নীলকর দ্বারকানাথ
সে যুগের যুগধর্ম মেনেই নীলকর দ্বারকানাথ বেলগাছিয়ার প্রাসাদটিকে ব্যবসাগুলোর
সঙ্গে ইংরেজ সাম্রাজ্যের জনসংযোগ কর্মকান্ডের অন্যতম ভিত্তিরূপে গড়ে তুলেছিলেন। জমিদারিতে তিনি নীলের এবং রেশম চাষ ও উতপাদন করাতেন, মদ তৈরি ও ফেরি করতেন। কার টোগোর কোম্পানি শুরু করার বহু আগে দ্বারকানাথ পাবনার শিলাইদহে ১৮২১
সালে প্রথম নীলের কুঠি স্থাপন করেন। বিরাহিমপুর
কুঠি থেকে প্রথমে, সরকারের দাবিমত অর্থ না দিতে পারলেও কড়া জমিদার দ্বারকানাথ,
ইওরোপিয়দের জমিদারি পরিচালনে রেখে পরেরদিকে ভাল লাভ ঘরে তোলেন। প্রমোদ সেনগুপ্ত নীলস্বাধীণতা সংগ্রামতে স্পষ্টস্বরে বলছেন কৃষকের নিকট নীলের চাষ যত বেশী ক্ষতিকর হত,
নীলকরের পক্ষে তা ততটাই লাভজনক হত। ঠাকুর পরিবারের কোনও ব্যক্তির
সম্বন্ধেই কোনও পারিপার্শ্বিক প্রমাণদ্বারা প্রমাণিত কোনও কিছুই বলা নিষেধ এবং
এঁদের জীবনীকারেরা নানান গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উল্লেখ করা থেকে যত্নসহকারে পিছিয়ে
গিয়েছেন। এরসঙ্গে মনেরাখা দরকার বাঙালির ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ দ্বারকানাথ সম্বন্ধে উদাসীন
ছিলেন।
দ্বারকানাথ নীলকর ছিলেন। কড়া হাতেই জমিদারি চালাতেন এ তথ্য দ্বারকানাথের জীবনীকার ব্লেয়ার বি
ক্লিং জানিয়েছেন। রাবীন্দ্রিক বাঙালি না চাইলেও এ তথ্য
লুকিয়ে রাখা যাবে না। আজ আমাদের খুঁজে বেরকরতেই হবে, যে সব
অঞ্চলে রবিঠাকুরের ঠাকুর্দা কড়া হাতে জমিদারি চালাতেন, সেখানের রায়তদের অবস্থা কী
ছিল। যদিও সে তথ্য খুঁজে বেরকরা এই পুস্তকের উদ্দেশ্য নয়,
তবুও বাঙলায় অত্যাচরিত রায়তদের কথা বলতে আমাদের এ তথ্য উদ্ধার করা ভীষণ জরুরি। কয়েকস্তবক আগেই আমরা দেখেছি জমিদার গোলকনাথ রায় অথবা প্যারীসুন্দরী কিন্তু
নীলকর সাহেবের বিরুদ্ধে প্রজাদের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁধে কাঁধ রেখে লড়াই করেছেন। বাঙলায় একটা বড় অংশের জমিদার নীলকর ছিলেন না। তাঁদের অনেকেই কিন্তু স্বাভিমানবশে প্রজাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। দ্বারকানাথের তেমন কিছু কী খুঁজে পাওয়া যাবে! পেলে বাঙালি যে একটু শান্তি
খুঁজে পায়। যতই হোক দ্বারকানাথ, রবীন্দ্রনাথের
ঠাকুর্দা।
যে সাতটি নীলের কুঠি সে এলাকায় ছিল, তার মধ্যে পাঁচটিই
পাবনা-নদিয়া-বিরহিমপুর-সাহাজাদপুর জমিদারির মধ্যে পড়ত- শিলাইদহ, রায়নগর, মীরপুর,
ডোব্রাকোল, এবং সমিধপুর(comidpore), অন্যদুটি
মুর্শিদাবাদের বড় জঙ্গিপুর আর ছোট জঙ্গিপুরের জমিদারিতে, যেখানে তিনি রেশমও
উতপাদন করতেন। প্রফেশনাল জমিদার দ্বারকানাথ, রায়তি ব্যবস্থায় নীলচাষ
করলেও তার পিঠে নীলকর ছাপ বসেনি। প্রত্যক বছর
১৬০০মন নীল উতপাদন করতেন দ্বারকানাথের নীলকুঠি। কলকাতায় এই বিশাল পরিমান নীল বিক্রি করতেন প্রত্যেক বছর দুই লক্ষ টাকায়। তিনি তাঁর সময়ে অন্ততঃ বাঙলায় সব থেকে বড় নীল চাষী হিসেবে পরিগণিত হতেন। এছাড়াও তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ পদ্ধতিতে পরিশুদ্ধ চিনি তৈরি করতে ব্যর্থ
হলেও, চিনি তৈরির অন্যপিঠ, রায়নগরে একটি রাম উতপাদন কারখানা তৈরি করেন। মীরপুরের রাম লন্ডন প্রুফ ছাপ
পেলে লন্ডনে রওনা হতে পারত রপ্তানি শুল্ক না দিয়েও। আর এই ছাড় না পেলে সেটি দেশি মদ রূপে প্রতি গ্যালন আট আনায় কলকাতার
ট্যাভার্নগুলোতে বিক্রি হত। দ্বারকানাথ
প্রত্যেক বছর ৫০০০গ্যালন রাম উতপাদন করতেন আর সেটি কলকাতার বাজারে বারো আনা থেকে
একটাকায় বিক্রি হত।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্বর্ধনা
১৮৪৩এ ইংলন্ড থেকে নানান দেশের মহিলাদের নিয়ে নানান মুখরোচক স্কান্ডাল ধারণ
করে ভারতে ফিরে এলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ অবতাররূপে। ১০মে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাঁকে সোনার মেডেল দিয়ে সম্বর্ধনা জানানোর
উদ্যোগ নেয়। ডেপুটি গভর্নর উইলিয়ম উইলবারফোর্স
বার্ড তাঁকে এই সম্মানটি দিয়ে বললেন, exhorted my Native Friends
who are looking for high situation to profit by (Dwarakanath’s)
example to disply in the first instance the same zeal, ability, energy, and
perseverance… and then they may rest assured that they will not fail in
obtaining such advancement and such rewards as may be justly due to their
merits and services. উত্তরে দ্বারকানাথ বললেন, the prize less a
compliment to myself, than…a pledge conveyed through me to the Natives of
India, that their happiness and elevation are objects dear to their
rulers(Calcutta Star, 11th May). এই অনুষ্ঠানে বার্ড বললেন দ্বারকানাথ
তাঁর অতীতের কাজ কর্মের জন্য এই পুস্কারটি অর্জন করলেন, আর দ্বারকানাথ জানালেন
ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে মিলে ভারতের জনগণের উন্নতির জন্য তিনি তাঁর উদ্যম বিনিয়োগ
করবেন।
বৌবাজারে ৪৩টি ঘরের বেশ্যাখানার মালিক দ্বারকানাথ
Attachment
of Stigma in Sex Workers’ Milieu (Family & Community): A Hindrance of
Psychosocial Development of Their Children গবেষক Harasankar
Adhikari বলছেন, The 1806 Census Report of Calcutta noted that a brothel in holding number
235 & 236 in Bowbazar Street was being operated by a
member of Prince Dwarakanath Tagore’s family. It had 43 rooms for the sex workers who came from different parts of Bengal and belonged to the depressed classes. The females worked as servants during their
twilight years along with other activities to support
themselves (Mukherjee 1977, 71)। নবজাগরণের কী
মহিমা।
অহিফেন ঠাকুর
কুড়ি বছর বয়সে ঠাকুরবাড়ির প্রখ্যাততম পুরুষ
রবীন্দ্রনাথ ১২৮৮র জৈষ্ঠ সংখ্যার ভারতীতে, জার্মান প্রবন্ধের ইংরেজি অনুবাদ
অবলম্বন করে বাঙলায় একটি প্রবন্ধ লেখেন- ভারতবর্ষীয় রাজস্বের অধিকাংশ এই অহিফেন
বাণিজ্য হইতে উত্পন্ন হয়। কিন্তু
অহিফেনের ন্যায় ক্ষতিবৃদ্ধিশীল বাণিজ্যের উপর ভারতবর্ষের রাজস্ব অথ অধিক পরিমানে
নির্ভর করাকে সকলেই ভয়ের কারণ বলিয়া মনে করিতেছেন। ১৮৭১-৭২ খ্রিস্টাব্দে এই বাণিজ্য হইতে সাড়ে সাতকোটি পাউন্ডের অধিক রাজস্ব
আদায় হইয়াছিল। কিন্তু কয়েক বতসরের মধ্যে তাহা ৫
কোটি ৩ লক্ষ পাউন্ডে নামিয়া আসে। এরূপ রাজস্বের
উপর নির্ভর করা অত্যন্ত আশঙ্কার কারণ। ভারতবর্ষীয় অহিফেন নিকৃষ্ট হইয়া আসিতেছে, সুতরাং তার দাম কমিবার কথা। তাহা ভিন্ন চীনে ক্রমশঃই অহিফেন চাষ বাড়িতেছে।চীনে স্থানে স্থানে অহিফেন-সেবন-নিবারক সভা বসিয়াছে। ...এইরূপে চীনে অহিফেনের চাষ এত বাড়িতে পারে, ও অহিফেন সেবন কমিতে পারে
যে, সহসা ভারতবর্ষীয় রাজস্বের হানি হইবার সম্ভাবনা। ... সমস্ত ভারতবর্ষে দেড় কোটি একর উর্বরতম জমি অহিফেনের জন্য নিযুক্ত আছে। পূর্বে সে সকল জমিতে শস্য ও ইক্ষু চাষ হইত। এক বাঙলা দেশে আধ কোটি একরেরও অধিক জমি অহিফেন চাষের জন্য নিযুক্ত। ১৮৭৭-৭৮এর দুর্ভিক্ষে বাঙলার প্রায় এক কোটি লোক মরে। আধ কোটি উর্বর ভূমিতে এক কোটি লোকের খাদ্য জোগাইতে পারে। ১৮৭১ খৃস্টাব্দে জাক্তার উইলসন পার্লিয়ামেন্টে জানাইয়াছেন, মালোয়াতে
অহিফেনের চাষে অন্যান্য চাষের এত ক্ষতি হইয়াছিল যে, নিকটবর্তী রাজপুতানা দেশে ১২
লক্ষ লোক না খাইয়া মরে। রাজপুতানায় ১২
লক্ষ লোক মরিল তাহাতে তেমন ক্ষতি বিবেচনা করি না সে তো ক্ষণস্থায়ী ক্ষতি। এই অহিফেনে রাজপুতানার চিরস্থায়ী সর্বনাশের সূত্রপাত হইয়াছে। সমস্ত রাজপুতানা আজ অহিফেন খাইয়া আত্মহত্যা করিতে বসিয়াছে। অত বড় বীর জাতি আজ অকর্মণ্য, অলস, নির্জীব, নিরুদ্যম হইয়া ঝিমাইতেছে। আধুনিক রাজপুতানা নিদ্রার রাজ্য ও প্রাচীণ রাসজপুতানা স্বপ্নের রাজ্য হইয়া
দাঁড়াইয়াছে। অতবড় জাতি অসার হইয়া যাইতেছে। কী দুঃখ! আসামে যেরূপে অহিফেন প্রবেশ করিয়াছে, তাহাতে আসামের অতিশয় হানি
হইতেছে। বাণিজ্য-তত্বাবধায়ক ব্রুস সাহেব
বলেন, অহিফেন সেবনরূপ ভীষণ মড়ক আসামের সুন্দর রাজ্য জনশূন্য ও বন্য জন্তুর বাসভূমি
করিয়া তুলিয়াছে এবং আসামীদের মতো অমন ভালো একটি জাতিকে ভারতবর্ষের মধ্যে
সর্বাপেক্ষা অধম, দাসবত্ এবং নীতিভ্রষ্ট করিয়া তুলিয়াছে। অহিফেন বাণিজ্য আমাদের ভারতবর্ষের তো এই সকল উপকার করিয়াছে। কথিত যৌবনে বাপঠাকুর্দার ওপর রাগ করে প্রথমে
দেবেন্দ্রনাথ আর পরে রবীন্দ্রানাথ দুজনেই দ্বারকানাথের বহু কাজগপত্র পুড়িয়ে
দিয়েছেন। ফলে দ্বারকানাথকে নতুন করে উপস্থিত
করার অন্য উপায়ও আজ আর নেই। রবীন্দ্রনাথ
দ্বারকানাথের গুরু রামমোহনের স্মৃতি তর্পণ করলেও জ্ঞাণতঃ দ্বারকানাথের উপাসনা করেন
নি। এমনই ছিল তাঁর ঠাকুর্দার প্রতি রবীন্দ্রবিতৃষ্ণা।
তিনি হয়ত জানতেন দ্বারকানাথ ছটি ক্লিপারের একটি বড়
অংশিদারি অর্জন করেছিলেন। এরমধ্যে প্রধাণতমটি
ছিল ৩৬৩টনের ওটারউইচ। খিদিরপুর ডকে
পরিকল্পনা করে বানানো। এটির অর্ধেক অংশিদারি
ছিল তাঁর আর অর্ধেক ছিল দুই ইংরেজ উইলিয়ম স্টর্ম আর এন্ড্রু হেন্ডারসনের। এটি কলকাতায় তৈরি তৃতীয় ক্লিপার। এর আগে যে দুটি তৈরি হয়েছে হাওড়া ডকে সে দুটি হল বম্বের
আফিমব্যবসায়ীগুরু রুস্তমজী কাওয়াসজীর জন্য ১৮২৯এর রেড রোভার আর ১৮৩১এর সিল্ফ। সেই শতকের ত্রিশের দশকে চিনে অবৈধ আফিম চালানের পরিমান
প্রায় তিনগুন হয়ে যায় এই ক্লিপারের দ্রুত পরিবহনক্ষমতায়। এবং উত্তর-পূর্ব বাতাস বয়ে ক্লিপারগুলি শীতেই যখন চিনে
পৌঁছত সেখানে আফিমের দাম থাকত চড়া। এবং ক্লিপারের অনেকবেশি বোঝা নেওয়ার ক্ষমতার জন্যও আফিম
ব্যবসায়ীদের কাছে ক্লিপার প্রধাণ পরিবহন হয়ে ওঠে। দ্বারকানাথের আরও দুটি আফিম ক্লিপার ছিল ৩৭১ টনের ১৮৩৭
সালে খিদিরপুরে তৈরি এরিয়েল এবং ১১২ টনের মাভিজ। এরিয়েল চিনে আফিম ব্যবসা করতে গিয়ে কমিশনার লিনএর হাতে
ধরা পড়ে। একইসঙ্গে মনেরাখতে হবে দ্বারকানাথের ব্যবসাগুলির মধ্যে
আফিম ব্যবসার পরিমান বেশ কম ছিল।
No comments:
Post a Comment