তাঁকে এজেন্সিতে চাকরি দিয়ে কোম্পানি অতিরিক্ত মুনাফার নির্ভরতা পেশ
করেছিলেন চাকুরিদাতারা। আনুগত্যটি তিনি আন্তরিভাবে প্রকাশ করতে
পেরেছেন মালঙ্গীদের ওপর বোর্ডের অত্যাচার নামিয়ে আর লাভের পরিমান বাড়িয়ে। ২৪ পরগণার বালান্দা পরগণার মালঙ্গীরা আবগারি দপ্তরের দারেগা গোপীমোহন
মল্লিকের বিরুদ্ধে অত্যাচার আর জোর করে অর্থ আদায়ের অভিযোগ আনেন। দ্বারকানাথের জীবনীকার ব্লেয়ার বি ক্লিং মালঙ্গীদের এই অভিযোগ সম্বন্ধে
বলছেন, দ্য দারেগা হ্যড ডিডাকটেড ক্রেডিট
ফ্রম দ্য মালঙ্গীজ একাউন্টস ফর ভ্যারিং কোয়ান্টিটিজ অব সল্ট টু এনেবল হিম টু মেক
গুড হিজ এগ্রিমেন্ট ফর ৬০০০ রুপিজ উইথ দ্বারকানাথ টেগোর, দ্য দেওয়ান অব সন্ট বোর্ড। আবেদনকারী
মালঙ্গীরা জানায় এটি দ্বারকানাথের
বন্দোবস্ত, সেরেস্তাদারেরা এধরনের
বন্দোবস্তে দুপয়সা কামিয়ে থাকেন – অভিযোগ দ্বারকানাথও সেই
চক্করের বাইরে ছিলেন না। বারাসতের
তত্কালীর কার্যকারী জেলাশাসক রিচার্ড হারবার্ট মাইটন বিশদ তদন্তের নির্দেশ দেন। তদন্তে দারেগার মালঙ্গীদের কাছ থেকে উতকোচগ্রহণের প্রমাণ পাওয়াগেল। তবুও বলা হল, দ্য লিগাল প্রুফ অব
হিজ(টেগোরর্স) মিসকন্ডাক্ট ইজ সামহাউ ইমপার্ফেক্ট, আই হ্যাভ নট কনসিডার্ড ইট
নেসেসারি টু কল আপন হিম ফর এক্সপ্লানেশনস,
স্টিল দেয়ার আর জাস্ট গ্রাউন্ডস অব সাসপিশন দ্যাট হিজ নেম ওয়াজ নট মেড ইউজ অব
উইদাউট আ কজ। বড় কর্তাদের প্রশ্রয় তিনি বরাবরই পেয়ে এসেছেন। বিশেষ করে রামমোহন, বিদ্যাসাগরেরমত ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালিদের জীবনে
ঔপনিবেশিক ইংরেজ পৃষ্ঠপোষকদের অভয়হস্ত তাঁদের তত্কালীন কলকাতার সামাজিক-আর্থিক
সিঁড়ির অনেকদূর ধাপ উঠে যেতে সাহায্য করে।
তদন্তে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়ার অবস্থা হয়। পার্কারএর সাক্ষ্যে নতুন এক তথ্য উঠে আসে যে, দ্বারকানাথ ২৪ পরগণায় লবনের
সেরেস্তাদার থাকার সময়, তার বিরুদ্ধে কোম্পানির নুন চুরিরও অভিযোগ উঠেছিল। পার্কারের সাফাই ছিল দ্বারকানাথ, রামমোহনের সঙ্গী ছিলেন বলেই সে সময়ের
গোঁড়া হিন্দুরা তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে অভিযোগ করেন যে, দ্বারকানাথ নুলুয়া
গোলা (Nullooah Golahs) থেকে সরাসরি
৯০০০মন নুন সরিয়ে প্রচুর উপরি লাভ করেছেন। পার্কার
তদন্তে বললেন দ্বারকানাথের বিরুদ্ধে হিসেব রাখার গোলমালের তথ্য পাওয়া যায় নি। এক কলমের খোঁচায় দ্বারকানাথকে সেই দায় থেকে মুক্তি দেন। পার্কারএর যুক্তি, যে ব্যক্তি সেরেস্তাদারির কয়েক লাখ টাকা চাকরির সময়
ব্যবহার করছেন, মাত্র কয়েক হাজার টাকার জন্য হাতগন্ধ করবেন কেন! দারোগা প্রসঙ্গে
তিনি বলেন যে, দ্বারকানাথ নামী ব্যক্তিত্ব, তাই নিচের দিকের কর্মীরা তার নাম ব্যবহার
করে দুর্ণীতির আশ্রয় নিতে পারে।
তবুও তদন্ত গড়াল অনেকদূর। গভর্ণর জেনারেল ইন কাউন্সিল জানায়, মালঙ্গীদের দ্বারকানাথের এই বন্দোবস্তের
অভিযোগ বিযয়েও নজরদারি করে তারা কিছু পায়নি। শেষে ইন্ডিয়া
অফিসও তদন্ত করে। তারা যে শুধু দ্বারকানাথ সম্বন্ধে
কিছু পায় নি। আড়ংএর হিসেবপত্র সম্বন্ধে জানানো হয়,
ফুল প্রডিউস আব দ্য আড়ং হ্যাড বিন
রিটার্নড বাই দ্য দারেগা এন্ড আন্ডার হিজ কাবুলিয়ত হি ওয়াজ বাউন্ড টু ডেলিভার দিস
এমাউন্ট। দ্বারকানাথের জীবনীকার
খোঁচা দিয়ে বলছেন এ সবের জন্য শুধু গোঁড়া হিন্দুরাই দায়ি। ভবিষ্যতেও, নবজাগরণের পুত্রকন্যাদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের অভিযোগ কে নস্যাত
করতে, প্রত্যেক অভিযোগকারীকে গোঁড়া হিন্দু বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই অঙ্কে সব
ব্যাটাকে ছেড়ে বেঁড়ে ব্যাটাকেই ধরলেন ক্লিং। সরাসরি তিনি আইকনকে বাঁচাতে অন্যান্য মধ্যবিত্তদের স্বাভাবমত অভিযোগের
আঙুল তুলেছেন খেটেখাওয়া মালঙ্গীদের দিকে। লবনের ব্যবসা
থেকে লাভ করতে, ব্রিটিশরা মালঙ্গীদের ওপর যে অত্যাচার নামিয়ে এনেছিল বাঙলার
ইতিহাসে তার তুলনা মেলা ভার। এ বিষয়টি
বিশদে জনগণের স্বাধীণতা সংগ্রাম বাখান সংক্রান্ত অধ্যায়ে বর্ণন করা হয়েছে।
কোম্পানির নিযুক্ত সেরেস্তাদার দ্বারকানাথ যে শ্রমিক
মালঙ্গীদের বন্ধু হবেন না এ কথা বলাই বাহুল্য। লবনের লভ্যাংশ নিয়ন্ত্রণের জন্য বছরে নির্দিষ্ট সময়ে লবন তৈরি নিষিদ্ধ করে
সরকার। দ্বারকানাথের জীবনীকার, ব্লেয়ার
ক্লিংএর অভিযোগ মালঙ্গীরা সরকারের নিয়ম ভেঙে অনির্দিষ্ট সময়ে নুন তৈরি করে আইন
ভাঙছে এবং সেই বেনিয়মকে নিয়মে পরিণত করতে সমস্ত দায় চাপিয়ে দিচ্ছে প্রখ্যাত মানুষেটির
ওপর। ক্লিং আরও বললেন, ইংরেজরা মনে করল এই
প্রগতিশীল হিন্দু নেতার পাশে ব্রিটিশ সরকারের দাঁড়ানো উচিত। ক্লিং এক চিঠি উল্লেখ করে বলছেন, ব্রিটিশ শাসনের সমর্থনে সরকারপক্ষ বলল, ফর দ্য সেক অব দ্যট সিভিলাইজেশন, হুইচ দ্য
ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট প্রফেস ইট টু বি দেয়ার ফার্স্ট অবজেক্ট টু প্রোমোট, তাই
দ্বারকানাথ বা তাঁর অনুগামীদেরমত প্রখ্যাত মানুষদের নামের মাহাত্ম্য গোঁড়া হিন্দু
অভিযোগকারীদের থেকে বাঁচানো দরকার।
সরকারি দৃশ্য-অদৃশ্য হস্তক্ষেপে নিজেকে সমস্ত অনিয়মের
অভিযোগ থেকে মুক্ত করে, যথেষ্ট পরিমানে সরকারি আইনি বৈধ উপরি এবং সরকারিস্তরে
ঠিকঠাক যোগাযোগ নিশ্চিত করে ১৮৩৪এর ১ অগাস্ট নিজের আত্মীয় প্রসন্ন কুমার ঠাকুরকে
দেওয়ান পদে বসিয়ে, কোম্পানিকে পদত্যাগপত্র পেশ করলেন দ্বারকানাথ(ঠিক একই ভাবে অভিযোগ
থেকে মুক্তি লাভ করেন নবকৃষ্ণ। নবকৃষ্ণের ধন মান এবং পদবৃদ্ধির সহিত শত্রুও
বৃদ্ধি হইয়াছিল। তাঁহার প্রতিযোগী মহারাজা নন্দকুমার, গিউবাহাদুর এবং তাত্কালীক
মেয়ার আদালতের ভূতপূর্ব্ব কার্যাধ্যক্ষ্য(অল্ডারম্যান) উইলিয়ম বোলট সাহেবের
কুমন্ত্রণায় রামনাথ দাস, রামসোনার ঘোষ প্রভৃতি নবকৃষ্ণের নামে উত্কোচ গ্রহণ,
বলপূর্ব্বক অর্থ সংগ্রহ এবং তাহাদিগের পরিবারের প্রতি বল প্রকাশের অপরাধে অভিযোগ
করে। একটী সিলেক্ট কমিটী নিযুক্ত হয় এবং তাত্কালিক নাগরিক জমিদার(ম্যাজিস্ট্রেট)
চার্লস ফ্লয়ার সাহেবের উপর ইহার তদন্তের ভারার্পণ হইলে তিনি বিশেষ অনুসন্ধানের পর
জানিতে পারিলেন, যে নবকৃষ্ণকে সাধারণ্যে অপদস্থ এবং তাঁহার চরিত্রে দোষারেপ করিবার
অভিসন্ধিতে এই অভিযোগ করা হইয়াছে, সুতরাং নবকৃষ্ণের নির্দ্দোষিতা সপ্রমাণ হইল - বিপিন বিহারী মিত্র, কলিকাতাস্থ শোভাবাজার-নিবাসী
মহারাজা নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুরের জীবনচরিত)। শুরু করলেন উইলিয়ম কারএর সঙ্গে নতুন এজেন্সি হাউস, কার, ঠাকুর এন্ড কোং। ১৮২০তে ৮ থেকে ১২ শতাংশ সুদে, ২০০০ টাকা সম্বল করে, যে টাকা ধার দেওয়ার
ব্যবসা শুরু করেছিলেন দ্বারকানাথ(অমধর্ণ ছিলেন, মথুরামোহন সাউ, চিত্ত গেঁসাই,
বাঞ্ছারাম শিকদার এবং অন্যান্য জমিদার, রিচার্ডসন, জন বেরেটন বার্চ, শীতলচন্দ্র
ঘোষ, আর সি জেনকিনস, নীলকর রোনাল্ড ম্যাকডোনাল্ড, জাহাজ প্রস্তুতকারক জন
আর্মস্ট্রং কুরি, জন বেয়ার্ড, জন ফ্রিম্যান, নীলকর আর্চিবল্ড ব্রাইস, বৈকুণ্ঠনাথ ও
মন্মথনাথ রায়, হে টুইডল স্টুয়ার্ট, রানী ইন্দ্রানী এবং আনন্দ চন্দ্র ঘোষ, নীলকর
মুরি চারডন, মহারাজ কুঁয়র বাসদেও সিং, উইলিয়ম স্টর্মকে), ১৮৪০এ সেই অর্থ চক্রবৃদ্ধি
সুদে বেড়ে দাঁড়ায় ২,০০,০০০ টাকায়।
লবন দপ্তরে চাকরিতে ম্যাকিনটশ এন্ড কোম্পানির সঙ্গে
ব্যবসায়িক যোগাযোগ হল। গোপীমোহনের সময় থেকেই ঠাকুরেরা
এজেন্সি হাউসগুলির সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। দ্বারকানাথের গুরু
রামমোহন রায়েরও ব্যবসা ম্যাকিনটশ কোম্পানিটির মাধ্যমে চলত। ফলে আরও দ্বারকানাথের সুবিধে হল। ম্যাকিনটশ এন্ড কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা অ্যানিস
ম্যাকিনটস রামমোহনের বন্ধু ছিলেন। অন্য দুই
অংশিদারের প্রথমজন, জর্জ জেমস গর্ডন, রামমোহনের ইউনিটেরিয়ান কমিটির সদস্য। দ্বিতীয়জন জেমস ক্যালডর, সতী আইন প্রণয়ণের সময় বেন্টিংঙ্ক আর রামমোহনের
পর্দার পেছনের দৌত্যের অন্যতম সংযোগসূত্র। এমত যোগাযোগ
নিয়ে দ্বারকানাথ ম্যাকিনটশ এন্ড কোম্পানির কোম্পানির বেনিয়ান হলেন। তাঁর দায় হল প্রয়োজনে পুঁজি জোগাড় এবং ব্যবসার দায় গ্রহণ করা। এজেন্সি হাউসের সঙ্গে কাজ করা আরও তিনটি ব্যাঙ্কের মধ্যে গোপীমোহনের
কমার্শিয়াল ব্যঙ্কের মাধ্যমে ম্যাকিনটসের সঙ্গে দ্বারকানাথের যোগাযোগ স্থাপন হল। শুরু হল দ্বারকানাথের উদ্যেগপতির জীবন।
No comments:
Post a Comment