মাননীয় রন্তিদেব
সেনগুপ্ত মহাশয় সমীপে
সম্পাদক, সাপ্তাহিক বর্তমান,
কলকাতা।
মহাশয়,
আমরা কলাবতী মুদ্রার নথিকরণ দলের সদস্য। বিগত কয়েক দশক ধরে আমরা
গ্রাম বাংলার জ্ঞাণ ভান্ডার নথিকরণের কাজ করে চলেছি, তৈরি হয়েছে বঙ্গীয়
পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সংঘ। দুই সংগঠণের যৌথ উদ্যমে সম্প্রতি ফুলিয়ায় তাঁত বিষয়ে তথ্যানুসন্ধানে
বেশকিছু মনখারাপের তথ্য উঠে এল, সেই তথ্য জানানোর জন্য এই পত্রের অবতারণা। আমরা নিয়মিতআপনার বহুল
প্রচারিত সাময়িকীর নানান সামাজিক প্রতিবেদনের ভক্ত এবং বাঙালিদের নানান দুর্দশার
কথা আপনাদের সাংবাদিকদের প্রতিবেদনে নিয়মি উঠে আসছে।
আশাকরব আপনারা এই চিঠিটি প্রকাশকরে ফুলিয়ার তাঁতিদের অবস্থা জনসমক্ষে তুলে ধরতে
সাহায্য করবেন।
দেশভাগের প্রতিক্রিয়ায় বাঙলাদেশের টাঙ্গাইলের ২২টি
গ্রামের বহু তন্তুবায় চলেএসেছিলেন এ বাঙলার ফুলিয়া অঞ্চলে। ফুলিয়ার
অগ্রণী তন্তুবায়, হরিপদ বসাকের নীলাম্বরীর নকশা উপন্যাসে বিশদে সেই জনপদ
পাতার ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে, যদিও সেই ইতিহাস বাখান এই রচনার অংশ নয়। নানান
অত্যাচার অনাচারে, শহুরে উচ্চবর্ণের বিশ্বাসঘাতকতায়, আমলাদের সমর্থন অথবা
চক্রান্তে আর তাঁতিদের অক্লান্ত পরিশ্রমে, সৃষ্টিতে আর গবেষণায় ক্রমে ক্রমে ফুলিয়া
হয়ে উঠল এ বাঙলার শিল্প-কারিগরী ইতিহাসের অন্যতম প্রধাণ অংশিদার। ফুলিয়ার
টাঙ্গাইল, পাশেরই ঐতিহাসিক জনপদ, শান্তিপুরের শান্তিপুরীর বয়ন শিল্পের অসাধারণ
কুহকী আকর্ষণীয় তন্তুবায়েদের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে ফুলিয়া জনপদ নিজস্ব সুচারু
দক্ষতায় বিশ্ববিজয়ী তাঁতশিল্পের মর্যাদা অর্জন করল। ফুলিয়ার
কারিগরদের অসামান্য দক্ষতা, বাঙলার বয়নশিল্পে ফুলিয়াকে নিজের স্থান তৈরি করতে
সাহায্য করল মাত্র কয়েকটি দশকের যাত্রায়। ফুলিয়ার তাঁতিদের সাধারণতম তাঁতে বোনা
কাপড় আজ ইওরোপ, এশিয়ার নানান দেশে রপ্তানি হচ্ছে মাথা উঁচু করে।
আশ্চর্যের, ফুলিয়ার এই বিশ্বজোড়া নাম ডাক ডেকে এনেছে
মৃত্যু ফাঁদ। নিজের মাংস আর মৃগনাভিরই স্বাদ-গন্ধে হরিণের মৃত্যু। এক লাখেরও
বেশি হস্তচালিত শিল্পী তন্তুবায়ের রুটি রুজি মারতে ফুলিয়া, রাণাঘাট, শান্তিপুরের
নানান এলাকায় বসে গিয়েছে কয়েক হাজার কলের তাঁত, দৈত্যসম শাড়ি কারখানা। এই কল একই
ধরণের ফুলিয়ার শাড়ি বুনে দিচ্ছে অত্যন্ত কম মূল্যে, অতি কম সময়ে। বন্ধ হয়ে
যাওয়া ফুলিয়ার হস্তচালিত তাঁতের অন্ততঃ পঞ্চাশ হাজার তাঁতি শ্রম দান করছেন সেই সব
কলের তাঁতের কারখানায়। শ্রম দানই বলা ভাল। কেননা কলে
সামগ্রিকভাবে হয়ত বেশি অর্থ রোজগার করছেন, কিন্তু কলে খেটে তাঁতিরা শাড়ি পিছু
মজুরি পাচ্ছেন যথেষ্ট কম। তাঁতে একটি শাড়ি তৈরি করতে মজুরি পেতেন শদুয়েক টাকা,
কিন্তু কলে একটা শাড়িতে পাচ্ছেন ২০ টাকা সর্বাধিক। মরে যাচ্ছে হাড়রক্তজলকরে
তিলে তিলে গড়ে তোলা ফুলিয়ার গর্বিত ঐতিহ্য। বিগত এক বছরেরমধ্যে ফুলিয়ার প্রায়
পঞ্চাশ শতাংশ হাতে টানা তাঁত বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এরই মধ্যে
অন্ততঃ তিনটি পারম্পরিক তাঁত সমিতি বিপুল উদ্যমে বিশ্বের নানান প্রান্তে কাপড়ের
ব্যবসা করে চলেছেন- বিশ্ব বাজারে ফুলিয়া আজ বড় নাম। বাঙলার
একমাত্র টাঙ্গাইল শাড়িকে তাঁরা বাঁচিয়ে দিয়েছেন নবতম উদ্যমে। এর সুফল
ভোগকরছেন এককালে সোসাইটির প্রবল বিরোধিতা করা বহু মহাজনও। অথচ প্রত্যেকজন হস্তচালিত তাঁতির মনে আজ ধুসর মৃ্ত্যুর
ছোঁয়া। ভারত সরকারের সংরক্ষণের তালিকায় হস্তচালিত তাঁতের
উল্লেখ রয়েছে। এ যেন সেই আবার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলের ইতিহাসের
প্রত্যবর্তন।
ভারত সরকারের যে দপ্তরের এই কর্মটি রক্ষণাবেক্ষণ করার দায়, ডেভেলাপমেন্ট
কমিশনার অব টেক্সটাইলসএর এনফোর্সমেন্ট ডায়রেক্টরেটএর আমলারা মুদ্রারাক্ষসের
প্রভাবে কলের তাঁতের স্বার্থ রক্ষণাবেক্ষণেই ব্যস্ত – স্বাধীণতার পর মধ্যবিত্তরা সমাজ উন্নয়ণ কর্ম নিয়ে,
দেশের গর্ব নানান প্রযুক্তি নাশে যে স্বেচ্ছাচার করে এসেছেন এই উদ্যম তারই সর্বশেষ
প্রক্রিয়া। একদিন হয়ত ঐশ্বর্যমন্ডিত ফুলিয়ার, অমর্ষি-কসবা, চন্দ্রকোণার
তাঁতের চরমতম দশাপ্রাপ্ত হবে। দেশজ ঐতিহ্য, দেশজ সাধারণ মানুষের
উদ্যম, দেশজ মানুষের গবেষণালব্ধ জ্ঞাণ রক্ষা, বিকাশে মধ্যবিত্ত আমলা সমাজের
বিন্দুমাত্র উত্সাহ নেই। ভারত সরকারের সঙ্গে বাঙলার সরকারও উদাসীন। সম্প্রতি
বাঙলাদেশ থেকে কলের তাঁতের একই ধরণের অসংখ্য টাঙ্গাইল বস্ত্র এ বাঙলার বাজার ছেয়ে
ফেলছে –
সেখানের হাতে বোনা টাঙ্গাইলের আরও বেশি দুর্দশা। বাঙলাদেশ থেকে
যে ৪০০ও বেশি দ্রব্য ভারতে আসা বন্ধ ছিল, তা ভারত সরকারের ফরমানে নেমে এসেছে
কয়েকশতে। ফুলিয়ার অগ্রণী তাঁতি হরিপদ বসাক ভারতের পরিকল্পনা
কমিশনের পারম্পরিক বস্ত্রশিল্পীদের অন্যতম প্রতিনিধি, তিনি সেই ফরমানের
বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। কিন্তু কাকস্যঃ পরিবেদনা। দেশের
শিল্পীদের পায়ে কুড়ুল মেরে প্রতিবেশীদেশের বড় শিল্পের সঙ্গে সখ্যের দৌত্য কতটা দুদেশের
সাধারণ মানুষের, গড়েতোলা ঐতিহ্যের প্রচার-প্রসারের জন্য হচ্ছে তা সরকারই জানেন। ভারত সরকারের
অন্যতম উদ্যম বিদেশ আগত কলের তাঁত স্থাপনে উতসাহদেওয়া, তাতে হস্তশিল্প মারাযায়
যাক, দেশের ঐতিহ্য লুপ্তহয় হোক। ভারতে চিনের হাতে লুঠ হয়ে যাওয়া
ভারতীয় বস্ত্রের ভারতের বাজার ধরতে সরকারি মদতে পাঞ্জাবে বিশাল বিশাল কলের তাঁত
বসানো হচ্ছে। এতে
ভারতে চিনের তাঁতের বাজার কতটা পড়বে, অথবা পশ্চিমি কলের তাঁতের যন্ত্রপাতির বাজার
কত রেখা বাড়বে, ভারতে বেকারিজ্বালা কতটা দূর হবে, এসব কথা স্পষ্ট করে না বলা
গেলেও, একটি কথা নিশ্চিতভাবে ভবিষ্যদ্বানী করা যায়, ভারতের পারম্পরিক তাঁত শিল্পের
ওপর বড় ধাক্কা আসতে চলেছে, পাঞ্জাবী এই উদ্যমে।
ফুলিয়ার তাঁতিদের আরও বড় মরণফাঁদ পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুত
নিগমের এক তুঘলকি ফরমান। ফুলিয়ার যাঁদের ঘরে
হস্তচালিত তাঁত রয়েছে তাঁদের সবাইকে ব্যবসায়িকহারে বিদ্যুতের মাসুল দিতে হয়। অথচ পাশের জনপদ
শান্তিপুরের তাঁতিরা কিন্তু বাড়ির ব্যবহৃত মাসুলই দেন। হস্তচালিত তাঁতে বিদ্যুত
প্রয়োজন যে হয় সে তথ্য কোনো বিদ্যুত দপ্তরের আমলার কাছে থাকলেও সমাজের বহু মানুষ
এই গুঢ় তথ্য জানেন না। সরকারি এক ব্যবসায়িক
সংস্থার পক্ষে পাশাপাশি দুই জনপদে দুরকম নীতি বিষ্ময়কর বৈকি। আজকের সমাজে এমনিতেই হস্তচালিত তাঁতের দুর্ভোগের শেষ নেই। কলের তাঁতের বিষয়টি কেন্দ্রিয় সরকারের অধীণে হলেও
বিদ্যুতের বোঝাটি কিন্তু রাজ্যসরকার একটি কলমের খোঁচায় সমাধাণ করে দিতে পারেন।
মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর সমীপে এই আবেদন জানালাম। নিবেদনে,
বিশ্বেন্দু নন্দ, কলাবতী মুদ্রা নথিকরণ দলের পক্ষে
২৪/১৮, নাবালিয়া পাড়া রোড, কলকাতা – ৭০০০০৮
০৯১৬৩৮২৫৯৯৪, ০৩৩২৮৯৪৪৭৫৮
No comments:
Post a Comment