ইতিহাস সাক্ষী, অতীত থেকেই বিশ্ববাজারে নীলরংএর একটি বড় অংশ সরবরাহ করত
ভারত। গ্রিস আর রোমর নানান সাহিত্যিক উত্স থেকে ভারতের নীল
চাষের বর্ণনা পাওয়া যায়। সাম্প্রতীক অতীতে এক ফরাসি লুই বন্নো
১৭৭৭এ বাঙলায় বাণিজ্যিকভাবে নীল চাষ আরম্ভ করেন। পরের বছরই কর্নেল ব্লুম কোম্পানি সরকারকে জানায় বাঙলা সুবায় নীল চাষ নতুন
ধরণের ব্যবসার সুযোগ করে দিতে পারে। ভারতের
বিশিল্পায়ণের সঙ্গে নীল চাষের সংস্পর্শ পিঠোপিঠি জড়িত। ভারতের বস্ত্র শিল্পকে ধংস করে যখন বিপুলভাবে ইংলন্ডে বাষ্পীয়ষন্ত্র
বস্ত্র কারখানাগুলি গড়ে উঠছে, ঠিক সে সময় সেই বস্ত্রখন্ডগুলি রাঙাতে প্রয়োজন হয়ে
পড়ল প্রচুর রঞ্জক পদার্থের। ইংলন্ডে যত
বস্ত্রের মিল বাড়তে থাকে ততই রঞ্জক পদার্থের চাহিদাও উর্ধমুখী হয়। এই বিপুল চাহিদামাফিক রঞ্জক দ্রব্যটি সরবরাহ একমাত্র করতে পারে ভারতের
কৃষকেরা এ সরল তথ্য জানত ব্রিটিশ শাসক আর বণিকেরা।
বাঙলা-বিহারের নালচাষের বিপুল সুযোগ দেখে এই দুই প্রদেশ
জুড়ে একের পর এক নীলের কুঠি গড়ে উঠতে শুরু করে। বাঙলা বিহারের চাষের জমি জোর জবরদস্তি দখল করে চাষীদের দাদন দিয়ে বাধ্য করা
হল নীল চাষে। আর দেশের সরকার যখন দেশের প্রজার
পাশে না দাঁড়িয়ে ধণীদের অত্যাচারে মদত দেয় তখন দেশে নেমে আসে ব্যাপকতম অত্যাচারের
নিশান। হঠাতই গজিয়ে ওঠে নীলকর নামক এক
শ্রেণীর মানুষ। ১৭৭৭, পলাশির পর ২০ বছর প্রায়
বিনামূল্যে বাঙলায় নানান দ্রব্য ব্যবসা করে, লুঠ করে, ঘুষ নিয়ে যে বিপুল উদ্বৃত্ত
তৈরি করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, সেই অর্থে কোম্পানি নীলকরদের অল্প সুদে ধার দিয়ে
পুরো চাষের উত্পাদন কিনে নিয়ে রপ্তানি করত ইওরোপের বাজারে।
১৭৮৬ থেকে ১৮০৩ পর্যন্ত কোম্পানি নীলকরদের অল্প সুদে
প্রায় এক কোটি টাকা ধার দেয়। বাঙলার নীলের
দাম ছিল প্রতি পাউন্ড একটাকা চার আনা আর ইংলন্ডে কোম্পানি বিক্রি করত প্রায় পাঁচ
টাকায়। বাঙলায় ১৮১৫-১৬ সালে ১,২৮,০০০মন নীল
উত্পাদন হয়। একমাত্র বাঙলা বিহারের নীলই সে সময়
বিশ্ব বাজারে স্থান আর দাম পেত। লবন, বস্ত্র,
আফিমেরমত ইংরেজদের আগামী একশ বছর একচেটিয়া বাণিজ্যে যোগ হল নীল। বাঙলার নীলের গুণগতমানে অধিকাংশ কোম্পানি কর্মচারী চাকরি ত্যাগ করে নীলকর
হয়ে ওঠে। এ ছাড়াও সরকারের কাছ থেকে কোনও সুযোগ সুবিধে না পেয়েও বহু জমিদারও নীল চাষ
করতে শুরু করে।
নীল চাষে নীলকরদের প্রায় কোনও দায় ছিল না। চাষীদের সঙ্গে দাদন দেওয়ার সময়ই কত জমিতে চাষ হবে, কত অর্থ অগ্রিম পাবে,
নীলকর কী দামে উতপাদিত নীল কিনবে তা লিখে রাখা হত। চুক্তি অনুযায়ী নীলকরেরা তাদের উতপাদন বুঝে নিত, কোনও অব্যাহতি মিলত না। একবার নীল চাষ করলে বরাবরের জন্য একজন নীল চাষীকে নীলই চাষ করতে হত। চাষ করতে না চাইলে দারোগাকে সঙ্গে নিয়ে, চাষীর ওপর অসীম অত্যাচার করা হত,
চাষীর বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হত। ইওরোপে দাস
ব্যবসার সমস্ত অত্যাচারে এই চাষীদের ওপর নামিয়ে আনত নীলকরেরা। চাষ আরম্ভ হওয়ার মাত্র কুড়ি বছরেরমধ্যে রায়তদের ওপর নীলকরদের অত্যাচার
এতই বেড়ে যায় যে, সারা বাঙলায় নানান স্বাধীণতা সংগ্রাম দমনে লেগে থাকা শংকিত
কোম্পানি সরকারও দুর্দম নীলকরদের সংযত হতে নির্দেশ দেয়।
কিন্তু নীল চাষে লাভ এতই বেশি যে, নীলকরেরা সরকারের
আরওপিত কোনও বাধা মানতে চায় নি। সি ই বাকল্যান্ড বেঙ্গল আন্ডার লেফটানেন্ট গভর্নর
বইতে লিখছেন, নীলকরদের অত্যাচার এতই বেড়ে চলে যে, সরকার কৃষক স্বাধীণতা সংগ্রামের
শঙ্কাতে ১৮১০ সালে চারজন দাগি নীলকরকে বাঙলায় বসবাসের অনুমতি দানে অস্বীকার করেন। সরকারের পক্ষেও নানান নীলকর অত্যাচার বিরোধী নির্দেশিকা
জারি করা হয়। এমনকী নীলকরদের
গুদামও ধংস করার নির্দেশও জারি হয়। কিন্তু এই নির্দেশিকা বাস্তবে কাজে প্রয়োগ করতে
অনিচ্ছুক সরকারের পক্ষে বাঙলা বিহারের চাষীদের রক্ষা করা সম্ভব হয়নি, এই ধরনের
নির্দেশিকা শুধু কথার কথাই থেকে গিয়েছে আর বাঙলার চাষীদের লাল রক্তে প্রথমে নীলকরদের
সিন্দুক আর পরে কোম্পানির ভাঁড়ার ভরেছে, কোম্পানির অংশিদারেরা তাদের লভ্যাংশ নিয়ে
মনেরসুখে ঘরকন্না করেছে।
No comments:
Post a Comment