ধ থেকে
No comments:
Post a Comment