জমিদার প্যারীসুন্দরী-গোলোকনাথের অসামান্য নীল আন্দোলনের গড়ে তোলার
বিপরীতেই রামমোহন-দ্বারকানাথের ভূমিকা। আমরা আলোচনা
করব বাঙলার তথা কলকাতায় দুই মহাতেজ বাঙালি রামমোহন আর দ্বারকানাথের ইংরেজ নীলকরদের
আর বাঙলায় ইংরেজদের জমি কেনার আন্দোলনের প্রতি এই দুই নবজাগরণের অগ্রদূতের সদর্থক
সমর্থনের প্রায়অব্যক্ত ইতিহাস। দুই মহাতেজ কলকাতায়
নানান সভাসমিতিতে অথবা সংবাদপত্রকে প্রভাবিত করেছেন। রামমোহন রায় ব্রিটেনে গিয়ে সমর্থন জোগাড় করার ইতিহাস রচনা করেছেন। এই আন্দোলনের ইংরেজি নাম কলোনাইজেশন। সুসভ্য
ইংরেজদের এই পোড়া বাঙলা দেশে জমি কিনে বাস করার, অবাধে ব্যবসা করতে দেওয়ার
তথাকথিত প্রগতিশীল আন্দোলনে এই দুই বাঙালি অগ্রণী ভূমিকায় আজও ভারতীয় ঐতিহাসিকদের
নীরবতা আশ্চর্যজনকতো বটেই, সন্দেহজনকও। ঐতিহাসিকেরা
দ্বারকানাথের জীবনীকার ব্লেয়ার বি ক্লিংএর দাবি, রামমোহন কলোনাইজেশনের আন্দোলনের
সামাজিক ভূমিকা তৈরি করেছেন, আর দ্বারকানাথ দিয়েছেন আন্দোলনের আর্থিক ভিত্তি। প্যারীসুন্দরী, গোলকনাথ বা বিশ্বনাথের নীলকর বিরোধী লড়াই আজও পরিচিতি লাভ
করেনি। প্রিন্স পিতার কুকর্মকে কোনও তত্বতেই
ঢাকা না দিয়ে, দেবেন্দ্রনাথ তত্ববোধিনীতে সরাসরি নীলকর বিরোধী লেখা ছেপেছেন। ঠাকুর জমিদারিতে রায়তদের ওপর অমিত অত্যাচারের সংবাদ পাওয়া গেলেও, দেবেন্দ্রনাথ
বাঙালির ইংরেজ তোষণের বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছেন। দেবেন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিকতা যতটা প্রচার পেয়েছে, তাঁর নীলকর বিরোধী ভূমিকা
প্রচার পায়নি।
কলোনাইজেশনের জোড়া-তাত্বিক
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে গড়ে ওঠা এজেন্সি হাউসগুলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ
নিয়ে ইংরেজবাণিজ্যবিশ্বে ব্যবসা চালাত। এদের ব্যবসার
কর্মকান্ড নির্ভর করত এদেশে ব্যবসায়ী ইংরেজদের লাভের বিনিয়োগের ওপর। নীল ব্যবসাকালে এজেন্সি হাউসগুলো নীলকরদের ১০ শতাংশ হারে টাকা ধার দিত। ১৮২৩এর সরকার নতুন ধারনীতি প্রণয়ন করায় নীলকরদের ধার পেতে বেশি সুবিধে হয়। এই নীতি বাঙলার নীলচাষকে আরও কয়েক দফা এগিয়ে দেয়। ১৮২৪এর ইঙ্গ-বর্মা যুদ্ধে সরকারের কোষাগারে টান ধরল। ইংলন্ডে বাঙলার কাঁচামালের দাম দারুণভাবে পড়তে শুরু করায় দেশিয় নীল
(ইংরেজদের)ব্যবসার ওপর চরম আঘাত নেমে আসে। ব্যবসায় মন্দা
শুরু হয়। এজেন্সি হাউসের একটি বড় অংশ অর্থ
নীলচাষে খাটছিল ১০ শতাংশ বাত্সরিক সুদে। ফলে এজেন্সিদের
অনেকেই বিনিয়োজিত অর্থ ফেরত দিতে পারছিল না। একের পর এক
এজেন্সি হাউসে তালা ঝুলতে শুরু করে। নীলকরেরা বিপদ
অনুভব করে। নীলকরেরা সরকারকে দাবি জানায়, দাদন
নিয়ে যেসব চাষী নীল সরবরাহ করার শর্ত পূরণ করছেনা তাদের বিরুদ্ধে সরকারকে আইনি
ব্যবস্থা নিতে হবে। নীলকরদের দাবি মানে নিল সরকার। আর্মহার্স্টএর ষষ্ঠ নিয়মে নীলকরদের আসল সুদ সমেত ফেরত পেতে আইনের দ্বারস্থ
হওয়ার অনুমতি মিলল। এতেও অত্যাচারী নীলকরদের মন ওঠেনা। তাদের চাই আরও কড়া নতুন আইন। তারা আর দাদন
দিতে চায় না। ভারতে জমি কিনতে চায়। এই দাবিতে বহুদিন ধরেই আন্দোলন করছিল ব্রিটিশাররা। ১৮৩৩এর সনদে ব্রিটিশ নাগরিকদের ভারতে জমিকেনার অধিকার দেওয়ার অনেক আগে
থেকেই রামমোহন রায়, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রভৃতি জমিদারদের
একাংশ এই আন্দোলনের পক্ষে সওয়াল করছিলেন। যুক্তি ছিল,
অবোধ, অসভ্য ভারতীয়রা সুসভ্য ইংরেজদের সংস্পর্শে এসে সভ্য হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে, আর
ব্যবসায়ী ইংরেজদের ব্যবসার দক্ষতার মাধ্যমে দেশের সম্পদ বৃদ্ধি হবে। অথচ ভারতীয় জমিদারদের সংখ্যাগুরু অংশ এই দাবির বিরোধী।
নেপলিয়নের পতনের পর ইওরোপের বাইরে থাকা প্রায় প্রত্যকটি
মহাদেশের বড় অংশ ইংরেজদের পদতলে। ১৭৮০তেই ইউনিটেরিয়ানদের
এডাম স্মিথ ওয়েল্থ অব নেশনএ মুক্ত
বাণিজ্যে ডাক দিচ্ছেন। ইংরেজদের অবাধ বাণিজ্যের অর্থ অন্তঃত
বাঙালিরা জেনে গিয়েছে পলাশির উত্তর ক্লাইভ-হেস্টিংসএর স্বেচ্ছাচারী লুঠেরা যুগলবন্দীতে। পুরেনো অভিজ্ঞতা নয়, মাত্র সাত দশকও পেরোয়নি। অথচ ইউনিটেরিয়ান রামমোহন-দ্বারকানাথ এদেশে ব্রিটিশারদের বাণিজ্যর জন্য
প্রয়োজনীয় জমি কেনার অধিকার দাবির পাশে দাঁড়ালেন। ইংলন্ডে ইউনিটেরিয়ানদের প্রভাব যথেষ্ট ছিল। নতুন শিল্পমালিকদের সামনে ভারতীয় উপনিবেশের ধংস হওয়া বাজারের হাতছানিই
মুক্ত বাণিজ্য। ১৮৩২র নতুন সংস্কার আইন আর ১৮৩৩র সনদ
কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের বিরুদ্ধে ইউনিটেরিয়ানদের সবথেকে বড় জয়।
১৮২৮এর ফেব্রুয়ারিতে সংবাদ কৌমুদীতে নীলকরদের চাষের জমি
দখলের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ হয়। সে সময়ে ভারতে ধান উত্পাদনের হার কমছিল। ২৬ ফেব্রুয়ারিতে দ্বারকানাথ সংবাদকৈমুদীর সম্পাদককে এই
সংবাদের বিরুদ্ধে কড়া চিঠি লেখেন। দাবি নীলকরেরা বাঙলার পতিত জমি উদ্ধার করে সাধারণ
রায়তদের(লোয়ার ক্লাস শব্দটি সচেতন ভাবে ব্যবহার করবেন দ্বারকানাথ, যা পরে, এমনকি
স্বাধীনতার পরেও গ্রামবাংলার খেটেখাওয়া মানুষ বোঝাতে ইংরেজি শিক্ষিতদের কলমে অহরহ
ব্যবহৃত হবে) অর্থ সরবরাহ করে তাদের সুন্দর জীবনযাপন করার সুযোগ করে দিচ্ছে। আরও দাবি এই উন্নয়ণের কাজকর্মকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে
ইংরেজদের আরও বেশি করে জমি কেনার সুযোগ করে দিতে হবে। তিনি দেশের মানুষকে হুমকি দিয়ে রাখলেন এই বলে যে, তার
এই প্রস্তাবে যে বিরুদ্ধাচরণ করবে সে আদতে দেশের মানুষেরই শত্রুতা করবে। দ্বারকানাথের গলায় এ যুগের বিশ্বায়ণের রাজনীতির কারবারিদের
সুর। অথবা উল্টোটাও বলা যায়। আজকের বিশ্বায়ণের প্রবক্তারা, সে বামপন্থী হোক,
দক্ষিণপন্থী অথবা মধ্যপন্থী সরকার অথবা বিশ্বব্যাঙ্কই হোক, তারা দ্বারকানাথের
দেওয়া হুমকির সফলতমপথটি অনুসরণ করছেন। দ্বারকানাথ বেঙ্গল হরকরাতেও নতুন একটি পত্রাঘাত
করেন। যদিও সেখানে নতুন
তথ্য নেই। সংবাদ কৌমুদীতে
প্রকাশিত চিঠিরই প্রায় প্রতিলিপি। নীলকরেরা ১৮২৮এর জুন আর ১৮২৯এর জুনে একত্রিত হয়ে
কোম্পানি সরকারের কাছে ভারতে অবাধে জমিকেনা আর বসবাসের সুযোগ করে দেওয়ার দাবি
জানান। এ প্রতিবেদন ৩০মে
১৮২৯এর বেঙ্গল হরকরায় প্রকাশ হয়।
No comments:
Post a Comment