মধুসূদন যখন দূরদ্বীপবাসিনীর স্বপ্নে খ্রিস্টান হওয়ার স্বপ্নে মশগুল, তখন
কলকাতা থেকে মাত্র কয়েকশ ক্রোশ দূরে ঢাকার আশেপাশে দুদুমিঞা ইংরেজ শাসনের মূলচ্ছেদের
সংগ্রামে গ্রামের হিন্দুমুসলমান একসঙ্গে ব্রিটিশ বিরোধী লড়াই দিচ্ছেন, ইংরেজ
নীলকরদের অত্যাচারে তাঁর সঙ্গীসাথী গ্রামীণ ভাইবোনদের লাঠিয়াল পাঠিয়ে সাহায্য
করছেন। ধণীদের জন্য তৈরি ব্রিটিশ আদালতের সমান্তরাল
সালিশি আদালত বসাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে। ১৮৪৩এই
ময়মনসিংহে কৃষকেরা অত্যাচরী নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রাণপনে লড়াই করছেন। বহু জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বহু গ্রামীণ হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে। আবার বহু এলাকায় জনগণের লড়াইএর
নেতৃত্ব দিয়েছেন ছোট জমিদারেরা। জমিদার
গোলোকনাথ রায়ের লড়াইএ কথা ময়মনসিংহের ইতিহাসএ কেদারনাথ মদুমদার লিখছেন,
...১৮৪৩ খ্রীষ্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার
কাগমারীর ঘটনা। কাগমারীর নীলকুঠীর কিং সাহেব কয়েকজন
প্রজাকে গুদামে আবদ্ধ করেন ও তাহাদের নীলের দাদন লইতে বাধ্য করিবার চেষ্টা করেন। প্রজারা নীল বুনিতে অস্বীকার করায় একজন প্রজার মাথা মুড়াইয়া তাহাতে কাদা
মাখিয়া নীলের বীজ বুনিয়ে দেওয়া হয় ও অপর একজনকে একটি বৃহত সিন্দুকে আবদ্ধ করিয়া
রজনীকালে বেলকুচির কুঠিতে পাঠাইবার চেষ্টা করা হয়। ...যথাসময়ে প্রজারা (জমিদার) গোলকনাথ রায়ের নিকট কিং সাহেবের অমানুষিক অত্যাচারের কথা অবগত করাইলে
গোলকনাথ কৃষকগণকে লইয়া কিং সাহেবের কুঠি আক্রমণ করেন এবং কিং সাহেবকে ধরিয়া লইয়া
গোপন করিয়া রাখেন। উভয়পক্ষই জেলা-ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট
বিচার প্রার্থী হয়। এদিকে গোলকনাথ ও কিং সাহেব কাহারও
সংবাদ পাওয়া যায় না। জেলা-ম্যাজিস্ট্রেট গোলকনাথকে
গ্রেপ্তার করার জন্য পাবনার জয়েন্ট-ম্যাজিস্ট্রেট, রাজসাহির ম্যাজিস্ট্রেট ও
মালদহের জয়েন্ট-ম্যাজিস্ট্রেটকে লিখিয়া পাঠাইলেন। কিন্তু
গোলকনাথকে কোথাও খুঁজিয়া পাওয়াগেল না। বহুদিন পর
পাকুল্যা থানার দারোগার সাহায্যে কিং সাহেব পরিত্রাণ লাভ করেন।
১৫ বছর পরই এসে পড়বে সিপাহি সংগ্রাম। হিন্দু প্যাট্রিয়টের আগ্নীস্রাবী সম্পাদক হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায় আর
বন্ধু গিরীশচন্দ্র ঘোষ সিপাহীদের সংগ্রামের বিরুদ্ধে কলম ধরলেন। সিপাহীদের বিরুদ্ধে কলম ধরলেন আলালদের ব্যঙ্গ করা প্যারীচাঁদ মিত্রের ভাই
কিশোরীচাঁদ, যিনি জীবিতকালে একদিনও বাঙলায় লেখেন নি। দাসত্ব প্রকল্পে আলালেরা সাম্রাজ্যের থেকে যে উপহারগুলো পেয়েছে, তার বদলে
সাম্রাজ্যকে নানান প্রতিউপঢৌকনের প্রয়োজন হয়ে পড়ছিল। ১৮৫৮তে কিশোরীচাঁদ হরিশ্চন্দ্রের পথ বেয়ে লিখলেন দ্যা মিউটিনি দ্য
গভর্মেন্ট এন্ড দ্য পিপল বাই আ হিন্দু। কিশোরীচাঁদের
জীবনীকার মন্মথনাথ রায় বলছেন, ...তিনি অকাট্য যুক্তি দ্বারা প্রমাণ করেন যে
সিপাহী বিদ্রোহ সৈন্যসংক্রান্ত বিপ্লব মাত্র, ইহাতে সমগ্র জনসাধারণের কিছুমাত্র
সহানুভূতি নাই। দেশবাসী রাজভক্তই আছেন। কয়েকজন মূঢ় সিপাহির জন্য নির্দ্দোষ দেশবাসীর উপর প্রতিহিংসা গ্রহণ
নিতান্তই অসঙ্গত। ...শুনিয়াছি লর্ড ক্যানিং বাহাদুর এই
পুস্তকখানি পাঠ করিয়া সাতিশয় প্রীত হন এবং একখানি প্রশংসাপূর্ণ পত্র লিখেন। ...১৮৫৮খৃঃ অব্দে ২৫শে ফ্রেব্রুয়ারী তারিখে হিন্দুপ্যেট্রিয়ট উক্ত
পুস্তিকার সুদীর্ঘ প্রশংসাপূর্ণ সমালোচনার উপসংহারে বলেন যে, সিপাহী
বিদ্রোহ-সংক্রান্ত প্রবন্ধগুলির মধ্যে ইহা যে অতিশয় চিন্তাশীল ও যুক্তিপূর্ণ
প্রবন্ধ, তাহাতে সন্দেহ নাই। এই পুস্তক
প্রকাশের পূর্ব্বেই কিশোরীচাঁদ এক প্রকাশ্য সভা আহ্বান করিয়া ক্যানিং বাহাদুরকে
সিপাহী বিদ্রোহের ন্যায়সঙ্গত এবং বিচক্ষণ নীতি অবলম্বনের দন্য ধন্যবাদ দিয়াছিলেন।
বিগত কয়েকশ বছর অনেক কিছু কেউই বুঝে দেখিনি। রেনেসাঁরমত দাসত্ব প্রকল্প প্রচারে গা ভাসিয়ে দিয়েছি। সত্যিই বুঝে দেখা হয় নি। কলকাতা না ঢাকা-রাজসাহি, কেষ্ট
বন্দ্যো-মধুসূদন-কিশোরাচাঁদ না গোলোকনাথ রায় কে নবজাগরণের আগ্রদূত আখ্যা পাবেন, আজ
সেই তত্ব নতুন করে বুঝে দেখা দরকার।
No comments:
Post a Comment