বাঁকুড়া-বর্ধমান-বীরভূম জেলার হাপুগান একসময় গাইতেন
বাজিকর, মাল, বাইতি, কাকমারা, বেদে, পটুয়া সম্প্রদায়।
এ ধরনের প্রায় প্রত্যক সমাজ মূলতঃ ভ্রাম্যমান জীবনযাপন করতেন।
দেশিয় রোগএর নানান দেশজ ওষুধের –স্থানীয়
ভাষায় টোটকা(আজকের নিন্দিত অর্থে নয়) –
খনি ছিলেন এঁরাই। এরাই রোগ থেকে বাঁচবার
নানান টোটকাও বলতেন নিজেদের গানে।
এ দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যখন এ্যালোপাথি জাঁকিয়ে
বসেনি, যখন দৈত্যসম ওষুধ সংস্থাগুলোর স্বার্থই রোগীর স্বার্থের ওপরে ওঠেনি,
ডাক্তারেরা লক্ষ লক্ষ কাঞ্চনমুদ্রা ব্যয় করে ডাক্তারি পড়ে রুগিমার ডক্তার হয়ে
বহুজাতিক ওষুধ সংস্থার অদৃশ্য ক্যানভাসারের কাজে দামি গাড়ি বাড়ি হাঁকিয়ে বড়লোক
হবার দায় নিজের কাঁধে তুলে নেননি, যখন পূর্ব ভারতের গ্রামে গ্রামে নাথ কবিরাজেরাই
চার-পাঁচ হাজার বছর ধরে দেশের মানুষের রোগ সারাবার মহত দায় নিজেদের কাঁধে তুলে
নিয়ে ছিলেন, সে সময়ই সেই কবিরাজকুলের সাহায্যে এগিয়ো আসতেন এই বাজিগরেরা –
বিশেষ করে এই কাজে সেই সমাজের মেয়েদের ভূমিকা ছিল অগ্রণীর।
হাপু গানের সঙ্গে নাচ দেখিয়ে তারা ঢুকে যেত অন্তরপুরে তাঁদের ওষুধের সামগ্রী নিয়ে। ওষুধের সঙ্গে থাকত নানান ধরনের বিক্রির জিনিসপত্র। যে নৌকো করে এঁরা দেশে দেশান্তরে ঘুরতেন তাকে বলাহত
বেদে নৌকো।
বীরেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলাদেশের সঙ প্রসঙ্গে নামক পুস্তকে
বেদে গানের নানান উদাহরণ পাওয়া যাবে।
এই গানে তাল রাখতে ঘুঙুর, খঞ্জনি আর ডাবকি ব্যবহৃত হত। দ্রুত উচ্চারনের জন্য গানের আগে মুখে এক ধরনের শ্বাস
নেওয়ার ধরণটাই হাপু গানের নিজস্ব ধারা। স্ত্রী আর ছোটছোট ছেলেমেয়েরা বগল বাজিয়ে হাত দিয়ে শরীরের
নানান অঙ্গে আঘাত করে বিচিত্র শব্দ তুলে, নানান অঙ্গভঙ্গীকরে গান পরিবেশন করতেন ।
চিরকালেরমতই যদিও বিশেষজ্ঞরা হাপুকে মোটাদাগের, অশ্লীল বা অশ্রাব্যসব অভিধা
দিয়েছেন, তবুও বলা যায় হাপুর তুলনা হাপুই – অশিক্ষিত-অমার্জিত জনগণই দেশের
সংস্কৃতির হকদার, রক্ষাকর্তা। যে সব মানুষ এধরনের
সংস্কৃতিকে মোটাদাগের, অশ্লীল বা অশ্রাব্যবলে গালি পাড়ছেন, তারাই নিজের দেশের
সম্পদের প্রতি অশ্রদ্ধাজ্ঞাপণ করছেন – এ কথা বলার আজ সময় হয়ে এসছে, একথা আজ
কম্বুকণ্ঠে বলতে হবে। সঙ্গীত
প্রেমীদের জন্য আরও কিছু সংবাদ –
হাপু গান শুনলে মনে হবে যেন পশ্চিমি দ্রুত উচ্চারণে গান গাওয়া।
কয়েকটা হাপুগানের নমুনা
হাপু আতা পাতা লো,
হাপু সর্ষে পাতা লো,
হাপু আম খাবি জাম খাবি,
তেঁতুল খাবি লো,
তেঁতুল খেলে প্যাট গুলোবে ছেলে হবে না,
হাপু কাকে খেলে লো,
হাপু ক্যা ঝাড়ুনি লো,
হাপু বেদের মাকে লো
ই ডাঙাড়ে ঐ ডাঙাড়ে শালিক বস্যেছেঁ
বেদের মাকে বিয়া করতে পাল্কী আস্যেছেঁ
হা ফুঃ কদম ফুঃ
বুঢ়াতে বুঢ়ীতে লড়াই লাগ্যেঁছে
বুড়া কপালে বুঢ়ী পাদ্যেঁ দিয়েঁছে
হা ফুঃ কদম ফুঃ –
ইত্যাদি
অথবা
হাই লো বামুন দিদি
বাগদি ঠাকুরঝি
আমি কেলে গয়লার বেটার
ঠিয়ে কখন হাঁস্যেছি-
হাঁস্যেছি বেশ করেছি
তর বাপের কী
যখন ছিলাম ছ বছরের
তখন উঠে নাই গা
এখন আমি বছর তেরো
হব ছেলের মা
মাছ ধরতে গিলাম আমি
কুঁয়ে লুদির কুলে
দেখি এ্যাক মিনসে
রসির লাগর
ডাঁড়া ফেলছে চারে
জলে নেমে জাল ছাঁকি
আর মিনসে থাকে চেঁয়ে
ভাল্ কেনা তুই ঢ্যামনা মিনসে
থানা কেনা চেয়ে
তাকে দেখে উচএ যাব
নইক তেমন মেয়ে
মাছ ধরছি চিংড়ি চাঁদা
গচি মাগুর গাগর
কার্তিক মাসে মাছের রসে
বলবো কি বুন্ বলবো কিলো
আমার প্যাট হয়েঁছে ডাগর
খোসার দুম খোলাক দুম
কাঁথা চাপা দিঁয়ে মারব ঘুম –
ইত্যাদি
বছর পনের আগে বীরভূমের নলহাটিতে শুনেছিলাম এঁদের গান আর
চমত্কৃতও হই।
No comments:
Post a Comment