নীলকর শার্দুল
নীলচাষে বাঙলা-বিহারের কৃষকেরা নীলকরদের ভূমিদাসে পরিণত হল। বাঙলার বিশিল্পায়ণের সঙ্গে ইংলন্ডের শিল্পায়ণ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই ইংলন্ডের শিল্পের জন্য আফিম, নীল, পাট, তন্তুচাষ, ধাতু, কাঠ, কাঁচা
চামড়াসহ নানান দ্রব্য সরবরাহ করতে হত প্রচুর পরিমানে। এগুলি করবরাহ করতে গেলে অধিকাংশ দ্রব্য চাষ করতে হয়। তাই ভারতকে ব্রিটেনের কাঁচা মালের বাজার হিসেবে গড়ে তুলতে কোম্পানিকে
সরাসরি বাঙলার স্বাধীণতা সংগ্রামী প্রজাদের সঙ্গে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোযণা করতে হল। এই চাষগুলি করতে বিপুল পরিমান চাষীর সঙ্গে চুক্তি চাষে যেতে হয়, এই
কাঁচামালের বাজার কোম্পানি কোনও ভাবেই এ দেশের মানুষদের সঙ্গে অংশিদারিত্বে
করবেনা, অন্য ভাষায়, লাভের বখরা সে দেশেই নিয়ে যাবে বা স্বদেশির সঙ্গেই করতে
ইচ্ছুক, তাই তাকে সরাসরি ইংলন্ড থেকে অনুগত প্রজাও এ দেশে আনতে হল এবং তাদেরকে
দেশে বসবাসের আর ব্যবসার জন্য জমিকেনার অনুমতি দেওয়ারও ব্যবস্থা হল ১৮৩৩এর আইনে। ইংরেজ কথিত ভারতের নবজাগরণের অগ্রদূত রামমোহনের শিষ্য দ্বারকানাথ নিজে
নীলকর ছিলেন তাই নয়, এই দুজন তাঁরা নীল বা আফিম স্বাধীণতা সংগ্রামের বিরুদ্ধেও
ইংলন্ডে গিয়ে শুধু প্রচার চালান নি, তাঁরা ব্রিটিশদের বাঙলায় স্থায়ীভাবে জমিকেনার
যা সে সময় কলোনাইজেশন আন্দোলনরূপে পরিচিত ছিল, তার পক্ষেও জোরদার সওয়াল করেন।
১৮৩৩এর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সনদে সরাসরি সাম্রাজ্যের
বন্ধুদের লড়াইতে ইংরেজরা ভারতে জমিকেনার অধিকার লাভ করে। বহু দাস কুখ্যাত ব্যবসায়ী বাঙলা-বিহারে প্রচুর পরিমানে জমি কিনে(তখন আর
জমির কীইবা দাম ছিল) বড় জমিদারে রূপান্তরিত হয়ে পড়েন। অনেকে আবার কোম্পানি সরকারের নানান দপ্তরকে কাজে লাগিয়ে প্রায় জলের দরে জমি
কেনার কাজ সেরে ফেলেন। দাস ব্যবসার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে,
নদিয়া-যশেরের বেঙ্গল ইন্ডিগো কোম্পানি, ৫৯৪টি গ্রাম সমেত এক বিশাল এলাকার
দখল নেয়। এই কোম্পানি বিশাল জমিদারি বাবদ
সরকারকে বছরে সে যুগের তিন লক্ষ চল্লিশ হাজার টাকা খাজনা দিত। শুধু নদিয়াতেই কোম্পানির মূলধন খাটত ১৮ লক্ষ টাকা। সতীশচন্দ্র মিত্র যশোহর-খুলনার ইতিহাস পুস্তকে লিখছেন সে সময় সুযোগবুঝে
বহু জমিদার তার জমিদারি পত্তনিতেই দিয়ে দিতেন। ১৮১৯ খ্রীষ্টাব্দের অষ্টম আইনে
জমিদারদিগকে পত্তনি তালুক বন্দোবস্ত করিবার অধিকার দেওয়ায় এক এক পরগণার মধ্যে
অসংখ্য তালুকের সৃষ্টি হইল এবং জমিদারগণ নীলকরদিগের নিকট বড় বড় পত্তনি দেতে
লাগিলেন। এদেশীয় সম্পত্তিশালী ব্যক্তিরাও
নিজেদের অথবা পরের জমিদারির মধ্যে পৃথকভাবে পত্তনি লইয়া নীলেপ ব্যবসায়ে যোগ দিলেন,
তাহাদের মধ্যে নাড়াইলের জমিদার ছিলেন অগ্রণী। প্রমোদ সেনগুপ্ত নীল স্বাধীণতা সংগ্রাম বইতে
প্রসন্নকুমার ঠাকুরের একটি উদ্ধৃতি দিয়েছেন, আলস্য,
অভিজ্ঞতা আর ঋণের জন্য দেশীয় জমিদারগণ জমি পত্তনি দিতে উদগ্রীব হন, কারণ ইহাতে
তাহারা জমিদারি চালাইবার দায় হইতে নিষ্কৃতি লাভ করেন এবং জমি পত্তনি দানের ন্যায়
একটা নিশ্চিত আয়ের সাহায্যে রাজধানীতে কিংবা কোন একটা বড় শহরে বাস করিতে পারেন।
এবার নীলকরদের কাজের পদ্ধতিগুলি একটু নজর দিয়ে দেখা যাক। যেহেতু সে সময় যশোর-খুলনা অঞ্চলে নীলচাষ বিশাল পরিমানে হত, তাই
সতীশচন্দ্র মিত্রমশাইএর যশোর-খুলনার
ইতিহাস পুস্তকটি এই প্রসঙ্গ আলোচনায় আজও অন্যতম প্রামাণ্য দলিলরূপে পরিগণিত হয়। সতীশ মিত্রমশাই তার পুস্তকে বলছেন, নীলচাষের
জন্য বহু যৌথ কোম্পানি স্থাপন করিয়া ছিলেন। এই সকল
কারবারকে বলা হইত কনসার্ন। একএকটি কনসার্নএর মধ্যে নানান স্থানে
কতগুলি কুঠি(ফ্যাক্টরি) থাকিত। কনসার্নের মধ্যে প্রধান কুঠির নাম
ছিল সদর কুঠি। ম্যানেজারের অধীনে কতগুলি দেশিয়
কর্মচারী থাকিতেন, তন্মধ্যে প্রধান ছিলেন নায়েব বা দেওয়ান। উহার বেতন ৫০ টাকা। নায়েবের অধীনে থাকিতেন গোমস্তা। রায়তদের হিসবপত্রের সহিত উহাদেরই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এই জন্য তাহারা প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যভাবে দস্তুরি বা উত্কোচ লইয়া বেশ
দুপায়সা আয় করতেন। সাহেবদের অশ্লীল গালাগালি বা বুটের
আঘাত উহারা বেশ হজম করিতে জানিতেন এবং কোন প্রকার মিথ্যা প্রবঞ্চনা বা চক্রান্তে
পশ্চাদপদ না হইয়া ইঁহারা অনেক দেশীয় প্রজার সর্বনাশ বা মর্মান্ততিক যাতনার হেতু
হইয়া দাঁড়াইতেন। ইঁহাদের মধ্যে ভাললোক বেশীদিন ভাল
থাকিতে পারিত না। গোমস্তা ব্যতীত জমি মাপের আমীন, নীল
মাপের জন্য ওজনদার, কুলি খাটাইবার জন্য জমাদার বা সর্দার, খবর প্রেরণের জন্য ও
সময়মত রায়তগণকে কাজের তাগাদা করার জন্য তাগিদগীর থাকিত।
মিত্র মশাইএর দেওয়া বিবরণ হিসেবে, যশের খুলনা আর নদিয়া
এই তিন জেলার যে সব বড় কনসার্ন গড়ে উঠেছিল তারমধ্যে বেঙ্গল ইন্ডিগো
কোম্পানি সব থেকে বড় ছিল। এর অধীনে
চারটি বড় কনসার্ন ছিল। সবথেকে বড়টা ছিল মোল্লারহাটি, যে
অঞ্চলের নানান সত্যি কাহিনী ভিত্তি করেই দীনবন্ধু মিত্র নীলদর্পণ নাটকখানি রচনা
করেছিলেন। এছাড়াও ছিল হাজরাপুর কনসার্ন, সিন্দুরিয়া
কনসার্ন, জোড়াদহ কনসার্ন, খড়গড়া কনসার্ন, মহিযাকুন্ড কনসার্ন, নহাটা কনসার্ন,
শ্রীখন্ডী-হরিপুর-নিশ্চিন্তপুর (নাড়াইলের জমিদারদের কনসার্ন)কনসার্ন, রামনগর
কনসার্ন, মদনধারী কনসার্ন ইত্যাদি প্রত্যকটি কনসার্নে ছয় বা সাতটা করে কুঠি ছিল। ১৮৫৯ পর্যন্ত বছরে গড়ে এই তিন জেলায় ১০,৭৯৯মন নীল উত্পাদন হত।
নীল চাষের দুটি ব্যবস্থা – নিজ আবাদী আর রায়তী বা দাদনী আবাদী। নিজ আবাদীতে
নীলকরের নিজের জমিতে দিনমজুর অথবা ক্ষেমজুর দিয়ে চাষ করায়। সাধারণতঃ নিজ আবাদীতে দূর দূর থেকে মজুর এনে চাষ করাতে হত। এর জন্য পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, মানভূম, সিংভূম থেকে সাঁওতাল শ্রমিক
এনে চাষ করাতে হত। পুরুষ শ্রমিকদের মজুরী ছিল মাসিক তিন
টাকা আর মহিলাদের দুই টাকা। এছাড়াও তাদের
থাকা খাওয়ার সমস্ত ব্যয় করতে হত নীলকরদের। আর রায়তী
আবাদীতে অগ্রিম দিয়ে রায়তদের জমিতে নীল চাষ করানো হত চাষীকে মাত্র দুটাকা দাদন
দিয়ে। এই দুটাকায় রায়তকে লাঙল, সার, বীজ, নিড়ান দেওয়া,
গাছকাটা সমস্ত ব্যয় করে কুঠীতে গাছ পৌঁছে দিয়ে যে টাকা পেত তাতে তার তিন চারগুন
লোকসান হত। রায়তের ক্ষতিতেই নীলকরের লাভ। নীলকরের লাভ হত কম করে একশ টাকা। ১৮৬০ সালের
নীল কমিশনের হিসেবে নিজ আবাদীপ্রথায় দশহাজার বিঘে চাষের জন্য ব্যয় হত আড়াই লক্ষ
টাকা। কিন্তু রায়তী ব্যবস্থায় বিঘেয় দুটাকা অর্থাত কুড়ি
হাজার টাকা ব্যয় করলেই লাখ লাখ টাকা মুনাফা হত।
রাণাঘাটের জয়চাঁদ পালচৌধুরী কমিশনের সামনে সাক্ষ্যতে
বলছেন, যেখানে আটখানা লাঙলের (মজুর সমেত)
বাজারদর ছি্ল এক টাকা, সেখানে নীলকরদের দাম ছিল টাকায় ষোলখানা। তারপর জয়চাঁদ স্বীকার করেন যে, সব নীলকরই ঐ দর দিত, সুতরাং আমিও তাই দিতাম। নীলচাষে রায়তের কোনও ই লাভ থাকেনা। জয়চাঁদের মতে নীল চাষের জন্য
নীলকরকে খুব কম খরচ করতে হত। জয়চাঁদ একজন সাধারণ রায়তের হিসেব
দিয়ে দেখিয়েছেন যে, এই চাষীটির দুই বিঘায় নীল চাষ করতে খুব কম খরচ হত দশটাকা তের
আনা(তাছাড়া চাষীকে জরিমানা বাবদ খরচ করতে হত যেমন গরুর অনধিকার প্রবেশের জন্য গরু
পিছু প্রতিদিন ছয় আনা। এই খরচগুলি হিসাবের খাতায় উঠতনা,
কারন গরু ছাড়িয়া আনার সঙ্গে সঙ্গে চাযীকে এই টাকা দিতে হত।) তারপর তার ফসলের জন্য চাষী কি পেত! তার ফলস হয়েছে ত্রিশ বান্ডিল, টাকায়
আট বান্ডিল দরে তার দাম হয় চার টাকা। যেখানে তাকে
ফসল তৈরি করতে খরচ করতে হয়েছে দশ টাকা সেখানে তার লোকসান হচ্ছে ছয় টাকা তের আনা। পরিস্কার দেখাযাচ্ছে যে রায়ত মদুরি বাবদ কিছুই পাচ্ছেনা। অর্থাত নীলকরের জন্য তাকে সারা বছর বেগার খেটে দিতে হচ্ছে। এসবের পরেও চাষাকে আমলাদের দস্তুরি কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়ে দিতে হত। যাক পরিমান আট আলা থেকে দশ আনা। এি পন্থায় যে
চাষী নীলকরের কাছে একবার দাদন নিয়েছে, সেই দাদন আর কোন কালেই শোধ হত না।
জয়চাঁদকে যখন প্রশ্ন করা হয় এত লোকসানের পর নীল করের
জন্য নীলচাষী নীল চাষ করছেন কেন, এর উত্তরে তিনি বলেন এর কারণ নীলকরদের অসংখ্য প্রকার অত্যাচার ও বলপ্রয়োগ, যথা রায়তদের
গুদামঘরে আটক রাখা, তাহাদের ঘরবাড়ি জ্বালাইয়া দেওয়া, তাহাদের ওপর মারপিট আরও
বিভিন্ন প্রকারের উত্পীড়ন ইত্যাদি। মুর্শিদাবাদের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ককবার্ন কমিশনকে বলেছিলেন, যেসব নীলকর জমিদার হয়েছে তারা প্রজা রক্ষা
আইনের কথা শুনলে হাসে। কোন আইনই তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা
যায় না এই কারনে যে যতক্ষণ প্রজার সবকিছু নীলকরের মুঠোর মধ্যে রয়েছে ততক্ষণ
পর্যন্ত প্রজা আইনের সাহায্য নিতে কিছুতেই সাহস পাবে না। আদতে ইংরেজ নীলকর আর তাদের ভারতীয় সাঙ্গপাঙ্গরা নীল
চাষীদের দন্ডমুন্ডের কর্তা। ইংরেজ আইনে সে
যথাবিহিত সুরক্ষিত। ইচ্ছে করে খুন করেও যে পার পেয়ে যেত। ফরিদপুরের ম্যাজিস্ট্রেট ডোলাতুর কমিশন কে জানাচ্ছেন, এরকম একএকটা বাক্স নীলও ইংলন্ডে পৌঁছয় না যা
মানুষেক রক্তে রাঙা নয় – এই উক্তির জন্য মিশনারিদের সমালেচনা
করা হয়েছে, কিন্তু এটা আমারও কথা। ফরিদপুর জেলার ম্যাজিস্ট্রেট
থাকাকালীন আমি যে অভিজ্ঞতা আর্জন করেছি তার ভিত্তিতে আমি জোরের সঙ্গে বলতে পারি এই
কথা সম্পূর্ণ সত্যি। আমি অনেক প্রজাকে দেখেছি যাদের দেহ
বল্লমদিয়ে গেঁথে দেওয়া হয়েছিল, বেশ কয়েকজন প্রজার দেহ আমার কাছে আনা হয়েছিল যাদের
দেহ নীলকর ফোর্ডএর গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল। আরও কয়েকজন
প্রজার কথা জানি যাদের দেহ বল্লমদিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
No comments:
Post a Comment