ক্লাইব এবং তাঁহার কৌন্সিল মেম্বরগণ কলিকাতার ট্রেডিং এসোসিয়েশন নামে একটি
বণিকসভা সংস্থাপন করিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া
কোম্পানির প্রায় সমুদায় ইংরেজ কর্মচারি বণিকসভার মেম্বর হইলেন। নিয়ম হইল যে দেশের মধ্যে যত লবন, তামাক ও গুবাক উত্পন্ন হইবে তত্সমুদয়
প্রথমতঃ দেশীয় লোকদিগকে এই বণিকসভার নিকট বিক্রি করিতে হইবে। পরে বণিকসভা সেই সকল পণ্যদ্রব্য দেশীয় বণিকদিগের নিকট বিক্রয় করিবেন। দেশীয় বণিকগণ বণিকসভার নিকট হইতে এরূপ লবন, তামাক এবং গুবাক ক্রয় করিয়া
লইয়া দেশীয় জনসাধারণের নিকট বিক্রয় করিতে পারিবে। দেশীয় বণিকগণ দেশীয় লোকের নিকট এই সকল পণ্য দ্রব্য কখনও ক্রয় করিতে পারিবে
না।
মূল্য সম্বন্ধে আবার নিয়ম হইল যে বণিকসভা এদেশের লবন প্রস্তুতকারিদিগের
নিকট হইতে পঁচাত্তর টাকা মূল্যের একশতমন লবন ক্রয় করিবেন। পরে তাহার পাঁচ টাকা মূল্যে সেই লবনের এক এক শত মন দেশীয় বণিকদের নিকট
বি্ক্রয় করিবেন। দেশীয় বণিকগণ পাঁচশত টাকা মূল্যে এক
এক শত মন লবন ক্রয় করিয়া তাহার উপর নির্দিষ্ট লাভ রাখিয়া জনসাধারণের নিকট সেই লবন
বিক্রয় করিবে।
পাঠক! একটু চিন্তা করিয়া দেখ এটি লুঠ না বাণিজ্য। বঙ্গদেশে এই সময় হয়ত পাঁচটাকা সিকা হারে একমন লবন বিক্রয় হইত। প্রজাগণ দুইটি পয়সা দিয়া একএকসের লবন ক্রয় করিত। কিন্তু একদিকে দেশের লবন নির্মাতা মহাজন ও মালঙ্গীদিগকে পাঁচ সিকার স্থানে
প্রত্যেক মণ বারো আনা মূল্যে ইংরাজ বণিকসভার নিকট বিক্রয় করিতে হইল। পক্ষান্তরে দেশীয় সমুদয় প্রজাদিগকে পাঁচসিকার স্থানে সাত টাকা সাড়ে সাত
টাকা হারে লবন ক্রয় করিতে হইল। সমুদায় লোকেরই
লবনের প্রয়োজন আছে। কিন্তু যখন
দেশীয় বণিকগণকে পাঁচটাকা মূল্যে একএকমন লবন ক্রয় করিতে হইল, তখন সাত-সাড়ে সাত
টাকার কমে তাহারা সে লবন বিক্রয় করিলে তাহাদের কিছুই লাভ হয় না। যাহাতে বণিকসভার অপরিমিত লাভ হইতে পারে সেই উদ্দেশ্যে সমুদয় দেশীয়
লোকদিগকে ক্ষতিগ্রস্ত হইতে হইল(নন্দকুমার ও শতবত্সর পূর্বের বঙ্গ
সমাজ – চন্ডীচরণ সেন)।
১৭৭০এর দুর্ভিক্ষ – ৭৬এর মন্বন্তর
বাঙলা সমৃদ্ধিকে ছারখার করে দিল। কোম্পানি
৯০,০০০ টাকা ব্যয় করল তিন কোটি মানুষের জন্য। ইতোমধ্যে ১৭৭২এ কোম্পানির চাকুরে হয়ে হেস্টিংস ভারতে(তখন ব্রিটিশ ভারত
বলতে বাঙলা প্রধাণতঃ) এলেন, দেখলেন আর লুঠ করলেন। তখন ক্লাইভের বাঙলার লুঠতরাজি শেষ। তখনও কিছুটা
হলেও বাঙলায় নুনের বাণিজ্য ইংরেজদের নজরের বাইরে। তখনও এক মন নুনের ওপর কর মাত্র তিন পয়সা। হেস্টিংস এসে নুনের ওপর দখল নিলেন। মনেরাখা দরকার
নুনের ওপর দখলের অর্থ যুদ্ধের অন্যতম অপরিহার্য উপকরণ সল্টপিটারেরওপর নিয়ন্ত্রণ।
বিভিন্ন জমিদারিরমতই নুন মহল ইজারাদারির আওতায় চলে গেল। বাঙলার নুন তৈরির প্রধান স্থানগুলি ছিল, মেদিনীপুরের উপকূল অঞ্চল নামে
পরিচিত যা আদতে তমলুক বা হিজলি অঞ্চল, আজকের কাঁথি উপকূল। এছাড়াও বাখরগঞ্জ, খুলনা, নোয়াখালি আর চট্টগ্রামের সমুদ্রতীরেও নুন তৈরি
হত। মোগল আমলে নবাবের কাছাকাছি থাকা ব্যবসায়ীরা মালঙ্গীদের
সঙ্গে সরাসরি ব্যবসা করলেও নুন তৈরি আর তা বিক্রিতে মালঙ্গীদের অধিকার খর্ব করে নি। ব্রিটিশ আমলের আগেও মালঙ্গী আর সাধারণ ব্যবসায়ীদের যথেষ্ট কাজের সুযোগ ও
পরিবেশ ছিল।
লুঠেরা ব্রিটিশ আমলে সমগ্র পরিবেশটিই পাল্টেগেল। লেস্টর হাচিনসন বলছেন একদা ভারতে চাকরি করতে গেলে কোম্পানির সঙ্গে
ব্যক্তিও সরকারের সঙ্গে সরাসরি লুঠের বখরা পাবে, এই লোভ দেখিয়ে ভারতের চাকরিতে
আসার গাজর ঝোলাত ব্রিটিশ কোম্পানি মহামহিমরা। এ ছাড়াও সে ব্যবসায় ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের কোনও করও দিতে হত না। বাঙলায় এসে তাই সরাসরি লুঠকার্যে নেমে পড়ত কোম্পানির কাজে আসা বহু
উচ্চপদস্থ কর্মচারী। এন কে সিংহ বলছেন, মির কাশেমের সঙ্গে
ব্রিটিশদের যুদ্ধের কারনই হল বিনা শুল্কে ব্যবসা করার অধিকার দেওয়ার দাবি। বিশেষ করে নিমক মহলে নুনের ব্যবসার নিয়েও ঝগড়া লাগে। ক্লাইভ বিশেষ সুবিধাভোগীদের নিয়ে সাধারণ রায়তমানুষের দেওয়া করে ১৭৬৫তে যে
ব্যক্তিগত কোম্পানি বলাভাল ক্লাবটি বানিয়েছিলেন সেই ক্লাবের সদস্যরা দেশিয়
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নুন উত্পাদক, মালঙ্গীদের সমস্ত ঐতিহাসিক যোগাযোগ ছিন্ন করে দেয়। মালঙ্গীরা একচেটিয়া ব্রিটিশ ব্যবসা ভিত্তিক শোষণের শিকার হয়ে পড়ে।
মনেরাখা দরকার এই বিশেষ সুবিধাভোগী ক্লাবটি ব্রিটিশদেরই
বিরোধিতায় ১৭৬৮তেই উঠে যায়। তবুও দেশিয়
ব্যবসায়ীরা নতুন এই সুযোগ নিতে পারেনি, ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা সরাসরি এই ব্যবসার ওপর
তাদের নিয়ন্ত্রণ ছাড়েন নি। ঐতিহ্যবাহী
বাঙালি ব্যবসায়ীরা হয়ে পড়লেন কোম্পানি কর্মচারী থেকে ব্যবসায়ী বনে যাওয়া
ব্যক্তিদের গোমস্তা, অর্থাত দালাল। এরাই
ব্রিটিশদের ব্যবসায়ীদের ধামাধরা হয়ে অমিত অত্যাচার শুরু করলেন দেশিয় উত্পাদকদের
ওপর। মালঙ্গীরাও বাদ গেলেন না। কোম্পানি আরও লুঠ লাভের জন্য লবনের ব্যবসার ওপর শতকরা ৩০ টাকা কর ধার্য করে।
১৭৭২ সাল থেকে নতুন করে কোম্পানির লুঠের যুগ শুরু হল। ভারতে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এসে নুন ব্যবসা নতুন করে সরকারি
নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলেন। সরকারিভাবে কোম্পানি কর্মচারীদের
ব্যক্তিগত ব্যবসা অবৈধ হলেও অবাধে কোম্পানির আমলারা বাঙলা জুড়েই ব্যবসা করতেন
গোমস্তা আর নায়েবদের সঙ্গে নিয়েই। ১৭৮০তে আবার
নতুন করে এক ব্যবসার নীতি প্রণীত হল। কেম্পানি এক
উচ্চপদস্থ কর্মচারীর অধীনে প্রত্যেকটি অঞ্চলে একজন করে এজেন্ট নিযুক্ত হল। মালঙ্গীরা এই এজেন্টদের কাছে দাদন নিয়ে চুক্তিবদ্ধ হতেন। এজেন্ট ছাড়া খোলা বাজারে নুন বিক্রি বন্ধ হল। ক্রমশঃ নুন ব্যবসা সরকারি আর সরকারি আমলা-ব্যবসায়ীদের এঅকচেটিয়া দখলে চলে
যাওয়ায় বাঙলার সাধারণ বাজারে নুনের আকাল দেখা দিল। এর ফলশ্রুতি নুনের মূল্যবৃদ্ধি। আলিবর্দি খাঁর
সময় যে একশ মন নুনের দাম ছিল ৪০ থেকে ৬০ টাকার কাছাকাছি, সেই দ্রব্য ১৭৭৩এর
কোম্পানি আমলে বেড়ে দাঁড়াল ১৭০ টাকা, ১৭৭৮এ ৩১২ টাকা, ১৭৯০তে ৩১৪ টাকা, ১৭৯৬
থেকে ১৭৯৭ ৩০৮ টাকা, ১৭৯৮তে ৩৮০টাকা, ১৮০৩ সালে ৩৪২ টাকা। এদেশে খাদ্যদ্রব্যের অন্যতম প্রধান উপাদান নুন মানুষের আওতার বাইরে চলে
যাওয়ায় দেশের মানুষের যে স্বাস্থ্য ভাঙার কাজটি করল কোম্পানি তাতে সব থেকে বড়
লাভটি ঘটল তা হল রাজস্বের পরিমান বৃদ্ধি পাওয়া। ১৭৮০র নতুন ব্যবস্থায় কোম্পানির রাজস্ব ২,২৯,১৯২ পাউন্ড থেকে বেড়ে
দাঁড়ায় ৬,৫৫,৮৪৮ পাউন্ড। সরকারি রিপোর্টে স্পষ্ট বলা হয়েছে,
শুধু মানুষই নয়, পশুরাও তাদের জীবনধারণের অন্যতম উত্স নুন থেকে বঞ্চিত হল।
লবন অবাধ লুন্ঠনে সব থেকে ক্ষতি হল বাঙলার মালঙ্গীদের,
যারা হাজার হাজার বছর ধরে অত্যধিক পরিশ্রমে বিশ্বকে বাঙলার নুন খাইয়ে এসেছে। বাঙলার তমলুক অঞ্চলে যাদের মালঙ্গী বলাহত, খুলনার সুন্দরবন অঞ্চলের নবন
উত্পাদকদের বলাহত, মাহিন্দর। যে দপ্তর থেকে
নুন ব্যবসাটি নিয়ন্ত্রত হত, তার নাম নিমক চৌকি। এই চৌকিতে কয়েকশ দারোগা একজন এজেন্টের অধীনে নিয়মিত নজরদারি রাখত। মাহিন্দারদের অগ্রিম অর্থ দাদন দিয়ে সংগ্রহ করত মালঙ্গীরা। মাহিন্দাররা ছিল ছোট চাষী। দারোগাদের অত্যাচারে
বহু মাহিন্দর এলাকা থেকে পালিয়ে যেতে থাকে। অত্যাচারী
ইউয়ার্টএর বিরুদ্ধে স্থানীয় মাহিন্দরেরা স্বাধীণতা সংগ্রাম করেন। শেষ পর্যন্ত ইউয়ার্টকে খুলনায় বদলি করা হয়। ১৭৯৩তে ২৯নং রেগুলেশনের মাধ্যমে ব্রিটিশরা নিজেরদের অত্যচারী কর্মচারীদের
বিরুদ্ধে নানান নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করে। কিন্ত
দেখনদারি ছাড়া কাজের কাজ কিথু হয় নি।
তবে বাঙলায় সবথেকে বড় নুন উত্পাদনের কেন্দ্র ছিল তমলুক
হিজলি বা কাঁথি অঞ্চল, নিমক মহলের সরতাজ। অঞ্চলে প্রায়
৬০ হাজার মালঙ্গী এই কাজে নিযুক্ত ছিলেন। প্রতকটি বছর
আট লক্ষ মন নুন তৈরি হত। মালঙ্গীদের দুটিভাগ ১) আজুরা মালঙ্গী
আর ২) ঠিকা মালঙ্গী। এছাড়াও নুন তৈরিতে সরাসরি
জড়িয়েছিলেন ছিলেন কুলি, মাঝি, গাড়োয়ান, ওজনদারসহ নানান পদের মানুষজন। আজুরা মালঙ্গীরা ছিল সংখ্যায় অনেক বেশি। ঠিকা মালঙ্গীরা চারভাগে ভাগ ছিল, ১) মহাজৌনদার, ২) জৌনদার, ৩)
মুধুম-নাদার, ৪) নাদার। নাদারেরা ছিলেন প্রায় পনের হাজারেরমত। এতমামদার আর হুদ্দাদাররা মালঙ্গীদের দাদন দিত। তাই তারা ছিল দন্ডমুন্ডের কর্তা। এতমামদারেরা
ইচ্ছেমত মালঙ্গীদের খাটাতে পারত। কয়েক অঞ্চলের
এতমামদারদের বলাহত হুদ্দাদার বা লবন কারখানার মালিক। মালঙ্গীদের আর এক শত্রু ছিল কয়াল, ওজনদার। কয়ালরা সরাসরি কোম্পানিদ্বারা নিযুক্তহত বলেই এরা অত্যাচারের সীমা ছাড়িয়ে
প্রচুর নুন চুরি করত। এছাড়াও অত্যাচার করত দারেগা,
শাবান্দার(কেরানী)। মালঙ্গীদের বেতমারা, কয়েদ, প্রহার
সবই ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। এছাড়াও কম মজুরিতেও কাজ করতে হত।
এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে ১৭৯৩তে মার্চ-এপ্রিলে
মেদিনীপুরের দুরুদুমনান পরগণার ৩০০ আজুরা মালঙ্গীদের পরিবার জমিদার আর দারোগাদের
অত্যাচারে মুড়াগাছা অঞ্চলে পালিয়ে যান। ১৮৯৪তে ১৫টি
পরিবার কয়ালদের অত্যাচারে হাওড়ার তন্তুবেড়িয়া গ্রামে পালিয়ে আসেন। ১৭৯৩তে স্বাধীণতা সংগ্রামের আগুণ ঘনিয়ে ওঠে। ১৭৯৯তে বীরকুল, বালিসাই, মিরগোদা প্রভৃতি পরগণায় রাম দিন্দা, ভগবান মাইতি,
হারু মন্ডল, হারু পাত্র, জয়দের সাউ, বলেন কুণ্ডু আর বৈষ্ণব ভুঁইয়াদের নিয়ে তৈরি হয়
একটি স্বাধীণতা সংগ্রামী নেতৃত্ব গোষ্ঠী। ১৮০০ সালের ২৯
এপ্রিল বীরকুল পরগণা, দীঘা, বলাশয় আর মীরগোদা পরগণায় বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। বিক্ষোভের ঢেউ এসে ঝাপটা মারে কাঁথিতে।
মালঙ্গীদের নায়ক বলাই কুন্ডু কোম্পানির সন্ট কমিটির
প্রেসিডেন্ট ও আমলাদের নির্দিষ্ট দাবিপত্র পেশ করেন। দাবি ছিল আরও বেশি লবন তৈরির মজুরি বৃদ্ধি আর বেগার প্রথা রদ করা। ১৮০৪এ প্রেমানন্দ (মতান্তরে পরমানন্দ) সরকার নুন কারখানা ঘুরে ঘুরে
মালঙ্গীদের সংঘবদ্ধ করতে ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেন। এতেও কাজ না হওয়ায় মালঙ্গীরা জানুয়ারি মাসের শেষে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তিনশ মালঙ্গী কাঁথির লবন এজেন্টএর দপ্তর ঘোরাও করে। ফারপুহার সনএর কাছারিতে হাজির হন। ১৮০৬এর ৫ মে একশ অনুচরসহ ম্যাসনের দপ্তর ঘেরাও করেন এবং
তাদের দাবি মেনেনেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে থাকেন। ঘেরাও চলাকালীন, এজেন্টদের পাইক
বরকন্দাজ প্রেমানন্দকে গ্রেফতার করলে মালঙ্গীরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। মালঙ্গীদের দাবি পূরণ করার আশ্বাস দিলে ঘেরাও ওঠে। কিন্তু কাজের কাজ হয় না। এরপর কী ঘটেছিল
সে সম্বন্ধে ইতিহাস নীরব (মেদিনীপুর পত্রিকা, ৪র্থ বত্সর, ১৩৬২ শারদীয় সংখ্যা)।
এতেও লুঠেরা ব্রিটিশদের মন ওঠেনি। ভারতে লবন কর সংগ্রহের জন্য সরকার লবন হেজ অর্থাত গুল্মজাতীয় গাছের বেড়া তৈরি
করে। এই কাজটি শুরু হয় কোম্পানি আমলে ১৮০৩
সালথেকে এলাকার বাইরের অবৈধ নুন আমদানি বন্ধ করার জন্য। কোম্পানির পরিচালনায় ভারত সরকার নির্দিষ্ট এলাকায় একটি করে লবন চৌকি বসায়,
যা আদতে একটি লাইনেরমতই দেখায়। ভারতে ব্রিটিশ
অধিকার বাড়তে থাকায় এই লাইন ক্রমশঃ ছড়াতে থাকে। শেষ পর্যন্ত প্রায় ৪ হাজার কিমি ধরে এই লাইনের দৈর্ঘ তৈরি হয়। পাঞ্জাবের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত থেকে শুরু হয়ে, এই হেজ বঙ্গোপসাগরের তীর
ওড়িশা রাজ্যে শেষ হয়। ১৮৪৩এ এই চৌকিগুলি ইনল্যান্ড কাস্টমস
দপ্তরের অধীনে যায়। স্বাধীণতা সংগ্রামীদের হাত থেকে এই
চৌকিগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে এগুলি ঘিরে নানান মৃত গুল্মসহ ভারতীয় পাম গাছ লাগানো হয়। কিন্তু ক্রমশঃ এগুলি জাবিত গাছে রূপান্তরিত হয় এবং প্রায় দুমানুষ উঁচু (প্রায়
১২ ফুট)দেওয়ালে রূপান্তরিত হয়। রয়
মক্সহ্যামএরমত ঐতিহাসিক, যিনি সর্ব প্রথম এই ঘটনাটি সর্বসমক্ষে নিয়ে আসেন, তিনি
বলছেন এর উচ্চতা অনেকটা চিনের প্রাচীরেরমতই। অবৈধ নুন পাচারকারীদের
ধরতে এই প্রাচীর ঘিরে এক কর্মযজ্ঞপ্রায় তৈরি হতে থাকে। ১৮৭২এর হিসেবে দেখাযায় সরকার এই প্রাচীর বাঁচাতে কাস্টমস অফিসার, জমাদারসহ
প্রায় ১৪,০০০ কর্মচারী নিয়োগ করে। ১৮৭৯ সালে লবন
উত্পাদন অঞ্চলেই কর নেওয়ার নীতি অনুসরণ করলে এই হেজঘিরে কর্মযজ্ঞ পরিত্যক্ত হয়। তবে এই নুন কর কিন্তু উঠে যায় ১৯৫৬ সালে। বর্তমানে নতুন করে আবার আয়োডিন নুন খাওয়াবার তালে স্থানীয় নুন তৈরির ওপর
সরাসরি নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে, যা আদতে অনেকটা ব্রিটিশদের নীতি স্মরণ করিয়ে দেয়।
ভারতে পূর্ব আর পশ্চিম উভয় উপকূলেই নুনের কারখানা ছিল
হাজার হাজার বছর ধরে। বাঙলার নুনের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারত
কচ্ছের রনে তৈরি নুনও। এই রনে যেসব কর্মচারী নুন তৈরি করতেন
তাদেরও বলাহত মালঙ্গী। ব্রিটিশ ১৮০৩এ ওড়িশা দখলের পর বাঙলা
আর ওড়িশার নুন শিল্পের মধ্যে সরাসরি দাঁড়ি টেনে দেওয়া হয়। একচেটিয়া কারবারের ফলে শুধু বাঙলা আর ওড়িশার নুনের চোরাকারবার চালুহল তাই
নয়, সারা ভারতেও ব্রিটিশদের চোখ এড়িয়ে নুনের অবৈধ চালানের শুরু হয়।
১৮২৩এ এই চোরা কারবার রুখতে আগ্রার কাস্টমস কমিশনার জর্জ
সান্ডার্স গঙ্গা আর যমুনার মাঝে মির্জাপুর থেকে এলাহাবাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি চৌকি
বসান। এই লাইন থেকে শুরু হল কাস্টমস লাইনের। আদত উদ্দেশ্য দক্ষিণ ও পশ্চিম থেকে ভারতের অন্যান্য প্রান্তে নুনের
চোরাচালান বন্ধ করা। এ ছাড়াও আরও একটি লাইনও তৈরি হল,
সেটি এলাহাবাদ থেকে নেপাল পর্যন্ত, উত্তর পশ্চিম সীমান্তের নুনের চোরাচালান বন্ধ
করার জন্য। নুন নিয়ে ব্রিটিশ অবসেসন বন্ধ হল না। ১৮৩৪এ ভারতের কাস্টমস এর প্রধান হয়ে এলেন জি এইচ স্মিথ। পাঞ্জাব হয়ে এই হেজকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত করলেন। নুনের ওপর আরও নজর দিতে স্মিথ তামাক আর লোহার ওপর কর তুলে দিলেন। তাঁর হাতে পড়ে এই লাইনের দৈর্ঘ আরও বাড়তে থাকে এবং এক সময় এর সারা বছরের
খরচ দাঁড়ায় ৭,৯০,০০ টাকা। স্মিথ এবার
প্রত্যক চার মাইল অন্তর একটি চৌকি বসালেন। প্রত্যেকটি
চৌকির এলাকা হল সেই চৈকি ঘিরে ১০ থেকে ১৫ মাইল অঞ্চল। প্রত্যেক চৌকিতে থাকত ১০ জনের এক দল। তবে পরে চৌকি নুনের কর নেওয়া ছাড়াও আফিমের চোরাকারবারও ধরতে শুরু করে।
প্রথমের দিকে প্রত্যেক দুটি চৌকির মাঝের অংশ স্থানীয়ভাবে
যা পাওয়া যেত, যেমন মাটি, পাথ, তাই দিয়ে এই প্রাচীর তৈরি হত। মাঝে মাঝে দেখাগেল এই দেওয়াল উই, ঝড়, আগুনে ধসে যাচ্ছে। এর রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বাড়ছে। ১৮৪০ থেকে এই
দেওয়ালের রক্ষণাবেক্ষণের কাজে লাগানো শুকনো ঝোপঝাড় মাটিতে শিকড় গজাচ্ছে। এর পর থেকে এই গাছগুলিই তৈরি করল বিশ্বের প্রথম প্রাকৃতিক প্রাচীর। ১৮৬৮তে এই প্রাচীরের দৈর্ঘ দাঁড়ায় ১৮০ মাইলের কাছাকাছি। ১৮৫৭র মহাস্বাধীণতা সংগ্রামের পর স্বাধীণতা সংগ্রামীদের হাতে নষ্ট হয়ে
যাওয়া প্রাচীর সারানো হয়। ১৮৬৭ থেকে ১৮৭০ পর্যন্ত ভারতের কমিশনার
অব ইনল্যান্ড কাস্টমস হয়ে আসেন এলান অক্টিভিয়ান হিউম। তার হিসেবে প্রত্যেক বছর এই পাঁচিল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজন হবে
২৫০টনেরমত স্থানীয় মালপত্র। তাই তিনি
স্বাভাবিক গাছপালা দিয়েই এই প্রাচীর গড়ার আর রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করতে শুরু করলেন। ব্যবহৃত হল, বাবুল, পাম, করোন্ডারমত নানান গাছ। এ ছাড়া বাঁশঝাড়ও পোঁতা হল। হিউম এই লাইন
বাড়াবার কাজ করে গিয়েছেন। এরপর যারা তার
পদে এলেন তাঁরাও কিন্তু এই কাজ করতে বেশ উতসাহ দেখিয়েছেন। ১৮৫৮র হিসেবে সারা ভারতে ব্রিটিশ যত কর আদায় করত তার একের দশমাংশ আসত নুন
থেকেই। বলা দরকার হিউমের সময়ই এই লাইন
উত্তরের সিন্ধু থেকে দক্ষিণের মাদ্রাজ পর্যন্ত প্রায় ২৩০০ মাইল জুড়ে ছিল।
বাঙলায় লবন লুঠের পরিমান কী ছিল তার জন্য দুটি তথ্যই
যথেষ্ট। Frederick Halliday, বাঙলার
স্বরাষ্ট্র বিভাগের সচিব, পরে বাঙলার ছোটলাট লেখেন, The
present price of the Government manufacturetl salt in Bengal is-very much
raised to the consumer in the market by the necessary want of economy, not to
say extravagances, connected with the Government system of manufacture, and by
those many peculations, and extortionss, and corruptions, which are inevitable
in such a system, and carried on with such instruments. It has seerned almost
certain under those circumstances to persons informed upon the subject, that if
the Government were to withdraw, and if there were no duty imposed, and the
whole were left perfectly free, the native manufacturers in
Bengal would forthwith completely and entirely undersell the imported salt, and
there would not be a grain of salt imported into Bengal."
ব্রিটিশ ইন্ডিয়া এসোসিয়েশনের রাধাকান্ত দেব বাহাদুর এক
প্রতিবেদনে বলেন, " The selling price of salt is arbitrarily
fixed by the Government, and is at all times so high that,
though the country has abundant resources for the manufacturc
of the article, English merchants can afford to import
it. The dearness of the article induces even those who
live near the salt manufactures to use earth scraped
from the salt lands; while those who reside in the interior
have recourse to the alkali found in the ashes of burnt
vegetables. The officers employed in the salt department are vested with judicial powers contrary to all
principles of justice and policy, and necessarily employ them
very irregularly and vexatiously. The subordinate
officers are furnished with opportunities, on pretence of
preventing smuggling, of harassing the carriers of salt and
the refiners of salt-petre. Your petitioners are of opinion
that, among other reforms required in this department,
it is desirable that the Government, if they cannot
immediately afford to forego so odious a source of revenue,
should fix an unvarying rate of impost on the manufacture
of salt, say zoo rupees [lt;zo] on every I oo maunds
[8 200 lbs.], whereby not only the poor will be greatly
benefited, but the laws will be rid of the anomaly of
judicial excisemen, and the traders of the harassment caused by the subordinate officers of salt Chowkis. But as salt is the necessary of life, the duty on salt should be entirely
taken off as soon as
possible.
১৮৯৪ এর ১৪ আগস্ট হাউস অব কমন্সে দাদাভাই নৌরজি বলেন, Then the Salt Tax, the most
cruel Revenue imposed in any civilised country provided Rs. 8,600,000/- and that with the opium 'formed the bulk of the revenue of
No comments:
Post a Comment