মুলতঃ ব্রিটিশ প্রচারে একটা সমীকরণ সারা বিশ্বজুড়ে তৈরি
হয়ে ছিল, জ্ঞান মানেই ইয়োরোপ, আর সবাই পাদটীকা। বাংলার পাঠশালে শিক্ষা গ্রহণ করা
রামমোহন এবং বিদ্যাসাগর দুজনেই নতুন প্রযুক্তির জন্য পশ্চিমের দিকে হাপিত্যেশ করে
নতজানু হয়ে তাকিয়ে রয়েছেন। তারা দুজনেই পূর্বের জ্ঞানচর্চাকে টানমেরে পশ্চিমের
পায়ে লুটিয়ে দিতে চাইছেন। দেশের শিকড়ে কুড়ুল মেরে বিদেশের ওপর দেশের নির্ভরতা তৈরির
প্রথম কারিগর এই দুই ব্যক্তিত্ব। সেই কাজের প্রাপ্য লভ্যাংশ তাঁরা আজও পেয়ে চলেছেন। আজও তাঁরা প্রথম আধুনিক ভারতীয় রূপে পুজ্য রয়ে গিয়েছেন।
বিদ্যাসাগরের সময় রাজেন্দ্রলাল মিত্র,
তার পরে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী অথবা দীনেশচন্দ্র সেন এবং আরও নানান মানুষ বলার
চেষ্টা করছেন ভারতের জ্ঞানচর্চা, প্রযুক্তিচর্চার নানান দিকগুলিকে অন্ততঃ
শহুরে চোখে ঠুলি বাঁধা ইংরেজি শিক্ষিত মানুষদের সামনে নিয়ে আসার। কিন্তু সবই প্রায়
অরণ্যে রোদন হয়েছে। কেননা তাঁরা যা প্রমান করতে চেয়েছেন, তাত্বিকভাবে সে সময়, কোনও
ইওরপিয় সেই কথাগুলো বলেননি। তাই তাদের বক্তব্য খুব একটা মান্যতা পায়নি। আজও একটি
বৃত্তের বাইরে সেই কাজগুলো নিয়ে প্রশ্ন চিহ্ন ঝুলে রয়েছে। জোসেফ নিডহামের সায়েন্স
অ্যান্ড সিভিলাইজেসন প্রকাশের পর থেকেই নতুন করে ভারতের জ্ঞানচর্চার দিকে নজর গেল।
যদিও নিডহামের নিজেই ইয়োরোপের প্রযুক্তির প্রাধান্যে খুব মুগ্ধ ছিলেন। চিনা
প্রযুক্তির আলোচনায়, জাতপাতভেদ, কেন পূর্বের প্রযুক্তি ধ্বংস হল ইত্যাদি বিষয়
অবতারনা করেছেন অসীম ইয়োরোপকেন্দ্রিকতায়। তবুও পূর্বের জ্ঞানচর্চা বা প্রযুক্তিকে
নানানভাবে ইয়োরোপের জ্ঞানচর্চা বা প্রযুক্তির বিকাশের পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার
এক অজানা পথ খোঁজার কাজ শুরু হল, পূর্বের মানুষদের প্রচেষ্টায়। এই খোঁজে বোঝাগেল যে জ্ঞানচর্চা বা প্রযুক্তিগুলোকে
ইউরো-আমেরিকিয় তাত্বিকেরা গ্রিসের ভিত্তি বলে দেখাতে চাইছিলেন, তার অধিকাংশেরই
সূত্র কিন্তু গাঁথা রয়েছে পূর্বের দেশগুলোর সঙ্গে, বিশেষ করে ভারতের জ্ঞানচর্চার
বিকাশের সঙ্গে। এই বোঝানোর বড় তাত্বিকতা নিজের কাঁধে তুলে নিলেন এডওয়ার্ড সইদ,
তাঁর ওরিয়েনটাল-ইজম তত্বে। জানাগেল পশ্চিম যেগুলোকে নিজেদের তৈরি বলে বড়াই করছিল
তাঁর অধিকাংশই পূর্ব থেকে পশ্চিমে গিয়েছে। যেমন অঙ্ক। জর্জ জোসেফ অপূর্ব দক্ষতায়
ক্রেস্ট অব দ্য পিকক বইতে কেরল অঙ্কের কুড় খুঁজেছেন। বলেছেন নিউটন বা লিবনিৎজ়
কলনবিদ্যার জনক নন। এর সূত্র খুঁজে পাওয়া যাবে কেরল-এ নীলকান্তর তন্ত্রসংগ্রহে,
জয়স্থদেবের যুক্তিভাষায়, পুতুমানা সোমাইয়াজির করণ পদ্ধতিতে এবং শঙ্করভরনমের
সদরত্নমালায়। আর এই অঙ্কবিদ্যার ভিত্তিভূমির ওপর গড়ে উঠেছিল দক্ষিণ ভারতের বিশাল
নৌযান তৈরি এবং বাণিজ্যে যাওয়ার গর্বিত ঐতিহ্য। তাত্বিকভাবে নৌযান তৈরির বিদ্যা
এবং সমুদ্রযাত্রা পরস্পরের হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে। লোথালের ড্রাই ডক থেকে চোল
রাজের উদ্যমে সমুদ্র কুনহালি মারাক্কারের যাত্রা ভারতের অদম্য জ্ঞানচর্চা ইতিহাসের
দিকে আঙ্গুল দেখায়। ভারতের বহুবিধ সংস্কৃতির মতই, কয়েক সহস্রাব্দধরে এই প্রযুক্তি
নানান অঞ্চলে, নিজেদের চাহিদা, উপকরণ, সামর্থ্য ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে গড়ে
উঠেছিল।
এর আগে আমরা ভারতের করমন্ডল উপকূলের
নানান ধরণের নৌকো, তার জ্ঞানচর্চা নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছি। বিশদ আলোচনা হয়েছে রাজা
ভোজের নামে চলা যুক্তিকল্পতরু নামক পুঁথির বিষয় এবং আদতে এই পুঁথিটি রাজা ভোজের
রচনা কিনা তাই নিয়েও পণ্ডিতদের নানান সংশয় নিয়ে। সেই প্রবন্ধে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি
যে, এই রচনাটি রাজা ভোজের নামে, জনৈক বাঙ্গালী তান্ত্রিকের রচনা, এবং রচনাকাল ভোজ
রাজার সময়ের অন্ততঃ তিনশ বছর পরের সময়ের। এই প্রবন্ধে আমরা মালাবার উপকূলের
সমুদ্রযান এবং সমুদ্রবিদ্যার বিষয়ে আলোচনা করব।
একদিকে পাহাড়ি ভুমি অন্যদিকে অনন্ত
সাগর – এই নিয়ে মালাবার। সমুদ্রের টানে বহু শত বছর ধরেই এই অঞ্চলের মানুষ সমুদ্রকে
ভিত্তি করে তার বেঁচে থাকার উপায় করে নিয়েছিল। আমরা যেন মনেরাখি, মানুষের সমুদ্র
ভাবনার শুরু কিন্তু প্রচুর সমুদ্রগামিনী নদী, খাঁড়ি ইত্যাদিতে হাত পকিয়ে। এর পরে
সমুদ্রযাত্রার ভাবনা। মালাবারের নাবিকেরা ভারত মহাসাগরের নানান দ্বীপে নিজেদের
তৈরি সমুদ্রযান নিয়ে ক্রমশঃই পৌঁছতে শুরু করে। মালাবারের প্রভাব আজও দেখাযাবে
লক্ষদ্বীপের নৌযান তৈরির কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে।
প্রথম খ্রিস্টাব্দে পেরিপ্লাস অব দ্য এরিথ্রিয়ান
সিতে মালাবার উপকূলের দুটি বন্দর ক্রাঙ্গানোর (মু্যিরিজ) আর পোরাক্কাদু(বারেস)র
উল্লেখ রয়েছে। ক্রাঙ্গানোরের সঙ্গে রোমের খুব ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। ভারতের সঙ্গে
বানিজ্যকে অক্ষুন্ন রাখতে রোমানরা ক্রাঙ্গানোরে অগাস্টাসের মন্দির উৎসর্গ করে। কেরলের
বহু স্থান থেকে প্রচুর রোমের মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে। এই ২০০০ বছর ধরে দক্ষিণ ভারতীয়রা পারস্য উপসাগর
এবং লোহিত সমুদ্রের আদেন, অরমু্য এবং মোকা বন্দরে তাদের জাহাজ নিয়ে যাত্রা করেছে। মারকো
পোলো বলছেন ভারতের জলযান চিনের ফু চাউ পারস্য উপসাগরের হরমুজ বন্দরে যেত। পূর্ব
আফ্রিকায় মোজাম্বিকের উপকূলে বহু বণিকের কর্মকাণ্ড লক্ষ করেছেন ভাস্কো ডাগামা। মোম্বাসা
আর মেলিন্দ পনহোতে বহু গুজরাতি ব্যাবসায়ি ব্যাবসা করতে যেতেন। বহু দেশের নাবিকেরা
ভারতীয়দের সঙ্গে কথা বলে এই দক্ষতা অর্জন করার চেষ্টা করতেন। তাদের অপূর্ব দক্ষতার
জন্য তাদের সংগে তুলনা চলত ভেনিস এবং জেনোয়ার নাবিকদের (যদিও ইওরপিয় নাবিকদের মত
ভারতীয়রা, কোনও একটি দেশ - ভারত, খুঁজতে গিয়ে আরেকটি দেশ - আমেরিকা বা ওয়েস্ট
ইন্ডিজ আবিষ্কার করেন নি)।
চের রাজার নাবিকেরা ব্যবসা করতে যেতেন
কালিকট, কদুঙ্গাল্লুর, কোল্লমের মত পূর্ব পশ্চিম উভয় উপকুলের বন্দর থেকে। ইবন
বতুতা বলছেন আদেন বন্দরে ভারতীয়দের স্থায়ী বসতি ছিল এরা থানা এবং কুইলন থেকে
প্রায়শঃই যাত্রা করতেন। থোম পাইরেজের মালাবার উপকূলে ৪০০টি সমুদ্রগামী জাহাজ ছিল, এরা
ক্যাম্বে, করমন্দল, শ্রীলংকা এবং মলদ্বীপে ব্যবসা করত। বলোনার লুদভিকো ডি ভারথেমার
লেখায় মালাবারের ব্যবসায়িদের, মালাবার থেকে পারস্য উপসাগরে ব্যবসার বর্ণনা রয়েছে।
রোম থেকে পূর্ব আফ্রিকার উপকূল থেকে পারস্য উপসাগর এবং লোহিত সাগরে ভারতীয়
ব্যাবসায়িদের সমুদ্র যাত্রা বিশ্বজোড়া বিপুল ব্যবসার দিকে ইঙ্গিত করে। অর্থাৎ
পতুগিজ বণিকদের(না খুনি) ভারত পদার্পণের বহু সহস্র বছর আগে থেকে ভারতীয়রা
বিশ্বজুড়ে ব্যাবসা করেছে। ঔপনিবেশিক সময় থেকে ইয়োরোপীয় বিদ্বানরা প্রমান করতে
চাইতেন ভারতের সমুদ্র যাত্রার শিক্ষা পর্তুগিজদের থেকে হয়েছে। অথচ পর্তুগিজ নাবিকেরা
ভারতে এসে নতুন সমুদ্রবিদ্যার সন্ধান পাচ্ছেন।
মালাবার উপকূলের সমুদ্রবিদ্যা চর্চার প্রমান
লক্ষদ্বীপের নানান পুঁথিতে রয়েছে। নাবিকদের লেখা রহমানি আর রোজনামায় ভারতের নানান
উপকূলভূমির বর্ণনা পাওয়াযায়। আরবু-তামিল, আরবু-মালায়লম ভাষায় প্রচুর পুঁথি আজও
মালাবার উপকূলের নানান স্থানে পাওয়া যার। পুঁথিগুলো যদিও এই দুই ভাষায় লেখা, কিন্তু
লিপি আরবি অক্ষরে। লক্ষদ্বীপ সোসিও-কালচারাল সোসাইটি লক্ষদ্বীপ নাবিকাশাস্ত্র
পরম্পারায়মে এ ধরণের বহু পুঁথি প্রকাশি করেছে। মাস্তিন সেখ, আলিয়ার থাঙ্গল আর
তাপ্পু কান্নাকুর তিনটি পুঁথি পাওয়া গিয়েছে। এতে সমুদ্র যাত্রায় আকাশ, বাতাস,
খারাপ আবহাওয়া, তারা, এবং নৌ যাত্রার জন্য কন্সটেলেশন, অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ,
বন্দরের স্থান, মরশুম, যাত্রা শুরুর তারিখ ইত্যাদির বিশদ বর্ণনা রয়েছে।
ভারত সমুদ্রে নৌ যাত্রার জন্য নানান
ধরণের জাহাজ তৈরি করা হত। কোন ধরণের জলে, কোন ধরণের বানিজ্য দ্রব্য, কোন আবহাওয়ায়
যাত্রা হবে, এই সব বিচার করে জাহাজ তৈরি হত। ক্যাম্বে উপসাগরের উত্তাল সমুদ্রের জন্য
নানান ধরণের জাহাজ তৈরি হত। এদের নাম দেওয়া হত বালাম, বাঘলা, কতিয়া, গালিবাত,
গ্রাব, পাত্তামার ইত্যাদি। ১৫০০সালের পরে
ভারত মহাসাগরে নতুন ধরণের জাহাজ তৈরি হওয়া শুরু হল। গুজরাট আর মালাবারে এগুলোকে
কোটিয়া নামে আর পারস্য উপসাগরে এগুলো বাঘলা নামে চিহ্নিত হত। ভারতের পশ্চিম
উপকূলের সমুদ্র আর জাহাজ শিল্প অনেকটা ইসলামের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। অনেকগুলি
সাধারন হাল(common hull) ডিজ়াইন করা হত এবং এতে অনেকগুলো লাতিন সেল(lateen
sail)। নৌযান তৈরিতেএই হালগুলির বিশদ ডিটেল আঁকা জরুরি ছিল,
নয়ত হাওয়া নিয়ন্ত্রণ(পক্ষে বা বিপক্ষে) বা সমুদ্র স্রোত নিয়ন্ত্রণ করা যেমন কঠিন
হত তেমনি জাহাজের যাত্রীদের অবস্থাও শোচনীয় হয়ে পড়ত। পর্তুগিজ আমলের আগে মুলতঃ
জাহাজগুলোর মালিক কারিমি ব্যবসায়িরা ছিল। এই জাহাজগুলো প্রধানতঃ লোহিত সাগর এবং
ভারতের মধ্যে চলাচল করত। এই জাহাজে সশস্ত্র যোদ্ধা নিয়োজিত থাকত জলদস্যুদের মোকাবিলার
জন্য।
এর পরের লেখটি হবে নৌকোগুলোর বিভাগ বর্ণনা।
No comments:
Post a Comment