যে সব ব্রিটিশ আজ সাম্রাজ্যের ফলাফলে গর্বিত তাদের অবস্থান আমরা এই পোড়া
উপনিবেশউত্তর-ভারতের সামান্য প্রজা হয়েও বুঝতে পারি। নানান কুকর্মে দুষ্কর্মে জড়িত দেশি পূর্বজদের পাশে দাঁড়াবার একটা স্বাভাবিক
দেশি প্রণোদনা থাকে, সে বোঝার দায় বয়ে বেড়ানোর উত্সাহ অনেক ব্রিটেনবাসীরই হয়। কিন্তু স্বাধীণ দেশের ভারতীয়রা, যাদের আর ব্রিটেন থেকে সামান্য কিছু
পাউন্ডের খুদকুঁড়ো আর কিছু সরকারি খেতাব ছাড়া আর কিছুই পাওয়ার নেই, তাদের আজও ঔপনিবেশিক
ব্রিটেনের কুকর্মগুলির পাশে দাঁড়ানোর অর্থ সাধারণ যুক্তিবদ্ধ কারনে খুঁজে পাওয়া
দুষ্কর। ব্রিটিশ ব্যতীত ভারতের উন্নতি হওয়া অসম্ভব ছিল যাদের মত,
তাদের নতুন করে জানানোযাক, লুঠেরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য উত্তরাধিকার সূত্রে মোগলদের
তৈরি করা ভারতের সেচ ব্যবস্থাকে বিনিয়োগ না করে ধংস করেছে, ধংস করেছে ভারত সমাজের
প্রাণ কেন্দ্র, একেরপরএক পুকুর, বিড়ম্বনাজনকশর্তে পুঁজি এনে আর ভারতের সাধারণ
রায়তদের করের অর্থে বছরেরপরবছর ক্ষতিতে রেল চালিয়ে ভারতের কাঁচামাল আর টন টন
ভারতীয় শষ্য ব্রিটেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য মানুষমারা রেলপথ তৈরি করেছে, রেল রাস্তার
আশে পাশের অঞ্চলে মন্বন্তর ঘটেছে শয়ে শয়ে, আর রেলরাস্তা তৈরি করতে আর বাঁচাতে,
সম্পদ লুঠ করতে রেলপথের পাশে বড়বড় বাঁধ আর রাস্তা তৈরি করে বাঙলা তথা ভারতের
হাজার হাজার বছর ধরে বিকশিত স্বাভাবিক, অবশিষ্টতম সেচ ব্যবস্থাও ধংস হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় তাঁর আত্মজবনী
আত্মচরিতএ বলছেন, ১৯২২ সালের উত্তরবঙ্গ বন্যা সম্বন্ধে বলা যেতে পারে
যে, যদি গ্রামবাসীর প্রর্থনা গ্রাহ্য করা হইত, তাহা হইলে এই বন্যা নিবারিত হইতে
পারিত, ইন্ততঃপক্ষে ইহার প্রকোপ খুবই হ্রাস পাইত। ...বন্যা হইবার এক বত্সর পূর্বে গ্রামবাসীরা রেলওয়ে বাঁধ সম্পর্কে
গবর্ণমেন্টের নিকট দরখাস্ত করিয়াছিল। দরখাস্তকারিগণ অজ্ঞ গ্রামবাসী, কিন্তু এ কথা তাহারা বেশ বুঝিতে পারিয়ছিল
যে, যদি রেলওয়ে বাঁধের সঙ্কীর্ণ কলভার্টগুলির পরিবর্তে চওড়া সেতু করিবার ব্যবস্থা
না হয়, তবে তাহাদিগকে সর্বদাই বন্যার বিপত্তি সহ্য করিতে হইবে। কিন্তু কার্যতঃ ঠিক ইহাই ঘটিয়াছিল। আসল কথা এই যে, বিদেশী অংশীদারদের স্বার্থের দিকে দৃষ্টি রাখিয়া রেলওয়ে
রাস্তা ও বাঁধগুলি তৈরী করা হয়। খরচা যত কম হইবে, অংশীদারদের লাভের অঙ্কও তত বেশী হইবে। এই কারনে রেলপথ নির্মাণ করিবার সময় বহু পরিসর এত কম করা হয় যাহাতে
সঙ্কীর্ণ কালভার্ট দ্বারাই কাজ চলিতে পারে। আনন্দবাজার পত্রিকা ১৯২২ সালের ২১শে নবেম্বর তারিখে রেলওয়ে বাঁধই যে দেশের
সর্বনাশের কারন এই প্রসঙ্গে সম্পাদকীয় মন্তব্যে লিখিয়াছিলেনঃ- রেলওয়ে লাইনই যে উত্তরবঙ্গের
লোকেদের অশেষ দুঃখ-দুর্দশর কারন এ বিষয়ে আমরা কয়েকটি প্রবন্ধ ইতিপূর্বে লিখিয়াছি। আমদীঘি ও নসরতপুর অঞ্চলের(সান্তাহারের উত্তরে দুইটি রেলওয়ে স্টেশন)
গ্রামবাসীরা, বগুড়ার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মার্ফত্ রেলওয়ে এজেন্টের নিকট দরখাস্ত
করে যে, পূর্বোক্ত দুইটি স্টেশনের মধ্যে রেলওয়ে লাইনে সঙ্কীর্ণ কলভার্টের পরিবর্তে
চওড়া সেতু করা হোক, তাহা হইলে প্রবল বর্ষার পর উচ্চভূমি হইতে যে জলপ্রবাহ, তাহা
বাহির হইবার পথ পাইবে। ইহার উত্তরে রেলওয়ে এজেন্ট জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে নিম্নলিখিত পত্র লিখেনঃ-
মহাশয়, আপনার ১৯২১ সালের ২৫শে এপ্রিল তারিখের পত্র পাইলাম। উহার সঙ্গে উমিরুদ্দীন জেদ্দার এবং আমদীঘি ও তন্নিকটবর্তী গ্রামসমূহের
অধিবাসীগণের যে দরখাস্ত আপনি পাঠইয়ছেন, তাহাতে এই আবেদন করা হইয়াছে যে আমদীঘি ও
নসরতপুর ষ্টেশনের মধ্যে একটি সেতু নির্মাণ করা হউক। তদুত্তরে আমি জানাইতেছি যে, যথাযোগ্য তদন্তের পর আমরা এই সিদ্ধান্ত
করিয়াছি যে, উক্ত স্থনে সেতু নির্মাণের কেন প্রয়োজন নাই। এবং স্বাধীণতার পর এ ধরণের অত্যাচার অনাচার রোখা যাবে এধরণের ভাবনা নিয়ে
স্বাধীণতা আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন বহু মানুষ। স্বাধীণতার পর যে কী হয়েছে, কত মানুষ তথাকথিত উন্নয়ণের জোয়ারে উচ্ছেদ
হয়েছেন, তা আজ আর নতুন করে বলার নেই।
একদা যখন ভারত আর রাশিয়া বিশ্বে
খাদ্যশষ্য রপ্তানির প্রধানতম দেশ ছিল, সে সময় বাঙলা তথা ভারতে মন্বন্তরে কোটি কোটি
মানুষ খাদ্যের অভাবে মারাগিয়েছে- সহজ ভাষায় বললে ব্রিটিশদের লোভ লালসায় খুন হয়েছে। বাল মুকুন্দ ভাটিয়া, ফেমিন ইন ইন্ডিয়াতে
বলছেন, ১৮০০র আগের মন্বন্তরে মারাগিয়েছে মেটামুটি তিরিশ লাখ(৭৬
ধরে কি?)। ১৮০০ থেকে ১৮২৫এর মধ্য পাঁচটিতে খুব
কম (দশলাখ), ১৮৫০-৭৫এ ছয়টি কম(পঞ্চাশ লাখ), ১৮৭৬-১৯০০ পর্যন্ত মোটামুটি (সাড়ে
ছকোটি) মানুষ মারা গিয়েছে, মারা গিয়েছে খুব আলতো শব্দ হল, বলা দরকার ছিল ব্রিটিশরা
ঠান্ডামাথায় মন্বন্তর ঘটিয়ে গণত্যা ঘটিয়েছে। এত মানুষকে
ব্রিটিশ সাম্রাজ্য খুন করার উত্তরে ম্যানচেস্টারের মিল মালিকদের আফসোস ছিল ভারতে
তাদের বস্ত্র পণ্যের বাজার শেষ হয়ে যাওয়ার।
ব্রিটিশ শাসনের আগে যেসব মহামারী ঘটেছে তার বিশদ তালিকা
কবে স্থান কারণ
একাদশ শতাব্দ(দুটি) স্থানীয় অনাবৃষ্টি
ত্রয়োদশ শতাব্দ(একটা) দিল্লিতে কারণ
জানা য়ায় না
চতুর্দশ শতকে(তিনটে) স্থানীয় যুদ্ধের
জন্য শষ্যহানি
পঞ্চদ শতকে(দুটি) ঐ ঐ
ষোড়শ শতাব্দ(তিনটি) ঐ অনাবৃষ্টি
সপ্তদশ শতাব্দ(তিনটি) সর্বত্র অরাজকতা
অষ্টাদশ শতাব্দের প্রথমার্ধ(চারটে) স্থানীয় অনাবৃষ্টি
এবার ব্রিটিশ শাসনে যে সব মন্বন্তর ঘটেছে তার বিশদ
১৭৬৯-৭০ ছিয়াত্তরের মন্বন্তর- বাঙলা সুবা ইংরেজদের খাদ্যসশ্যের ব্যবসা, অনাবৃষ্টি,
বাঙলায় এককোটি, বিহারে অন্ততঃ তিরিশ লক্ষেরও বেশি মানুষকে না খেতে দিয়ে মন্বন্তর
ঘটিয়ে হত্যাকন্ড করেছে ব্রিটিশ রাজ
১৭৮৩ মাদ্রাজ, বোম্বাই মৃত কত আজও হিসেব চলছে
১৭৮৪ উত্তর ভারত ঐ
১৭৯২ মাদ্রাজ, হায়দারাবাদ, বোম্বাই ঐ
দাক্ষিণাত্য, গুজরাট,
মারোয়াড়
১৮০২ বোম্বাই ঐ
১৮০৩-৪ উত্তরপশ্চিম সামান্ত প্রদেশ,
রাজপুতানা ঐ
১৮০৫-০৭ মাদ্রাজ ঐ
১৮১১-১৪ ঐ সামান্য
১৮১২-১৩ রাজপুতানা পাঞ্জাব ২০ লক্ষ
১৮২৩ মাদ্রাজ কত কেউ জানেনা
১৮২৪-২৫ বোম্বাই, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত ঐ
১৮৩৩-৩৫ উত্তর মাদ্রাজ, বোম্বাই ঐ
১৮৩৭-৩৮ উত্তর ভারত ১০ লক্ষ
১৮৫৪ মাদ্রাজ কত কেউ জানেনা
১৮৬০-৬১ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত পাঞ্জাব ৫ লক্ষ
১৮৬৫-৬৬ ওড়িশার ৬টা জেলা, বিহার ও
উত্তরবঙ্গ, মাদ্রাজ ১,৩০,০০০ ১,৩৫,০০০,
৪,৫০,০০০,
১৮৬৮-৬৯ রাজপুতানা ১২ লক্ষ ৫০ হাজার
উত্তর পশ্চিম সীমান্ত
প্রদেশ ৬ লক্ষ
পাঞ্জাব ৬ লক্ষ
মধ্যভারত ২,৬০,০০০
মুম্বাই কত কেউ
জানেনা
১৮৭৩-৭৪ বাঙলা, বিহার, অযোধ্যা,
উত্তর পশ্চিম সীমান্ত ঐ
১৮৭৬-৭৭ বেম্বাই ৯ লক্ষ
হায়দারাবাদ ৭০ হাজার
মাদ্রাজ, উত্তর পশ্চিম
সীমান্ত
আর অযোধ্যা ৮২,৫০,০০০
মহীশূর ১১,০০,০০০
১৮৮০ দাক্ষিণাত্য, দক্ষিণ বোম্বাই,
মধ্যপ্রদেশ, হায়দারাবাদ,
উত্তর পশ্চিম সীমান্ত অজ্ঞাত
১৮৮৪ বাঙলা, বিহার, ছোটনাগপুর,
মাদ্রাজের কয়েকটি জেলা, অজ্ঞাত
১৮৮৬-৮৭ মধ্যভারত অজ্ঞাত
১৮৮৮-৮৯ বিহার, ওড়িশা, গঞ্জাম
মাদ্রাজ, কুমায়ুন,
গাড়োয়াল ১৫ লক্ষ
১৮৯১-৯২ মাদ্রাজ, বোম্বাই, দাক্ষিণাত্য, বাঙলা ১৬ লক্ষ ২০ হাজার
১৮৯৫-৯৭ বুন্দেলখন্ড, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত
বাঙলা, অযোধ্যা, মধ্যভারত ৫৬,৫০,০০০
১৮৯৯-১৯০০ ভারতের সর্বত্র ২৫ লক্ষ
১৯০১ গুজরাট, দাক্ষিণাত্য, বোম্বাই
কর্ণাটক, মাদ্রাজ,
পাঞ্জাবের দক্ষিণ ৭,০৫,০০০
অমর্ত্য সেন বন্দিত গণতন্ত্রিক ব্রিটিশ সরকারের হিসেবে
১৮৫৪ থেকে ১৯০১ পর্যন্ত ভারতে দুর্ভিক্ষের মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৮৮ লক্ষ ২৫
হাজার। এগুলি শুধুই
সংখ্যামাত্র। এ আগে কত ঘটেছে শুধু
অনুমান করাযায়মাত্র। ভারতে রেলপথ সৃষ্টির
সঙ্গে দুর্ভিক্ষের সরাসরি সম্পর্কটি চোখে আঙুলদেওয়া। কিন্তু খুব একটা প্রকাশ্যে আসে নি আজও। বাল মুকুন্দ ভাতিয়া ছাড়া ঐতিহাসিকদের আজও নজর পড়েনি এই রেললাইন সৃষ্ট
মন্বন্তরগুলিতে। ১৮০২ থেকে ১৮৫৪
পর্ষন্ত ভারতে মোট ১৩টি দুর্ভিক্ষ হয়েছে আর কোম্পানি সরকারের হিসেবে মৃত্যু ঘটেছে
মাত্র ৫০ লক্ষের কাছাকাছি কোনও একটা
সংখ্যা। অথচ রেলপথ পাতার পরে,
১৮৬০ থেকে ১৮৭৯ পর্যন্ত ভারতে ঘটেছে ১৬টা বড় মন্বন্তর আর তাতে মারা গিয়েছেন ১
কোটি ২০ লক্ষ মানুষ। এটিও সদাশয় ব্রিটিশ
সরকারের তৈরি হিসেব। আদত হিসেব কত কেউ
জানেনা।
No comments:
Post a Comment