ভারত ত বহুদিন হইতেই পরহস্তগত হইয়েছে, কিন্তু নরপিশাচ নাদের শাহ ও
উচ্ছৃঙ্খল আরঙ্গজেবের ন্যায় শাসকগণ ও সর্ব্বগ্রাসী বণিকদিগের হস্ত হইতে যে নিস্কৃতি
পাইয়া মহারাণীর হস্তে আসিয়াছে, ইহা ভারতবাসী অল্প সৌভাগ্যের বিষয় নয়। মহারাণীর
কালে আমাদিগের কোন কোন বিষয়ে যে প্রভূত উন্নতি হইয়াছে, তাহার সন্দেহ নাই – অক্ষয় কুমার দত্ত, প্রাচীণ
হিন্দুগণের সমুদ্র যাত্রা
রাণীর অভয়হস্ত মাথায় নিয়ে অক্ষয় কুমার দত্ত সাম্রাজ্যে বেকনিয় মানসিকতা(স্পিরিট)র
মানুষ চাইলেন। তিনি চাইতেন মানব সভ্যতা প্রকৃতি
শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করুক। শিল্পবিপ্লবীয় বিজ্ঞাণের প্রবক্তা
বেকনের রচনায় মানবসমাজ অথবা প্রকৃতির বিরুদ্ধে যে হিংসা প্রয়োগ করে নিয়ন্ত্রণের ভাব
প্রকাশ পেয়েছে তা চারিয়ে গিয়েছিল নবজাগরণের প্রবক্তাদের মধ্যে। পশ্চিমি বিজ্ঞাণচর্চার ধর্মের মধ্যেই রয়েছে হিংসার মূলশর্ত। ব্যঙ অথবা খরগোশের প্রস্থচ্ছেদ করে জ্ঞাণ আহরণের চেষ্টা অথবা মানুষকে
গিনিপিগ বানিয়ে বিভিন্ন ওযুধের কার্যকারিতার প্রয়োগ অথবা মারণবিজ্ঞাণ-প্রযুক্তির
বলে বলীয়ান ভোপাল, নাগাসাকি অথবা চেরনোবিল তৈরি করে লাখো মানুষের শ্মশান সৃষ্টিকরা
বিজ্ঞান গবেষণার প্রাথমিক ধাপ। ভারত অহিংস
পথে বিজ্ঞাণচর্চার পথিকৃত। সে পথ জৈন
অথবা বৌদ্ধ অথবা অন্য কোনও দেশি পদ্ধতি হোক না কেন। সেই মানবমুখীন প্রচেষ্টাগুলিকে আঁস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলা হল। পশ্চিমি মানবতাহীন বৈজ্ঞাণিক জ্ঞাণচর্চার বিকাশের দর্শণের দিকে ভারতীয়
জ্ঞাণচর্চাকে সবলে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা শুরু হল বাঙলার নবজাগরণের
সময় থেকে।
সেই প্রচেষ্টা আরও বল পেল স্বাধীণতার পর। রেনেসাঁর জয়গানের মধ্যে দিয়ে শুরু হল প্রকৃতি ধংসকারী বেকনীত তত্বে শিল্প
বিপ্লবকে আপন করার ইতিহাস। অক্ষয় কুমারের
বেকনিয় মনোভাবের মানুষ তৈরির ডাকের উদ্দেশ্য তিনটি। প্রথমতঃ ভারতীয় অহিংস জ্ঞাণচর্চায় পশ্চিমি জ্ঞাণচর্চার
হিংসা-প্রযুক্তির অনুপ্রবেশ। দ্বিতীয়তঃ ভারতীয় জ্ঞাণচর্চার ইতিহাসের মূল উত্পাটন। তৃতীয়তঃ দুর্দম প্রকৃতিকে সবলে নিয়ন্ত্রণ করে প্রকৃতিকে
প্রাকৃতিক সম্পদ ছাপ্পাদিয়ে অবাধ লুন্ঠন।
ইয়ংবেঙ্গল আর তাঁদের গুরুঠাকুরদের উদ্যোগে ভারতীয়
জ্ঞাণবিজ্ঞাণচর্চায় পুর্ণচ্ছেদ পড়ল। মেকলের অশ্লীল
মিনিটে চুপ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর দেশের হাজার হাজার বছরের শিক্ষা পরিকাঠামো ভাঙলেন,
ন্যায় আর সাংখ্যকে মিথ্যা দর্শণ আখ্যা দিলেন, বললেন পশ্চিমি প্রযুক্তিই অভিষ্ট
লক্ষ্য। রামমোহন বললেন শাস্ত্র শেখা প্রচুর
হয়েছে, দেশ সংস্কৃত অনেক শিখেছে, এবার থেকে পশ্চিমি শিক্ষা আর প্রযুক্তি শেখার
পালা। প্রথম জীবনে জগদীশচন্দ্র বসু পশ্চিমি
বিজ্ঞাণচর্চায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। দেশিয়
ইংরেজদের বিরোধিতায় বিরক্ত হয়ে, তাদের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেন। ক্রমশঃ প্রায় সমস্ত কাজের আর্থিক সম্মতি তিনি আদায় করতেন বিদেশি বন্ধুদের
সাহায্যে। নানান তাত্বিক, বাস্তব ধাক্কায়
বেসামাল হতে হতে দেশজ জ্ঞাণের সঙ্গে পশ্চিমি জ্ঞাণচর্চাকে মেলাবার ভাবনা ভাবার
চেষ্টা করতে করতে শেষ বয়সে দেশজ বিজ্ঞাণ ভাবনায় আশ্রয় নিতে চাইছিলেন। তাঁর বাঙলা রচনাগুলি এই পরিবর্তনের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
জগদীশচন্দ্র, বোধহয়, শেষ বয়সে পশ্চিমি প্রযুক্তির
তথাকথিত অগ্রগতিতে আতঙ্কিত হয়ে রোডিও তরঙ্গের ভাবনাটিই ত্যাগ করেছিলেন। একজনও ছাত্র তৈরি করেননি, যিনি রোডিও তরঙ্গের আবিষ্কারকে এগিয়ে নিয়ে যেতে
পারেন(More importantly, he would perhaps have become an
Indian role-model for production of wealth through science - J.C.
BOSE: The Inventor Who Wouldn’t Patent - Prof Rajesh Kochhar, http://www.qsl.net/vu2msy/JCBOSE1.htm)। জগদীশচন্দ্রের দেশজ শিকড় বোঝার আরও
একটা দিক হল, তিনি একটাও আবিষ্কারকে কুক্ষিগত করেননি। সেই আবিস্কার পেটেন্টযোগ্য করে ধনী হতে চাননি। অথচ তাঁর সময়ের বহু আগেই বেকনিয়ান স্পিরিটের মানুষ চাইছেন অক্ষয় কুমার
দত্ত, যিনি প্রকৃতির বুক চিরে তৈরি করতে পারবেন অযুত সম্পদ। আশ্চর্যের বিষয় হল, সারা ভারতবর্ষ যাকে ত্যাগের মূর্তি হিসেবে আজও দেখতে
অভ্যস্ত, সেই সিস্টার নিবেদেতা, সারা বুলের সঙ্গে আমেরিকায় জগদীশচন্দ্রের বিশেষ এক
আবিষ্কার পেটেন্ট নিয়েছেন, অর্থও রোজগার করেছেন। কিন্তু সেই অর্থের অংশিদারি অস্বীকার করেন জগদীশচন্দ্র (Exasperated
by Bose's "quixotic" approach towards money, two of his lady friends,
British-born Margaret Noble (better known as Sister Nivedita) and American-born
Mrs Sara Bull on their own initiative obtained in 1904 an American patent in
Bose's name (for his " galena single contact-point receiver"). Bose,
however, remained unmoved and refused to encash the patent. The irony of the
situation seems to have gone unnoticed. Here in Nivedita we have a spiritualist
advocating the cause of patents and royalties and a physics professor
dismissing the idea. The reason must be sought in their backgrounds: Nivedita
was a product of industrial Europe while Bose was a child of the orientalised
East - সুত্রঃ - ঐ)।
রয়েল সোসাইটির হনুকরণে ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন অব
কাল্টিভেশন অব সায়েন্সএর প্রতিষ্ঠাতা মহেন্দ্রলাল সরকার। এই প্রথম বিদেশিয় প্রথায় সংঘ তৈরি করে দেশিয় বিজ্ঞান চর্চার পরম্পরাকে
মুছে ফেলার কাজের শুরু। এর অনেক আগে থেকেই ইওরোপে পশ্চিমি প্রযুক্তি
প্রকৃতি ধংসের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। ভারতে সে
উদ্যমের মুখড়া দেখা গিয়েছে দ্বারকানাথের খনি উদ্যমের মধ্যে। সমস্তটাই পশ্চিমের অনুকরণ। ইওরোপের জ্ঞাণচর্চার
ইতিহাসকে বিশ্বজ্ঞাণচর্চার ইতিহাসরূপে বৈধতা দিতে তৈরি করা সাম্রাজ্যের জ্ঞাণাঞ্জণ
লাঠ্যৌষধি প্রকল্প। ভারতে ধাতু বিদ্যা বহু প্রাচীন।
কিন্তু বিশ্বের সম্পদ লুঠ করে অযুত সম্পদ কিছু মানুষের কুক্ষিগত করানোর উদ্যমের
হাতিয়ার হয়ে উঠল পশ্চিমি প্রযুক্তি চর্চা। এই প্রকল্পেই সমাধি ঘটবে দেশজ
বিজ্ঞাণচর্চার দীর্ঘ ইতিহাসের ধারা। মার্ক্স-এঙ্গেলস
বলছেন ভারতের সভ্যতার তুলনায় পশ্চিম উন্নত ছিল তাই ভারতের ওপর ব্রিটেন রাজত্ব
করেছে। এতবড় অনৃতভাষণ ভারত আজও সেনামুখে
গিলেছে।
মহেন্দ্রলালই প্রথম যিনি হাতে কলমে দেশি বিজ্ঞাণকে
জলাঞ্জলি দিয়ে পশ্চিমের ইতিহাসকে বৈধতা দেওয়া শুরু করলেন। মহেন্দ্রলাল কালিকে নগ্ন সাঁওতালি রমণী বললেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সগর্বে সেই তথ্য উপন্যাসে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রকাশ করে
পশ্চিমধন্য হলেন। আজও বাঙলায় তাত্বিক নিরাপত্তার কাঁটাবেড়ার
সংরক্ষণ আর নিরাপত্তা পেয়ে আসছেন সাম্রাজ্যেরবন্ধু রামমোহন, দ্বারকানাথ,
বিদ্যাসাগর, মহেন্দ্রলালবেয়ে সুনীলও। দেশজ রসায়ণ
চর্চারপ্রতি নিবেদিতপ্রাণ প্রফুল্ল রায়মশাই শিল্পবিপ্লবের মহত বেকনিয় মনোভাবের স্বপ্নে
গড়ে তুললেন বিশালতম বেঙ্গল কেমিক্যাল(চরখার অন্যতম সমর্থক তিনি, শেষের দিকে তাকে
তাঁর কোম্পানি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়)। বহিরাঙ্গে
দেশজ কিন্তু অন্তরে পশ্চিমের শিল্পবিপ্লবের অনুকরণপ্রিয়তায় আত্মগর্বী। ১৯১৬তে জগদীশচন্দ্রের নাইটহুডের সম্বর্ধনায় রায়মশাই বললেন, If he had taken out patents for the apparatus and instruments which he
had invented, he could have made millions by their sale. (J.C. BOSE: The Inventor Who Wouldn’t Patent -Prof Rajesh Kochhar, http://www.qsl.net/vu2msy/JCBOSE1.htm)।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে ইংরেজি মাধ্যমে আর পদ্ধতিতে
শিক্ষাবিক্রি ব্যবস্থার বিরোধিতায় বাঙলায় বেশ কয়েকটি তত্ববোধিনী পাঠশালা তৈরি হল। প্রধাণ উদ্দেশ্য ইংরেজি ভাষাকে মাতৃভাষা(স্বাধীণতার পরও বাঙলার বহু
বিদ্যালয়ে ইংরেজিভাষা প্রথম ভাষা। ইংরেজির পায়ে
মাথাকোটার প্রবণতা ক্রমশঃ বর্ধমান) আর খ্রিস্টধর্মকে পৈতৃক ধর্মরূপে গ্রহণ করার
প্রবৃত্তি দমন। ইংরেজ প্রণোদিত ধর্ম-সংস্কৃতি
সংস্কারের আন্দোলন আন্দোলন খেলার মৌচাকে প্রথম ঢিল মারার চেষ্টা করল তত্ববোধিনী
সভা। কিন্তু রায়তদের মেরে ধণার্জন আর কলকাতায় ইঙ্গসমাজে
প্রতিপত্তি অর্জণের তাগিদে মেকলেপন্থী বাঙালি-ইংরেজরা এই বিদ্যালয়গুলি বর্জন করলেন। রায়ান আর বার্ডদেরমত ইংরেজ সাম্রাজ্যের প্রতিনিধিরা এই পদক্ষেপকে পরোক্ষে ধংস
করলেন। কেননা ইংরেজি পড়াশোনার সঙ্গে গাড়ি
ঘোড়া চড়ার সমীকরণ তৈরি হয়ে গিয়েছে কলকাতার সমাজে। শহুরে বাঙালিরা কী করে যেন সে তত্ব বুঝে ১৮০০র প্রথম থেকেই ইংরেজি শিখতে
শুরু করেছে। ...গাড়িঘোড়া চড়ে সেরমত
শ্লোক কাটাও শুরু হয়ে গেল পাড়ায় পাড়ায়। এখানে
পড়াশেনার অর্থ কিন্তু ইংরাজি মাধ্যমে, পদ্ধতিতে পড়াশোনা। তখন আর বুনো রামনাথ দেশের আইডল নন। দেশিয়
শিক্ষাপদ্ধতি, শুধু পড়াশোনা জানার সঙ্গে গাড়িঘোড়া চড়ার সমীকরণে বিশ্বাসী ছিল
না। ১৮৩৬এ উইলিয়াম এডাম বাঙলায় তিন দফার শিক্ষা সমীক্ষা
প্রকাশ করলেন। বাঙলা-বিহারে অন্ততঃ এক লাখের বেশি
পাঠশালার সন্ধান পেলেন। আগামীদেনের প্রায় প্রত্যেক প্রখ্যাত
শিক্ষাবিদ আর সমাজতাত্বিক এডামের শিক্ষা প্রতিবেদনকে একপ্রকার এড়িয়েই চলবেন। না হলে বাঙলায় বেন্টিঙ্ক-মেকলে-বিদ্যাসাগর প্রণোদিত ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানো
সরকারি নীতিকে সমর্থন করা যায় না। উইলিয়ম এডাম
পাঠশালাগুলি রেখে প্রচলিত দেশি ভাষা আর পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করতে সরকারকে সুপারিশ
করেছিলেন। এই পাঠশালাগুলো তুলেদিতে বিদ্যাসাগরের
ভূমিকা আজও চর্চা হয় নি।
একঝাঁক সমিতি – নিরাপদ শহুরে
বিদ্রোহ
১৮০৫এর ২ এপ্রিল বোর্ড আর রেভিনিউএর এক চিঠিতে দেখি জ্বলন্ত গ্রাম বাঙলার
প্রেক্ষাপটে, সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে নতুন জমিদারদের উত্তরাধিকারীদের উদ্যোগে তৈরি
হচ্ছে একঝাঁক সমিতি। ঐতিহাসিকেরা বলছেন এগুলো স্বাধীন মত
প্রকাশের সমিতি। বিনয় ঘোষের ভাষায় ম্যাঞ্চেস্টার
সমিতি তৈরির উদ্যম। তিনি এগুলোকে বলবেন মুক্তচিন্তার
ব্যামাগার। মুক্তচিন্তার অঘোষিত উদ্দেশ্য
গ্রামীণদের আন্দোলন থেকে মুখ ফিরিয়ে হিরন্ময়ী নিস্তব্ধতা পালন, ব্রিটিশ সভ্যতার মহিমা
প্রচার, ভারতের কুশ্রীতা গায়ন। সমিতিগুলোতে নানান
উচ্চপদস্থ আমলাদের উপস্থিতিতে নানান বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু হল। রিফর্মিস্টরা পাশ্চাত্যের ভাবনাগুলোকে নিজের ভাবনারূপে ভাবতে ভালবাসতেন। এই ভাবিয়ে তোলার উদ্যমটি সাম্রাজ্যের দাসত্ব প্রকল্পের অনুসারী আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ
প্রকল্প। এই উদ্যমকে বাঙলা রেনেসাঁর সুতিকাগাররূপে
স্ততিবাচনে ভরিয়ে দেওয়া হবে। বিনয় ঘোষ জানালেন,
বিলেতে রামমোহনের সঙ্গে সাক্ষাত করা ব্রিটিশ সোসালিস্ট শিল্পপতি রবার্ট
ওয়েন(ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকুরে, কালকাতার আলালি রিফর্মিস্টদের আর এক প্রখ্যাত
গুরুঠাকুর জেরিমি বেন্থামেরসঙ্গে দৈত্যসম কাপড়ের কলের ব্যবসার অংশিদার(The mills continued to have great commercial success, but some of Owen's
schemes involved considerable expense, which displeased his partners. Tired of
the restrictions imposed on him by men who wished to conduct the business on
the ordinary principles, in 1813 Owen arranged to have them bought out by new
found investors. These, including Jeremy
Bentham and a well-known Quaker, William
Allen, were content to accept just £5000 return on
their capital. http://en.wikipedia.org/wiki/Robert_Owen)। ব্রিটিশ প্রশাসকদের বিশিল্পায়ণের মার
বাঁচিয়ে হাতের তাঁতশিল্প যতটুকু বেঁচে ছিল, ভারতে তৈরি নতুন কলের কাপড়ের(মার্ক্সএর
ভাষায় মিলোক্রাসি) চাপে সেটুকুও লাটে উঠে যাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়) এবং
রসায়নবিদ ডালটন ম্যাঞ্চেস্টার সোসাইটির সদস্য ছিলেন। এর আদলে গড়ে উঠছিল সমিতিগুলো।
মুক্তবুদ্ধির সমিতিগুলি
বিচারক গুরু উইলিয়ম জোন্স প্রতিষ্ঠিত এশিয়াটিক সোসাইটি বাঙলার প্রথম মুক্তবুদ্ধির
সোসাইটি। বলছেন বাঙলার বামপন্থী ঐতিহাসিকরা। কতটা মুক্তবুদ্ধির! ১৭৮৪র ১৫ জানুয়ারির প্রথমতম সভাটিতে ইওরোপিয় সদস্যদের
জোন্সগুরু প্রশ্ন করলেন Whether you will enroll as members any number
of learned Natives you will hereafter decide। যে দেশটির উন্নতির জন্য মুক্তবুদ্ধির সোসাইটি গঠন করছেন, সেই সমিতিতে
বাঙলার এক জনও প্রতিনিধি রইলেন না। ১৮২৯এর ৭
জানুয়ারি সদস্য উইলসন এ দেশিয়দের কমিটিতে নেওয়ার জন্য প্রথম করুণাঘন প্রস্তাবটি
পেশ করলেন(এর আরও ২৫ বছর পর, আর এক ইয়ং বেঙ্গলি, রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র সোসাইটির
প্রথম ভারতীয় সভাপতি নির্বাচিত হবেন)। মেকলের ঘৃণাপূর্ণ
প্রস্তাবের বছর পাঁচেক আগেই শাসক ব্রিটিশ বুঝতে পারছে, ভারত সাম্রাজ্য রক্ষায়
দাসত্ব প্রকল্প প্রচার, প্রসার বড় হাতিয়ার। আর এই কাজে শহুরে
বাঙালিদের যোগ্য করে তোলা প্রয়োজন। ভারতীয়দের
সরকারি চাকরির যোগ্যতা মান হিসেবে কর্নওয়ালিস ঠিক করেলেন সেরেস্তাদারি(মন্মথনাথ
ঘোষ, রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় পুস্তকে লিখছেন, দক্ষিণারঞ্জনের পিতামহ
ভৈরবচন্দ্র ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হিজলী কাঁথির লবন-কুঠির সদর আমিন ছিলেন এবং
প্রভূত অর্থ ও সামাজিক প্রতিপত্তি অর্জ্জন করিয়াছিলেন।)। সেই প্রবণতাতেই হিন্দু কালেজের আগেই
ইংরেজি শেখার বহু বিদ্যালয়ও গড়ে উঠছে।
শহুরে বাঙালিদের উদ্যোগে প্রথম যে সোসাইটিটি গড়ে উঠল
তার নাম আত্মীয় সভা ১৮১৫ সালে। উদ্যোগ রামমোহন
রায়ের। প্রথমে রামমোহনের মানিকতলার বাটিটিতে,
পরে সিমলের প্রাসাদে মদ্যমাংস সহযোগে সভাগুলি শেষ হত। ধর্মসংস্কার আর গ্রামবাঙলা থেকে নজর ফেরানোর নামে ব্রিটিশরা যা যা করতে
চাইছে, তার সব কটির মহড়া আত্মীয় সভার ঔপনিবেশিক ধর্মপুত্ররা দিয়ে ফেলেছেন। ধর্ম সংস্কার, নিষিদ্ধ খাদ্যসমস্যা, বেদপাঠের অধিকার, পৌত্তলিকতার সমস্যা
ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে ব্যাপক ঝড়তোলা আলোচনা-সমালোচনা করতেন। কিন্তু গ্রামীণ স্বাধীণতা সংগ্রাম নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ তাঁদের ছিল এমন
একটিও দিগদর্শন বোধহয় পাওয়া যাবেনা সমিতির আলোচনাগুলির তালিকা থেকে। কেন! এই সমিতিটিতে সভ্য ছিলেন দর্পনারায়ণ ঠাকুরের পুত্র গোপীমোহন, তাঁর
পুত্র প্রসন্নকুমার, দ্বারকানাথ ঠাকুর, তেলিনীপাড়ার জমিদার অন্নদাপ্রসাদ
বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসুর পিতা নন্দকিশোর বসু, খিদিরপুরের ভূকৈলেসের জমিদার
গোকুল ঘোষালের উত্তরাধিকারী রাজা কালিশঙ্কর ঘোষাল ইত্যাদি। শুধু কালিশঙ্করই নয়, প্রায় সকল সদস্যই পারিবারিকভাবে কর্নওয়ালিসের নুন
খাওয়া প্রজা লুঠের অংশিদার জমিদার। স্বাধীণতা
সংগ্রামের পক্ষে দাঁড়াবেন কে!
এমত আত্মীয়সভা তৈরির আগেই রামমোহন ১৮০৩-৪এ লিখে
ফেলেছিলেন পৌত্তলিকতাবিরোধী গ্রন্থ তুহফাতুলমুহাহিদিন। ব্রিটিশ আমলে কলকাতায় ইংরেজি শিক্ষিত মহলে তিনিই প্রথম বেদান্ত চর্চার
উদ্গাতা। ১৮১৫তে প্রকাশ। তিনি সরাসরি কলমতুলে নিলেন পৌত্তলিকতাবাদীদের বিরুদ্ধে। অনেকেই কখন পশু পক্ষীকে কখন মৃত্তিকা
পাষাণ ইত্যাদিকে উপাস্য কল্পনা করিয়া ইহাতে মনকে কি বুদ্ধির দ্বারা বন্ধ করেন,
বোধগম্য করা যায় না এরূপ কল্পনা করিয়া কেবল অল্পকালের পরম্পরা দ্বারা এদেশে
প্রসিদ্ধ হইয়াছে। লোকেতে বেদান্ত শাস্ত্রের অপ্রাচুর্য
নিমিত্ত স্বার্থপর পন্ডিত সকলের বাক্য প্রবন্ধে এবং পূর্বশিক্ষা ও সংস্কারের বলতে
অনেক অনেক সুবোধ লোক এই কল্পনাতে মগ্ন আছেন ও নিমিত্ত এ অকিঞ্চন বেদান্ত শাস্ত্রের
ভাষাতে এক প্রকার যথা সাধ্য প্রকাশ করিলেক। রামমোহন তাঁর লেখায় সরাসরি নির্ভর করলেন জেসুইট
পাদ্রিদের ভণ্ড, স্বার্থপর পণ্ডিতদের কেন্দ্র করে ভারতীয় ধর্ম বিশ্লষণের
ভাষা। পদ্রিরা ভারতীয়দের ধর্মগুলোকে একদেহী
নাম দিয়েছিলেন হিন্দুধর্ম। তিনি তার
পুস্তকে নিজের দেশের সংস্কৃতি বর্ণনা আর বিশ্লেষণে পাদ্রিদের ভাষা ব্যবহার করলেন। এই বিশ্লেষণ তাকে ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবিদের কাছাকাছি টেনে আনে। সরাসরি সাম্রাজ্যের সঙ্গী হয়ে আত্মনিবেদনের পথে যেতে প্রণোদনা যোগায়। কয়েক দশক পরে কার্ল মার্ক্সও বলবেন ভারতীয়দের গাছ, সবলা গরু অথবা বাঁদর
পুজোর অনাচারের গল্প, মিথ্যা ধর্মের ঔপনিবেশিক তত্ব।
No comments:
Post a Comment