পলাশির পর সোজা বাঁকা দুই পথে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সিন্দুকে যে টাকা ঢুকল,
হিসেব করে দেখা গেল তা দিয়ে ভারতে ব্যবসার তিন বছরের ইনভেস্টমেন্টএর অর্থ উঠে এসেছে। তখন থেকে কোম্পানি এ দেশে রূপো আনা বন্ধ করে দিল। দেওয়ানির সনদ অধিকারের পর এই ব্যবস্থা পাকাপাকি হয়ে উঠল। তখন কোম্পানি চিনের সঙ্গে সবে ব্যবসা শুরু করেছে। চিন থেকে ইংলন্ডে চা আমদানি করত। ইংলন্ডে চায়ের
বাজার তখন চাঙ্গা বললে কম বলা হয়। ফলে রূপো দিয়েই
কোম্পানিকে সেই চা কিনতে হত। এখন বাঙলায়
রূপো আনা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, কোম্পানির তখন উদ্দেশ্য হল চিনেও রূপো পাঠানো বন্ধ করতে
হবে। তৈরি হল কোম্পানি ষড়যন্ত্র।
বাঙলার রাজস্ব হাতে পাওয়ার পর ইংলন্ড বাঙলা আর চিনের
মধ্যে সে এমন এক বাণিজ্য ত্রিভূজ গড়ে তুলতে শুরু করল, যাতে বিনিয়োগ না করেই লন্ডনে,
চিন থেকে চা আমদানি বজায় থাকে। ক্যান্টনে
বাঙলা থেকে পাঠানো আফিম(পরে মালওয়া আফিমও যোগ হবে) বাণিজ্য(আদতে চোরাচালান)কে তুঙ্গে
নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা হল। বাঙলা থেকে প্রায়
বিনামূল্য লুঠকরা সুতির কাপড় আর আফিম চিনে রপ্তানি হল। চোরাবাণিজ্যের রসায়নে, বাঙলা-বিহারের চাষীর ঘর থেকে লুঠ করা সরকারি আফিমের
মাদক এককোটিরও বেশি চিনের রক্তে ঢুকে পড়ল। বাঙলা-চিনের
আফিমের ব্যবসা শুরু হল। ক্রমশঃ চিন থেকে আফিম ব্যবসার
উদ্বৃত্তে অর্থাত চিনের অর্থেই বহুমূল্য চা-রেশম-পোর্সেলিন ব্রিটেন নিয়ে যেতে শুরু
করল কোম্পানি। এশিয়া লুঠসম্পদ ব্রিটেনে নিয়ে যাওয়ার
সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটেন থেকে দামি ধাতু এশিয়ায় আসা বন্ধ হয়ে গেল। এশিয়ায় ব্যবসা করতে আর রূপো আনারও আর প্রয়োজন হল না, বিনিয়োগ করারও
প্রয়োজন হল না। এশিয়ার অর্থেই এশিয়ার দ্রব্য কিনে দেশগুলোর
সম্পদ চক্রবৃদ্ধিহাতে বাড়তে শুরু করল ইওরোপ। এশিয়ার সম্পদ লুঠের সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার বছরের বিকশিত শিল্প পরিকাঠামো
ভেঙে দিয়ে পাইকারি বাজারও দখলকরল ব্রিটেন। এশিয়া-ইওরোপের
বাণিজ্য সম্পর্ক হেঁটমুন্ডঊর্ধপদ হল। অন্ততঃ দুহাজার
বছর ধরে এশিয়ার প্রযুক্তি, শিল্প দ্রব্যের বাজার ছিল ইওরোপ। পলাশির ৩০ বছরের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতির ইতিহাস পাল্টে গেল। এশিয়া অধমর্ণ হল আর ইওরোপ হল উত্তমর্ণ।
সনাতন বাঙলায় বৈদ্যদের রোগ সারানোয় আফিমের ভূমিকা
অবসংবাদী ছিল। বিভিন্ন ব্যথায়, বার্ধক্যজনিত রোগে
আফিমের প্রয়োগ ছিল সর্বজনবিদিত। ভারতের নানান
প্রান্তে কৃষকেরা আফিমের চাষ করত সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থেকে। ব্যবসায়ীরা কৃষকদের থেকে পরিশুদ্ধ আফিম বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করতেন। কিন্তু ইংরেজরাই প্রথম ব্যাপকভাবে আফিমকে ব্যবহার করতে শুরু করলেন মাদক
হিসেবে, শুধুই লাভের উদ্দেশ্যে। তারজন্য গোটা
একটা দেশকে মাদকাসক্ত করতেও সভ্যতার বিবেকে বাধেনি। এই পুস্তকে ইংরেজদের আর বাঙালি-পার্সি ইংরেজ বন্ধুদের আফিম ব্যবসায় নিয়ে বহু
কিছু আলোচনা হয়েছে। এই অমানবিক ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে
ছিলেন দ্বারকানাথেরমত বাঙলার নানান স্বনামধন্য জগতখ্যাত ব্যক্তিত্ব, আজকের
মুম্বইএর গোড়া পত্তন করেছিলেন এমন কিছু মানুষ যারা আজ ভারতের ব্যবসা জগতে নিজস্ব
আলোয় ভাস্বর। তাঁদের শুরু কেমন হয়েছে তা আমাদের
যেমন জানতে হবে, তেমনি যাঁরা বাঙলার একদা জনজাগৃতি এনেছেন বলে আজও খ্যাত, তারাও
শুধু বাঙলার চাষীদের পীড়ন করেই ধনী হয়েই খান্ত থাকেন নি, তাদের একটা বড় অংশ
ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চিনে আফিম রপ্তানি করেছেন স্ব-ইচ্ছায়, দুদুটো যুদ্ধ
বাধিয়েছেন, চিনের জনগণকে আফিম খাইয়ে ইওরোপকে ধনী করার চক্রান্তে, আর সেই বাণিজ্য
থেকে উদ্বৃত্তের খুদকুঁড়ো নিজেদের সিন্দুকে ভরার স্বার্থে।
অস্বস্তিকর এই কথাগুলি আজ একমাত্র বাঙালিদের কম্বু
কণ্ঠেই বলতে হবে, নিজেরদের আত্মশুদ্ধি আর বিগত আড়াইশ বছরের গ্রামীণ বাঙলা ধংস
প্রকল্পে সামিল হওয়ার তাড়নার জবাবদিহিতে। ব্রিটিশদের
অত্যাচারে বাঙলার খুন হয়ে যাওয়া কোটি কোটি বাঙলার হতভাগ্য খেটে খাওয়া জনগণ আজ জবাব
চায়, সেই সময়ের শহুরে ধনী বাঙলা-বাঙালি উত্তরাধিকারীদের কাছে, যারা ব্রিটিশের
অত্যাচারের পাশে দাঁড়িয়ে, বাঙলার রক্তে সরাসরি হাত রাঙিয়ে আফিম, নুন আর আফিম ব্যবসা
এবং নীল চাষ করে ধণ উপার্জণ করেছেন। হাজার হাজার
বছর ধরে গড়ে তোলা বাঙলার শিল্প-কারখানা আর সামাজিক ব্যবসা পরিকাঠামোকে ধংস
করেছেন, সমাজ সংস্কারের নামে। সোসাল রিফর্ম
ছিল সে যুগের অত্যন্ত আদরনীয় শব্দবন্ধগুলির মধ্যে অন্যতম। কোম্পানির শাসনকালে, বানিয়া ব্রিটিশদের এবং ব্রিটিশপদপ্রান্তে প্রণত শহুরে
বাঙালিদের অমিত ধণার্জণ এবং বিত্তবাসনা, ইংরেজদের বাঙলার শিল্প ধংসকরণ প্রকল্পে
স্ব-ইচ্ছায় অংশগ্রহণ, এই ধংসযজ্ঞকে আরও ত্বরান্বিত করে।
এই ধংসযজ্ঞের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গ্রামীণ বাঙলা বুক চিতিয়ে
লড়াই দিয়েছে আগ্রাসী ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে। শহুরে বাঙলার সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্রিটিশ প্রসাদপুষ্ট জনসাধারণ একবারও স্বাধীণতা
সংগ্রামীদের পাশে এসে দাঁড়াবার কথা ভাবেননি। ধংস হয়ে যাওয়া এইসব শিল্প-ব্যবসা-সামাজিক রীতিনীতিগুলি ভিত্তি করে বেঁচে
থাকা লাখো লাখো স্বাধীণতা সংগ্রামী শ্রমিক-শিল্পী, তাদের পরিবার এবং এই কাজের ওপর
নির্ভর করে পরোক্ষে জীবিকা নির্বাহ করা হাজারও মানুষ খুন হলেন, জীবিকা থেকে উচ্ছেদ
হলেন, শিল্পী থেকে পথের ভিখারি হলেন, আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে আমনাগরিকে
রূপান্তরিত হলেন। ভারতের শিল্প পরিকাঠামো ধংস করে,
ইংলন্ডে শিল্প পরিকাঠামো গড়তে, এই শিল্পীদের জীবনে, নতুন নতুন ধরনের অমিত-পাশবিক
অত্যাচার নামিয়ে এনে গ্রামীণ স্বাধীণতা সংগ্রামীদের জীবিকা থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে
সরাসরি, যে কাজে সর্বান্তকরণে সমর্থন দিয়েছেন বাঙলার শহুরে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত
সাম্রাজ্যের বন্ধুরা। ব্রিটিশদের অমানুষিক অত্যাচারে,
কখোনো শহুরে বাঙালির ঔদাসিন্যে, কখোনোবা তাদের প্রত্যক্ষ মদতে, কোটি কোটি সাধারণ
মরে হেজে যাওয়া গ্রামীণ বাঙালি, যারা জানল না কি দোষে তাদের খুন হতে হল অথবা
ছেলেমেয়েবউনিয়ে রাস্তায় দাঁড়াতে হল, অথবা খেতমজুরি করে খেতে হল। আজ তারা জবাব চায় বাঙলার নবজাগরণের গুরুঠাকুরদের
উত্তরাধিকার যাঁরা বহন করছেন সেই উজ্জ্বল ইংরেজি শিক্ষিত মানুষদের থেকে।
উত্তমর্ণ অর্থনীতির উদ্বৃত্ত শিল্পোন্নত দেশ থেকে অধমর্ণ
বাঙলাকে, ইওরোপের সংস্কৃতি-অর্থনীতির ওপর সরাসরি নির্ভরশীল দেশে পরিণত করার জন্য
বাঙলার চিরাচরিত শিল্পী-কারিগরেরা শহুরে বাঙালিদের কাছে জবাব চায়।
জবাব চায় ভারতীয় সমবায়ী সমাজের হাজার হাজার
কৃষক-শিল্পী-মজুর, যারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে স্বাধীণতা সংগ্রামের ঝান্ডা
তুলে, ব্রিটিশ তোপেরমুখে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছেন, রাইফেলের বেয়নেটের আঘাত
খেয়েও লুঠ হয়ে যাওয়া সমাজমাতৃকার সম্মান রক্ষায় ব্যক্তিগত লাভলোকসানের সমঝোতার
হিসেবের কড়ির কথা বিন্দুমাত্র চিন্তা করেননি, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সেনা-পুলিশের
অত্যাচারে খুন হয়েছেন, অথচ মাথা বিকিয়ে দেননি বিদেশি লুঠেরা সাম্রাজ্যের শক্তির
পায়ে। তারা সাম্রাজ্যের বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে চায়, কী
তাদের দোষ, কার দোষে তিল তিল করে গড়ে তোলা দেশটির হাঁড়ির হাল হল। শহুরে বাঙালিরা চিনকে আফিম মাদকে মত্ত করার ইংরেজ প্রকল্পে সামিল হয়েছিলেন কেন সেই স্পর্ধিত প্রশ্ন তারা করতে চাইছে আজ।
শহুরে বাঙালিদের পূর্বজরা, নিজেদের এবং পরিবারে সম্পদ বাড়াবার জন্য, সমাজে আরও একটু প্রতিপত্তি বৃদ্ধির জন্য, ব্রিটিশদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছেন, সেই কর্মকে প্রত্যেক বাঙালির প্রশ্ন করা প্রয়োজন।
আজও বাঙলার খ্যাতিমানেরা ব্রিটিশ প্রণোদিত বাঙলা ধংস প্রকল্পের সফল কৃতকর্মের জন্য বাঙলা তথা ভারতে পুজ্য, প্রণম্য এবং আদরনীয়, অথচ বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গিয়েছেন বাঙলার বিদ্রোহী আদিবাসী আর লৌকিক সমাজ। স্বাধীণতা সংগ্রামী বাঙলা আজ জবাব চায়। সব হারানোর হিসেব নিকেষ করতে চায়।
No comments:
Post a Comment