দ্বারকানাথ নিজের উদ্যোগেই জমিদারি আইন বিষয়ে যথেষ্ট পড়াশোনা করে তাঁর
জমিদার জাতভাইদের জমিদারি বিষয়ে আইনি পরামর্শ দানে উদ্যমী হলেন। ১৮১৫তে কলকাতাবাসী জমিদারেরা, সর্বগ্রাসী ব্রিটিশ কোম্পানি সরকারের কবল
থেকে জমিদারি বাঁচাতে, সর্বস্বপণকরে নতুন ব্রিটিশ আইন বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তাঁর উত্তরাধিকারী ক্ষিতীন্দ্রনাথ বলছেন, সে সময়ের ব্রিটিশ আইনজ্ঞ কাটলার
ফার্গুসনের কাছেই শুধু আইনই শিখছেন না, দ্বারকানাথ নিজ উদ্যোগে পড়াশোনা করে, কর্নওয়ালিশের
রেগুলেশনগুলো, সুপ্রীম কোর্ট, জেলা কোর্ট আর সদর কোর্টের নানান আইন ব্যবহারে বেশ
সড়গড় হয়ে উঠেছেন। সে সময়ের কলকাতায় জমিদারির আইনের মারপ্যাঁচ
জানা মানুষ খুবই কম ছিল। একই সঙ্গে তিনি নানান ব্যবসার আইনও
জানতেন। এই দুই জ্ঞাণ বাস্তবে প্রয়োগ করার
ক্ষেত্রে তাঁর জুড়ি প্রায় ছিলই না। যশোরের জমিদার
রাজা বরদাকান্ত রায়, বাগবাজারের দুর্গাচরণ মুখার্জী, কাশিমবাজারের কুমার হরিনাথ রায়
বা পাইকপাড়ার রানী কাত্যায়নী দ্বারকানাথকে আইনি পরামর্শদাতারূপে নিয়োগ করেছেন। তিনি আইনটাও ভাল জানতেন, নতুন জমিদারদের মনস্তত্বও ভাল বুঝতেন। যেমন রাজা বরদাকান্ত জনৈক ব্রিটিশ ব্যবহারজীবি ম্যাক্সওয়েলকে আইনি পরামর্শ
দাতা রেখেও যথেষ্ট সুফল পান নি, ফলে আবার তাঁকে দ্বারকানাথের দ্বারস্থ হতে হয়।
আইন পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করার অনেকগুলি সুফল জীবনে পেয়েছিলেন
দ্বারকানাথ। জমিদারদের সঙ্গে বন্ধুত্বের জেরে, কলকাতার
সুদের বাজারের হার যথন ৮ থেকে ১২ শতাংশ, তিনি তখন জমিদার হরিনাথের থেকে ৭৫,০০০টাকা
ধার নিচ্ছেন মাত্র ৪ শতাংশে। তাঁর
পূর্বপুরুষেরা ব্রিটিশদের দালালি করেই শুধু ধণ উপার্জন করেছেন। দ্বারকানাথ, নিজে জমিদার হওয়ায় জমিদারদের সুবিধে অসুবিধেগুলো ভাল বুঝতেন
বলে জমিদারদের সমস্যাগুলো নিজেরমত সমাধান করার চেষ্টা করেছেন। তিনিই বেধহয় প্রথম কয়েকজন নব্যজমিদারদের মধ্যে অন্যতম যিনি বিদেশিদের হাতে
তৈরি জমির বাজারটা, বিদেশিদেরমতকরে বোঝার চেষ্টা করেছেন। দ্বারকানাথ বুঝতে পেরেছিলেন জমিদারেরা সাধারনতঃ ইংরেজ আইন ব্যবসায়ীদের
স্মরণাপন্ন হতেন না। এদেশে ইংরেজি আইনকে দেশিয় জমিদার অথবা নতুন সময়ের উকিলেরা
তখনও, ভালকরে বুঝে উঠতে পারেন নি পুরোনো মানসিকতার কারনে। কেউ কেউ বুঝলেও বাস্তবে কাজে লাগাতে পারেননি, নানান রকম সংযোগের অভাবে, যে
যোগাযোগ ছিল দ্বারকানাথের, বিশেষ করে সাহেব মহলে। তিনি জানতেন-বুঝতেন বিদেশি আইন ব্যবস্থার মূল খাঁজখোঁজগুলি, যার মধ্যে
দাঁড়িয়ে তিনি মক্কেলের সুবিধে বার করে আনতে পারতেন। তিনি জানতেন বিদেশি আইন ব্যবস্থায় মামলার রায় অনেকটা নির্ভর করে উকিলের ব্যক্তিগত
যোগাযোগর ওপর, সেই যোগাযোগ সঠিকভাবে কাজে লাগানোর দক্ষতার ওপর। দ্বারকানাথের সেই সম্পদে ধনী ছিলেন। এবং পরে আরও অনেক
যোগাযোগ নানান ভাবে তৈরি করে নিয়েছিলেন। নিজ দক্ষতায়,
যোগাযোগে, দ্বারকানাথ একে একে বাঙলার জমিদারদের আইনি অভিভাবক হয়ে উঠলেন। ...সেকালে আজকালকারমত উকিল ব্যরিস্টারে ছড়াছড়ি ছিল না। যে দুই একজন ব্যারিস্টার ছিলেন, বাঙালিরা তখন সাহেব বলিয়া তাঁহাদের কাছে
ঘেঁসিতেই সাহস করিতেন না। দ্বারকানাথ
তখনকার বাঙালিদের মধ্যে অদ্বিতীয় আইনজ্ঞ ছিলেন বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না। ব্যবস্থাশাস্ত্রে তাঁহার আশ্চর্য পারদর্শিতা ছিল। সুতরাং লোকেরা প্রয়োজন হইলে, তাহার নিকট আইন সম্বন্ধে পরামর্শ ও ব্যবস্থা
গ্রহণ করিতে আসিতেন। অবশ্য
দ্বারকানাথের কতকগুলি বাঁধা ঘর ছিল, তদ্ব্যতীত যে সকল লোক তাঁহার নিকট পরামর্শ
গ্রহণ করিতেন, তাঁহাদেরও যথেষ্ট সুবিধা হইত এবং দ্বারকানাথের নিকট যে উপকার
পাইতেন, তাহার প্রতিদানস্বরূপ তাঁহারা তাঁহাকে অর্থ প্রদান করিতেন। বলিতেগেলে দ্বারকানাথ নামে উকিল না হইলেও কার্য্যত একপ্রকার ওকালতী
ব্যবসায় খুলিয়াছিলেন। ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনী
দ্বারকানাথ জমিদারিকেও সফল ব্যবসার রূপ দিতে পেরেছিলেন। তাতে বাঙলার রায়তের ওপর অত্যাচার নামিয়ে আনতে হলেও দ্বারকানাথের জমিদারি
উদ্যমে ঠাকুর পরিবারের জোড়াসাঁকো শাখার সম্পদ ক্রমশঃ বেড়েছিল চক্রবৃদ্ধিহারে,
গুণোত্তর প্রগতিতে। ঠুঁটোজগন্নাথ নব্যজমিদারদের কাছে তিনি
সফল ব্যবসায়ী, যাঁর বাজার সম্বন্ধে ধারণা স্পষ্ট। জমিদারদের সেই অধরা বাজারের প্রধান মুতসুদ্দি, যার মাধ্যমে জমিদারেরা
বাজারকে ছুঁতে পারেন। জমিদারির আইনটা দ্বারকানাথ বেশ ভালই
বোঝেন তাই ইওরোপিয় ব্যবসায়ীদের কাছে তিনি একমাত্র সফল জমিদার। ব্যবসায়ীমহলে যোগাযোগ এবং বাঙলার জমিদারির জ্ঞাণ আবলম্বন করে ব্যবসায়ীরা
জমিদারদের সঙ্গে কীভাবে দরকষাকষি করবেন সেই অজানা অচেনা বন্ধুর পথ তিনি ইংরেজ
ব্যবসায়ীদের বাতলে দেওয়ার মুরোদ রাখতেন। তিনি ব্যবসাও
এতই ভাল বুঝতেন যে প্রথমদিকে নিজে কোম্পানি অথবা কুঠী তৈরি না করেও বিলাতী
কুঠীর আর্ডার অনুযায়ী নীল, রেশম প্রভৃতি কিনিয়া বিলাতে পাঠাইতেন। এইরূপ নানান কার্যে লিপ্ত থাকায় দেশীয় ও কি সরকারী, কি বেসরকারী ইংরাজ
সকলেরই মধ্যে নিজ নাম সুপ্রতিষ্ঠিত করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।(ক্ষিতীন্দ্রনাথ উবাচ)
পিতা রামলোচনের থেকে দুটি জমিদারি উত্তরাধিকারসূত্রে
অর্জন করেন। নিজের উদ্যমে বিরাহিমপুর, যশোর,
কুমারকুলি, পাবনা, সাহাজাদপুর, কালিগ্রাম, রমপুরের স্বরূপপুর, মন্ডলঘটের তের আনা
অংশ, দ্বারবাসিনী, জগদীশপুর, যশোরের মহম্মদশাহী, কটকের সরগরা প্রভৃতি বিশাল
জমিদারি অর্জন করেছিলেন। তাঁর জমিদারিতে নীল আর রেশমের চাষ হত। কটক, পান্ডুয়া আর বালিয়ায়ও তালুক ছিল। ১৮৩০এ তিনি রাজসাহির কালিগ্রাম আর ১৮৩৪এ পাবনার সাহাজাদপুর জমিদারি কেনেন। ক্ষিতীন্দ্রনাথ বলছেন ...কালীগ্রাম ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দে এবং সাহাজাদপুর
১৮৩৪ খ্রীষ্টাব্দে এবং অন্যান্য জমিদারীও এই সময়ের কাছাকাছি কেনা হইয়াছিল। এইরূপে চাকরী করিবার মধ্যেই অনেক জমিদারী কিনিয়া এক বিস্তৃত ভূম্যধিকারী
হইয়া বসিলেন। ১৮৪০সালে
বহরমপুর, পান্ডুয়া, কালিগ্রাম আর সাহাজাদপুরের জমিদারির সমস্ত আয়ব্যয় একটি অছিতে
সমর্পণ করে তার পুত্রদের দিয়ে যান। অন্যান্যগুলি
জমিদার-অংশিদারদের সঙ্গে তাঁকে ভাগ করে নিতে হয়েছিল। তাঁর ইংরেজিতে লেখা বইএর জীবনীকার ব্লেয়ারের ভাষায় দক্ষিণ বঙ্গের মোট জমির
আয়ের এক পঞ্চমাংশ আয় আসত তাঁর জমিদারি থেকে।
No comments:
Post a Comment