পাঠক ও পাঠিকাদিগের মধ্যে অনেকেরই
এরূপ সংস্কার আছে যে, মুসলমানদিগের রাজত্বকালে প্রজাগণের উপর ঘোরতর অত্যাচার
অনুষ্ঠিত হইত। আমরাও অস্বীকার করি না যে, মুসলমান
রাজাগণ অত্যন্ত অত্যাচারী ছিলেন। তাহাদের অত্যাচারে যে প্রজাদিগকে
উত্পীড়িত হইতে হইয়াছিল তাহতে কোনও সন্দেহ
নাই। কিন্তু তাহাদের অত্যাচারের মধ্যে
কোনও কৌশল পরিলক্ষিত হইত না। তাহাদের অত্যাচারে এক প্রকার
অসভ্যজনোচিত নিষ্ঠুরতা মাত্র। কৌশলপরিপূর্ণ প্রণালীবদ্ধ অত্যাচার,
পণ্যদ্রব্যের একাধিকার সংস্থাপনপূর্বক বাণিজ্যের মূলে কুঠারাঘাত প্রদান, নানাবিধ
চক্রান্তদ্বারা প্রাজাসাধারণের অর্থশোষণ ইত্যাদি কুপ্রথা দ্বারা মুসলমান রাজত্ব
কখনও কলঙ্কিত হয় নাই। তাহাদের অসভ্যজনোচেত কোপানলে পড়িয়া সময়ে সময়ে অনেকানেক দেশীয় ধনী ও
জমিদারদিগকে একেবারে বিনষ্ট হইতো হইয়াছে, জাতিভ্রষ্ট হইতে হইয়াছে। তাহাদের অদম্য ইন্দ্রিয়াসক্তি পরিতৃপ্তার্থ সময়ে সময়ে তাহারা কত কত
ভদ্রমহিলার প্রতি ঘোর নিষ্ঠুরাচরণ করিয়া স্বীয় হস্ত কলঙ্কিত করিয়াছে। কিন্তু অর্থহীন শ্রমেপজীবীদিগকে, দুর্বল বাণিজ্য ব্যবসায়ীদিগকে, তন্তুবায়
ও শিল্পিগণকে তাহাদের অত্যাচারের কথা তো দূরে থাকুক, অনেকানেক তন্তুবায় ও শিল্পিগণ
আপন আপন শিল্পনৈপুণ্যের পরিচয় প্রদান করিয়া সময়ে সময়ে পুরস্কারস্বরূপ লাখেরাজ ভূমি
প্রাপ্ত হইয়াছে।
কিন্তু পালাশীর
যুদ্ধের পর যখন বঙ্গদেশে ইংরেজ বণিকদের আধিপত্য সংস্থাপিত হইল, যে সময় হইতে
মুর্শিদাবাদের নবাব ইংরেজদের করতলস্থ হইয়া পড়িলেন, যখন কাপুরুষ মীরজাফর ইস্ট
ইন্ডিয়া কোম্পানির তত্সাময়িক অর্থলোভী কর্মচারীদের নিকট দাসখত দিয়া মুর্শিদাবাদের
সিংহাসনে অধিরূঢ় হইলেন, তখন হইতেই দেশীয় বাণিজ্যের মূলে কুঠারাঘাত পড়িল, নানানবিধ
পণ্যদ্রব্য সম্বন্ধে একচেটিয়া অধিকার সংস্থাপিত হইল, দিন দিন দেশীয় বণিকদিগের
প্রতি ঘোর অত্যাচার অনুষ্ঠিত হইতে লাগিল। তন্তুবায়
প্রভৃতি শিল্পিগণ ব্যবসা পরিত্যাগ পূর্বক আপন আপন গ্রাম ছাড়িয়া স্থানান্তরে পলায়ন
করিতে লাগিল।
ইস্ট ইন্ডিয়া
কোম্পানির কর্মচারীগণ সিরাজউদ্দৌলার সিংহাসনচ্যুতির সময় স্বপ্নেও মনে করেন নাই যে,
ভবিষ্যতে এই বিস্তীর্ণ ভারত সাম্রাজ্যের শাসনভার তাহাদের হস্তেই ন্যস্ত হইবে। সুতরাং পলাশীর যুদ্ধের পর মীরজাফর বঙ্গের সুবাদার হইলে, ইংরাজগণ তাহার
নিকট এই প্রস্তাব করিলেন যে, আপনি আমাদের বাণিজ্য-কুঠির সাহেব ও গোমস্তাদিগের
কাজকর্ম সম্বন্ধে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করিতে পারিবে না। কিন্তু অন্য কেহ তাহাদের উপর অত্যাচার করিতে আসিলে, আপনাকে তাহাদের সহায়তা
করিতে হইবে। কাপুরুষ মীরজাফর এই প্রস্তাবে সম্মত
হইলেন, ইংরেজদিগের বাণিজ্য-কুঠির সাহেব ও গোমস্তাগণ, তন্তুবায় প্রভৃতি দেশীয় সকল
শ্রেণীস্থ শিল্পিদের ঘোর অত্যাচার আরম্ভ করিল। বিশেষতঃ এই
সময়ে ইংলন্ডের ভদ্রবংশীয়গণ ভারতবর্ষে আসিতে সম্মত হইতেন না। ইংলন্ডীয় সমাজের যে সকল নীচাশয় অর্থলোলুপদিগের স্বদেশে অন্ন জুটিত না,
যাহারা সর্বপ্রকার কুকার্যানুষ্ঠানেই রত হইত, তাহারাই অর্থলোভে এদেশে আগমন করিত। এবং অর্থসঞ্চয়ার্থ কোন প্রকার কুকার্য করিতেও কুণ্ঠিত হইতনা। ইহারা তন্তুবায়দিগকে বলপূর্বক বাধ্য করিয়া দাদন দিত(অর্থাত্ অগ্রিম টাকা
প্রদান করিত)। তন্তুবায়দিগের অনিচ্ছা সত্বেও
তাহাদিগকে এরূপ টাকা গ্রহণ করিয়া, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্টসংখ্যক বস্ত্র
প্রস্তুত করিয়া দিবে বলিয়া মুচলেকা লিখিয়া দিতে হইত। কিন্তু সেই সকল বস্ত্রের মূল্য নিরূপণকালে ইংরাজগণ কিম্বা তাহাদগের কুঠির
গেমস্তাগণ যে বস্ত্রের প্রকৃত মূল্য একশত টাকা হইবে তাহার দাম পঞ্চাশ টাকার অধিক
দিতে সম্মত হইতেন না। নিরাশ্রয় তন্তুবায়দিগের এইরূপ
অত্যাচারের প্রতিকার পাইবার কোনও আশা
ছিলনা। দেশের নবাব মীরজাফর। তিনি ইংরাজগণের বাণিজ্য-কুঠির সাহেব ও গোমস্তাগণের কার্য-কর্মে কোনও
প্রকার হস্তক্ষেপ করিবেন না বলিয়া আঙ্গীকার করিয়াছেন, সুতরাং তন্তচুবায়গণ নির্বাক
হইয়া এই অত্যাচার সহ্য করিতে লাগিল। এই সময়ে কাশিমবাজারে ফরাসী, ওলান্দাজ
ও আরমানিয়ানদিগেরও রেশম কুঠি ছিল। পূর্বে তন্তুবায়গণ তাহাদের নিকটও
বস্ত্র বিক্রয় করিত। কিন্তু এখন ইংরেজগণ তন্তুবায়দিগকে
ফরাসী কিম্বা ওলান্দাজদিগের নিকট বস্ত্র বিক্রয় করিতে নিষেধ করিলেন, কেন ব্যক্তি
ইংরেজদের নিষেধ অমান্য করিয়া ফরাসী কিম্বা ওলান্দাজদিগের নিকট বস্ত্র বিক্রয় করিলে
ইংরেজদিগের ফ্যক্টরি সাহেব ও গোমস্তাগণ তাহার প্রতি গুরুতর দণ্ডবিধান করিতেন। কখন কখন লুট করিতেন, কখন কখন তাহাদের স্ত্রীলোকদিগকেও অপমান করিতেন। এইরূপে অনেকানেক তাঁতিকে জাতি
ভ্রষ্ট হইতে হইল, তখন তাহারা অনন্যেপায় হইয়া মস্তক মুন্ডনপূর্বক বৈরাগী হইতে লাগিল
এবং তন্তুবায়ের ব্যবসা একেবারে পরিত্যাগ করিল।(চন্ডীচরণ সেন - নন্দকুমার ও শতবত্সর পূর্বের বঙ্গ সমাজ)।
বাঙলাদেশের তন্তুবায়েরা ছিলেন অত্যন্ত পরিশ্রমী, নিপুণ
আর বংশ পরম্পরায় এক সুদীর্ঘ ঐতিহ্যের এবং প্রযুক্তির উত্তরাধিকারী। শুধু সামাজিক নিরাপত্তায় আর নিজেদের ওপর আস্থায় দীর্ঘকাল ধরে এক
ঐতিহ্যশালী বঙ্গ পরম্পরার সূচনা করেন। একদিকে দেশের
চাহিদাহীন (পশ্চিমি ভাযার গরীব জনগণ) কোটি কোটি জনসাধারণের জন্যেও যেমন, তেমনি
দেশের অপচয়মূলক সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত, অথচ উচ্চদামে খরিদকরতে পারা উচ্চরাজকর্মচারী
অথবা শাসন কর্তাদের জন্যও তৈরি করতেন। রাধাকমল
মুখোপাধ্যায় ইকোনমিক হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া,
১৬০০-১৮০০ পুস্তকে বলছেন, অষ্টাদশ শতাব্দে বাঙলায় কম করে দশ লক্ষ
তন্তুবায় বস্ত্র উত্পাদনে নিযুক্ত ছিলেন।
১৭৫৭ সালের পর থেকে ইংরেজ ব্যবসায়ীদের মদতে দাদনি
বণিকদের রমরমা বাড়তে থাকে। আগেই আমরা
দেখেছি মুঘল আমলে রাজ কর্মচারীদের ব্যক্তিগতভাবে ব্যবসা করার অনুমতি দেওয়া হত না,
অন্ততঃ বাঙলার শাসকেরা শিল্পীদের নিজেদের ব্যবসা করতে অথবা ভারতের নানান প্রান্তের
পারম্পরিক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ব্যবসা করতে সরাসরি মদত দিতেন এবং শিল্পীদের জীবন
থেকে দাদনি বণিকদের প্রভাব অনেকাংশে কমিয়ে রাখতে পেরেছিলেন এই তথ্য ইতিহাস সমর্থন
করে। নবাবি আমলে তন্তুবায়দের ওপর গোমস্তাদের অত্যাচার
নবাবের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং নবাব এই গেমস্তাদের কঠোর হাতে দমন করার নির্দেশ দেন। একটি বিষয় পরিস্কার বাঙলা সুবাসহ পূর্ব থেকে উত্তরভারত, এই সমগ্র ভূভাগে
যে শিল্পীদের শিল্পকৃতির সমারোহ সরা বিশ্বজুড়ে ব্যাপ্ত হয়েছিল, তার ইতিহাস শুধু
বাঙলা অথবা সেই অঞ্চলেই নেই, সারা বিশ্বের নানান কথায় তার উল্লেখ পাওয়া যায়। এবং সমধিক কৃতিত্ব যদি শিল্পীসমাজ দাবি করে তাহলে মুঘল সম্রাটদেরও এই
শিল্প আর ব্যবসার পরিকাঠামো তৈরির বিষয়েও কিছুটা হলেও দাদ দিতে হবে। সমাজের গণতান্ত্রিকতাকে বজায় রেখার সঙ্গে সঙ্গে কড়া শাসন ব্যবস্থায়
মধ্যসত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণের রাখার একটা চেষ্টা ছিল মোঘল আমলে, ফলে দেশিয়
শিল্পীদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য আর একই সঙ্গে সুদূর অতীত থেকে প্রবাহিত সামাজিক নিরাপত্তাবোধটিও
কোনও ভাবেই ব্যাহত হয় নি, এ কথা স্পষ্ট করে আজ বলা প্রয়োজন রয়েছে। সমন্ততান্ত্রিক বেড়াজাল, গ্রাম্য মূঢ়তা আর জমিদারি শোযণের দোহাই দিয়ে
যাঁরা বাঙলায় ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থার পরোক্ষে জয়গান গাইছেন, আদতে তাঁরা সামগ্রিকভাবেই
ইওরোপিয় ঔপনিবেশিক শক্তির হাতের খেলার পুতলমাত্র।
ইংরেজ আমলে মধ্যস্বত্বভোগী গোমস্তাদের রমরমার যুগ শুরু
হল। এতদিন যারা সমাজের চাপে মাথা নামিয়েছিল তাদের রমরমার
যুগ শুরু হল ইংরেজদের আমলে, যারা পরে ইংরেজ সঙ্গ করে সমাজের নবজাগরণের মর্যাদা
অর্জন করবে। ইংরেজরা বাঙলা লুঠতে যতদূর সম্ভব
মধ্যসত্বভোগীদের সংখ্যা বাড়িয়ে সাধারণের ওপর অত্যাচারের আর লুন্ঠনের মাত্রা
চরমসীমায় নিয়ে যায়। এই মধ্যসত্বভোগীদের মধ্যে ইংরেজদের
অন্যতম প্রধান হাতিয়ার ছিল গোমস্তারা। গোমস্তারা
ইংরেজ বণিকদের হয়ে নির্দিষ্ট পরিমান দাদন দিয়ে নির্দিষ্ট পরিমান বস্ত্রের জন্য
চুক্তি করত। কেনার সময় এই চুক্তি লঙ্ঘন করে
অত্যধিক অল্প দামে সেই নির্দষ্ট দাদনি বস্ত্র কেনার জন্য অসম্ভব অত্যাচার নামিয়ে
আনত। উইলিয়ম বোল্ট, সমকালীন সময়ে ১৭৬০ সাল নাগাদ, ডাচ
এডভেঞ্চারার্স নামে খ্যাত ছিলেন। বাঙলার বড়লাট
ভেরলেস্ট এবং তাঁর অনুগামীদের ব্যাক্তিগাত ব্যবসার বিরুদ্ধে কলম ধরায় তাঁকে ভারত
থেকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি কনসিডারেশন অব ইন্ডিয়ান
এফেয়ার্স লেখেন। প্রকাশিত হয় ১৭৭৭এ ইংলন্ডে। এই পুস্তকটি নানান তথ্যসহকারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের একচেটিয়া লুঠ
আর কুকর্ম ফাঁস করে দেয়। সুপ্রকাশ রায়এর অনুবাদে এই পুস্তকের
নির্দিষ্ট কিছু তথ্য তুলেদেওয়া গেল-
দরিদ্র কারিগর
ও শ্রমিকগণের উপর কল্পনাতীত লাঞ্ছনা ও অত্যাচার অনুষ্ঠিত হইয়াছে। তাহাদের কার্যত কোম্পানির একচেটিয়া ক্রিতদাসে পরিণত করা হইয়াছে। দরিদ্র তন্তুবায়গণের শোষণ-উত্পীড়নের বিভিন্ন প্রকার ও অসংখ্য পদ্ধতি
উদ্ভাবিত হইয়াছে এবং উহার প্রত্যেকটি কোম্পানির দালাল(বেনিয়ান) ও গোমস্তাগনের
দ্বারা তন্তুবায়গনের উপর প্রয়োগ করা হইয়া থাকে। শোষণ-উত্পীড়নের সেই সকল পদ্ধতির মধ্যে কয়েকটি
হইল- জরিমানা, কারাগারে আটক, চাবুক দ্বারা প্রহার, বলপূর্বক মুচলেকা আদায় প্রভৃতি। ইহার ফলে কারিগরের সংখ্যা যথেষ্ট হ্রাস পাইতেছে...
বঙ্গদেশের
সমস্ত আভ্যন্তরিক ব্যবসা-বাণিজ্যই ধারাবাহিক উত্পীড়নের ক্ষেত্রে পরিণত হইয়াছে এবং
বস্ত্র কারিগরগণ ইহার মারাত্মক ফলাফল অত্যন্ত তীব্রভাবে অনুভব করিতেছে। দেশের প্রত্যেকটি দ্রব্যই কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসায়ের শিকারে পরিণত
হইয়াছে এবং ইংরেজগণই তাহাদের বেনিয়ান(দেশিয় দালাল) ও গোমস্তা নামক অতি নিকৃষ্ট
জীবগুলির মার্ফত নিজেদের সুবিধামত স্থির করিয়া দিতেছে প্রতেযেক কারিগর কী পরিমান
দ্রব্য প্রস্তুত করিবে এবং উহার জন্য তাহাকে কি মূল্য দেওয়া হইবে।
এক বিরাট সংখ্যক
কারিগরের নাম কোম্পানির গোমস্তাদের হিসাববহিতে তালিকাভুক্ত থাকে। এই কারিগরদিগের অন্য কেনো স্থানে স্বাধীণভাবে কাজ করিতে দেওয়া হয় না। এক গোমস্তার অধীনস্থ কারিগরকে ক্রীতদাসেরমত অন্য গোমস্তার অধীনে
স্থানান্তরিত করা হইয়া থাকে। ইহার উপর গোমস্তাদের অত্যাচার নিরবিচ্ছিন্ন
ভাবেই চলিতে থাকে। বস্ত্র প্রস্তুত হইলে তা কারিগরের
নামাঙ্কিত করিয়া গুদামে তুলিয়া রাখা হয়। গেমস্তাগণ
অবসরমত প্রতি বস্ত্রখন্ডের উপর নিজের ইচ্ছামত মূল্য ধার্য করে। গুদামে যে প্রতারণা আর ধাপ্পাবাজি চলে তহা কল্পনাতীত। তাহার একমাত্র উদ্দেশ্য হইল দরিদ্র কারিগরদের বঞ্চিত করা, কারন গোমস্তাগন
বস্ত্রের যে মূল্য ধার্য করে তাহা বাজার দর অপেক্ষা শতকরা অন্ততঃ পনের টাকা কম,
এমনকী কোন কোন ক্ষেত্রে তাহা শতকরা চল্লিশ টাকা কম হইয়া থাকে। এই জন্য কারিগরগণ সকল সময়ে ন্যাহ্য মূল্য পাইবার জন্য তাহাদের বস্ত্র
গোপনে অন্যের নিকট, বিশেষতঃ ওলান্দাজ ও ফরাসী বণিকগণের নিকট বিক্রয় করিবার চেষ্টা
করে। কারণ তাহারা ন্যাহ্য মূল্যে ক্রয়
করিবার জন্য সকল সময়েই প্রস্তুত। এই গোপন বিক্রয় বন্ধ করার জন্য
কোম্পানির ধূর্ত গোমস্তাগণ কারিগরদের উপর চৌকিদার নিযুক্ত করে এবং প্রায়শঃই বস্ত্র
প্রস্তুত হইতে না হইতেই উহা তাঁত হইতে কাটিয়া লয়। ...তন্তুবায়গণও কোম্পানির মুচলেকা
নামক বলপ্রয়োগে স্বাক্ষরিত চুক্তি মানিয়া চলিতে অপারগ হইয়া (গেমস্তা ও
চৌকিদারগনের) বস্ত্র বলপূর্বক কাড়িয়া লইয়া তাহাদের ক্ষতিপূরণের জন্য ঘটনাস্থনেই
বিক্রয় করিয়া দেয়।
পার্লামেন্টের সিলেক্ট কমিটির নিকট সাক্ষ্যদানের সময়
টমাস মুনরোও কেম্পানির ছলেবলে তন্তুবায়দের সঙ্গে ব্যবসা করার নীতি বুঝিয়ে বলেন। তিনি জানান যতক্ষণ না কোনও তন্তুবায় শুধুই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া
কেম্পানিকেই তাঁতজাত বস্ত্র সরবরাহ করতেবন এই মুচলেকা লিখিয়ে নিতে না পারছে,
ততক্ষণ তাকে কারাগারে বন্দী করে রাখা হত। ততক্ষণই তাদের
বেত্রাঘাত করা হত। যে চৌকিদারেরা তাঁত চলার সময় বেত
মারার কাজ করত তাদের মাইনেও তাঁতিদের বহন করতে হত। তিনি প্রমাণ দিয়ে জানান একটি গ্রামের সব তন্তুবায়দের ক্রীতদাস করে নেওয়া
হয়। এরপর ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে তন্তুবায়দের মাজা ভেঙে যায়। এদের একটি বড় অংশ নিজেদের কাজ থেকে উচ্ছেদ হয়ে, বিদ্রোহী সন্ন্যাসীদের
সঙ্গে যোগদান করে, পরে শুধুই চাষবাসে সময় অতিবাহিত করতে থাকে।
বাঙালি শহুরে উচ্চবর্ণ বিভিন্ন কাজে ইংরেজদের সহায়তা
পেয়ে, সহায়তা করে কল্পিত নিরাপত্তার জন্য কলকাতায় এসে বাস করত। তন্তুবায়দেরও ইংরেজরা একইভাবে কলকাতার কাছে এনে বসাবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু হাড়ে হাড়ে ইংরেজদের চিনতে পারা তন্তুবায়েরা ইংরেজ এবং তাদের
বশংবদ গেমস্তা বেনিয়ানদের এই চাল ধরে ফেলে। উইলিয়ম বোল্ট
বলছেন, ইংরেজ বণিকদের শোষণ-উত্পীড়ণে উত্যক্ত হয়ে মালদহের জঙ্গলবাড়ির সাতশ
তন্তুবায় পরিবার বাস্তু ত্যাগ করে অন্যত্র গিয়ে বসবাস করতে থাকে, তবুও কলকাতায়
আসেনি। ইংরেজদের গোমস্তা, তাগাদ্গার,
চৌকিদারদের অত্যাচারের বিরোধিতায় তন্তুবায়দেরসঙ্গে কাটুনি, তুলাচাষীদের স্বাধীণতা
সংগ্রাম আরম্ভ হয়। সন্ন্যাসী বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে
এদের একটি অংশ সশস্ত্র স্বাধীণতা সংগ্রামের অংশ হয়ে পড়েন, আর এক অংশ সংঘবদ্ধভাবে
প্রতিরোধ, অসহযোগ, ধর্মঘট প্রভৃতি নানান প্রকার বীরত্বপূর্ণ আন্দোলন নিয়মিত সংগঠিত
করতে থাকেন। এই আন্দোলন কখোনো স্থানীয়স্তরে, কখনো
স্থানীয় এলাকা ছাড়িয়ে বিহারেও ছড়িয়ে পড়েছিল।
শান্তিপুরের সংগ্রামে তন্তুবায়েরা সরাসরি ব্রিটিশ
রাজশক্তির বিরোধিতা করে অসহযোগিতা করতে থাকেন। স্থানীয় কনট্রাক্টর ব্ল্যাকোয়ার কোম্পানিকে তার প্রতিবেদনে জানাচ্ছেন,
তন্তুবায়েরা নানান আছিলায় কোম্পানির সঙ্গে দাদন নিয়ে সম্পাদিত চুক্তি এড়িয়ে গিয়ে,
যারা কোম্পানির থেকে দাদন নেয় না তাদের বিক্রি করছে। নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ বলছেন শান্তিপুরের তন্তুবায়দের সংগ্রাম এতই তীব্র হয়ে
ওঠে যে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ তাদের থেকে বস্ত্র আদায় তরতে না পেরে মজুরি বৃদ্ধির
সুপারিশ করছেন। ১৭৮৮র বোর্ড অব ট্রেডএর এক
সমীক্ষায় প্রকাশ পাওয়া এক ছত্র তুলে দেওয়া গেল, তাহারা শঙ্খধ্বনী শুনে একটি পূর্ব নির্দিষ্ট স্থানে জমায়েত হত এবং নিজেদের
মধ্যে অভাব অভিযোগ সম্বন্ধে নানান আলেচনা করত। এই বিক্ষোভ
বহুদূরের আড়ং পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে এবং সকলে ইংরেজ কোম্পানির জন্য নির্দিষ্ট
বস্ত্র উত্পাদন বন্ধ করে দেন। জোরজুলুম করে শান্তিপুরের
তন্তুবায়দের কবলে আনতে না পেরে কোম্পানি কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ দেন যে, এদের
বিরুদ্ধে বিদেশিরা রয়েছে এবং একমাত্র এদের স্বাধীণতা সংগ্রামের নেতৃত্বকে গ্রেফতার
করে, তাদের কাজে তদারককারী নেতৃত্ব দেন। এদের প্রধান লেতৃত্বের
নজনকে গ্রেফতার করা হয়। এদের ছয়জনকে শর্তাধীনে ছেড়েদেওয়া
হলেও তিনজনকে আরও বহুদিনের জন্য খিদিরপুরের কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়।(সুপ্রকাশ রায় – ভারতের স্বাধীণতা সংগ্রাম ও কৃষক বিদ্রোহ)
ঢাকার তিতাবাড়ি
অঞ্চলে বোষ্টম দাসের যোগ্য নেতৃত্বে ইংরেজরা ভয়পেয়ে কুঠিতে আটক করে রেখে তাকে
অত্যাচার করে খুন করে। এরপর তিতাবাড়ির দুনিরাম পালের
নেতৃত্বে আন্দোলনকারীদের স্বাধীণতা সংগ্রাম এতই তীব্র আকার ধারণ করে যে, বেআইনি
আটক, দৈহিক অত্যাচার, জোরকরে সই করিয়ে নেওয়া প্রভৃতি যথেষ্ট কমে যায়। হরিপালের নয়ন নন্দী, শান্তিপুরের বিজরাম এবং তার পর লোচন দালাল, রাম হরি
দালাল, কৃষ্ণচন্দ্র বড়াল, রামরাম দাসের নেতৃত্ব দিয়ে পায়ে হেঁটে কলকাতা এসে
কর্তৃপক্ষকে প্রতিবাদ পত্র দিয়ে অত্যাচারের প্রতিকার দাবি করেন। কুমারখালির বলাই, দুনি, ফকিরচাঁদ তন্তুবায়দের যোগ্যতম নেতৃত্ব দেন।
১৭৯৩এর বোর্ড অব ট্রেডকে ঢাকার কমার্সিয়াল
রেসিডেন্ট জন টেলর লেখেন, ঢাকার তন্তুবায়েরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে জিনিষপত্রের
মূল্য বৃদ্বি পাওয়ায় আগেসম্পাদিত চুক্তি অনুসারে বস্ত্র সরবরাহ করা অসম্ভব। কমার্সিয়াল রেসিডেন্ট মূল্যবৃদ্ধির দাবি অস্বীকার করলে তন্তুবায়েরা নতুন
ধরনের এক নাশকতামূলক কাজ করতে শুরু করেন। তারা দামি
সুতোর বদলে কমদামি সুতো ব্যবহার করে বস্ত্র বুনে সেই বোনা বস্ত্র কোম্পানিকে
সরবরাহ করে নিজেদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করে। ১৭৯৪তে সোনামুখীর কমার্সিয়াল রেসিডেন্ট জন চিপ বোর্ড অব ট্রেডকে
লেখা এক চিঠিতে জানান, পুরোনো তন্তুবায় দের সঙ্গে অনেক নতুন তন্তুবায় এসে দাদন
নিয়ে যায়। এর আগে নতুনেরা কোনও দিন দাদন গ্রহণ
করেন নি। হঠাতই একদল ব্যবসায়ী অঞ্চলে এসে
উপস্থিত হন। এদের উপস্থিতিতে দাদন নেওয়া
পুরোনো-নতুন সকলেই হঠাত অদৃশ্য হয়ে যান। পরে জানা যায়
এরা কোম্পানির কাজ ছেড়ে নতুন ব্যবসায়ীর কাজ করছেন। এই বয়কটের ফলে কোম্পনির স্থানীয় কর্তারা ক্ষিপ্ত হয়ে সোনামুখীর
তন্তুবায়দের মুচলেকা লিথিয়ে নিতে অত্যাচার শুরু করেন। তাদের চিঠির বয়ান অনুযায়ী বাঁকুড়ার পটেশ্বরেও একই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এরপর তন্তুবায়দের ভয় দেখানোর জন্য তন্তুবায়দের কোম্পানিক কাজ থেকে বরখাস্ত
করা শুরু করলে সকলেই স্বেচ্ছায় বরখাস্ত হতে চায়। তারা শুধু নিজেরাই কোম্পানির কাজ ছেড়ে যায়নি, অন্য এলাকার তন্তুবায়দেরও
এই কাজ করতে প্রভাবিত করে। তিনি জানান
বীরভূমের সুরুলে ব্রিটিশদের চিরকালীন ভাগকরার নীতি প্রয়োগ করে সুফল পেলেও
বাঁকুড়াতে এর কোনও প্রভাব পড়ে নি। এরা ষড়যন্ত্র করে অস্বাভাবিকভাবে সমবেত হয়ে রয়েছে।
জন চিপ আরও একটি চিঠিতে লেখেন, কাটোয়ার সোনারুন্দি
গ্রামে তন্তুবায়, কারিগরদের ওপর ইজারাদার মন্ডলদের প্রভাব অপরিসীম। তাদের কাজই হল কোম্পানি আর তন্তুবায়দের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করা। এদের প্রভাব প্রতিপত্তি এতই বেশি যে, তাঁর পক্ষেও নানান বিভেদমূলক নীতি
নিয়েও তাদের মধ্যে প্রভেদ আনা যায়নি। তিনি আরও
বলছেন, এই আড়ংএ আগের কমিশনাররা এত বেশি অত্যাচার করেছে যে এখানে আর পুরোনে
তন্তুবায় আর নেই বললেই চলে। কোম্পানির
অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তন্তুবায়রা নতুন প্রজন্মকে আর তাঁতের কাজে আনছেন না। তারা চাষ করে সুখী আছে। হরিপালের
দ্বারহাট্টা কেন্দ্রের তন্তুবায়েরা কোম্পানিকে জানান তারা আর কোম্পানির জন্য
বস্ত্র বয়ন করবেন না। রেসিডেন্ট কমিশনার বহু চেষ্টা করেও
সেই ঐক্য ভাঙতে পারে নি।
অথচ তন্তুবায়েরা দেশব্যাপী সশস্ত্র এবং নিয়মমাফিক
আন্দেলন করেও তাদের ধংস কার্ষ এড়াতে পারে নি। দেশিয় দালালদের সহায়তায় বাঙলার অবাধ লুন্ঠনের ফলে
ক্রমশঃ ব্রিটেন তাদের দেশের শিল্প পরিকাঠামেকে গড়িপিটে নিতে থাকে, এবং এদেশের ধংস
হয়ে যাওয়া শিল্পের পরিকাঠামোর ওপর আর লুঠ হয়ে যাওয়া কাঁচা মালের ওপর গড়ে ওঠে
ল্যাঙ্কাশায়ারএর বিশাল বাষ্পচালিত বস্ত্র শিল্প, যাদের অতিরিক্ত উতপাদন কমদামে
ছেয়ে ফেলে ভারতের বাজার। বিশ্ব বাজার থেকে
ক্রমশঃ নিশ্চিহ্ন হয়ে যান বাঙলার শিল্পী তন্তুবায়েরা। যাদের দীর্ঘশ্বাস এখোনো শোনা যায় বাঙলার আকাশে বাতাসে।
No comments:
Post a Comment