এই মিনিটে অসহ্য ঘৃণাবাচন সত্বেও মেকলে মধ্যবিত্ত ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি
ঐতিহাসিকদের সহৃদয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এসেছেন। এঁদের বিবেক
বিন্দুমাত্র অস্বস্তি বোধ করে নি, একটি আঁচড়ও লাগে নি। নিজের সংস্কৃতি বিষয়ে অনৃততম ভাষণ আর চরম ঘৃণাপূর্ণ বাক্যবন্ধ শ্রবণেও
তত্কালীন ইংরেজি শিক্ষিত, বর্ণময়, সরকারি চাকুরে মধুসূদন গুপ্ত, কৃষ্ণমোহন
বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, রাধানাথ শিকদার, রামগেপাল ঘোষ(১৮১৫-৬৮, কেলসল,
ঘোষ এ্যান্ড কোং এর অংশিদার, পরে নিজের সংস্থা আর সি ঘোষের মালিক। ডিমস্থিনিস অব
বেঙ্গল নামে তাঁকে সেসময়ে ডাকা হত), প্যারীচাঁদ মিত্র, কিশোরীচাঁদ মিত্র,
রাজেন্দ্রলাল মিত্র, শিবচন্দ্র দেব, হরচন্দ্র ঘোষ(১৮০৮-৬৮, প্রেসিডেন্সি স্মল কজ়
কোর্টএর বিচারক), প্যারীচরণ সরকার, দিগম্বর মিত্র, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়(১৮১০-৭৮,
সিপাহি স্বাধীনতা সংগ্রামের পর ক্যানিং তাঁকে অউধ জমিদারিটি দেন এবং রাজা উপাধি
দেন), রাজনারায়ণ বসু, দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মধুসূদন
দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কৃষ্ণদাস পাল(ইয়ং বেঙ্গল ভিন্ডিকটেডএর লেখক
এবং ডিরজ়িও রিমেম্বেরডএর ১২০ পাতায় এই বইটি তুলে দেওয়া হয়েছে, এবং এই বইতে তিনি
ইয়ং বেঙ্গালিদের নানান উদ্যম সমর্থন করার পাশাপশি কিছু বিষয়ে প্রশ্ন তুলছেন,
অন্ততঃ লেখটাতে একবার চোখ বুলিয়ে লেখকদের যা মনে হয়েছে), হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়,
দুর্গাচরণ লাহা, কেশবচন্দ্র সেন, শিবনাথ শাস্ত্রী, উমেশচন্দ্র দত্ত, বিপিনচন্দ্র
পাল, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত- প্রতিবাদতো জানালেনই না, বরং উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে নীরব থেকে
তাঁর বক্তব্য সম্মান জানালেন। ইংরেজি শিখে যে
সব মেকলে অনুগামী আলালেরা সম্মান, চাকরিতে অর্থ উপার্জন করে ব্রিটিশ দাসত্ব
প্রকল্পের অধীণে প্রখ্যাত হয়েছেন, তাঁদের পক্ষে শিরদাঁড়া সোজা করে আপন সংস্কৃতির
সম্মান রক্ষা করার সময় তখনও আসে নি(আজও এসেছে কী!)। মুঘল, সুলতানি পূর্বে বাঙালিরা ফার্সি শিখে বড় চাকরি করেছে, ধণ আহরণ করেছে। ষড়গোস্বামীর দুজন সরাসরি উচ্চতম রাজ কর্মচারী ছিলেন। ইংরেজ আমলে শিখেছে ইংরেজি, রাজকর্মচারী হয়েছে, ব্যবসা করেছে। পার্থক্য রয়েছে। রূপ সনাতন দুজনে রাজকর্মচারী হয়েও,
রাজার ভাষা শিখেও শ্রী চৈতন্যের ডাকে রাজপদ আর চরমতম ঐশ্বর্য ত্যাগ করতে
বিন্দুমাত্র সময় নেন নি।
এর আড়াইশ বছর পর, সেই মধ্যবিত্তের ইংরেজি শিখে ধণী হয়ে
ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার বাসনা এতই প্রবল যে তাঁদের বিন্দুমাত্র নজর গেলনা কলকাতার
ইংরেজী মানচিত্রের বাইরে স্বাধীণতা সংগ্রামীদের লড়াইতে। সাথীতো হন নি, মৌখিক সহানুভূতিটুকুও জানান নি। আলালেরা জানতেন, ইংরেজি শিক্ষার যে বেসাতিতে সামাজিক-আর্থিকস্তরে আরোহন
করতে চাইছেন তাঁরা, সেখানে প্রয়োজন অত্যাচারী গণতান্ত্রিক-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের
অদৃশ্য অভয়হস্ত। ইংরেজি শিক্ষা সমান চাকরি সমান অর্থ
সমান সামাজিক আরোহন, এই সমীকরণটি বুঝে ফেলেছিলেন আলালেরা। তাদের কাছে প্রকল্পটি যথেষ্ট আকর্ষনীয় ছিল। সামাজিক প্রতিষ্ঠার অর্থই হল কয়েক পুরুষ পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠা আর
স্বচ্ছল্য। এক শতক পরেও পরিবারের শিক্ষিত
উত্তরাধিকারীদের জন্য নিশ্চিন্ত চাকরির ব্যবস্থা। ১৮৮১-৮১তে সোমপ্রকাশ লিখবে, আমাদিগের
দেশের লোকেরা পুত্রকে যে লেখাপড়া শিখান, মূলেই চাকুরীই তাহার উদ্দেশ্য। পুত্র লেখাপড়া শিখিয়া কৃতী হইবে, স্বাধীন প্রবৃত্তি ও মত হইবে, এ চেষ্টা
আমাদিগের দেশের লোকের অন্তঃকরণে এক মুহূর্তের জন্যও বোধ হয় স্থান প্রাপ্ত হয় না। সমাজে বল, সভায় বল, পিতামাতা গুরুজনের নিকট বল, চাকুরীর যত সমাদর এমন
কিছুরই নহে।...যিনি বড় চাকুরী করেন, মোটা বেতন পান
তাঁহার পিতামাতা, বড় চাকুরের পিতামাতা মনে করিয়া সুখানুভব করিয়া থাকেন।
ঠিক এরই বিপরীতে স্বাধীণতা সংগ্রামী গ্রামবাঙলা ইংরজি পদ্ধতিতে
শিক্ষার বিরোধিতা করে গিয়েছে বহুদিন পর্যন্ত। ইংরেজি শিক্ষার সঙ্গে চাকরির সমীকরণ অথবা আইন ডাক্তারি ব্যবসারমত স্বাধীণ
ব্যবসার খুদকুঁড়ো ছুঁড়ে দিয়ে কলকাতার সমাজকে নিজের মুঠোতে আনতে পেরেছিল। পলাশির চক্রান্ত থেকেই বাঙলার সনাতন গ্রামীণ সমাজ ইংরেজদের চরমতম
বিরোধিতায় ইংরেজি শিক্ষাকে ত্যাগ করেছে ঘৃণাবত। কিছু অবস্থাপন্ন গ্রামীণ শিল্পী-কারিগর তাঁদেরর সন্তানসন্ততিকে ইংরেজি পদ্ধতিতে
শিক্ষা দিলেও আদতে সার্বিকভাবে কিন্তু গ্রাম সমাজ স্বাধীণতা সংগ্রামের সঙ্গে সঙ্গে
শিরদাঁড়া সোজা করে ইংরেজি শিক্ষা বর্জন করার কৃতিত্ব অর্জন করতে পেরেছিল। আজও বহু চেষ্টায় ইংরেজি শিক্ষার কাজটি করানো যাচ্ছে না। স্বাধীণতা সংগ্রামের সময় গ্রামীণেরা দেখেছে, কলকাতার বুদ্ধিবিভাষাময়
বাঙালিরা পড়াশোনা শিখে তাঁদের নিজেদের কূলবৃত্তি ছেড়ে ইংরেজের দাসত্ব প্রকল্পে
সামিল হয়েছে। সনাতন ভারতীয় সংস্কার ধারণ করে
অধিকাংশ কারুজীবিই ইংরেজি শিক্ষার বদলে, সমাজের অংশ হয়ে স্বাধীণভাবে বংশগত সামাজিক
নিরাপত্তা বেছে নিয়েছে। ইংরেজি শিক্ষা বিষয়ে তত্ববোধিনী
পত্রিকা বলছে, পুত্তলিকার ন্যায় নৃত্য
করিতে বল, সঙ সাজিতে বল, তোমার কথাগুলি মস্তকের উপরে স্থান দিব, কিন্তু যদি
স্বাধীণরূপে বুদ্ধিচালনা করিতে বল, যদি দেশের পূর্বাপরের সহিত যোগ রাখিয়া চলিতে
বল, যদি দেশ কাল পাত্র বিবেচনাপূর্বক বিদ্যাকে কার্যে প্রয়োগ করিতে বল, এককথায় এই
যে, যদি জীবন্ত মনুষ্য হইতে পার, তবেই সর্বনাশ! বিদ্যাশিক্ষার ফল কি এই।
১৮৩০ থেকে ১৮৪০ সালের মধ্যে পূর্ব ভারত জুড়ে গ্রামীণ স্বাধীণতা
সংগ্রামের আঁচ ছড়িয়ে পড়ছে দাবানলের মত। রামমোহন আর
দ্বারকানাথ নীলচাষীদের সমর্থনে কলোনাইজেশন আন্দোলন করে দেশের কৃষকের সর্বনাশের পথ
খুলে দিয়ে গিয়েছিলেন। সেই পথে প্রাক্তণ দাস ব্যবসায়ী ইংরেজ
জমিদার-নীলকরের প্রবেশ এবং নীলচাষী আর জমিদারদের সঙ্গে সরকারের বিরোধ ধূমায়িত হতে
থাকে। এই প্রথম নীল বিদ্রোহে কলকাতার বুদ্ধিজীবিরা সংবাদপত্রে
লেখালেখি করে অত্যল্প হলেও আত্মীয়তা শুরু করেন। এর আদত কারণ নীল বিদ্রোহের সরাসরি আঘাত এসে লাগছিল নব্যছোটজমিদারদের গায়। ইংরেজ নীলকররাও বাঙালি চাষীদের ওপর অত্যাচারের সঙ্গে সঙ্গে হঠাত বা ছোট জমিদারদের
ছেড়ে কথা বলে নি। নীলদর্পণ রচনার মূল
প্রতিপাদ্যই ছিল, ইংরেজ সরকারের সঙ্গে জমিদার আর ব্রাহ্ণণের সরাসরি বিরোধিতার
প্রকল্প। এতদিন ছোটলোক গ্রামীণদের ওপরে
নির্বিচারে পড়া ব্রিটিশ পুলিশ আর সেনার লাঠি এসে পড়তে লাগল উচ্চবর্ণের আর
মধ্যউচ্চআয়ের মানুষদের ওপর। এক অংশ এসে
দাঁড়ালেন নীল সংগ্রামের পাশে। কলকাতা সমান
সরসারি চাকরির হাতছানি আর ব্যবসার ঐশ্বর্য। অধিকাংশই চুপ
রইলেন। আত্মীয় সভার দায় পুরণ হল।
সাম্রাজ্য সেবায়
...১৮১৪ খ্রীষ্টাব্দে রামমোহন রায় কালেক্টরের সেরেস্তাদারী পদ হইতে অবসর
লইয়া কলিকাতায় আসিয়া বাস করিলেন। তদানীন্তন
কালে এই পদই দেশীয়দিগের পক্ষে সর্বোচ্চ পদ ছিল। লর্ড কর্নওয়ালিসের শাসনকালে ইহা স্থীরকৃত হয়(ক্ষিতীন্দ্রনাথ
ঠাকুর, দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনী)। কলকাতার
প্রখ্যাতরা সাম্রাজ্য সেবায় ক্রমশঃ যোগ্য হয়ে উঠার চেষ্টা করছেন উচ্চপদের ব্রিটিশ
সিভিলিয়ান, বিচারকদের প্রত্যক্ষ্য দেখাশুনোয়। ডিরোজিওর ছাত্ররা চন্দ্রশেখর দেব, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, শিবচন্দ্র দেব, গোবিন্দচন্দ্র
বসাক, মাধমচন্দ্র মল্লিক, হরচন্দ্র ঘোষ, রাধানাথ সিকদার সরকারি চাকরি করছেন। মনেরাখা দরকার হরচন্দ্র ঘোষকে লর্ড অকল্যান্ড নিজের নামাঙ্কিত স্বর্ণ
রৌপ্য ঘড়ি উপহার দেন এবং ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটরূপে বরণ করে নেন(রায়বাহাদুর
প্রমথনাথ মল্লিক)। প্রায় ১৫ বছর পরে আর এক হরচন্দ্র
ঘোষের পদে প্যারীচাঁদ মিত্রের ভাই কিশোরাচাঁদ মিত্র ডেপুটির পদ লাভ করেন। ইংরেজ সিভিলিয়ান আর বাঙালি চাকুরিজীবিদের নজারদারিতে একের পর এক সমিতি
গড়ে উঠছে। সাম্রাজ্য জানে সব বাঙালি তখনও তৈরি
হয় নি। অথচ ন্যুনতম যোগ্যতামান তৈরি করানো
অত্যন্ত প্রয়োজন হয়ে পড়ছিল। হিন্দু কালেজে
ইংরেজি ভাষায় ছাত্র পিটিয়ে সাম্রাজ্য যোগ্য করার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। ক্রমশঃ কলকাতা শহরে ইংরেজি শিক্ষিতদের সংখ্যা বাড়ছে।
তিনটি বড় কারনে বাঙালি আলালদের চাকরিতে যোগ্য করে গড়ে
তোলা প্রয়োজন ছিল- প্রথমতঃ তখনও ভারত সরকার ইংলন্ড থেকে দামি চাকুরে এনে এ
দেশ শাসন করছিলেন। ভারতীয়দের চাকুরিতে অনেক কম মাইনেয়
কাজ করানো যায়। ফলে ইংলন্ডের জন্য অর্থ বাঁচে। ফলে চাকরিতে ভারতীয়দের অংশ গ্রহণ খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়তঃ বাঙলার বাইরে যে অত্যাচারের ঢেউ উঠেছে গ্রামের পর গ্রাম
স্বাধীণতা সংগ্রামের প্রেক্ষিতে, সেই দিক থেকে শহুরেদের মুখ ফেরানেও প্রয়োজন। আর শহুরে ভারতীয়রাও এই শসনে অংশ নিয়ে সাম্রাজ্যকে আরও বেশি নিজেদের ভাবতে
শিখবে। তৃতীয়তঃ সরকারি দমন
নীতিতে শুধুই ব্রিটিশ মুখ। সাধারণ সেপাই
ছাড়া উচ্চপদের পরিচালকেরা মুখ্যত ব্রিটিশ। সে সময়
গ্রামবাঙলায় অত্যাচার এতই বাড়তে শুরু করে, সদ্য ১৮৩৩এর শেষের দিকে ভারতে ভ্রমণে
আসা বিশপ হেব্বারও ১৮৩৫এ আশংকা প্রকাশ করে বলেছেন দেশের মানুষের মন ব্রিটিশদের
প্রতি বিমুখ হয়ে উঠছে। ফলে আরক্ষা বাহিনী অথবা প্রশাসনে আরও
বেশি ভারতীয়দের নিয়োগ করা জরুরি। কিন্তু বিশাল
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দাসত্ব করতে ন্যুনতম যোগ্যতা মানের প্রয়োজন ছিল। সরকারও বুঝতে পারছে, যোগ্য করে তোলার কাজে কিছুটা হলেও দেশের মানুষকে নিতে
হবে, যদিও পুরো নিয়ন্ত্রণ থাকবে সরকারের হাতে।
কমিটিগুলোতে ভারতীয়রাই সদস্য হচ্ছে। গ্রামের বাস্তবতা ভুলে সাম্রাজ্যের প্রচার করা সত্যিকেই আত্মস্থ করছেন
বিনা প্রশ্নে। গ্রামের সংগ্রামের দিকে পিঠ করে আলালেরা
বহুকাল ধরেই ব্রিটিশ প্রণোদিত শহর ভিত্তিক সংস্কার আন্দোলন চালিয়েছেন। ভারত সরকার তাদের কাছ থেকে দেখেছে। তারা জানে এই
মানুষদের কতদূর দৌড়। সব থেকে বড় কথা যেসব সৌভাগ্যবান পরের
দিকে সাম্রাজ্যকে সেবা করেছে, সাম্রাজ্য চেষ্টা করেছে তাদের যোগ্যতার মাপ করে
সকলকে কিছু না কিছু খুদ কুঁড়ো উপহার দিতে।
যেমন উত্তরপাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। ভরতপুর অবরোধের সময় কোম্পানির সেনা বিভাগে কাজ করে বহু অর্থ রোজগার করেন। অর্থ বিনিয়োগ করে তিনি হুগলির কালেক্টরির রেকর্ড কিপারের পদ অর্জন করেন। কালেক্টরীর সম্পত্তি খাজনার দায়ে বিক্রি হওয়ার সময় অল্পমূল্যে খরিদ করে
জমিদার হন। বাঙালিকে জমিদারি অর্জনের এই পথ
দেখিয়ে গিয়েছেন দ্বারকানাথ ঠাকুর।
ক্ষিতীন্দ্রানাথ তাঁর উত্তরপুরুষ, দ্বারকানাথের জীবনী লিখতে গিয়ে বলছেন, ...দ্বারকানাথ
২৪ পরগণার কালেক্টরেটের সেরেস্তাদার হওয়াতে কোন জমিদারীর কিরূপ আয়, সাতান কি
নাতান, এই সকল বিষয় সকলই নিশ্চই জানিতে পারিয়াছিলেন। সুতরাং যেই কোন জমিদারী নীলামে উঠিল, অমনি তাহা কিনিয়া লইলেন। ...কালিগ্রাম ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দে এবং সাহাজাদপুর ১৮৩৪ খ্রীষ্টাব্দে এবং অন্যান্য জমিদারীও এই সময়ের কাছাকাছি কেনা হইয়াছিল। শুধু কলকাতার সৌভাগ্যবানেরাই নয়, জেলার
নানান সুযোগসন্ধানী, সাম্রাজ্যের নানান সেবা করার ফলস্বরূপ এই উপহার অর্জন করার
সৌভাগ্য লাভ করেন।
দ্বারকানাথের চাকরি পাওয়ার সময়ে ঘুষের বড় কড়ার ছিল।...৩৫ টাকা বেতনের কর্মচারী তাহার উপরিতন সাহেব কর্মচারীকে মাসিক ৫০০ টাকা
দিবার বন্দোবস্ত করিয়াছিলেন – তিনি নিজে কেন না আর ৫০০ টাকা মুনাফা করিবেন(ক্ষিতীন্দ্রনাথ
ঠাকুর – দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনী)। সাম্রাজ্য বাড়ায় সেটি হয়ত আরও বেড়েছে। তাতেও চাকরি হয় না। রামমোহন অথবা দ্বারকানাথ যে পদে তাঁদের চাকরি শেষ করেছিলেন তারও তিন-চার
দশক পরে ভারতীয়রা ক্রমশঃ আরও বড় দায়িত্ব পালনে যোগ্য হয়ে উঠছেন। ক্রমশঃ বিভিন্ন উচ্চপদে চাকরি পাওয়ার লড়াই বাড়ছে। সেসময় প্রখ্যাতরা জীবিকা নির্বাহ করতে ইংরেজদের প্রসাদধন্য জীবিত-মৃত
বাঙালিদের ধরছেন নিজেরমত করে। রাজনারায়ণ বসু
আত্মচরিতএ বলছেন, ইংরাজী ১৮৪২ সালে কলকাতা রিভিউ নামক সাময়িক পত্রিকায়
শ্রীযুক্ত কিশোরীচাঁদ মিত্র রামমোহন রায়ের জীবনী লিখেন। কিশোরীচাঁদ মিত্র বিখ্যাত টেকচাঁদ ঠাকুরের (প্যারীচাঁদ মিত্রের) কনিষ্ঠ
ভ্রাতা। তিনি নিজেও একজন বিখ্যাত লোক। আমি যে বত্সর হিন্দু কলেজে প্রথম উঠি, সেই বত্সর তিনি কলেজ পরিত্যাগ করেন। শ্রুত হওয়া গিয়াছিল যে তাঁহার ঐ জীবনী প্রণয়নে মহাখ্যাতসম্পন্ন খৃষ্টীয়
ধর্ম্মপ্রচারক ডাক্তার ডফ্ সাহায্য করেন। ঐ জীবনী কিশোরীবাবুর সাংসারিক উন্নতির কারণ হয়। তাঁহার ঐ লেখা বেঙ্গল সেক্রেটারী হেলিডে সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। হেলিডে সাহেব তাঁহাকে ডেপুটী ম্যাজিস্ট্রেটী পদ দেন। আমি উক্ত জীবনীরচনায় বিলক্ষণ সাহায্য করি। রামমোহন রায় সম্বন্ধীয় অনেক গল্প আমার পিতার নিকট হইতে সংগ্রহ করিয়া
তাঁহাকে দিই।
The Zemindar and Ryots, আলালের
ঘরের দুলালএর লেখক প্যারীচাঁদ
মিত্রের ভাই কিশোরীচাঁদ মিত্র সাম্রাজ্য সেবায় চাকরি পাচ্ছেন না। কারন গ্রন্থাগারিক প্যারীচাঁদ আর তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সার্ভে দপ্তরের
কর্মচারী রাধানাথ শিকদার সাম্রাজ্যের স্বার্থে হালকা ঘা দিয়েছেন। যদিও কিশোরীচাঁদ জীবনে ইংরেজি ছাড়া বাংলায় কলম ধরেন নি। সেটুকুও বোধ হয় যথেষ্ট ছিল না। তাঁকেও চাকরি
পেতে, সাম্রাজ্যের সব থেকে বড় বন্ধু রামমোহন রায়ের জীবনী লিখে নিজের আনুগত্যের
যোগ্যতা প্রমাণ করতে হচ্ছে। চাকরির জন্য
বাঙালিরা প্রায় প্রস্তুত। বাঙলা সরকারের সবথেকে বড় সিভিলিয়ন
খুঁজে নিচ্ছেন সাম্রাজ্যকে সেবা করার মস্তিস্ককে।
হিন্দু কলেজের ২০০ টাকা মাইনের শিক্ষক, এম ডব্লিউ
উলাস্টন, ১৮৩২ সালে দ্য ওরিয়েন্টাল পার্ল পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ
লেখেন, নাম, স্কেচেস অব হিন্দু ইয়ুথ(সূত্রঃ – ডিরজিও রেমেমবারড, বারথ
বাইসেন্টিনারি সেলেব্রেসন কমেমোরেসন ভলুম, ভলুম ১, পাতা ১৮-২৪), কয়েকজন ছাত্রের
সেযুগের উপযোগিতা এবং তাদের কৃতিত্ব বর্ণনা করে। এইচ – জি(হরচন্দ্র ঘোষ?) নামে
হিন্দু কলেজের এক ছাত্রের কথা উলাস্টন উল্লেখ করছেন যিনি মহামহিম গভর্নর জেনারেলের
পারসি অনুবাদক, বা তাঁর ব্যাক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব পেয়েছিলেন।
কিন্তু তিনি করেন নি। পরে তিনি কলকাতার কাছের কোনও জেলার সদর আমিন হিসেবে নাম করেন।
তিনি আরও এক ছাত্রের কথা লিখছেন কে-ই-ম-আর(আচার্য কৃষ্ণকমল না কিশোরীনাথ মিত্র?),
যিনি প্রায় ইংরেজদের মত ইংরেজি বলতে পারতেন, লিখতে পারতেন! তিনি লিখছেন, আই হ্যাভ
অফন কনভারসড উইথ হিম অন দ্য সাবজেক্ট অফ ক্রিসচানিটি, ...হ্যাড রিড পোরসন্স অব
টেস্টামেন্ট এ্যান্ড হি ওয়ান ডে পুট আ স্লিপ অব পেপার ইন্টু মাই হ্যান্ড, ইন হুইচ
হি ডিসটিঙ্কটলি ডিক্লেয়ারড হিজ় কনভিকসন অব দ্য ট্রুথ অব দ্য স্ক্রিপচার। ...হি
ওয়াজ এমপ্লয়েড এ্যাট আ স্কুল এ্যাট ৫০ রুপিজ পার মেনসেম(প্রত্যেক মাসে! ঠাকুরদাস
তার কয়েক দশক আগে মাত্র ২ টাকা মাসে কামিয়ে নিজেকে স্বচ্ছল ভাবছেন!), অ্যান্ড
সাবসেকোয়েন্টলি, ওয়াজ রেকমেন্ডেড বাই আ ভিজিটর টু আ রাজা ইন দ্য মফঃস্বল এজ় হিজ
প্রাইভেট টিউটর ফ্রম হুম হি রিসিভড ১০০ রুপিজ পার মেনসেম। আরেক ছাত্র কে-এন
বি-ই(বোধহয় রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন)। কে-এনকে তিনি বলছেন পাবলিক ফিগার। ভাল তার্কিক।
এখন ক্রিশ্চিয়ান এবং এনলাইটেন হয়েছেন। হিন্দুদের বিবাহ নিয়ে তাঁর একটি লেখ উলাস্টন
উদ্ধৃত করছেন সেই প্রবন্ধে, দ্য হিন্দুজ় নো নাথিং অব মেকিং লাভ, নর হ্যাভ দে এনি
বুকস অব লাভ টেলস অর সংস।
যারা সাম্রাজ্যকে সেবা করার জন্য তৈরি হয়ে উঠছেন,
তাদের যাপন কেমন ছিল? সেই প্রবন্ধ থেকেই তোলা যাক – ওয়ান ডে আই ওয়াজ ভিজিটেড,
হোয়াইল এট ডিনার, বাই থ্রি অব দ্য ইয়ং কলেজ়িয়ানসঃ দে টুক চেয়ারস বাই দ্য টেবল,
বাট ডিক্লাইন্ড ডূইং এজ় আই ওয়াজ ডুইং দ্যাট ইজ টু সে ম্যাস্টিকেটিং, নট হ্যাভিং
এ্যাজ ইয়েট রিচড দ্য হাইট অব লিবারেলিস্ম হুইচ দে সাবসিকুইয়েন্টলি এটেন্ড।/ আফটার
ডিনার দে প্লেড এ্যাট হুইস্ট, হুইচ ইজ় আ কমন এ্যামিউজ়মেন্ট এ্যামং দেম – সাম আর
ভেরি এক্সপার্ট এট চেস, এ্যান্ড মেনি প্লে এ্যাট ব্ল্যাকগ্যামন। এ্যাট টি টাইম, দে
ওয়ার স্টিল রিলাক্ট্যান্ট টো টেক এনিথিং, বাট ওয়ার এভিডেন্টলি হাংরি, নট হ্যাভিং
টেকন রিফেসমেন্ট সিন্স দ্য মর্নিং। ... অন ওয়ান ওকেসন থ্রি অব দেম ডাইইন্ড উইথ মি
টুগেদার, এ্যান্ড বিফস্টেক ওয়াজ দ্য চয়েসেস্ট ডিস অন দ্য টেবল; ওয়াইন দে প্লেজড ইন
হ্যাম্পারস, বিয়ার দে ডিডন্ট লাইক, বাট সডা ওয়াটার, শ্যঁপা এ্যান্ড মাউন্টেন ডিউ,
ওয়ার মাচ এস্টিমড।
প্রবন্ধ শেষেরদিকে ডাফ তার সাম্রাজ্যবাদিতার দায়িত্বের
ঝুলি খুলে দিয়ে লিখছেন, লাইং ইজ় আ ভাইস হাইলি
ক্যারেক্টারিস্টিক অফ দ্য হিন্দুজ। আই ডোন্ট থিঙ্ক ইট পসিবল এনি পিপল কান বি মোর
এ্যাডিক্টেড টু ইট দ্যান দে আর; এ্যান্ড দেন দ্য কুল ইন্ডিফারেন্স, এ্যান্ড
ডিসগাস্টিং শেমলেস উইথ হুইচ দে লাই, মেকেস দ্য অফেন্স ডবলই এ্যাগ্রাভেটিং। ...ও
হাউ মাচ রিমেইন্স টু বি ডান! হোয়াট ডিফিকাল্টিজ় ইয়েট রিমেইন টু বি আন্ডারগন,
বিফোর, দ্য হিন্দুজ উইল এ্যাপ্রক্সিমেট টো দ্য এক্সেলেন্স হুইচ উইল মেক দেম
এস্টিমেবল ইন দ্য সাইট অব আ ভারচুয়াস মেন!
No comments:
Post a Comment