ঋতুপর্ন ঘোষের অকাল মৃত্যু শহুরে উচ্চ-মধ্যবিত্ত সমাজকে
নাড়িয়েছে। ঋতু নিজের সৃষ্টিকে উৎসর্গ করে ছিলেন পশ্চিমি ভাবনায়(যাকে অনপনেয়
বাঙালিত্ব বলে চালান হচ্ছে) ভাবিত চোস্ত ব্রিটিশ কায়দায় ইংরেজি বলা(সত্যজিত
ফেলুদার জবানীতে লালমোহনবাবুর ইংরেজি জানাকে যেমন মস্করা করে খোঁটা দেন, আর তোপসে ফেলুদার ব্রিটিশ কেতায় চোস্ত ইংরেজি বলায় মুগ্ধ। এখনও কলকাতায় ইংরেজি না জানা,
না বলতে পারা মানুষজনকে অশিক্ষিত বলা হয়) শহুরে মেকলে পুত্র কন্যাদের তৈরি সংস্কৃতি বিকাশের
কাজে, কিন্তু নিজের মত করে। রাজেন-মৃণাল-সত্যজিত-ঋত্বিক-গৌতম-অপর্ণা হয়ে মধ্যবিত্ত
বর্ণিত পরিশীলিত, বুদ্ধিদীপ্ত, মূল্যবোধযুক্ত, বিশ্ব ধারার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা
চলচ্চিত্র তৈরির ঘরানাটা শুকিয়ে যেতে যেতে ঋতুর আলোছায়া কারুসাজির কল্যাণে শহরের
মধ্যবিত্তের মননে আবার ঘাঁটি গড়তে শুরু করল, উঠে এলেন আরও এক ঝাঁক নতুন পরিচালক।
এই উচ্চ-মধ্যবিত্তভিত্তিক সংস্কৃতিটির
ভিত্তিভূমি দুশ বছর আগে, ১৮০০ আশেপাশে থেকে উপনিবেশের মদতে ইওরোপমুগ্ধ রামমোহন,
বিদ্যাসাগর, দ্বারকানাথের হাত ধরে মেকলেদের নির্দেশনায় শুরু হয়েছিল। এই মহাতেজেরা
বাংলার স্বাধীনতার জন্য লড়াই(১৭৬৩ থেকে ফকির-সান্ন্যাসী স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু) করা গ্রামীণদের অজ্ঞ, মূর্খ, জ্ঞানহীন, বোধহীন ইত্যাদি বিশেষণে লাঞ্ছিত করেছিলেন। বামপন্থী আন্দোলনের সুত্রে গ্রামীণদের পিঠে দাগানো এই
সুভাষিতগুলোর সঙ্গে জুড়ল সবলা গরুপুজক, হনুমান পুজক, গাছ পুজক, সামন্ততন্ত্রে গলাপর্যন্ত ডুবে থাকা,
ইতিহাসহীন, মুখাবয়বহীন, দারিদ্রের করাল গ্রাসে লাঞ্ছিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের বিশেষণসহ নানান বাছা বাছা মধ্যবিত্তিয় অভিধা। বললেন গ্রামীণদের অশিক্ষিতের পটুত্ব এবং অর্ধদক্ষতা প্রমাণিত। পশ্চিমের তৈরি নব্য জ্ঞানচর্চা সমাজতত্ত্বে,
মধ্যবিত্ত নিজেকে ত্রিভুজ সমাজের মাঝখানে বসিয়ে, উচ্চবিত্তকে সেই ত্রিভুজের মাথায়
বসাল। অন্য সক্কলকে প্রান্তিক, মূর্খ, গরীব, দলিত, সংখালঘু ইত্যাদি দেগে দিয়ে পেল
উচ্চবিত্তের- এক) পিঠচাপড়ানি, চাকরি, ব্যাবসার অংশিদারি, উমদোরির দায়ভাগ, আর দুই) চুঁইয়ে
পড়া লুঠ সম্পদের ছিটেফোঁটা।
ঠিক সেই ধারার উত্তরাধিকারে ভারতে গ্রাম-সংস্কৃতিকে করুনার
দৃষ্টিতে দেখা(আজও ভারতীয় মধ্যবিত্তের সিনেমার অন্যতম দিকফলক মৃগয়ায় ছো নাচে মাদল বাজার শব্দ হয়। থাকে না বিন্দুমাত্র ছো নাচের শাস্ত্রীয়তার ব্যাকরন। মৃগয়ার আলোচনায়, এতদিন এই তুচ্ছ দেশী বিষয়ে বিন্দুমাত্র অস্বস্তি প্রকাশ করা হয় না।
সমালচকেরা এগুলো সোনামুখে গিলে ফেলেন(জনেন কি?)। মনের মানুষ নিয়ে যত কম কথা বলা যায় তত ভাল) মধ্যবিত্তকেন্দ্রিক সিনেমা সংস্কৃতির, পথ চলা শুরু হল
স্বাধীনতার পরপর। মধ্যবিত্তরা যেহেতু উচ্চবিত্তদের সম্পদ বাড়ানোর কাজটির প্রধান
পরিচালক এবং বুদ্ধিদাতা, ক্রমশঃ নতুন ছবি করিয়েরা উচ্চবিত্ত, ক্ষমতার কেন্দ্রে,
সরকারে থাকা মানুষদের বোঝাতে সমর্থ হলেন এই সিনেমাগুলিকে পৃষ্ঠপোষণ জরুরি, তাতে
ইয়োরোপে দেশের মান বাড়ে(দেশে কি হল, সিনেমা চলল কিনা, এ সব ভাবনা গুলিমারুন)। সরকারি মদতদান শুরু হল। যেখানে সরকার সাহায্য করতে পারছে না,
বড়ও পুঁজি এগোচ্ছে না, সেখানে মধ্যবত্ত উদ্ধারে এগিয়ে এল ইওরোপীয় সিনেমা সংগঠকরা। ভারতের ছবিগুলো
বিদেশে পিঠ চাপড়ানি, পুরস্কার, এমনকি অর্থ সাহায্য পেল। এমনকি মুলধারার সিনেমা সম্মান, অস্কারও উপহার স্বরূপ দেওয়া হতে শুরু হল।
বিপরীতে এদের ঘরানার বাইরে যত সিনেমা
সেগুলো সব যাত্রা, লাউড, মেলোড্রামাটিক, গাদ্গ্যাদে, মাঠ পেরোনো ইত্যাদি ছাপ
পেয়েছে। নব্বইয়ের পর মধ্যবিত্তিয় পিঠচাপড়ানি সিনেমায় ভাঁটার টানকে উপেক্ষা করে সোনার
আংটি থেকে চিত্রাঙ্গদা সিনেমাযাত্রায় ঋতু নতুন করে নানান ধরণের মধ্যবিত্তকে হলমুখী
করাতে পেরেছিলেন। তিনি খুঁজে নিচ্ছিলেন নতুন ভাষা। তাঁর সিনেমা ক্রমশঃ শহুরে মধ্যবিত্তর
নানান স্তরের নানান খাঁজ খুঁজে পেল। মধ্যবিত্ত সমাজের স্তরগুলোর নানান সমস্যা,
ব্যথা বেদনা এই প্রথম ঋতুর হাতযশে মুখ খোলার সুযোগ পেল। ভারতের সত্যজিত ঘরানার
চলচ্চিত্রের যৌন সংস্করনের উত্তরাধিকারী হিসেবে তিনি সেই কাজে পুরোপুরি সফল তাঁর
উদাহরণ, মৃত্যুর পর তাঁর বাড়ির সামনে মানুষের ঢল, ১২টি জাতীয় পুরস্কার, এবং বড়
পুঁজি নিয়ন্ত্রিত প্রচারমাধ্যমগুলোতে নিরন্তর সাধুধ্বনি।
চলচ্চিত্র ছাড়াও তাঁর নানান কাজের আলোচনা,
বিশেষ করে, যৌনতার ভাবনা অথবা তাঁর লিঙ্গ পরিবর্তনের উদগ্র প্রচেষ্টা(আমাদের ধারনা
তাঁর মৃত্যুর বড় কারনও বটে), তৃতীয় লিঙ্গের সাম্যের আন্দোলনে জড়িয়ে থাকার চেষ্টা বড়
প্রচারমাধ্যমগুলোয় এসেছে, সরাসরি নয়, নারীত্বের জয়গানের টিকা হিসেবে। যে মানুষটি
১৮৩৬এ ভারতের প্রথম দণ্ডসংহিতা রচনা করে সমযৌনতার আশেপাশে থাকা নানান সমাজকে
নিষিদ্ধ করবেন, সেই মেকলের সন্তান সন্ততিদের কাছে সংস্কৃতির প্রকাশভঙ্গিতে যৌনতার
ব্যাবহার আজও অনেকটা নিষিদ্ধ এলাকা। ঋতু শহুরে বাংলার আকাশ বাতাসে সেটিকে অনেকটা
জলচল করার চেষ্টা করেছিলেন, নিজগুণে। শুধু ঋতুর যৌনতার ধারনাই নয় - অস্বস্তির
সমকামিতা, বৃহন্নলা ইস্যু, বাস বদলেরমত হাজারও শহুরে মেকলে ঘরানার
উচ্চ-মধ্যবিত্তের চৌহদ্দিতে সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ বিষয়গুলি, স্বস্তির মোড়কে যতটা
চিনির সিরা দিয়ে গ্রহণযোগ্য করে উচ্চ-মধ্যবিত্ত সমাজে বাংলা ভাষায় খাওয়ানো যায়,
তার প্রচেষ্টা চলেছে সংবাদ মাধ্যমগুলোতে। ফলে পুরুষ দেহে নারীত্বের অস্তিত্ব অথবা নারীতে
পুরুষ অথবা সমাজে সমকামিতা অথবা বৃহন্নলাদের সামাজিক অধিকার ইত্যাদি বিষয়গুলো হঠাৎই
যেন কলকাতার নাগরিক রাষ্ট্রিক জ্ঞানচর্চার অস্বস্তির অঙ্গ হয়ে ওঠে। সেই অস্বস্তি
ঢাকতে বিশ্বায়নের যুগের প্রেসিডেন্সিয় বা বালিগঞ্জীয় বাংলিশ চক্করবক্কর পুঁটুলি
ভাষায় ঋতুর নানান ধরণের যৌনতার যাপন, তাঁর যৌনতার সাংস্কৃতিক প্রকাশভঙ্গী এড়িয়ে
যেতে, তাঁর কাজে কতটা তিনি নারীত্বের জয়গান গেয়েছিলেন, সেই সাধুবাদে শ্রদ্ধা
জ্ঞাপন আলোচনার মধুর সমাপ্তি ঘটে, বন্ধুদের চোখের জলের বাধ্যতামূলক সেন্সরশিপ
আরোপে। চিত্রাঙ্গদা শুধুই উঠে আসে একটা ব্যাতিক্রমী উদ্যমের টিকাসূত্র হিসেবে।
ব্যাস।
নবদ্বীপ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লিখতে গিয়ে,
পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি বইতে বিনয় ঘোষ, সুনীতি চাটুজ্যের এক লেখা তুলে লিখছেন, রাধা
সেজে যখন একটি পুরুষ উদ্দাম নৃত্য করছিলেন তখন সুনীতিবাবুর জুগুপ্সা হচ্ছিল।
শিল্পবিপ্লবোত্তর বড় পুরুষতান্ত্রিক পুঁজি, পুরুষত্ববলে বিশ্বের সব সম্পদ লুঠের
রাজনীতি অনুসরন করছিল। ভারতে মেকলের ইংরেজি শিক্ষিত সন্তান-সন্ততিরা পুরুষত্বের
স্পর্ধা বন্দিত পথকেই(সম্প্রতি এক মধ্যবিত্তিয় চলচ্চিত্র স্রষ্টার জৈবনিক সিনেমার
বিজ্ঞাপনের এক স্তবক – তুমি গেছ, স্পর্ধা গেছে, বিনয় এসেছে – পুরুষতন্ত্রের প্রবল
নির্ঘোষ, আদতে শক্তি চ্যাটুজ্জের এক পদ্যর স্তবক) সংস্কৃতি বিকাশের পথ হিসেবে দেখেছেন। সুনীতি কুমার থেকে বিনয় ঘোষ হয়ে, শক্তি বেয়ে, সত্যজিত আজও বাংলার পৌরুষ সংস্কৃতির মুখ। সেই বৃত্তে থেকেও ব্যাতিক্রম, ঋতু।
বাংলা-ভারতের গ্রাম সমাজ যেন ভরপুর নারীত্ব।
তাই আট হাজার বছর ধরে এই সমাজ মায়ের মমত্বে হাজারও উদ্ভিদ আর প্রাণীকে কোল
দিয়েছেন, নিজের মত করে বাঁচার সুযোগ করে দিয়েছেন, কোনও কিছু চাপিয়ে না দিয়ে। ঋতু
নিজের মত করে সেই নারীত্বের মমতার, ছাঁচে ঢালা শিল্পবিপ্লবীয় পুরুষতান্ত্রিকতার
বাইরে বেরিয়ে এসে, বুঝতে চেষ্টা করছিলেন মধ্যবিত্তের নানান রকমসকম। সব্বাইকে নিয়ে
চলার চেষ্টা করছিলেন। বুঝেছিলেন এই কাজটা করতে গেলে মায়ের মমতার বড্ড প্রয়োজন। তাই
তিনি হয়ত মা হতে চাইছিলেন। কিন্তু মেকলের উত্তরপুরুষেরা তাঁর কাজকে বুঝতে চায় নি।
পর্ণো বলেছে। তাই ঋতু মরিয়া প্রমান করিল, সে যে বিষয়টি নিয়ে মুখর ছিল, সেগুলি মরে
নাই- আলোচনায় বারবার উঠে আসতে চাইছে অদম্য উদ্যমে।
আলোচনাগুলোয় বারবার উঠে আসছে
সমকামিতা ইত্যাদি রক্ষণশীল ভারতের সংস্কৃতি নয়। একটি পশ্চিমি বিষয়। একে ভারতে নিয়ে
এসে রক্ষণশীল ভারত(হিন্দুদের)কে আধুনিক, পশ্চিমের সমাজের উপযোগী করে তোলা হচ্ছে। এ
ধরণের সিনেমায় যৌনতা ব্যবহারের ফলে সাবালক হচ্ছে বাংলা সিনেমা। আমতা আমতা করে বলা
হচ্ছিল রক্ষণশীল ভারতের বিরুদ্ধে যে লড়াই চলছিল, সেই সমাজে লড়াইয়ের কথাগুলো ঋতুর
সিনেমা, লেখনির কৃতির মধ্যে উঠে এসেছিল। রক্ষণশীল ভারতে সাংস্কৃতিকভাবে নীরব, প্রান্তিক
এই মানুষদের জন্য সারা জীবন ধরে ঋতু শুধু লড়াইই করেন নি, নিজের লিঙ্গ পরিবর্তন করে
সেই আন্দোলনকে যথেষ্ট মর্যাদা দান করে ছিলেন। প্রখ্যাতরা কোনও আন্দোলনে এলে
আন্দোলনের ছড়ানো দাবিগুলোয় ছাঁকনি বসে আপাত দৃষ্টিতে প্রায় গুরুত্বহীন দাবিগুলো
লঘু হয়ে যায় কিনা বা পশ্চিমি ভাবনাগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করে, রাষ্ট্রকে নমনীয় করে
যত কিছু অধিকার অর্জন করা গিয়েছে, প্রখ্যাতরা আন্দোলনে এলে সে অধিকারের অনেকগুলি ন্যূন হয়ে যায় কিনা, আন্দোলনের সমস্ত শ্রেয় সেই প্রখ্যাতরা টেনে নেন কিনা, এ বিতর্কে
না ঢুকে একটা কথা আমরা বলতে পারি, ঋতুর হাত ধরে রক্ষণশীল ভারত বনাম প্রগতিশীল
পশ্চিমি সমকামিতা, তৃতীয় লিঙ্গ, যৌন পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয়গুলো শহরের সমাজে আলোচনা
হচ্ছে। কলাবতী মুদ্রা যেহেতু বহু বছর ধরে পুরনো বাংলা-ভারতের ঐতিহ্য বোঝার চেষ্টা
করছে, তাই দেখার চেষ্টা করবে, ভারতে এর কোনও রেশ ছিল কি না। কিছুটা নজর দেব
বর্তমান সমাজেও। সেই কাজে বেদ, মহাকাব্যগুলো, নানান আঞ্চলিক কথা এবং পুরাণের নানান
গল্পে নতুন করে আলো ফেলার চেষ্টা করব।
No comments:
Post a Comment