এ্যাকাডেমিক ইন্সটিটউশনটি শ্রীকৃষ্ণ সিংহের মানিকতলা
বাগানবাড়িতে স্থানান্তরিত হল। আলালদেরমধ্যে
অগ্রগণ্য, রেভারেন্ড লালবিহারী দে স্মৃতি কথায় লিখছেন, The
young lions of the Academy roared out week after week, “Down with Hinduism!”,
“Down with Orthodoxy!” অহো! সংস্কারের ধ্বজাতোলা আলালি দুলাল সিংগিদের, কলকাতার সিংগিবাড়িতে কী বিপুল সংগ্রাম। সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় রাজধানী কলকাতাই বিশ্ব, বিশ্ব অর্থে ইওরোপ। কোম্পানি সরকার অন্নবস্ত্রদাতা পিতামাতা। পিতামাতারা যতটুকু চাখাতে চাইছে, ততটুকুই চাখছেন। রায়ত লুঠের সম্পদে, ভারতবিদ্বেষী খ্রিস্ট যাজকদের হাতের পুতুল হয়ে, দেশের
সাংস্কৃতিক বনিয়াদ ধংস করে, মুক্ত বুদ্ধির নবজাগরণের অগ্রদূতের সম্মান পাচ্ছেন। কী অদ্ভুত আর বিভত্স মজা!
কলকাতার ভাগ্যবস্ত মহলে এই বিভত্স মজা চলাকালীন শাসকেরা
বুঝতে পেরেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দর্শণের ভার বহন করতে ভারতীয়দের তৈরি করে তোলা
প্রয়োজন। ভাগ্যবন্তদের মনোজগতে ইওরোপিয়
চিন্তাধারার, ইওরোপিয় জীবনশৈলীর শেকড় রোপণ জরুরী। ভারত ভ্রমণরত প্রণম্য ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবিরা অবাধে অংশগ্রহণ করছেন সভা-সমিতিগুলোতে। এঁরাই রিফর্মিস্টদের গুরুঠাকুর। কোম্পানি
আমলা-বিচাকরদের চিন্তায় গড়ে উঠেছে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত। সরকারি কোন কোন বিদেশিয় ব্যক্তিত্ব, এই সভাগুলিতে ক্রমাগত বুদ্ধি যোগাতে আসতেন!
জীবনীকার মন্মথমাথ ঘোষ মহাশয়এর জবানীতে আগেই দেখেছি, সাম্রাজ্যের বড় দুই
পদাধিকারী, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এডাওয়ার্ড রায়ান, ডেপুটি গভর্নর বার্ড। অন্যান্য ইংরেজ আমলা-ধর্মযাজক-বণিক-ব্যক্তিত্বও উপস্থিত থাকতেন তা কয়েক
পৃষ্ঠা আগেই আলোচনা করেছি। এই তালিকায় রায়ান
আর বার্ড নাম হিসেবে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থার পরিচালকেরা সমিতিগুলোতে
গতিপ্রকৃতিতে অংশ নিয়ে আলালদের পাশ্চাত্যধর্মী দর্শণের পথে গড়ে তুলতে চাইছেন। গ্রাম বাঙলার অবস্থা বজ্রগর্ভ। সরকারের
কালঘাম ছুটছে গ্রাম-সংগ্রাম দমনে। সেনা নেমেছে
বাঙলাজুড়ে, কোথাও স্বাধীনতা সংগ্রাম দমম করা হচ্ছে অসম্ভব নিষ্ঠুরতায়, কোথাও আবার
সংগ্রামীদের সঙ্গে লড়াইএ সাময়িক পিছু হটছে ব্রিটিশ সেনা। নীলরক্তের নব্যজমিদারদের সন্তানেরা স্বাধীণতা সংগ্রামী গ্রাম বাঙলা থেকে
কলকাতার নিরাপদ দূরত্বে বসে রিফর্ম রিফর্ম খেলা খেলছেন ইংরেজ প্রশাসকদের
প্রত্যক্ষ্য নজরদারিতে। তবুও কলকাতায় সংগ্রামী আঁচ লাগছে। সমাচার দর্পণসহ নানান পত্রিকায় নীলকরদের উতপীড়নের
বিরুদ্ধে বিবরণ ক্রমশঃ প্রকাশ পাচ্ছে।
১৮২২এর ১৮মের সমাচার দর্পণ লিখছে, মফঃস্বলে নীলকর প্রজাদের ওপর দৌরাত্ম্য করেন তাহার বিশেষ কারন এই, যে
প্রজা নীলের দাদন না লয়, তাহাদিগের প্রতি ক্রোধ করিয়া থাকেন এবং খালাসীদিগকে কহিয়া
রাখেন ঐ সকল প্রজার গরু নীলের নিকট আইলে সে গরু ধরিয়া কুঠিতে আনিবা। ...গরু ধরিবার
পর প্রজা নীলের দাদন লইয়া গরু ছাড়ইয়া আসে ...চযে প্রজা নীলের দাদন লয়, তাহার মরণ
পর্যন্ত খালাস নাই। যেহেতুক হিসাব কষা হয় না, প্রতি সনেই
দাদন সময়ে বাকীদার কহিয়া ধরিয়া কয়েদ করিয়া রাখে। তাহাতে
প্রজারা ভীত হইয়া হাল বকেয়া বাকী লিখিয়া দিয়া দাদন লইয়া যায়।
ময়মনসিংহ এলাকায় গারো পাগলপন্থী আন্দোলন শুরু হয়েছে। ইংরেজ সমর্থিত অত্যাচারী জমিদারেরা গারো সমাজের বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াইতে
অংশগ্রহণ করছেন। গড়দরিপা অঞ্চলে গারোসমাজ টিপু গারোর
নেতৃত্বে জমিদারের পাইক বরকন্দাজদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়লাভ করল। স্বাধীণতা সংগ্রামীরা সেরপুর শহর দখল করে। নানান খন্ডযুদ্ধে স্বাধীণতা সংগ্রামীরা বিজয়ীহতে থাকল। ১৮২৬এ বিশাল
ইংরেজ সেনা বাহিনীর সঙ্গে লড়াইতে গারোরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। ইংরেজরা ১৮২৭এ কৌশলে টিপুকে ধরে। টিপুর
যাবজ্জীবন কারাবাস হয়।
লালবিহারী দে বর্ণনা দিচ্ছেন, সিংহসমছাত্রদের গুরু, মসিহা ডিরোজিও, কলকাতায় বসে কী ভাবে সরাসরি
ভারতের সংস্কৃতির বিরুদ্ধাচারণে ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ
করছেন। ঐতিহাসিকদের মতে তিনি ছাত্রদের সুপ্ত
চেতনা জাগাবার চেষ্টা করেছেন। কিশোরীচাঁদ
মিত্র হিন্দু কলেজের ইতিহাসএ বলছেন, তিনি তাঁহার ছাত্রদিগের জ্ঞাণচক্ষু
উন্মীলীত করিয়া দিয়াছিলেন। তিনি তাঁহাদের
ভাবিতে শিখাইতেন, এ দেশবাসীরা যে প্রাচীণ গোঁড়ামীর শৃঙ্খলে বদ্ধ ছিলেন, সে শৃঙ্খল
ছিন্ন করিতে শিক্ষা দিতেন। গভীর জ্ঞাণ
সম্পন্ন ডিরোজিও তাঁহাদিগকে লক্, রীড, ষ্টুয়ার্ট ও ব্রাউনের মত বুঝাইতেন। তিনি তাঁর অধ্যাপনায় পর্য্যবেক্ষণ শক্তির ও তর্ক কৌশলের যে মৌলিকতা দেখাইতেন,
তাহা স্যর উইলিয়ম হ্যামিলটনের মৌলিকতা অপেক্ষা কোনও অংশে নিকৃষ্ট নহে(কর্ম্মবীর কিশোরীচাঁদ মিত্র – মন্মথনাথ ঘোষ)।
ঐতিহাসিকদের বক্তব্য, দ্বন্দ্ব আর বিরোধের ভিতর নতুন পথ
তৈরি করে এগিয়ে চলে মানুষ। প্রশ্ন হল, কোন দ্বন্দ্ব, কোন বিরোধের কথা বলছেন তাঁরা। বাঙলার(আদতে কলকাতায়) প্রবীণদের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে
ডিরোজিওর শিষ্যরা সংগ্রাম করছেন! ভালকথা কী না জানিনা, এইটুকু জানি, তখন বাঙলার
গ্রামে গ্রামে হাজার হাজার স্বাধীণতা সংগ্রামী রায়ত, প্রাণ দিচ্ছেন বন্দুকের
গুলিতে, লাঠিয়ালদের লাঠির বাড়ি অথবা কামানের গোলায় ছিন্নভিন্ন হয়ে। নিরাপত্তার চাদরে মোড়া কলকাতার শহরে বসে আলালেরা শুধুই
মগজমারি করছেন। ডাউন উইথ হিন্দুজম, ডাউন উইথ অর্থোডক্সি স্লোগানে দেশের পরিকাঠামো ধংসে উপনিবেশ কর্তাদের
সাহায্য করছেন। সিংহসম এই কিশোরদের
নতুন মূল্যায়ণ হওয়া প্রয়োজন। আলোচনা সভাগুলোয় ডিরোজিও অথবা ডেভিড হেয়ার(দক্ষিণারঞ্জনের
জীবনীকার মন্মথমাথ ঘোষ মহাশয় বলছেন, দক্ষিণারঞ্জন এবং তাঁর সঙ্গী সাথীরা মাধব
মল্লিকের জোড়াসাঁকো বাড়িতে ডেভিড হেয়ারের সম্বর্ধনার আয়োজন করেন ১৮৩১ খৃঃ ৬
ফেব্রুয়ারী, তাঁর জন্মদিনে। সেখানে হেয়ার ভারতের তথাকথিত অনুন্নতির নিদান দেন পশ্চিমি
শিক্ষা প্রসার। প্যারীচাঁদ মিত্রের
ডেভিড হেয়ারের জীবনী থেকে হেয়াররের বক্তব্যের সারমর্ম্ম তুলে দেওয়া গেল- এদেশে আসিয়া দেখিলাম যে, এখানে নানানপ্রকার
দ্রব্যাদি উত্পন্ন হইতেছে, ভূমির উত্পাদিকা ও অর্থপ্রদ শক্তি অক্ষয়, লোক সকলও
বুদ্ধিমান ও পরিশ্রমী এবং অন্যান্য সভ্যদেশের লোকদিগের ন্যায় ক্ষমতাবান কিন্তু
বহুকালাবিধি কু-শাসন ও প্রজাপীড়ন হেতু এদেশ একেবারে অজ্ঞানতার আবৃত হইয়াছে। এদেশের অবস্থা সংশোধন জন্য ইওরোপীয় বিদ্যা ও
বিজ্ঞানশাস্ত্র প্রচার আবশ্যক বোধ হইতেছে। যে বীজ আমা কর্তৃক উপ্ত হইয়াছে, তাহা এখন বৃক্ষরূপে স্বপ্রকাশ
– উত্কৃষ্ট ফল প্রদান করিতেছে এবং তাহার লক্ষী আমার
চতুষ্পার্শে রহিয়াছে। যে বীজ ডেভিড হেয়ারেরা এবং তাঁদের ভারতীয় সাম্রাজ্যের
সঙ্গীসাথীরা পুঁতেছিলেন, সে বীজ স্বাধীণতার আগেথেকেই বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছে।)এর অংশ নেওয়া এক অর্থ যদিও করা যায়, কিন্তু রায়ান আর
বার্ডএরমত সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ দুই অংশিদারের অংশ গ্রহণ করা অন্য অর্থ বহন
করে। অত্যাচারী সরকারের
দুই বিভাগের নানান প্রখ্যাত ব্যক্তিরা, সেসময় সরাসরি গ্রামীণ স্বাধীণতা সংগ্রামের
বিরুদ্ধে সেনা ব্যবহার করছেন। প্রজাদের স্বাধীণতা সংগ্রাম দমন করছেন। কার্যতঃ সেনানিয়ন্ত্রিত ছদ্মগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তৈরি
করেছেন। আর কলকাতার আলালেরা সেই স্বর্গীয় সান্নিধ্য উপভোগ করছেন অনাবিল
আনন্দে।
No comments:
Post a Comment