নীল স্বাধীণতা সংগ্রাম
পালাশি চক্রান্তের পরেই ১৭৬৩ থেকেই সারা বাঙলায় ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে
কৃষকেরা হাতে অস্ত্র তুনে নিয়েছিলেন। সরকারের
দমনপীড়ন নীতি আর লুঠের রাজত্বের বিরুদ্ধে শহরের মানুষের আত্মসমর্পণের বদলে
গ্রামীণ সমাজ নিদেরমত করে লড়াই করেছে বলদর্পী ইংরেজদের বিরুদ্ধে। বাঙলা-বিহারের নীল স্বাধীণতা সংগ্রাম সেই চলতে থাকা বীরত্বপূর্ণ
লড়াইমালার এক বর্ণময় অংশ। প্রথমে বাঙলার
চাষীদের এই অত্যাচারের ধরণ বুঝতে বেশ সময় গিয়েছিল। কিন্ত যখন সারা পূর্ব বাঙলা নানান লড়াইএর ময়দানে অংশ নিয়ে ইংরেজদের
সেনা-পুলিশের বিরুদ্ধে নিজেদের রাগ, ক্ষোভ, অহংকার প্রকাশ করছে একইভাবে লড়াইতে
অংশ নিয়ে, তখনই বাঙলা-বিহারের নীল চাষীরা নীলকরদের অত্যাচারে একতাবদ্ধ হয়ে সেই
স্বাধীণতা সংগ্রামের এক অংশ হয়ে দাঁড়াল।
সন্ন্যাসী ও ফকির স্বাধীণতা সংগ্রাম, তিতুমীরের লড়াই, সাঁওতাল স্বাধীণতা
সংগ্রাম, সিপাহি স্বাধীণতা
সংগ্রাম, পাবনার
প্রজাস্বাধীণতা সংগ্রাম, নীল স্বাধীণতা সংগ্রামেরমত আঞ্চলিক নানা কৃষক
স্বাধীণতা সংগ্রাম থেকে মধ্যবিত্ত বাঙালি বেশ দূরেই ছিল। লুঠের রাজধানী কলকাতা আর স্বাধীণতা সংগ্রামী গ্রাম বাঙলার মানসিক দূরত্ব
তখন যোজন প্রমাণ। এই স্বাধীণতা সংগ্রাম এতই ঘনিয়ে ওঠে যে ব্রিটিশদের সঙ্গে
চাকরিজীবি, ব্যবসাকারী, স্বাধীণতা সংগ্রামের থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা বেশকিছু
বন্ধু মধ্যবিত্তরও অটল আসন টলতে শুরু করল। কলকাতার নানান
পত্র পত্রিকায় প্রথম প্রথম গা বাঁচিয়ে, পরে অনেক খোলাখুলিই স্বাধীণতা সংগ্রামের
সপক্ষে সওয়াল করা শুরু করল। বাঙলার গ্রামে
গঞ্জে যে আন্দোলন ঘনিয়ে উঠছিল, সেই আন্দোলনের ঢেউ এসে লাগল কোম্পানির নিরাপদ
গর্ভগৃহে থাকা কলকাতার আকাশে বাতাসে। হরিশচন্দ্র
মুখোপাধ্যায়, কালীপ্রসন্ন সিংহ, কাঙাল হরিনাথ
মজুমদার, শিশিরকুমার ঘোষ, মির মশাররফ হোসেন, দীনবন্ধু মিত্ররমত হাতে গোণা প্রখ্যাত মানুষজন কিন্তু রামমোহন বা
দ্বারকানাথ অথবা অন্যান্য খ্যাত-অখ্যাত নীলকর জমিদারদের অত্যাচারের পথের বিরুদ্ধে
গিয়ে কলকাতার বিবেক হয়ে ওঠেন। তাদের লেখনি
আর ক্রমাগত বক্তৃতায় ক্রমশঃ প্রকাশ পেতে থাকে নীলকরদের অমানুষিক অত্যাচারের
ধারাবাহিক কাহিনী। এরই প্রভাবে হয়ত ক্যলাকাটা রিভউরমত
বনেদি কাগজের সম্পাদক এবং পাঠককেও সাহস যুগিয়ে এই স্বাধীণতা সংগ্রাম তার মনোজগত
নাড়িয়ে দিয়ে যায় তার প্রমাণ ১৮৪৮ সালে স্বাধীণতা সংগ্রামের একটি সপক্ষে চিঠি
প্রকাশের স্পর্ধায়।
অবিভক্ত বাঙলায় নদীয়া ও যশোর, বাঙলার এই দুটি সবচেয়ে বেশি নীলচাষের অঞ্চল। সে সময়ের অবিভক্ত নদীয়ার কুমারখালী, কুষ্টিয়া, দৌলতপুর, চুয়াডাঙ্গা ও
মেহেরপুর ছিল নীলচাষের প্রধান অঞ্চল। ৫১টি নীলকুঠির হেড
আপিস ছিল কুমারখালীতে। এ অঞ্চলের শালঘর-মধুয়ার নীলকর টিআই কেনি ও
ধোকড়াকোল কুঠির স্টিফেন সাহেব অত্যাচারী কুঠিয়াল হিসেবে কুখ্যাত ছিলেন। এই দুই সাহেব-নীলকরের আবার ঘোরতর
বিবাদ-কলহও
ছিল, মাঝেমধ্যেই দু'পক্ষের
দাঙ্গাহাঙ্গামা বাধত। নীলচাষের ব্যাপকতার কারণে কুমারখালী অঞ্চলের
চাষিদের ওপর অত্যাচার যেমন প্রবল হয়েছিল, তেমনি প্রতিবাদ-প্রতিরোধও হয়েছিল
তীব্র। ব্রিটিশ শাসন আমলে ইংরেজ
বেনিয়ারা প্রতিষ্ঠিত করে জালালপুরে নিন্দিত নীল কুঠির। ১৮৮৬ খ্রীঃ বর্তমান
কটিয়াদী ঊপজেলার অন্তর্গত জালালপুরে উপমহাদেশের সবচেয়ে
বড় নীল চুল্লী ছিল। এখনও এই নীল চুল্লীর ধংসাবশেষ রয়েছে। যেখানে
আর্তমানবতার ভাষা স্তব্ধ। যেখানে অত্যাচার
অবিচারের দাপট ছিল আকাশচুম্বি এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই নীল কুঠি। পরাধীনতার বন্ধন কত নিষ্ঠুর এই নীল কুঠির চরমতম দৃষ্টান্ত। কেমন করে নৃশংসভাবে বেতমেরে পিঠের চামড়া তুলে নিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে
রাখা হত গাছের ডালে, সারাদিন মাঠে মাঠে
নীল চাষ করে শেষে
কানমলা দিয়ে শুণ্য হাতে ফেরত পাঠানোর সাক্ষী জালালপুরের নীলকুঠি। হযরত শাহ সুলতান
হাফিজ ইরানী মাজার অঞ্চলে নীল স্বাধীণতা সংগ্রামের নেতৃত্বের মূল ঘাঁটি ছিল। নীল কুঠির এলাকার
জলমহলকে
কুঠির বিল নামে আজও ডাকা হয়।
কুমারখালির অনমনীয় সাংবাদিককাঙাল হরিনাথের(একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, কাঙাল কিন্তু সন্ন্যাসী স্বাধীণতা সংগ্রামীদের পাশে
দাঁড়ান নি) 'গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা' আষাঢ় মাসের
পত্রিকায় নীল চাষের এবং নীল স্বাধীণতা সংগ্রামের নানান তথ্য উঠে
এসেছে ক্রমান্বয়ে, কলকাতার বুদ্ধিজীবিদের গা এড়িয়ে যাওয়ার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে। "অনেকেই বিশেষত রাজপুরুষরা নিশ্চয়ই মনে
করিয়াছেন,
নীলকরের দৌরাত্ম্য নিবারণ হইয়াছে। তাঁহারা নৃশংস স্বভাব পরিত্যাগ
করিয়া 'অহিংসা পরমধর্ম্ম' আশ্রয় করিয়াছেন। তাঁহাদিগের মন একেবারে নির্ব্বিকার হইয়াছে। এক্ষণে নীলপ্রধান
যে কোনও প্রদেশে হাঙ্গামা হয়, সে কেবল
প্রজাদিগের দোষেই হইয়া থাকে!!! যাঁহারা এরূপ বিবেচনা করিয়া থাকেন, তাঁহারা নিতান্ত
ভ্রমে পতিত হইয়াছেন সন্দেহ নাই। মহাত্মা গ্রান্ট সাহেব বিষধর
নীলকরদিগের বিষদন্ত ভগ্ন করিয়া দিয়াছিলেন। তজ্জন্য তাঁহারা অল্পদিন মাত্র আপন
স্বভাব প্রকাশ করিতে সমর্থ হয়েন নাই। ক্রোধে চক্র ধরিয়া ফঁস ফঁস করিতেন, দংশন করিতেন, কিন্তু
বিষদন্তাভাবে কৃতকার্য হইতে পারেন নাই। খলের স্বভাব
কিছুতেই পরিবর্ত্তন হয় না!!! ভগ্নদন্ত ভুজঙ্গের বিষদন্ত পক্ষান্তরেই
নির্গত হয়। রাজপুরুষরা কি সে সমুদায় একেবারে বিস্মরণ
হইয়াছেন?"
"ইতিপূবর্ব কুমারখালী সবডিবিজনে নীলকর সম্বন্ধীয় মোকদ্দমা
প্রায়ই উপস্থিত ছিল না। সম্প্রতি একেবারে
কতকগুলি উপস্থিত হইয়াছে। 'প্রজারা আমাগিদকে
নীল বুনানী করিতে দেয় না' নীলকরেরা এই
মম্র্মে মোকদ্দমা উপস্থিত করিতেছেন। প্রজারা 'নীলকরেরা আমাদিগের
বুনানী ধান্য নষ্ট করিয়া নীল বুনানী করিতেছেন', এইভাবে নালিশ
উপস্থিত করিতেছে। পক্ষপাতশূন্য হৃদয়ে বিবেচনা করিয়া দেখিলে বিলক্ষণ হৃদ্বোধ
হইবে, এখন নীল বুনানীর
সময় নহে। ধান্য রোপণ ও বপনেরই সময়। এ সময় বাধা দিতে
পারিলে কৃষকদিগের কৃষিকার্য্য একেবারে উচ্ছিন্ন যাইবেক। অগত্যা তাহারা
নীলকরদিগের শরণাগত হইয়া দাসত্ব শৃঙ্খল পরিধান করিবে। এই অভিপ্রায়েই
নীলকরেরা হাঙ্গামা উপস্থিত করিয়াছেন। নিরর্থক মোকদ্দমায়
দুঃখী প্রজাদিগকে আবদ্ধ রাখিয়া তাহাদিগের আবাদি ভূমিতে বলপূর্ব্বক
নীল বীজ ছড়াইতেছেন। নানা প্রকার
গোলযোগে কালবিলম্ব হওয়ায় প্রজাদিগের ধান্য বুনানীর সময় উত্তীর্ণ হইয়া
যাইতেছে।"
নীলচাষ যখন তুঙ্গে, তখনই চাষীদের মধ্যে ক্ষোভ দানা
বাঁধতে শুরু করে। নীলচাষের যা লাভ তা সবই কুঠিয়ালদের-জমিদার লিজ অনুযায়ী টাকা
পেয়ে গেলেও মূলচাষীরা কিছুই পাচ্ছিলেন না। চাষীরা ক্ষোভ
জানাতে
আরম্ভ করছিলেন। কোথাও কোথাও প্রকাশ্যেই নীলচাষ না করার কথা জানানো হলেই
ইংরেজদের
প্রকৃত চেহারা বেরিয়ে আসতে থাকে। চাষীদের নীলচাষে
বাধ্য
করার জন্য প্রথমে হুমকি দেওয়া হল। কাজ না হলে
অত্যাচার নেমে এল। অত্যাচার বলতে কুঠিতে ধরে নিয়ে যাওয়া
হত। কখনও বাড়ির আসবাব, গরু-ছাগল সবই নিয়ে যাওয়া হত। সেইসব জিনিস ছাড়ানোর
জন্য গেলে মুচলেকা দিতে হত। কখনও বাড়ির বৌ, মেয়েকেও কুঠিতে নিয়ে যাওয়া হত। অকথ্য অত্যাচার চালানো হত। মেয়েদের অত্যাচার থেকে বাঁচাতে মুচলেকায় দস্তখত লিখে চাষীরা আবার
নীলচাষে
বাধ্য হতেন। চাষীদের দমন করার জন্য কুঠিতে কুঠিতে তৈরী হল ‘গুমঘর’।
এক একটা কোম্পানিতে একাধিক কুঠি
থাকায় ধরে নিয়ে যাওয়া চাষীদের এক একটা গুমঘরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে
রেখে দেওয়া হত। এভাবে পরিজনদের
মধ্যে
ছড়িয়ে দেওয়া হত আতঙ্কের পরিবেশ। শেষ পর্যন্ত অবাধ্য চাষীর দেহ নদীর জলে লাশ হয়ে ভেসে যেত। কারোর দেহ গুম
করেই চিরকালের মতো গুম
হয়ে যেত। কুঠিয়ালরা ভয় দেখিয়ে সাদা
কাগজে সই করিয়ে নিতে লাগল বাড়ি বাড়ি গিয়ে। বাগান কেটে নীলচাষ
করাতে
বাধ্য করানো হল এভাবে। বাধা দিলে বাড়িঘরে আগুন
জ্বালিয়ে দেওয়া হল। স্বাধীণতা
সংগ্রামী কৃষকদের কুঠিতে ধরে নিয়ে গিয়ে মুগুর আইন প্রয়োগ করে
টিপ/সই করিয়ে ইচ্ছামতো
লিখে নিয়ে কাজ হাসিল করতে লাগল নীলকররা।
অত্যাচারী নীলকরদের মধ্যে মোল্লাহাটি কুঠির লালমোর কুখ্যাত হয়ে ওঠেন। লালমোরের নৃশংসতায় বাঙলার
নারীর চোখের জলে ভেসে গেল রাজপথ। বহু নারী পাশবিক কামনার
শিকার হলেন। নীলকর সাহেবরা ‘চোদ্দ কুঠির জল খাওয়ানো আইন’ তৈরী করল। সতীশ মিত্র ‘যশোরের খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন, চুক্তি ভঙ্গে
তাদের
কয়েদ খানায় রাখা হত। চোদ্দ কুঠির জল
খাওয়ানোর ভয় দেখানো হত। মুগুরের আইন পাশ
হচ্ছে
বলে
ভয় দেখানো হত। লালমোর সাহেব ছিলেন প্রবল
অত্যাচারী। নীল বুনতে না চাইলে স্বাধীণতা সংগ্রামীদের খুনও করা হত। গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া
হত।
কৃষক
কন্যাদের ধরে এনে অপমান করত। ১৮১০ সাল থেকেই নীলচাষীদের উপর অত্যাচারের
কাহিনী প্রকাশ হতে থাকে। জমিদার তিতুমীর ইংরেজদের
উদ্দেশ্যে হুশিয়ারী দিলেন অবিলম্বে অত্যচার বন্ধ করার জন্য। অত্যাচারের মাত্রা ছাড়াতে থাকে ১৮১০
সাল থেকে। কৃষকরা স্বাধীণতা সংগ্রামী হয়ে উঠছে, ছড়াচ্ছে
স্বাধীণতা সংগ্রামের এলাকা।
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে আজকের বাঙলাদেশের নীলফামারীর বিখ্যাত কাজীরহাটসহ এ অঞ্চলের অন্যন্য বড় বড় জমিদারীগুলো ভেঙে নতুন নতুন জমিদারী সৃষ্টি হল। এ সময় ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরা সুযোগমতো নিজেদের নীল চাষের ব্যবসায় নিয়োজিত করতে থাকে। শুরুর দিকে নীলকররা এ অঞ্চলের চাষীদের আগাম অর্থ ধার দিয়ে তাদের নীল চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করে। এতে কিছু কিছু চাষী নীল চাষ শুরু করলে জমিদারীর রাজস্ব আয় কমে আসে। ১৩ জন জমিদার বাধ্য হয়ে ১৮০১ সালের ১০ এপ্রিল যৌথ স্বাক্ষরিত এক অভিযোগনামা ইংরেজ কোম্পানির কাছে দেয়। তার পরও থেমে থাকেনি কুঠি তৈরি। ইংরেজ কর্মচারীরা একের পর এক নীল কুঠি ও খামার গড়তে শুরু করে। সদর থানার চিনির কুঠি ও দূরা কুঠিতে বড় বড় দুটি নীলকুঠি গড়ে ওঠে। বাফটন নীল কারখানা স্থাপন করেন ডিমলায়, আর ব্লাউডি কারখানা তৈরি করেন কিশোরগঞ্জ এবং ডাব্লিউ টেব্রামিক্র টেঙ্গনমারীতে কুঠি স্থাপন করেন।পরবর্তীকালে নীলকুঠির সংখ্যা আরও বাড়তে থাকে। নীলফামারী শহরের প্রাণকেন্দ্র একটি নীলকুঠি, শহর থেকে ৩ কিলোমিটার উত্তরে পুরাতন ষ্টেশন সংলগ্ন নটখানা এলাকায় আরেকটি বড় নীলকুঠি, দারোয়ানী নীলকুঠি, সংগলশী ইউনিয়নের নীলকুঠি এমন অসংখ্য নীলকুঠি ও নীলখামার গড়ে ওঠে। নীলফামারীতেই নীল চাষের উপযোগী উর্বর মাটি থাকায় এখানকার চাষীদের ওপর চোখ পড়ে ইংরেজ বেনিয়াদের। বিভিন্ন কুঠিবাড়ী থেকে নিয়ন্ত্রন করা হতো কৃষকদের। এসব কুঠিবাড়ী প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রনেই নীলফামারীতেই সবচেয়ে বেশী উৎপাদন হতো নীল। কিন্তু যেসব কৃষক অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ও ক্ষতিকর এই নীলচাষে অস্বীকৃতি জানাতো তাদের ওপর নেমে আসতো নির্যতনের ষ্টিম রোলার। নীলকরদের অমানবিক অত্যাচারে অত্যাচারিত চাষীদের আর্তনাদ ভেসে আসতো বিভিন্ন নীলকুঠি থেকে। অত্যাচারের মুখেও এ অঞ্চলের বঞ্চিত ও প্রতিবাদী কৃষকরা ১৮৪৭-৪৮ সালে আলাভজনক নীলচাষ পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। এর পর নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়লে ১৮৮৫-৬০ সালে এ অঞ্চলের কৃষকের ঘরে ঘরে শুরু হয় ব্যাপক স্বাধীণতা সংগ্রাম। নীল চাষ মুখ থুবড়ে পড়ে নীল বিদ্রোহে।
শুরু হল স্বাধীণতা সংগ্রাম। ছড়াতে লাগল গ্রাম থেকে গ্রাম। নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান যশোরের চৌগাছার বিষ্ণুচরন বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস। ১৮৩০ সাল থেকেই স্বাধীণতা সংগ্রাম মাথা চাড়া দিচ্ছিল বিক্ষিপ্ত ভাবে। জমিদার পুলিশ এবং ইংরেজদের যৌথ আক্রমনের বিরুদ্ধে সঙ্গবদ্ধ প্রয়াস নেবার পথ খুজে বেড়াচ্ছিল বাঙলার কৃষকরা। বিষ্ণুচরন দিগম্বর সেই বিপ্লবের পথের সন্ধান দিলেন। বিশ্বাস ভায়েরা কালেক্টরের কুঠির দেওয়ান ছিলেন। নীলকরের ক্রমবর্ধমান অত্যাচার ও নীলচাষীদের অপরিসীম দুঃখে বিচলিত হয়ে কাজে ইস্তফা দিয়ে প্রজাদের পক্ষ অবলম্বন করে নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হলেন। নীলকরদের বিরুদ্ধে ছড়া ও গান রচনা করেপ্রজাদের উত্তেজিত করে তোলেন তাঁরা। নীলকররাও প্রজাদের ঐক্যকে ভাঙার জন্য নানারকম ষড়যন্ত্র করতে শুরু করেন। বিশ্বাস ভাইরা বরিশাল থেকে লাঠিয়াল এনে প্রজাদের লাঠি ধরালেন। বাঙলার রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে এই দুই ভায়ের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
অন্যদিকে মালদা এলাকায় নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এলেন রফিক মন্ডল। নীলকরদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিনিও ছিলেন একজন বড় নায়ক। নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে তার সমস্ত অর্থ ব্যয় হয়ে যায়, এমনকি তিনি খাজনা দেবারও সঙ্গতি হারিয়ে ফেলেন। স্বাধীণতা সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়ল এক কুঠি থেকে অন্য কুঠি। ‘জমির শত্রু নীল, কাজের শত্রু চিল আর জাতির শত্রু পাদরি হিল’, এই
ছড়া
মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল গ্রামে গ্রামান্তরে। গ্রামের লাঠিয়ালরা একত্রিত হতে লাগলেন। যুবকরা শিখতে লাগলেন লাঠি চালনা। গ্রামের মেয়েরা শঙ্খ বাজিয়ে ইংরেজ বা নীলকরদের গ্রামে ঢোকার সংকেত জানিয়ে দিত। কখনও গ্রামে গ্রামে ঢাক বাজিয়ে গ্রামবাসীকে সতর্ক করত। শঙ্খ বা ঢাকের শব্দ শোনা মাত্রই গ্রামের পুরুষরা লাঠি,হাতিয়ার নিয়ে বেরিয়ে পড়ত। কুঠিয়ালরা এই স্বাধীণতা সংগ্রাম ভাঙ্গার জন্যে নানা ফন্দি বের করতে লাগল। হিন্দু-মুসলিম মিলিতভাবে ধর্মঘট ডাকলেন। ধর্মঘটে অভূতপুর্ব সাড়া পাওয়া গেল।
ইংরেজরা দিগম্বর বিশ্বাসদের ধরার জন্যে
হুলিয়া
জারি করল। তাতে ইনাম পাবার লোভও দেখানো হল। ইংরেজদের চর সক্রিয় থাকা
সত্ত্বেও
স্বাধীণতা সংগ্রামীদের অনুগামীরা এতই তৎপর ছিল যে ইংরেজরা
স্বাধীণতা সংগ্রামীদের ধরতে ব্যর্থ হল। তখন সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠল। একটা সময় কুঠিতে কর্মরত
সাঁওতালরা ইংরেজদের খুবই অনুগত ছিল। কিন্তু আদিবাসী
নেতা কানু সিধুকে ইংরেজরা হত্যা করে ১৮৮৫ সালে। এই ঘটনার পর আদিবাসীদের
আনুগত্যে চিড় ধরে। তারা কৃষক
বিদ্রোহে
কৃষকদের পাশে দাঁড়ায়। স্বাধীণতা
সংগ্রামের ভয়ংকর রূপ দেখে ইংরেজরা শঙ্কিত হয়ে পড়ে স্বাধীণতা
সংগ্রামের কথা এদেশের নানান সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে থাকে। প্রবল চাপে ইংরেজ সরকার গঠন করে ইন্ডিগো
কমিশন। বিচারকরা কুঠিতে ঘুরে ঘুরে নমুনা সংগ্রহ করে তদন্ত
রিপোর্ট
পেশ করেন। বারাসাতে ম্যাজিস্ট্রেট ইডেন সাহেব ১৮৫৯ সালে ২০ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করেন
নীলচাষ
আর বাধ্যতামূলক নয়। আসলে এই আদেশ ঘোষণা করে স্বাধীণতা সংগ্রামীদের ছত্রভঙ্গ করাই মূল
উদ্দেশ্য
ছিল। ইংরেজদের উদ্দেশ্য আংশিক সফল হলেও সম্পুর্ন
হয়নি। স্বাধীণতা সংগ্রামীদের দাপটে কাঠগড়া কুঠিতে নীলচাষ
বন্ধ করে দেয় স্বাধীণতা সংগ্রামীরা। এমনকি কুঠিতে আগুন ধরিয়ে দেয়।(http://www.khoyab.in/Prabandho_Rama।html)
নীল চাষীদের সংগ্রামে বিশ্বনাথ সর্দার বা বিশে ডাকাতের
ভূমিকা চিরস্মরণীয়। ১৩৬৮র ১০ বৈশাখ আনন্দবাজার পত্রিকায়
এক লেখায় মহত্মা হারাধন দত্ত মহাশয় সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালির ইংরেজদের অনুসরে
স্বাধীণতা সংগ্রামীদের ডাকাত দেগে দেওয়ার ছকের বাইরে বেরিয়ে এসে বিশ্বনাথ সর্দারের
বীরত্বকে বাঙলার সামনে তুলে ধরেছেন অকুতভয়ে। হারাধন দত্তর
জবানীতেই শোনা যাক বিশে ডাকাতের নীলকর অত্যাচার প্রতিরোধের কাহিনী, ইংরেজ আমলের সেই ঊষালগ্নে আমাদের দেশে
নীলকরদের খুব প্রভাব ছিল। নীলকরদিগকে জমিদারির ইজারাদেওয়া হইত। ইজারা দিতে জমিদারেরা বাধ্য হইতেন। আইনে সুবিচার
ছিল না। যে অপরাধে দেশিয় জমিদারেরা কারাদন্ডে
দন্ডিত হইতেন, সেই অপরাধে য়ুরোপিয় নীলকরেরা মুক্তিলাভ করিত। সামান্য কারণে চাষীর ওপর অকথ্য অত্যাচার চলিত। খুন দাঙ্গা,হাঙ্গামা ছিল প্রতিদিনের ঘটনা।।। গ্রামকে
গ্রামন জ্বালিয়ে দিত নীলকর সাহেবেরা। বাড়ী
ভেঙেফেলা, নিরীহ প্রজাদের কয়েদ করারতো অবধিই ছিলনা। নীলকরদের
অত্যাচারে সেকালের বাঙলাদেশ সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিল। ।।বিশ্বনাথের অভ্যুত্থানভূমিতে বিশেষ করে চূর্ণী নদীর তীরে তীরে – হাঁসখালি, মন্নুরহাট, কৃষ্ণপুর, বাবলাবন, রানীনগর, চন্দননগর, চৌগাছা,
খালাবেলিয়া, গোবিন্দপুর, আসাননগর প্রভূতি গ্রামে সুবৃহত অট্টালিকাময় নীলকুঠির
ভগ্নাবশেষ আজও চোখে পড়ে। ।।।এই নীলকরদের
বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করারমত সেখানে কেউই ছিলনা। সঙ্ঘবদ্ধ
আন্দোলনের অস্তিত্বই ছিল না।
বিশ্বনাথ
সর্দারকে বাঙলাদেশ নীল আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ও প্রথম প্রথিকৃত্ বলে আমি অভিহিত
করতে চাই। ঊনবিংশ শতকের প্রথম দশক। সে কালে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন এক প্রকার অবাস্তব ছিল। বিশ্বনাথ এককভাবে সেকালের এই দুর্ধর্ষ অপ্রতিহত নীলকরদের বিরুদ্ধে
দন্ডায়মান হয়েছেল, এবং মৃত্যুবরণ করে নীল আন্দোলনের প্রথম শহীদ হন। ডাকাত হিসেবেই আমরা বিশ্বনাথের গল্প শুনে এসেছি- কিন্তু ঊনবিংশ শতকের
প্রথম দশকে তিনি নানা ক্ষেত্রে বাঙলা দ্শের লাঞ্ছিত মানুষের প্রতিনিধি করেন এবং
ইংরেজ সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলেন, বিশ্বনাথ বাঙলার নীল আন্দোলনের প্রথম
অগ্রপথিক – এবিষয়ে মতান্তর হওয়ার অবকাশ নেই। এটাই বিশ্বনাথের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তী- বিশ্বনাথ স্বাধীণতা সংগ্রামী।
ঊনিশ শতকের
প্রথম দশকের শুরুতে বিশ্বনাথের ক্রিয়াকলাপ নীলকুঠি লুন্ঠনের মধ্যে সীমিত ছিল। নীলকর সাহেবদের জব্দ করা তাঁক অন্যতম প্রতিজ্ঞায় পরিণত হয়েছেল। ।।।তখন নদীয়ায় স্যামুয়েল ফেডী নামক এক
প্ররাক্রান্ত কুঠিয়াল ছিল। ফেডীর নীলকুঠী তদানীন্তন জেলা শাসক।, মিঃ এলিয়টের বাংলোর পাশেই ছিল। ।।।বিশ্বনাথ একদা েক দীপালী রাত্রে এই
নীলকুঠি আক্রমণ করে লুঠন করেন, এই আক্রমণে ফেডীর অনেক অনুচরও নিহত হয়। মিসেস ফেডী পুষ্করণীতে মাথায় কালো হাঁড়ি চাপা দিয়ে জীবন রক্ষা করেন। বিশ্বনাথ এই ইংরেজ মহিলার জীবন রক্ষার্থে সতর্ক দৃষ্টি রাখেন। বিশ্বনাথের আদেশে মেঘা(বিশ্বনাথের অনুচর), মি। ফেডীকে বাগদেবী খালের তীরভূমিতে এক জঙ্গলে আনয়ণ করেন। বিশ্বনাথের দলবল ফেডীর প্রাণদন্ড কামনা করে। বিশ্বনাথ এদের কথায় কর্ণপাত করেন নি।।।।
ফেডী আকাতরে
সেদিন প্রাণ ভিক্ষা করেছিল এবং বিশ্বনাথের কাছে প্রতিশ্রুত হয়েছিল যে, জীবনে সে এই
কাহিনী কোথাও প্রকাশ করবে না। কিন্তু মুক্তিলাভ করার পর
বিশ্বাসঘাতক ফেডী বিশ্বনাথকে ধরিয়েদেয় এবং বিশ্বনাথ সহ কয়েকজন অনুচরকে দিনাজপুর
জেলে প্রেরণ করা হয়। বিশ্বনাথ সেই জেল হতে অনুচর সহ
মুক্তিলাভ করতে সক্ষম হন এবং ফেডীর বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধে বদ্ধপরিকর হন।
বিশ্বনাথ ভদ্রলোক গ্রামীণ বাঙালি। তিনি অত্যাচারী ইংরেজ সমাজ অথবা লুঠেরা ব্রিটিশ সভ্যতার ইতিহাস জানতেনা। তিনি তার দীর্ঘ কালের অর্জিত নীতি, এশিয় সভ্যতাবশে ধৃত শত্রুকে আরও একবার
শোধরাবার সুযোগ দিয়েছিলেন, তাকে সত্যবচনে অবরুদ্ধ করে তার বিবেককে জাগ্রতকরার
চেষ্টা করেছিলেন। বিশ্বনাথেরমতই বাঙলার অত্যাচারিত
গ্রামীণ শিল্পী, কলাকুশলী, শ্রমিক, চাষীসহ হাজারো জনগণ সরাসরি তাঁদের অসন্তোষ
জানাতে স্বাধীণতা সংগ্রামের অনল প্রজ্জ্বলনের শিখা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন দিক দিগন্তরে। তাদের আন্দোলনের সফলতা অথবা বিফলতার প্রশ্ন ওঠেনা, সেদিনও ওঠেনি, নিজেদের
মানুষের ওপর অসীম অত্যাচারের অনুভূতি নিজের দেহে জাগিয়ে, দেশ, সমাজ, সম্পদ, জ্ঞাণ
লুঠ হয়ে যেতে দেখে সাধারণ প্রতিক্রিয়ায় গর্জে উঠেছিলেনমাত্র। বাঙলার মানুষ সিপাহি স্বাধীণতা সংগ্রামের আগে পর্যন্ত বিশ্বকে বুঝিয়ে
দিয়েছিলেন, সে কলকাতার শহুরে ভাইবেরাদারদেরমত নতমস্তকে ইংরেজদের লুঠের আত্যাচারের
জঙ্গলের শাসন মেনে নেবেন না। যদিও এই
একবিংশ শতক পর্যন্ত বিশ্বের দরবারেই শুধু নয়, ভারত তথা বাঙলার পড়াশোনা জানা মহলের
স্থির ধারণা ছিল, পলাশির চক্রান্তের পর সিপাহি স্বাধীণতা সংগ্রামের আগে কয়েকটি
ছোটখাট স্বাধীণতা সংগ্রাম(ইংরেজ প্রসাদে ধণসম্পত্তি অর্জণ করা বাঙালি লেখকদের
ভাষায় ডাকাতি) বাদ দিলে, বাঙলার জনগণ নতমস্তকে ইংরেজদের শাসন মেনেনিতে বাধ্য
হয়েছিল। সমগ্র বাঙলা তথা শহুরে বুদ্ধিজীবি
বাঙালিরা ধারণা করেছিলেন ইংরেজরা এক বিশাল উন্নত সভ্যতার নানান গুণাগুণ ভারতে নিয়ে
এসেছে, সেই সভ্যতার গুণগানকরা আর সভ্যতার রেণুগুলি আহরণ করা সে সময়ের একমাত্র
কর্তব্য। বাঙলার স্বাধীণতা সংগ্রামীদের সমর্থন
করেও মার্ক্সবাদীদেরও ব্রিটিশ শাসনের প্রতি প্রায় একই দৃষ্টিভঙ্গী প্রকাশ পেয়েছে।
বিশ্বনাথ নিজের এবং বাঙলার সমাজের ইতিহাস অনুযায়ী, হাজার
হাজার বছরের নীতি মেনে প্রতিবাদী অথচ ক্ষমাঘন দৃষ্টিতে ইংরেজদের দেখেছে। সে যদি একটিবার দস্যু, লুঠেরা, খুনি, পরের ধনে পরের জ্ঞাণে নিজেরদের
ঘরবাড়ি, ধনসম্পত্তি আর শিক্ষা অর্জন করেও বড় গলায় বিশ্বকে সভ্যতা শেখানোর
স্পর্ধা রাখা ইংরেজ সভ্যতার চরিত্র জানত, তাহলে সে কিন্তু ফেডিকে সহজে ছেড়ে দিয়ে
নিজের সমাজের মানুষকে আরও একবার অত্যাচারীর চাবুকের তলায় ফেলার উদ্যোগ নিতনা। বলা দরকার হারাধণ দত্ত কিন্তু বলছেন ফেডিকে যখন বিশ্বনাথ ক্ষমা করে
দিচ্ছেন, তখন কিন্তু তাঁর সঙ্গীসাথীরা বিনীতভাবে তার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে
ফেড়ির মৃত্যুদন্ড চাইছেন। কেননা এদের মধ্যে
অধিকাংশই নীলকরদের অভূতপূর্ব অত্যাচারে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে বিশ্বনাথের দলে
ভিড়েছেন অত্যাচারীকে শাস্তিদেওয়ার উদ্দেশ্যে। সারা বাঙলা জুড়ে গ্রামীণেরা যে স্বাধীণতা সংগ্রামের আগুণ জ্বালিয়েছিলেন
তার অন্যতম অনুঘটক এদেরমত অত্যাচারের সামনে পড়া মানুষজনেরা। সঙ্গীদের কথা অমান্যকরে যে ত্রুটি সর্দার করেছিলেন তাকে সংশোধন করতে
বিশ্বনাথ সরাসরি ফেডিকে শাস্তি দেওয়ার সংকল্প করলেন।
নদিয়া গেজেটিয়ারের ১৬পাতায় ফেডির কুঠিতে ছাড়া পাওয়া
বিশ্বনাথের নতুন করে হামলার কথা বিশদে লেখা রয়েছে। বিশ্বনাথের দল ফেডির ওপর প্রতিশোধ মিতে
শেষ রাতে ৩টে থেকে ৪টের মধ্যে ফেড়ির বাড়ি আক্রমণ করে। ফেডি আর লেয়ার্ড বন্দুকের শব্দে জেগে উঠেদেখেন তাদের বাংলেয় ডাকাত পড়েছে। বাহিনীর বাধা সত্বেও ফেডিকে বেঁধেফেলে বিশ্বনাথের দলবল। লেয়ার্ড বল্লমের আঘাতে অচৈতন্য হয়ে পড়েন। ।।।রাতের শেষের দিকে ফেডির অস্ত্রাগার আর সাতশ টাকা লুঠ করে বিশ্বনাথের দল
ফেডিকে নিয়ে চলে যায়। এর কিছুদিন পর ইংরেজ সৈন্যের হাতে
বিশ্বনাথ ধরাপড়েন এবং তাঁকে ফাঁসিকাঠে ঝোলানো হয়।
একসময়ে ইংরেজদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরাসরি কলমধরা, পরে
ইংরেজদের চাকরহয়ে কুকি স্বাধীণতা সংগ্রামের খবরাখবর সেনাবাহিনীকে বিক্রি করে
রায়বাহাদুর দীনবন্ধু মিত্রের নীল দর্পণ আজও বাঙলা সাহিত্যে শুধু নয়, একদা বাঙলায়
ঔপনিবেশিক আন্দোলনের ইতিহাসের অংশ সে। এই নাটক আজও
শোষণ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে এক বড় ভূমিকা পালন করে, আগামীদিনে যে কোনও অত্যাচারের বিরুদ্ধে নীল দর্পণ একই
ভূমিকাই পালন করবে, এতই যুগোত্তীর্ণ সে নাটক। অনেকেই মন্তব্য করেছেন, এই নাটকটির ঝোঁক অনেকটা উচ্চবর্ণ আর জমিদারদের
প্রতি ইংরেজদের অত্যাচারএর বিরুদ্ধে সহানুভূতি প্রকাশর। সেটিও কিছুটা সমানভাবে সত্যিই কেননা ইংরেজ আমলে বহু জমিদারই অত্যাচারিত
হয়েছেন। আমরা রাণীভবানীর কথা জানি, কয়েকস্তবক
পরে আমরা কুষ্ঠিয়ার জোড়াগ্রামের জমিদার প্যারীসুন্দরীর নীল বিদ্রোহে অংশগ্রণের
ইতিহাস আলোচনা করব। এর আগে রাণী ভবানীর জমিদারি আলেচনা
করতে দেখেছি বহু মহিলা জমিদার ইংরেজদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে রাণীর আশ্রয়ে ছিলেন। জনগণের সঙ্গে প্রতিবাদী জমিদারদের কথা বাঙলা সাহিত্যে খুব বেশি উঠে আসেনি,
কিছুটা এনেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, আসারও কথা নয় কেননা তখন যাঁরা জমিদারি করছেন তাংদের
একাংশ ইংরেজদের প্রাসাদপুষ্ট শহুরে ধণাঢ্য ব্যক্তি, এঁদের জমিদারির সঙ্গে ইংরেজ
শাসনপূর্ব জমিদারদের মানসিকতার কোনও মিল
নেই। এঁদের অনেকেই ইংরেজদের সঙ্গে মিলে সোনার বাঙলা ছারখার
করার কাজ করেছেন অপূর্ব দক্ষতায়। মনেরাখতে হবে
রামমেহন অথবা দ্বারকানাথের কলোনাইজেশনের আন্দোলনের অথবা বিদেশী নীলচাষীদের বাঙলায়
চাষ করতে দেওয়ার আন্দোলনের বিরুদ্ধে বাঙলার জমিদারেরা প্রায় একাট্টা ছিলেন। এই জমিদারের ইংরেজদের অমানুষিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন অকুতোভয়ে। ইংরেজরা নিজেদের অমানুষিক অত্যাচারের কাহিনীকে আড়াল করতে এই অত্যাচারের
একটা বড় দায় জমিদারদের ওপর চাপিয়েছিল, যার একাংশ সত্য আরএক অংশের সত্যতা ঘোমটা
পরানো।
আমরা যেন না ভুলি, ইংরেজ শাসন-পূর্ব প্রথাগত জমিদারদের
অনেকটা অবদানে বাঙলার উন্নতি ঘটেছিল। ইংরেজ প্রণীত
নব্য জমিদারি প্রণয়ণের আগে এঁরাই বাঙলার স্থানীয় শাসনে ছিলেন। বাঙলার সনাতন সমাজ-বাঙলার সাধারণে অসাধারণ মানুষ যদি একটি বড় কৃতিত্ব
দাবি করেন, মুঘল রাজত্ব যদি বাঙলার নানান দিকের উন্নতির জন্য অনেকটা বেশিই প্রশংসার
যোগ্য হয়, তাহলে বাঙলার প্রথাগত জমিদারেরাতে একটুমাত্রায় হলেও সেই কৃতিত্বের ভাগ
দাবি করতে পারেনই। যে সব গবেষক ইংরেজ আমলের আগের বাঙলার
কথা লিখেছেন, তাঁরা সেযুগের সর্বশক্তিমান ব্রিটেনের জমিদারদের সঙ্গে বাঙলার সমাজের
সঙ্গে মিশে যাওয়া জমিদারদের তুলনা করছেন, অনেকটা ইংরেজ প্রচারিত ঔপনিবেশিকতার
সূত্র মান্য করে, আর বেশিটা মার্ক্সবাদীদের ভারতীয় অচল অনড় সামন্ততন্ত্রের তত্বের
দাবি বাঙলায় জোর করে প্রতিষ্ঠা করতে।
যে বীরত্বে নীল চাষীরা নীলকরদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, সেই পরিমান নীল
স্বাধীণতা সংগ্রামীরা প্রচার পাননি। একমাত্র
সিপাহি স্বাধীণতা সংগ্রাম ছাড়া অন্য
কোনও ইংরেজ বিরোধী স্বাধীণতা সংগ্রাম শহুরে মানুষের সেই ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে
পারেনি। নীলস্বাধীণতা সংগ্রামের সঙ্গে কৃষকরা জড়িত ছিলেন বলেই স্বাধীণতা সংগ্রামী নায়কদের কপালে জুটেছে শুধু উপেক্ষা। নীল চাষিদের মধ্যে কত মানুষ মারা গিয়েছিলেন, কত নারী তার স্বামীকে হারিয়েছিলেন, কত নারী ধর্ষিতা হয়েছিলেন, কত চাষী
উচ্ছেদ হয়ে তাদের গ্রাম থেকে পালিয়ে গিয়েছেন তার কোনও লেখা জোখা নেই, কোনও পূর্নাঙ্গ চিত্র নেই। অনেকেরই ধারণা ৫০-৬০
লক্ষ বাঙলার রায়ত
নীল বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন, যা কোন ভারতীয় আন্দোলনে দেখা যায় নি। এত স্বাধীণতা
সংগ্রামীর
সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলন এবং
ইংরেজদের নীলচাষ বন্ধ করতে বাধ্য করার মধ্যে জয় সূচিত হয়েছিল তার ফলশ্রুতি এদেশ থেকে ইংরেজদের চলে যাওয়ার সোপান তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেই স্বাধীণতা সংগ্রামের ১৫০ বছর পরেও সেভাবে এই আন্দেলনের
নানান দিক মুল্যায়ন
করা হল না। স্বাধীন
ভারতের সরকারও খুব বেশী
আগ্রহী
নয়। আগ্রহী নন ইতিহাস গবেষকরাও। নীলস্বাধীণতা সংগ্রামের পুর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা এবং বিদ্রোহে অংশ নেওয়া স্বাধীণতা সংগ্রামীদের যোগ্য সন্মান দেওয়ার জন্যে এগিয়ে আসতে হবে এই প্রজন্মের মানুষদেরই।
তবুও মনেরাখা দরকার, জমিদারদের থেকে বেশি সাধারণ মানুষই
এই সংগ্রামে অনেকবেশি অত্যাচারিত হয়ে অংশ নিয়েছেন, তাই অনেক সময়ে নাল দর্পণ
নাটকটিতে ব্রাহ্মণ আর জমিদার প্রীতির ঝোঁক বদলে গিয়ে সাধারণ মানুষের অত্যাচারের
কাহিনীই ফুটে উঠেছে পরতে পরতে। যার ফলে আজও
এই বিশ্বায়ণের প্রাক্কালে, এই নাটক ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। আরও একটি কথা, বাঙলা রায়বাহাদুর দীনবন্ধু মিত্রকে মনে রাখেনি শুধুই নয়, আজ
বাঙলায় সমীক্ষা করলে স্পষ্ট হয়ে যাবে কতজন সাহিত্যপ্রীত মানুষজন তাঁর এই
বিপ্লববিরোধী সত্ত্বা চেনেন জানেন। নীল দর্পণ আজও
বাঙলার সংগ্রামী গ্রমীণদের প্রিয় একটি নাট্যসাহিত্য। এই যুগেত্তীর্ণ নাটকটি বিষয়ে এতই আলোচনা হয়েছে তাই এই প্রবন্ধের মাধ্যমে
দীক্ষিত পাঠককে নতুন করে এটিকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া ধৃষ্টতামাত্র। অথচ ঠিক উল্টো দিকে মীর মোশারেফ হোসেনের নীল স্বাধীণতা সংগ্রামের
পটভূমিকায় লেখা 'উদাসীন পথিকের
মনের কথা'য় উঠে এসেছে এক প্রতিবাদী নারী জমিদারের জীবন কাহিনী। ই-পত্রিকা সমকালএ আবুল হাসান
চৌধুরী, মির মোশারফ হোসেনের 'উদাসীন পথিকের মনের কথা' বিষয়ে বিশদ একটি প্রবন্ধ নিখেছেন,
যার ঠিকানা, www।samakal।com।bd/details।php?
মশারফের জন্ম নদীয়া জেলার নীলকবলিত এ অঞ্চলেই। তাই নীলচাষ, নীলকর, নীল স্বাধীণতা
সংগ্রাম ও তার পরিণাম এসব কিছুই ছিল তার অভিজ্ঞতার অন্তর্গত। খুব কাছ থেকে
দেখেছেন তার পিতার ঘনিষ্ঠ বন্ধু নীলকর টিআই কেনিকে। আর স্থানীয় নীল
স্বাধীণতা সংগ্রামের সংগঠক ও নেতা সা গোলাম ছিলেন ঘনিষ্ঠ জ্ঞাতি, অবশ্য সহায়-সম্পত্তি নিয়ে বিবাদের কারণে তার
সঙ্গে আদৌ সদ্ভাব ছিল না মির পরিবারের। একদিকে নীলকর
সাহেব পিতার বন্ধু, অপরদিকে নীল স্বাধীণতা সংগ্রামের নেতা পারিবারিক
শত্রু
এসব কারণে নীলকর ও নীল স্বাধীণতা সংগ্রাম সম্পর্কে মির-মানসে এক ধরনের
দ্বিধার ভাব দেখা দেয়। কেনি মোশাররফকে বিলেতে পাঠিয়ে লেখাপড়ার প্রস্তাব
দিয়েছিলেন, কিন্তু স্নেহান্ধ
মাতামহীর আপত্তিতে তা নাকচ হয়ে যায়।
এসব কারণে নীলকরের প্রতি তার কিছুটা যে অনুরাগ না জন্মেছিল
তা নয়। পাশাপাশি আবার নির্যাতিত
নীলচাষিও তার সহানভূতি লাভে বঞ্চিত হয়নি। এই দোলাচল
মনোভাব নিয়েই মোশাররফ 'উদাসীন
পথিকের মনের কথা'য় (১৮৯০) কুষ্টিয়া অঞ্চলের
নীলচাষ ও নীল স্বাধীণতা সংগ্রামের কাহিনী বিবৃত করেছেন। 'আমার
জীবনী' (১৯০৮-১০)-তেও
প্রসঙ্গত নীলকরের কথা এসেছে। মোশাররফ
সম্পাদিত 'হিতকরী' (১৮৯০) পত্রিকাতেও এ বিষয়ের কিছু খবর পাওয়া যায়। নীল
সংক্রান্ত ঘটনা তার শ্রুতি ও স্মৃতিতে উজ্জ্বল ছিল। মোশাররফের
নীল স্বাধীণতা সংগ্রামের একটি প্রামাণ্য ইতিহাস রচনার ইচ্ছা
থাকলেও বয়সের কারণে তার পক্ষে সেই কাজে হাত দেওয়া সম্ভব হয়নি। তাই
তিনি তার অনুজপ্রতিম সাহিত্য-সতীর্থ
জলধর সেনকে বলেছিলেন : "তোমাকে
নীলস্বাধীণতা সংগ্রাম সম্বন্ধে অনেক 'নোট' দিয়া
যাইব, তুমি
একখানি ইতিহাস লিখিও" (জলধর সেন : 'কাঙাল
হরিনাথ', প্রথম
খণ্ড , কলকাতা, ১৩২০; পৃ। ৩৯)। কিন্তু
জলধরের আলস্যে সে আর হয়ে ওঠেনি।
No comments:
Post a Comment