ভারতীয় সাহিত্যে জাহাজ(জলযান)গুলির চরিত্র
বিভিন্ন ধরণের জাহাজ তৈরির প্রণোদনা
এসেছিল মানুষের বিভিন্ন চাহিদার সূত্র থেকে। ভারতের প্রাচীন সাহিত্যে বিভিন্ন
ধরণের জলযানের বিশদ বিবরণ উল্লিখিত রয়েছে। পানিনির অষ্টাধ্যায়ীতে দুটি ধরণের
নৌযানের কথা উল্লিখিত রয়েছে দ্বৈপায়(উপকূলের দ্বিপগুলিতে ব্যবসার উদ্দেশ্যে) আর
দ্বৈপ বা দ্বৈপক (সমুদ্রস্থ দ্বীপে ব্যাবসার জন্য)। যুক্তিকল্পতরুতে যা বলা হয়েছে সেটি আমরা
পূর্বেই বিশদে আলোচনা করেছি।
ব্যবহার নির্ভর করে মালাবার উপকূলের নৌ যান বিভাগ
মালায়ালি ভাষায় অন্তত ৩৮ টি নৌকোর
বিভাগের নাম পাওয়া যাচ্ছে। এগুলো সবই অযান্ত্রিক। নৌকোগুলো ভাগ করা হয়েছে মাছধরা,
যাত্রী পরিবহন, পণ্য পরিবহণ, দস্যুতা, ক্রীড়া, এবং সমুদ্রে যাওয়া এই ছয়টি ভাগে।
মাছধরা
আজও মালাবার উপকূলের প্রায় গভীর
সমুদ্রে যে সব নৌকো মাছ ধরতে যায় সেগুলির ঐতিহ্য বহু পুরনো। সেগুলির নাম কান্নাটম।
মালায়ালি ভাষায় অন্য নামটি হল কাত্তুমারাম এবং কালাত্তাতি। তবে মাছ ধরা, পণ্য এবং
যাত্রী পরিবহন, এই তিনটি কাজে যে সব জাহাজ ব্যবহার হয় তাদের নাম পারু, ওটাম,
ভালাম, ভান্সি। ক্যাম্পাট্টনি এবং কছুভাল্লাম মাছ ধরার কাজে ব্যাবহার হয়। গুন্ডারত
দুটি মাছ ধরার নৌকোর নাম দিচ্ছেন চম্পা আর ওটাম। মাছ ধরা নৌযানগুলো সাধারনত কীল
ব্যবহার করে তৈরি হত না, বরং গাছ চেঁছে এবং প্লাঙ্ক বিল্ট করে তৈরি হত।
যাত্রীবাহী নৌযান
মালায়ালি সাহিত্যে এদের নাম টোনি
ছাড়াও কাতাভুটোনি, কেভটনি, কাত্তুটনি, ররনি এবং উড়ু পাওয়া গিয়েছে। প্রণালীগুলো পার
হওয়ার জন্য, চামড়া ব্যাবহার করে নৌযান তৈরি হত। এর নাম তোলোটাম।
যাত্রীবাহী নৌযান
মালাবারের বিশাল নদীজাল, হ্রদ এবং
সমুদ্র বাহিত হয়ে ব্যবসা করার জন্য বিশেষ নৌকো ব্যবহার হত। পশ্চাৎভূমি থেকে বন্দর,
বন্দর থেকে বিদেশে অথবা বিদেশ থেকে পণ্য এনে পসচাৎভুমিতে পণ্য বহন করে নিয়ে যাওয়ার
জন্য আলাদা আলাদা জলযান ব্যবহার হত। এদের নাম টোনি, পাটাভু, বটু, ভাল্লাম, ওটি,
পাট্টামারি, সিভাটা, প্লাভাম, কাপ্পাল। ওটাম ব্যাবহার হত চিন এবং সুমাত্রায়
ব্যাবসার জন্য। ঊরুও বিশাল বড় জাহাল যাতে ১৫০০টি বড়ও গুঁড়ি বয়ে নিয়ে যাওয়া যেত। টম
পিরেজ় লাদাস নামে এক ধরণের চ্যাপ্টা তল বিশিষ্ট নৌ যানের কথা বলছেন, যাতে আরও
বেশি পণ্য বহন করে নয়ে যাওয়া যেত।
জলদস্যুদের যান
ইবন বতুতা এবং মার্কো পোলোর বর্ণনায়
মালাবার উপকূলে জলদস্যুর বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে। প্রচুর ছোট ছোট খাঁড়ি, আঁকা বাঁকা
খালের মত নদী, অসমান ভঙ্গুর উপকূল, প্রায় সারা বছরের বানিজ্য, কোনও একটি রাজার
আধিপত্য না থাকা ইত্যাদির জন্য হয়ত মালাবার উপকূলে জলদস্যুর প্রাদুর্ভাব হয়। তারা
সাধারনতঃ মধ্যম গতির জাহাজ আক্রমন করত, খুবই দ্রুতগামী নৌকোয়। মালায়মে জলদস্যুদের
প্রতিশব্দ কাল্লাম। জাহাজগুলোরও প্রায় একই নামে হত। কাল্লাপাট্টাকু, কাল্লাপাকু,
কাদালকাল্লামারুদেভানসি, কাল্লাকাপাল এবং ইরুট্টুকুথিভাল্লাম ইত্যাদি।
খেলাধুলোর নৌকো
পূর্বের ত্রাভাঙ্কোর রাজ্যের আলেপ্পে
জেলার পাথানামথিটায় প্রচুর বাইচের নৌকো দেখাযায়। ওনামেরমত সাংস্কৃতিক উতসবে
জলযানগুলোর মধ্যে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এগুলির গঠন শৈলী এমনই হয়
যাতে দ্রুত জল কেটে চলতে পারে। কুন্ডম ভাল্লম, ভেপ্পু ভাল্লম, ওডি বা
ইরুট্টুকুথিভাল্লাম এবং চুরুলাম ভাল্লাম।
যুদ্ধযান
মালাবার উপকূলে চের, জ়ামিরন,
ত্রাভাঙ্কুর রাজাদের মধ্যে বৈরিতা ছিল অপরিসীম। যেসব নৌকো যুদ্ধে ব্যবহার হত,
সেগুলর নাম ছিল, উরুম কাপ্পাল। পাটাকাপ্পাল এবং অন্তঃবাহিনীকাপ্পালের মত ডুবো
জাহাজের নাম মালায়লম সাহিত্যে উল্লেখ রয়েছে।
তৈরির পদ্ধতি অনুযায়ী নৌযানের বিভাগ
র্যাফট বা ক্যাটামেরন
মালাবার থেকে করমন্ডল তট হয়ে বিস্তৃত
ওডিশা উপকূল পর্যন্ত ক্যাটামেরন প্রকৃতির জলযানের উপস্থিতি ছিল। কোল্লাম এবং
ত্রিভান্দ্রম এলাকায় মৎস্যজীবীরা ক্যাটামেরন ধরনের নৌ যান ব্যাবহার করতেন। এ ছাড়াও
পরব সমাজও এধরনের নৌযান ব্যবহার করতেন।
গাছের গুঁড়ি চেঁছে নৌকো
নাম থেকে তার তৈরির পদ্ধতিটি পরিস্কার(যেমন
বাঙলায় তালগুঁড়ি চেঁছে নৌকো)। একজনের বসার টোনি থেকে আট জনের বসার জন্য তৈরি ওডামস
নামের নৌকো। কেরলের দক্ষিণ থেকে উত্তর অঞ্চলে আজও ব্যবহার হয়। এধরনের নৌকোর নাম ওরুতাডিভালাম,
সিনিভালাম, কারামাডি ভালাম, কাম্বাভালাভালাম, টোনি, ভেপ্পুটোনি, ওডাম, কচিভানসি,
চেরুভানসি এবং ভিক্কুটোনি। এই নামগুলো দেওয়া হত কতগুলি গুঁড়ি নিয়ে, কত বড়, কত
মানুষ বসত সেই বিষয়টি ধরে। যেমন একটি গুঁড়ি দিয়ে তৈরি নৌকোর নাম ওরুটাডিভাল্লাম,
কচুভানসি ছোট নৌকো, যাতে একজন বা দু জন বস্তে পারে। এই নৌকোগুলো বেয়ে খালে, বিলে
বা নদিতে মাছ ধরা হয়।
প্লাঙ্ক নৌকো
আজকের কেরলে নদী বা খাঁড়িতে বেশ কিছু
সাধারন ধরণের নৌকো দেখা যায়। এগুলো ক্যাটামেরন বা চাঁছা নৌকোর গড়ন, চরিত্র এবং
কাজের ব্যাবহার থেকে অনেক আলাদা। এগুলো একইধারে মাছ ধরা, যাত্রী বহন, পণ্য পরিবহণ
এবং খেলাধুলোর কাজে ব্যাবহার হয়ে থাকে। প্লাঙ্ক জোড়া হিসেবে এগুলি দুভাগে ভাগ করা
হয়।
সেলাই এবং প্লাঙ্ক বিল্ট
প্লাঙ্কগুলি জুড়ে জুড়ে সেলাই করে তৈরি
হয় নৌকো। নারকেলের ছোবড়ার সুতো দিয়ে এই জুড়ে সেলাইএর কাজ করা হয়। শেল গুলির মধ্যে
রিব ব্যাবহার হয়, কীল এবং প্লাঙ্কের সাপোর্ট দিতে। এধরনের নৌকোর নাম, পাট্টি,
কাট্টুভাল্লাম, চন্দন ভাল্লাম, কোম্বান
ভাল্লাম, ভালিয়াভাল্লাম, কারাক্কু ভাল্লাম, কেভু ভাল্লাম, চারাক্কু ভাল্লাম,
পাট্টারমাড়ি, কাটাট্টু ভাল্লাম। নামগুলো থেকে পরিস্কার এই নৌকোগুলো কোন কাজে লাগে।
যেমন ভালিয়াভাল্লাম মানে বড় নৌকো চারাক্কু ভাল্লাম মালপত্র পরিবহণ করে। পাট্টারমাড়ি,
চারাক্কু ভাল্লাম, এবং কেভু ভাল্লামএ কীল এবং অন্য কীলার রয়েছে। অনেক সময় এই
নৌকোগুলোকে কেভু ভাল্লাম, এই এক নামে ডাকা হয়। উত্তর মালাবারে পাট্টি খুব চলতি
নৌকো। আলেপ্পি জেলায় লম্বা নৌকোর নাম চুন্দান ভাল্লাম। কেরলে ব্যাপক হারে সড়ক
পরিবহণ শুরু হওয়ার আগে কেভু ভাল্লাম নৌকো দিয়েই পণ্য পরিবহণ হত। আজও বিল, খাল এবং
খাঁড়িতে পণ্য পরিবহনের কাজে এ ধরণের হউক ব্যাপক ভাবে ব্যাবহার হয়। এই নৌকোগুলোর বড়
সুবিধে হল প্রচুর পরিমানে পণ্য দ্রব্য বয়ে নিয়ে যেতে পারে। এই নৌকোগুলো এটি বড় হয়
যে, এই নৌকোতে অনেকগুলো প্লাঙ্ক থাকে এবং এক একটা প্লাঙ্ক জুড়ে জুড়ে বিভিন্ন ধরণের
পন্যের জন্য আলাদা আলাদা কুঠুরি তৈরি করা যায়। যেহেতু এই নৌকোগুলো বহুদিনধরে নদিতে
থাকে তাই পুরো নৌকোটিকে নারকেল পাতায় ছেয়ে পন্যগুলকে রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। বড়
বাঁশের লগি, কাঝুক্কোল দিয়ে নৌকোটি বাওয়ার ব্যাবস্থা আছে। এধরনের নৌকো ব্যাবহার
করে ব্যাবসায়ীরা এক্কেবারে দক্ষিণ মালাবার থেকে কোচিন এবং কালিকট রাজ্যএ ব্যাবসা
করতে যেত।
পাট্টীমাড়ি আরও একধরনের বিশাল আকারের
পাল তোলা নৌকো, যেগুলি দূর দেশে ভ্রমনের জন্য ব্যবহার হত। আরেক ধরণের নৌকোর নাম
পুঝা ভান্সি। এগুলো চাল, গোল মরিচ এবং নারকেল বহনের কাজে ব্যাবহার হত।
নেইলেড এবং প্লাঙ্কড নৌকো
এধরনের নৌকোগুলো সাধারনত সমুদ্রে মাছ ধরার কাজে,
ফেরি চলাচলের, পণ্য পরিবহনের কাজে এবং খেলাধুলোর জন্য ব্যবহার হয়ে থাকে। ক্যাম্পাট্টোনি,
ক্যাভম,সেম্বকটনি, পিলাইভার বট এবং কিলনেট বট।শুধু বাইচের জন্য ব্যাবহার হয়
ইরুট্টুকুট্টি, কোভাল্লাম, পাল্লিয়ডাম, ওড়ি, চুন্দানভাল্লাম। এগুলো নেইলেড নৌকো।
প্লাঙ্কসগুলো জোড়া লাগানোর কায়দাটি কিন্তু আলাদা এই নৌকোগুলোয়, যেহেতু এগুলতে নেইল
ব্যবহার হয়ে থাকে। নেলগুলো তামা, লোহা,
এবং কাঠ দিয়ে তৈরি হয়। ইয়োরোপীয়রা লোহার নেল নিয়ে আসার পরেই এ ধরণের নেল ব্যাবহার
হওয়া শুরু হয়েছে। কীল এবং প্ল্যাঙ্কগুলোকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য রিবে নেল ব্যবহার
জরুরি।এটি এবং এর আগের লেখাটি শিপবিল্ডিং অ্যান্ড ন্যাভিগেশন ইন ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য পর্তুগিজ দিউরিং সিক্সটিন্থ অ্যান্ড সেভেন্টিন্থ সেঞ্চুরিজ – জোসেফ সি সি, থিসিস সাবমিটেদ টু য়ুনিভারসিটি অফ পুদুচ্চেরি থেকে নেওয়া।
No comments:
Post a Comment