১৮৩৩র ১৬ জানুয়ারি। ক্রমশঃ শহর
পরিচালনায় ইংরেজি শিক্ষিত আর কলকাতার প্রখ্যাতদের জুড়ে নেওয়া হচ্ছে। কলকাতার কোথায়
কল বসানো হবে, কোথায় পুকুর কাটা হবে সে বিষয়ে পরামর্শ করতে কলকাতা লটারি কমিটির
পক্ষে পরামর্শ করার জন্য দ্বারকানাথ ঠাকুর, হরিমোহন ঠাকুর আর রামগোপাল মল্লিককে
নিয়ে একটি সভা হয়। স্বাস্থ্যোন্নতি আর ময়লা সাফ করার
জন্যও আরও একটা সভা হল। লর্ড অকল্যান্ড প্রথম
মিউনিসিপ্যালিটি তৈরি করেছেন ১৮৪০এ। কলকাতাবাসীর
নিকট হইতে কর আদায় করিয়া রাস্তা ড্রেনাদি প্রস্তুত, সাফ, মেরামত, জলের ও আলোর
ব্যবস্থা কালেক্টর ও এসেসার করিবে ও তাহারা কর দাতৃগণের দুই-এর তৃতীয়াংশ মতে
নিযুক্ত হইবেন স্থির হয়।...১৮৫২
খৃষ্টাব্দে কলিকাতার চার ভাগকে উত্তর ও দক্ষিণ দুই ভাগ ও সাতজন সভ্য স্থলে
চারজন(দুইজন কর দাতৃগণের ও বাকি গভর্মেন্ট কর্তৃক) মনোনীত হল। উহাদেকর নাম মেজর খুলিয়ার, মিস্টার এস ওয়াচেপ, তারিনীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও
দীনবন্ধু দে (রায়বাহাদুর প্রমথনাথ মল্লিক, কলিকাতার কথা, ২য়, ২২৮)।
১৮৪৩এর ১৩ই মার্চ মিউনিপ্যালিটির কাজ তত্বাবধানের জন্য
পুলিশ আপিসে একটি সভা বসে। সভাপতি আশুতোষ
দেব, সেক্রেটারি বিশ্বনাথ মতিলাল এবং রায়বাহাদুর প্রমথনাথ দে, এছাড়াও
প্রসন্নকুমার ঠাকুর, হরকুমার ঠাকুর, শ্রীকৃষ্ণ সিংহ, নন্দলাল সিংহ ও নবকৃষ্ণ সিংহ,
রামতনু মল্লিক, মতিলাল মল্লিক, দ্বারকানাথ মল্লিক ও বীরনৃসিংহ মল্লিক,
দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, কাশীপ্রসাদ ঘোষকে নিয়ে কার্যকরী সভা সংগঠিত হয়। ভারতীয়দের নিয়ে কলকাতা শাসনের প্রথম উদ্যোগ। এর আগে ডেপুটিগিরির পেলেও শাসনের এতবড় সুযোগ পাননি কলকাতার নবজাগরণের
অগ্রদূতেরা।
ঈশ্বর গুপ্ত, ১৮৫৪(২৩ আষাঢ়, ১২৬১)র প্রভারকরএ
লিখছেন, আমরা পূর্ব্বে ইংলিসম্যান-পত্রদৃষ্টে লিখিয়াছিলাম, আমাদের সুবিজ্ঞতম
রাজনীতিজ্ঞ কার্য্যতত্পর ডেপুটী ম্যাজিস্ট্রেট বাবু কিশোরীচাঁদ মিত্র ৬০০ টাকা
মাসিক বেতনে কলিকাতা পুলিসের কনিষ্ঠ ম্যাজিস্ট্রেট পদে অভিষিক্ত হইয়াছেন, এইক্ষণে
আবার উক্ত পত্রেই দৃষ্ট হইল ঐ পদের বেতন কিছুমাত্র ন্যুন হয় নাই, বাবু হরচন্দ্র
ঘোষ যে ৮০০ টাকা বেতন পাইতেন কিশোরীচাঁদ মিত্র তাহাই পাইবেন। যাহাই হউক, এতত্ সুসংবাদে আমরা অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইলাম, আমাদিগের মিত্র
মিত্রবাবু পূর্ব্বে ৩৫০টাকা পাইতেন অধুনা ৪৫০ টাকা বৃদ্ধি হইল। রাজপুরুষেরা এতদ্দেশীয় কৃতবিদ্য উপযুক্ত রাজকর্ম্মচারীদিগের পদোন্নতির
প্রতি এরূপ প্রসন্নতা প্রকাশ করাতে অত্যন্ত যশশ্বী হইবেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। রাজকর্মচারীরা
ক্রমশঃ মনে করছেন, রায়ান, বার্ডএর নিরাপত্তার বেষ্টনী আর দিগদর্শণে যে নবজীবনের
অঙ্গীকারের আলো দেখছিল কলকাতার আগ্রদূতেরা, বিশেষ করে হিন্দু কালেজসহ নানান ইংরেজি
বিদ্যালয়ে পাঠগ্রহণ করা শিক্ষার্থীরা, ক্রমশঃ যশস্বী, চাকরিযোগ্য হয়ে উঠছেন। সাম্রাজ্যের অভয়হস্ত তাদের নিরাপত্তা দিতে শুরু করেছে। বাঙলা সরকারের সচিব হ্যালিডে, সরকারপক্ষীয় লেখা প্রকাশে পুরস্কারস্বরূপ
চাকরি দিচ্ছেন বাঙলায়। মোটামুটি ঠিকঠাক মাইনেও পাচ্ছেন।
দাসত্ব প্রকল্প ক্রশঃ শেকড় ছড়াচ্ছে ভারত সাম্রাজ্যে। কিছুটা হলেও শান্তি অর্জন করছেন সাম্রাজ্যের মাথারা। আরও প্রায় একশ বছর সাম্রাজ্য চালানোর জন্য এই পুরস্কারগুলো খুব জরুরি ছিল।
কোম্পানি আমলে প্রখ্যাতদের মধ্যে ছিলেন হরিশ্চন্দ্র
মুখোপাধ্যায়, শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, মধুসূদন দত্ত, প্যারীচাঁদ মিত্র, কিশোরীচাঁদ
মিত্র, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দ্বারকানাথ মিত্র, রমেশচন্দ্র মিত্র,
চন্দ্রমাধব ঘোষ, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, রাসবিহারী ঘোষ, রামগোপাল ঘোষ, কেশব সেন,
সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। কিশোরীচাঁদের
মাইনে ৪৫০ টাকা বাড়ায় ঈশ্বর গুপ্ত হর্ষবাক্য প্রকাশ করছেন। কিশোরীচাঁদ বাঙলা সুবায় কাজ করছেন। তবে এ সময়ের
প্রখ্যাতদের অনেকেই আবার সারা ভারতে সাম্রাজ্য সেবার জন্য তৈরি হয়ে উঠছেন। রায়বাহাদুর প্রমথনাথ মল্লিকের কলিকাতার কথা পুস্তকের ২৬২ পৃষ্ঠায় লিখছেন কার
টেগোর কোম্পানির কর্মচারী রামচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র গুরুদাস
বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় ভাইস-চ্যানসেলার। বিচারপতি এবং নাইট উপাধিধারী। নীলাম্বর
মুখোপাধ্যায় কাশ্মীরের প্রধান মন্ত্রী পদে বসেন। পরে কলকাতা মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস চেয়ারম্যান হয়ে অবসর লাভ করেন। তাঁর ভাই ঋষিবর মুখোপাধ্যায় কাশ্মীরের বিচারপতি আর গভর্ণর হন। প্রতুলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নাভা রাজার মন্ত্রী এবং পাঞ্জাব
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলার হন। কান্তিচন্দ্র
মুখোপাধ্যায় জয়পুর কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে রাজা রাজারাম সিংহের শুভদৃষ্টিতে
প্রধাণমন্ত্রী পদে আসীনহন। ফেমিন কমিশনের
সদস্য এবং সি আই ই উপাধি পান। সর্দার
কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায় নেপালের প্রধাণমন্ত্রী হন। সর্দার উমাচরণ মুখোপাধ্যায় ঢোলপুরে নাবালক রাজার শিক্ষক থেকে শুরু করে
রাজা প্রাপ্তবয়ষ্ক হলে বিচারক, কাউন্সিল মেম্বর আর রাজস্ব সচিব হন। স্যর প্রমদাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এলাহাবাদ হাইকোর্টের জজ হন। প্রসন্ন কুমার রায় প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রধাণ অধ্যক্ষ হন। লর্ড সিংহ গভর্ণর এবং আন্ডার সেক্রেটারি হন।
ব্যতিক্রমী দেবেন্দ্রনাথ
অন্যান্য পত্রিকাগুলোয় প্রকাশিত বিষয়গুলোর সঙ্গে তত্ববোধিনী পত্রিকার
বিষয়ের তুলনা টানলেই পরিস্কার হবে কেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যতিক্রমী বাঙালি। তত্ববোধিনী পত্রিকায় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পিতার পশ্চিমিকেন্দ্রিকতার বাইরে
বেরিয়ে এসে নিজ উদ্যোগে, বিদ্যাসাগর অথবা অক্ষয়কুমারেরমত বন্ধুর মাধ্যমে চেষ্টা
করেছেন মানুষদের কলকাতার নিরাপদ সীমানার বাইরের দিকে নজর ফেরাতে। খুব সহজে হয় নি। অর্থের লোভে, প্রতিযোগিতায় টিকে
থাকতে তখন কলকাতার পত্রিকাগুলি বাবুদের খেউড় বা ইল্লুতে নানান কাজকর্ম বাগান বা
কোঠাবাড়ি থেকে বের করে এনে সংবাদপত্রের পাতায় ঠাঁই দিচ্ছে, তখন তত্ববোধিনী
পত্রিকারমত কয়েকটি হাতে গোণা পত্রিকা কিন্তু গ্রমের অবস্থা শহর কলকাতার ধণাঢ্যদের
জানাবার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছেল অপরিসীম ভয়ের পরিবেশ বর্জন করে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধের মান আজও সম্ভ্রম উদ্রেক করে।
কলকাতার আলালেরঘরেরদুলালদের লাম্পট্য, অপরিসীম অর্থ
অপব্যয় আর ইংরেজদাসত্বের সংবাদের বাইরে বেরিয়ে এসে সেসময় তত্ববোধিনী পত্রিকা(৮৪
সংখ্যা, শ্রাবণ, ১৭৭২শক, শিরেনাম পল্লীগ্রামস্থ
প্রজাদের দুরবস্থা, লেখক অক্ষয় কুমার দত্ত) সরাসরি অত্যাচারিত গ্রামের রায়তদের
অবস্থার বর্ণনা দিচ্ছে অসম্ভব সততায়, করুণতম মমতায়। এ প্রসঙ্গে সেই প্রবন্ধের নির্বাচিত এক বড় অংশ তিলেদেওয়া গেল ...যে দেশে রাজা ও রাজ নিয়ম আছে, এবং যে
স্থানে প্রজারা বহু-বেতন-ভুক উত্তমোত্তম রাজ-কর্মচারি নিয়োগের উপযোগি যথেষ্ট কর
প্রদান করে, য়ে দেশ যে এমত অশাসিত থাকে, এবম তত্রত্য লোকের ধন, মান, প্রাণাদি
কিছুই যে সায়ত্ত নহে, ইহাতে তথাকার রাজ কার্য্যেরই ত্রুটি স্বীকার করিতে হয়। কিন্তু পাঠকবর্গ যেন এমন না মনে করেন, যে আমাদের রাজপুরুষদিগের সমুদার কার্যও
এরূপ বিশৃঙ্খল। যে বিষয়ে তাহাদের স্বার্থ আছে, তাহাত
যত্ন, পরিশ্রম ও উত্সাহের কিছুমাত্র অল্পতা দেখা যায় না- বোধহয় তাঁহারা
আত্মলাভার্থে প্রাণ পর্যন্ত পণ করিয়া অতি দুষ্কর কর্মও সম্পন্ন করিতে পারেন। স্বার্থ সাধনে প্রবৃত্ত হইলে উহাদের মনের প্রভাব বৃদ্ধি হয়, এবং অঙ্গসকল
দ্বিগুণ বল ধারণ করে। রাজস্ব সংগ্রহে কি অপূর্ব কৌশল, কি
পরিপাটী নিয়ম, কী অদ্ভুত নৈপুণ্য প্রকাশ করিয়াছেন। প্রজারা
নিঃস্ব ও নিরন্ন হউক, তথাপি তাহারদিগকে নিরূপিত রাজস্ব দিতেই হইবে, ভূস্বামির
সর্ব্বস্বান্ত হউক, তথাপি তিনি ত্রৈমাসের পর কপর্দ্দক মাত্রও রাজস্ব অনাদায় রাখিতে
পারিবেননা। অনাবৃষ্টি হইয়া সমস্ত শস্য শুষ্ক
হউক, জল প্লাবন হইয়া দেশ উচ্ছিন্ন যাউক, রাজস্ব দানে অপারগ হইয়া প্রজাগণ পলায়ন
করুক, তথাপি নির্দিষ্ট দিবসে সূর্য়াস্তের প্রাক্কালে তাঁহাকে সমস্ত রাজস্ব নিঃশেষে
পরিষোধ করিতে হইবে...
এইরূপ রাজার প্রতি
প্রজার, কর্ত্তব্য সাধন বিষয়ে রাজপুরুষদিগের যত্ন, নৈপুণ্য ও বিক্রম প্রকাশের
কিছুমাত্র ত্রুটি দেখা যায় না, কিন্তু প্রজার প্রতি রাজার কর্ত্তব্য সমস্ত বিষয়েই
তাহার সম্যক বৈপরীত্য প্রতীত হইতেছে। সে বিষয়ে
দৃষ্টি রাখিয়া নিরীক্ষণ করিলে সমুদায় বাঙালা দেশ সিংহ-ব্যাঘ্রাদি-সমাকীর্ণ
মহারণ্যের ন্যায় বোধ হয়, যেখানে কোন নিয়ম নাই, কাহারও শাসন নাই, যেখানে নৃশংস
স্বভাব হিংস্র-জীবসকল নিরুপদ্রব নির্ব্বিরোধ প্রাণিদিগের প্রাণনাশার্থেই সর্ব্বদা
সচেষ্ট আছে। প্রজাদের ধন সম্পত্তিতে রাজার কিছু
স্বভাব সিদ্ধ স্বত্ব নাই, তিনি তাহাদেক ধন মান প্রাণাদি রক্ষা করিবেন বলিয়াই কর
গ্রহণ করেন। কিন্তু আমাদের রাজপুরুষরা যদার্থে কর
গ্রহণ করেন তত্সাধন বিষয়ে তাঁহারা যেন মনোযোগি, পল্লিগ্রামসস্থ প্রজাদিগের
দুরবস্থাই তাহার সাক্ষী রহিয়াছে।
বাঙলাদেশের
অনেক ভূস্বামীরাই এই প্রকার উপদ্রব এবং অনেক প্রজারই এই প্রকার যাতনা। সংপ্রতি কৃষ্ণনগর জেলার কোন এক ভূস্বামী ও কর্ম্মচারিগিদের চরিত্র শ্রবণ
করিয়া বিস্ময়াপন্ন হওয়া গেল। তাঁহারা প্রজাদের স্থাবাস্থাবর
সম্পত্তি দূরে থাকুক, তাহাদিগের শরীরেও আপনার অধিকারভুক্ত জ্ঞাণ করেন, এবং তদনুসার
তাহাদিগের কায়িক পরিশ্রমও আপনার ক্রীত বস্তু বোধ করিয়া তাহার উপর দাওয়া করেন। তাঁহাদের এই প্রকার অখন্ড্য অনুমতি আছে, যে বিনামূল্যে ও বিনাবেতনে
তাঁহারদিগকে গোপেরা দুগ্ধ দান করিবেক, মত্সোপজীবিরা মত্স্য প্রদান করিবেক, নাপিতের
ক্ষৌর করিবেক, যান-বাহকে বহন করিবেক, চর্ম্মকারে চর্ম্মপাদুকা প্রদান করিবেক। ক্রীতদাসকেও ঐরূপ দাসত্ব করিতে হয় না। সেও স্বীয়
কার্যের বেতন স্বরূপ অন্ন বস্ত্র প্রাপ্ত হয়। আর উহারা
স্বীয় অধিকারস্থ ব্যবসায়ীদের নিকট যাবতীয় বস্তু ক্রয় করেন, তাহারও উচিতমূল্য দান
করেন না। ইহারা যে পণে দ্রব্য গ্রহণ করেন,
তাহার নাম সরকারী মূল্য – সে মূল্য ইহাদের ইচ্ছাধীন – সে মূল্য সাধারণরূপে প্রচলিত হইলে
বাণিজ্য ব্যবসায় উচ্ছিন্ন হইত। হায়! এই প্রকারের অত্যাচার করিয়াও
ক্ষান্ত নহেন, তাহার দিগের উপজীবিকাও হন্তা হয়েন। দূরদেশীয়
মনুষ্যেরা ইহাদের আচরণ শ্রবণ করিলে সহসা বোধ করিতে পারেন, প্রজাকূল সমূলে উন্মূল করাই
ইহারদের উদ্দেশ্য....
...ভূস্বামীরা
যে কতপ্রকার কৌশল করিয়া লোকের ধন হরণ করেন, তাহা নির্ব্বাচন করা দুষ্কর। ব্রাহ্মণের ব্রহ্মোত্তর ও দেবতার দেবোত্তর গ্রহণ করা কোন ভূস্বামীর সংকল্প
হইয়াছে। আমাদিগের সর্ব্বশোষক গভর্ণমেন্টকে
যথাসর্বস্ব সমর্পণ করিয়া ব্রাহ্মণদিগের যত্কিঞ্চিত যাহা অবশিষ্ট আছে, তাঁহারা তাহা
অপহৃত করিয়া আত্মস্ম্যাত্ করেন কত কত ব্রাহ্মণ পন্ডিত এ বিষয়ে প্রতিকারার্থে
ব্যক্তিবেশেষের দ্বারে দ্বারে ক্রন্দন করিয়া ভ্রমণ করিতেছেন, কিন্তু কিছুতেই
তাহাদের অন্ন-হন্তা ভূস্বামীদিগের কঠোর হৃদয়ে কারুণ্যরসের সঞ্চার হয় না। ইহারা রোদন করিলে তিনি বধির বত্ ব্যবহার করেন, বোধ হয় যেন আপনাকে
স্বাধীকারস্থ সমস্ত প্রজার সমস্ত বস্তু অদ্বিতীয় স্বত্ত্বাধিকারি জ্ঞান করিয়া তাহা
অধিকার করিবার নিমিত্ত সর্ব্বদাই ব্যস্ত থাকেন। কখন দেখ তিনি
লোভাক্রান্ত হইয়া পুণঃ পুণঃ ভূমির পরিমান পূর্ব্বক নানা কৌশলে রাজস্বের বাহুল্য
করিতেছেন, কখন কোন প্রজার নিরূপিত কর পরিবর্ত্তন করিয়া যথেচ্ছা বৃদ্ধি করিতেছেন,
কখন বা সাতিশয় ধনতৃষ্ণা-পরবশ হইয়া স্বেচ্ছানুসারে এক প্রজার ভূমি গ্রহণ পূর্ব্বক
অধিকতর করে, অন্যর হস্তে সমর্পণ করিতেছেন। আহা! মধ্যে
মধ্যে এ প্রকারও ঘটে, যে কোন দুঃখি প্রজা ভূস্বামির নিকট একখন্ড সকর জমি বা কোন
অপকৃষ্ট উদ্যান গ্রহন করিয়া যত্ন ও শ্রম সহকারে, তাহার পরিপাট্য ও উন্নতি করিয়াছে,
এবম আগামি বর্ষে তাহার সেই সমূদার পরিশ্রমের যথেষ্ট ফললাভ সম্ভাবনাময় মনে মনে পরম
পুলকিত রহিয়াছে, ইতিমধ্যে অন্য এক ব্যক্তি আগমন করিয়া কহিলেক, আমি তোমার ভূমির অধিকা করিতে চলিলাম,
ভূস্বামির নিকট সমধিক কর প্রদানে স্বীকার পাইয়া তাহা গ্রহণ করিয়াছি। এ কথা শ্রবণমাত্রে সেই প্রজার মুন্ডে
যেন অকস্মাত্ বজ্রাঘাত হয়, তাহার আশানুরূপ রমনীয় বৃক্ষ সমূলে উত্পাটিত হয়।
ভূস্বামীদের অত্যাচারের এক দীর্ঘ তালিকা দিয়েছেন লেখক। কিন্তু ইংরেজদের অত্যধিক খাজনার খাঁই মেটাতে তাদের সৃষ্ট নব্যজমিদারেরা
প্রজাদের উপর কী অত্যাচার নিমিয়ে আনত তা আজ অনুভব করা অসম্ভব। ভূস্বামীদেগের লোকে বলদ্বারা তাহাদের
ধান্য গ্রহণ করে, গে সকল হরণ করে, এবং তাহাদিগকে ...জলমগ্ন করে ও প্রহার করে। ভূস্বামী ও দারোগা এবং তাহাদের কর্ম্মচারিরা প্রজাদিগের যে প্রকার শারীরিক
দন্ড করে, তাহা কলিকাতাবাসী অনেক লোকে সবশেষ অবগত নহেন। অতএব পশ্চাতকয়েক প্রকার কায়দন্ডের বিবরণ করা হইতেছে-
১।দন্ডাঘাত ও বেত্র্যাঘাত
২। চর্ম্মপাদুকা প্রহার করা
৩।বংশকাষ্ঠাদি দ্বারা বক্ষঃস্থল দলন
করিতে থাকে(২০ জ্যৈষ্ঠের ভাস্কর পত্রে ইহার উদাহরণ আছে)
৪। খাপরা দিয়া কর্ণ ও নাসিকা মর্দ্দন
৫। ভূমিতে নাসিকা ঘর্ষণ করায়
৬। পৃষ্ঠে বাহুদ্বয় নীত রাখিয়া বন্ধন
করিয়া বংশদন্ডাদি দ্বারা মেড়া দিতে থাকে।
৭। গাত্রে বিছুটি দেয়
৮। হস্তদ্বয় ও পদদ্বয় নিগড়-বন্ধ করিয়া
রাখে।
৯। কর্ণ ধারণ করিয়া ধাবন করায়।
১০। কাঁটা দিয়া হস্ত দলন করিতে থাকে।(অর্থাত্ দুইখান কঠিন বাখারির এক দিক বাঁধিয়া তাহার মধ্যে হস্ত রাখিয়া
মর্দ্দন করিতে থাকে। এই প্রাণঘাতক যন্ত্রের নাম কাঁটা)
১১। গ্রীষ্মকালে প্রচন্ড রৌদ্রে পাদদ্বয়
অতি বিমুক্ত করিয়া ইষ্টকোপরি ইষ্টক হস্তে দন্ডায়মান রাখে।
১২। অত্যন্ত শীতের সময় জলমগ্ন এ গাত্রে
জল নিক্ষেপ করে।
১৩। গোণীবদ্ধ করিয়া জলমগ্ন করে।
১৪। ভাদ্র ও আশ্বিনমাসে ধান্যের গোলায়
পুরিয়া রাখে। (সেই সময় গোলার অভ্যন্তর অত্যন্ত
উষ্ণ হয়, এবং ধান্য হইতে প্রচুর বাষ্প উঠিতে থাকে)
১৫। চূনের ঘরে রুদ্ধ করিয়া রাখে।
১৬।কারারুদ্ধ করিয়া উপবাসী রাখে, অথবা
ধান্যের সহিত তন্ডুল মিশ্রিত করিয়া তাহাই এক সন্ধ্যা আহার করিতে দেয়।
১৭। গৃহ মধ্যে রুদ্ধ করিয়া লঙ্কা মরিচের
ধূম প্রদান করে।
দেবেন্দ্রনাথের জমিদার পরিবারে জন্ম। তিনি তত্ববোধিনীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদক। তবুও এই লেখায় জমিদার বিরোধী ভাবনা প্রকাশে তিনি বিন্দুমাত্র আড় হয়ে
দাঁড়ান নি। তাঁর অন্যান্য সম্পাদকের মত তিনি
শুধু শ্রদ্ধা করতেন না, মতপ্রকাশেরও স্বাধীণতা ছিল। এবং তত্ববোধিনীতে সম্পাদকমন্ডলী গণতন্ত্রিক উপায়েই রচনা নির্বাচন করতেন। প্রত্যেক সম্পাদককে প্রত্যেক প্রবন্ধ দেখে মন্তব্য করতে হত। বাঙলার পল্লীসমাজ সিংহ-ব্যাঘ্রাদি-সমাকীর্ণ
মহারণ্যের ন্যায় বোধ হয় বলে অক্ষয় কুমার দত্ত লিখছেন তত্ববোধিনী পত্রিকায়। তত্ববোধেনী পত্রিকা সে সময় গ্রামীণ বাঙলার দুরবস্থা বর্ণনে অগ্রগামী ভূমিকা
গ্রহণ করলেও, সে সময় নানান পত্রিকাও এ ধরণের সংবাদ প্রকাশ করত। সনাতন ধর্মের প্রতি বিদ্রোহ ঘোষণা করে খ্রিস্টান হওয়া, চাকরি পাওয়া,
সাহ্বদের অনুগ্রহ পাওয়ার সাগ্রহ প্রচেষ্টার বাইরে, আলালি বালখিল্যদের দৃষ্টি এই
রচনাগুলির ওপর পড়েছিল কীনা সে তথ্য এখোনো অপ্রকাশিত।
তত্ববেধিনী পত্রিকা যখন এই ধারাবাহিক রচনাটি প্রকাশ
করছে, তখন কিন্তু ইংরেজ নীলকর জমিদারদের স্বর্ণযুগ এবং বাঙলার মানুষ প্রথমে
তিতুমীর পরে বিশ্বাস ভাইদের নেতৃত্বে বিদ্রোহে ফেটে পড়েছে। মনে রাখতে হবে রামমোহন-দ্বারকানাথ প্রস্তাবিত কলোনাইজেশন প্রকল্পের (বাঙলার
অন্যান্য জমিদারেরাও বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন) ফলে বাঙলায় পুনর্বাসন পেয়েছিলেন ইংরেজ
রাজত্বে দাস ব্যবসা বেআইনি হয়ে যাওয়ার ফলে, বেকার হয়ে যাওয়া এক ঝাঁক ওয়েস্ট
ইন্ডিজের প্রাক্তণ আখচাষী দাস ব্যবসায়ী। তাঁরা ১৮৩৩এর
সনদে বাঙলা-বিহারে জমি কিনে যে অত্যাচার নির্ভর নীল চাষের পথ দেখালেন, তা বাঙলাদেশে
অভূতপূর্ব ছিল বলা যায়। যে কৃষ্ণনগরের জমিদারের উদাহরণ লেখক তত্ববোধিনীর
প্রবন্ধে দিয়েছেন, সেই অঞ্চলে একদা প্রায় দু-তিনদশক পূর্বে তিতুমীর লড়াই করেছেন
বীরবিক্রমে। কৃষ্ণনগরের জমিদারেরা কতটা এই
প্রাক্তণ দাস ব্যবসায়ীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন তা গবেষণাযোগ্য।
বিনয় ঘোষ প্রবন্ধের অত্যাচারের তালিকা প্রসঙ্গে বলছেন মধ্যযুগের সমাজে এ তালিকা দেখলে কেউ বিস্মিত
হতেন না। কিন্তু ইংরেজ সৃষ্ট নতুন
জমিদারশ্রেণী অত্যাচারের অপকৌশল সেকালের সামন্তদেরও লজ্জা দিয়েছিলেন তা এই বিবরণ
দেখলে বোঝা যাবে। ইংরেজ বর্ণিত বাঙলার তথাকথিত অন্ধকারাচ্ছন্ন মধ্যযুগে আদৌ যে এধরণের
অত্যাচারের কান্ড ঘটত কীনা সে কথা ঐতিহাসিকেরা বলবেন, কেননা ব্রিটিশ আমলের আগের
কয়েক শতাব্দ যদি বাঙলার স্বর্ণযুগ হয় তাহলে সেই যুগ রচনার কিছুটা শ্রেয় বর্তায় সেই
যুগের জমিদারদের ওপরও, কেননা এ যুগে বাঙলার অর্থনীতি ছিল উদ্বৃত্ত। সভ্য গণতান্ত্রিক ইংরেজ শাসনে আকাশ ছোঁয়া সম্পদের লালসায়, প্রকৃতি ধংসের
উল্লাসে, সাধারণ রায়ত রায়তদের ওপর নব্যজমিদারদের একাংশ অত্যাচার ঘটিয়েছিল এ কথা আজ
সর্বজনসত্য। নবজাগরণের ইতিহাস লিখতে গিয়ে বিনয়
ঘোষমশাই সঠিকভাবেই আঙুল তুলছেন নব্যজমিদারদের দিকে, কেননা এঁদের হাতেই কলিকাতা
শহরে শ্রীবৃদ্ধি ও বিকাশ। নবজাগরণেমুগ্ধ অন্যতম বাঙালি
ইতিহাসকার জীবনের শেষের দিকে নবজাগরণ প্রকল্পেই আস্থা হারাচ্ছিলেন। বাঙলার গ্রামবাঙলা শোষণ করে এই ভাবে
কলকাতা শহরে নতুন নাগরিক সমাজের সৌধ গড়ে উঠছিল। তার মধ্যে
তথাকথিত নবজাগরণের মন্ত্র উচ্চারিত হচ্ছিল প্রহসনের মতো, গ্রামজীবনের শোকসংগীতের
বিষাদের সুরের মধ্যে তার কোনও মাদকতা
সাধারণ মানুষের কানে পৌঁছচ্ছিল না, নবযুগের ও নবজাগরণের ইতিহাসের এই বৈশিষ্ট্য
অর্থাত তার সংকীর্ণ নগর কেন্দ্রিকতা, বাঙলাদেশে পূর্ণ মাত্রায় দেখাদিয়েছিল। ....কিসের
জাগরণ অথবা কেনই বা নব-জাগরণ তাও তাঁরা (গ্রামীণেরা) বুঝতে উত্সাহিত হয়নি। যাদের আর্থের খাঁইতে জমিদারেরা রক্তপিপাসু হয়ে উঠলেন, সেই ইংরেজদের
একটিবারও সমালোচনা করলেন না তিনি। বরং, ইংরেজদের
ভারত সমাজ ভাঙার প্রচেষ্টার বাহবা দিলেন গুরু মার্ক্সএর অনুসরণে। ভারত সংস্কৃতির হত্যাকারী, দেশিয় শিক্ষার ধংসকর্তা টমাস ব্যাবিংটন মেকলেকে
শংসাপত্র দিলেন উদারপন্থীরূপে।
ছোটমুখে আরও একটি বড় কথা। দেশের মানুষের অবস্থা বর্ণনে তত্ববোধিনী কলকাতা থেকে অনেক যুগ এগিয়ে ছিল। সে পত্রিকা কী বাঙলার গ্রামীণ জনগণের থেকেও অগ্রগণ্য ছিল! আমরা যেন
মনেরাখি তত্ববোধিনীতে এধরণের প্রবন্ধ প্রকাশ হওয়ার প্রায় একশ বছর আগেই গ্রামীণেরা
ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছেন।
২১ ডিসেম্বর ১৮৪৩ দেবেন্দ্রনাথ কুড়িজন বন্ধুসহ
রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের কাছে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নিলেন। ছিল ব্রাহ্মসমাজ, হল ব্রাহ্মধর্ম। রামমোহনের
ধর্মীয় ভাবনাকে ধর্মে পরিণত করলেন দেবেন্দ্রনাথ। দেবেন্দ্রনাখ যখন ব্রাহ্মধর্মকে প্রতিষ্ঠানের রূপ দিচ্ছেন, তখন
ঢাকা-ফরিদপুরে ফরাজিরা স্বাধীণ রাজ্য স্থাপনে উদ্যোগী হয়ে স্বাধীণতা সংগ্রাম করছেন। ময়মনসিংহে গারো স্বাধীণতা সংগ্রাম নতুন করে শুরু হচ্ছে। ত্রিপুরায় কৃষক স্বাধীণতা সংগ্রাম ধুমায়িত হচ্ছে। একই সঙ্গে কলকতায় চল্লিশের দশকে ক্রমশঃ পাদরিরা নতুন করে সক্রিয় হয়ে উঠতে
শুরু করেন। পাদরি ডাফ India
and Indian Missions প্রকাশ করেন এবং অতীতের পাদ্রিদেরমতই ভারতীয় ধর্ম
সম্বন্ধে কুত্সায় নেমেপড়েন। ডাফের ঢাকের
বাঁয়া নবযুগের বিদ্রোহী কলকাতার আলালেরা। দেবেন্দ্রনাথ বাইবেল
আর কোরান অনুসারে বেদান্তকে দাবি করলেন ঈশ্বর প্রেরিত গ্রন্থরূপে। রাজনারায়ণ বসু লিখলেন, Defence of Brahmoism and the Brahmo Samaj। দেবেন্দ্রনাথ এই দাবি থেকে সরে এলেন।
১৮৪৫এ চোদ্দবছরের বালক উমেশচন্দ্র সরকার আর তার এগার
বছরের বধূকে ডাফ খ্রিস্টধর্ম দীক্ষা দিলেন। উমেশচন্দ্র দেবেন্দ্রানাথের হাউসএর সরকার, রাজেন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ ভ্রাতা। উমেশচন্দ্র আর তাঁর স্ত্রীর ধর্মান্তরণে দেবেন্দ্রনাথ
যারপরনাই বিচলিত। ঠিক সেই সময়ের একটু আগে ১৮৪৩এর ৯ ফেব্রুয়ারি,
বৃহস্পতিবার হিন্দু কালেজের উনিশ-কু়ড়ি বছরের জনৈক পলাতক ছাত্র, মধুসূদন দত্ত,
ওল্ড মিশন রোর চার্চের সামনে লালদিঘির ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে নিশ্চিন্তে অঙ্ককষে
খ্রিস্ট ধর্মে আশ্রয় নিচ্ছেন ইংরেজিতে সাহিত্য রচনা করে বিশ্ববিখ্যাত হওয়ার স্বপ্ন
সাকার করতে। কেষ্ট বন্দ্যো তখনও
কলকাতার ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজের গোষ্ঠীপতি, বাঙলায় পাদ্রিদের কাজকর্ম প্রচার-প্রসারে মাত্রাতিরিক্ত
উদ্যমী। ইংরেজদের দাসত্ব প্রকল্প
প্রচারের তিনি তখন মূল কান্ডারী। মধুসূদন তাঁর এই পুজ্য প্রতিমাকে ছোটবেলা থেকেই দেখেছেন। দেখেছেন কলকাতার ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজে কেষ্ট বন্দ্যোর কী
দবদবা। কেষ্ট বন্দ্যোর
সমাজ-সিঁড়িতে ওঠার লেখচিত্র দেখে তিনিও উত্সাহিত। মধুসূদনের সেই দীক্ষা উত্সবে কৃষ্ণমোহন এসেছিলেন চুজন উইটনেসরূপে।
No comments:
Post a Comment