ময়মনসিংহ পরগণার কৃষক স্বাধীণতা সংগ্রাম
সন্ন্যাসী স্বাধীণতা সংগ্রাম দমনের সুবিধার জন্য ব্রিটিশ সরকার ময়মনসিংহ
জেলা তৈরি করেও স্বাধীণতা সংগ্রামের আঁচ বিন্দুমাত্র কমেনি। ১৭৮৭তে বাঙলার উপকূল এলাকাজুড়ে প্রবল জলোচ্ছাস, সুনামির আবির্ভাব হয়,
জমিদারেরা সরকারের কাছে খাজনা মকুবের আবেদন করলেও সরকার এই আবদনে কর্ণপাত করেন নি। সর্বস্বান্ত কৃষককে সবকিছু বিক্রয় করে খাজনা মেটাতে হয়।
সুনামির পর অভূতপূর্ব মন্বন্তর দেখা দিল। ছআনামনের চাল আড়াইটাকায় বিক্রি হওয়া শুরু হল। ময়মনসিংহের ইতিহাসে কেদারনাথ মজুমদার লিখছেন, সেকালে একটাকা থেকে
চারিটাকায় একএকজন মানুষ বিক্রয় হইত। এইসময় (জেলা
ম্যাজিস্ট্রেট)রটন সাহেব বোর্ডে লিখিয়া অনেক দরিদ্র তালুকদার ও জমিদারকে রক্ষা
করিয়াছিলেন। কিন্তু রায়তদের রক্ষাকরার কেউ ছিল না। বহু অত্যাচারে ময়মনসিংহ আর জাফরসাহি পরগণার ৮০৪৯জন মাতব্বর আর ১০০৫জন
প্রজা পালিয়ে যায়। এছাড়াও আটিয়া পরগণায় জমিদারির
নাবালক উত্তরাধিকারীকে সামনে রেখে গোবিন্দ চাকী, পাঁচু বসু আর রামচন্দ্র মুখার্জী
অপরিসীম অত্যাচার আরম্ভ করে। মহলের ১৪০০
মৌজার মধ্যো মাত্র ৫০০ মৌজায় প্রজা রয়েছে।
এইসময়েও খাজনা উদ্ধারো জমিদার যগলকিশোর রায়চৌধুরী সিংধা
পরগণায় বহুগ্রাম পুড়িয়ে ধংস করে ফেলেন। মামলা হলে,
ইংরেজদের প্রসদধন্য জমিদার শুধুই জামিনে মুক্তি লাভ করেন। ১৭৯০তে কর্নওয়ালিসের দশসালা পরিকল্পনায় যুগলকিশোরের সঙ্গে দশসালা
পরিকল্পনার চুক্তিহয়।
প্রচন্ড উত্পীড়নে ১৮১২তে ময়মনসিংহের কাপাকি থেকে প্রজা
স্বাধীণতা সংগ্রাম আরম্ভ হয়। এই স্বাধীণতা
সংগ্রাম সমগ্র পরগণা ছড়িয়ে পড়ে।
গারো পাগলপন্থী স্বাধীণতা
সংগ্রাম
১৮২৭এ টিপু গারোর প্রথম পাগলপন্থী স্বাধীণতা সংগ্রাম ব্যর্থ হওয়ার পর টিপুর
সহকর্মী গুমানু সরকার নতুন করে ১৮৩২সালে নীরবে স্বাধীণতা সংগ্রামের আগুণ ছড়িয়ে
দিতে থাকেন। তাঁর সঙ্গে উজির সরকারনামে জনৈক
সরদার সহকর্মীর কাজ করতে থাকেন। সেরপুরের
জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট গুমানুকে গ্রফতার করেও গারো স্বাধীণতা সংগ্রাম জ্বলেউঠতে পারে
চিন্তাকরে তাঁকে ছেড়েদিতে বাধ্যহন। ১৮৩২সালের
শেষেরদিকে স্বাধীণতা সংগ্রামী গারোরা ক্রমশঃ জমিদারির কাছারি আক্রমণ করতে শুরু
করেন, জমিদারের পক্ষের গারোদেরও বাড়ি লুঠ হয়। ১৮৩৩এর প্রথমদিকে জানকু আর দেবরাজ পাথর নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন। জানকু সেরপুরের পশ্চিমদিকের কড়ৈবাড়ি আরল দেবরাজ নলিতাবাড়ি্ দখলকরেন। কেদারনাথ মজুমদার বলছেন, এপ্রিলে দুজনই সেরপুরের জমিদারির কাছারি লুঠ করে,
পুলিশ থানা জ্বালিয়ে দেয়। জমিদার পালিয়ে যান। ডেপুটি ম্যাজিস্টেট গেরেট স্বাধীণতা সংগ্রাম দমন করতে এলে তার বাংলো
পুড়িয়ে দেয়। গেরেট-জমিদার বাহিনী এবার যৌথভাবে
দেবাজ পাথারের নলিতাবাড়ির দিকে এগোলে দেবরাজ সামনাসামনি যুদ্ধ না করে পাহাড়ের
গুহায় লুকিয়ে থাকেন। অবাধে নলিতাবাড়ি দখল করে কাছারি
সঅতাপিত হল। সেই রাতেই সরকারি বিজয়উত্সবের ওপর
দেবরাজ চকিতে আক্রমণ করে সব ছারখার করেদেন। সেরপুর জুড়িয়া এক ঘোর আতঙ্কের ছায়া পতিত হইল(ময়মনসিংহের
ইতিহাস, কেদারনাথ মজুমদার)।
জামাপুর থেকে দেড়শ সৈন্যের একটি দল ক্যাপ্টেন সিলএর
নেতৃত্ব সেরপুরে উপস্থিত হয়ে এক দল নিজের ও অন্যদল ইয়ংহাজব্যান্ডের নেতৃত্বে
স্থাপন করে মধুপুরে লড়াইএর ময়দানে উপস্থিত হন। জানকুও তীরধনুক নিয়ে চারহাজার গারো স্বাধীণতা সংগ্রামী লড়াইএর জন্য তৈরি
হল। ৩মে ভোরে জলঙ্গী গ্রামে জানকুর দলের ওপর হঠাত আক্রমণ
করে ছারখার করে দেয়। জানকু জঙ্গলে আত্মগোপণ করেন এবং ৮
তারিখ থেকে সিলের দলের ওপর চোরাগেপ্তা আক্রমণ চালাতে থাকেন। বহু সৈন্য হতাহত হয়। ইয়ংহাজব্যান্ড
নলিতাবাড়ি্ আক্রমণ করলে দেবরাজ হঠাতই তাদের ওপর আক্রমণ চালান। দুদলের প্রচুর হতাহত হয়, দেরাজেরা পাহাড়ে আশ্রয় নিলে ইংরেজ বাহিনী তাদের
অনেক চেষ্টা করেও খুঁজে পায় না। এই
খোঁজাখুঁজির সময় আবার দেবরাজ ইংরেজ বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুর সৈন্য ধংস করে।
১০মে জানকু আর দেবরাজের জনের পাঁচজন সর্দারদের বাড়ি
জ্বালিয়ে সর্দারদের আত্মসমর্পণে বাধ্যকরল। দুই নেতাকে
ধরিয়েদেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হল। ১৩মে কালভদ্র আর পন্ডিত সর্দার ধরা পড়ল। ক্রমশঃ সরাদাররা আত্মসমর্পণ করলে পাগলপন্থী স্বাধীণতা সংগ্রাম চালানো
অসম্ভব হয়ে পড়ে। কিন্তু জানকু আর দেবরাজের কোনও সন্ধান পাওয়া গেল না।
১৮৩৭ সালে সর্দারদের আত্মসমর্পণে পাগলপন্থী স্বাধীণতা
সংগ্রাম প্রকাশ্যে শান্ত হয়ে গেলেও গারোদেরমধ্যে ইংরেজবিরোধিতারআগুণ কিন্তু
ধিকিধিকি করে জ্বলছিল। গারোরা সরকারকে ঠিকমত কর দিচ্ছিলনা। ১৮৪৩এ এক দলছুট আত্মসম্মানহীন সর্দার সরকারের পক্ষে খাজনা সংগ্রহের প্রচার
চালাতে থাকে। গারোরা এই সর্দারকে সপরিবারে
হত্যাকরে। ঠিক আবার এগারো বছর পর ১৮৪৮এ নতুন
করে গারো আন্দোলন দমন করতে সরকারি বাহিনী গারো অঞ্চলে প্রবেশ করলে স্বাধীণতা
সংগ্রামীরা জঙ্গলে আত্মগোপন করলেও জমিদারি অথবা কাছারির ওপর চোরাগোপ্তা আক্রমণ
বন্ধ হয় নি। এই বাজারে প্রচুর পরিমান নুন কিনত
গারোরা। বাজার বন্ধ করে দিলে স্বাধীণতা
সংগ্রামী গারোরা আত্মসমর্পণ করবে ভেবে জমিদারদের দালালেরা বাজারগুলো বন্ধ করে দেয়। আক্রমণতো বব্ধহয়ই না বরং বৃদ্ধিপেতে থাকে।
খাজনা প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিতবিরক্ত গণতান্ত্রিক
ইংরেজ ১৮৬১তে গারো পাহাড়ে সেনা পাঠায়। স্বাধীণতা
সংগ্রামীদের না পেয়ে গারো গ্রামগুলো পুড়িয়ে দিয়ে একটি ছোট বাহিনী রেখে সেনা ফিরে
আসে। ১৮৬৬তে সুসঙ্গের জমিদার নতুন করে গারো পাহাড়ে নতুন করে
খাজনা ধার্য করলে আবার স্বাধীণতা সংগ্রামের আগুল লকলকিয়ে ওঠে। হঠাত হঠাত গারো আক্রমণে বহু পাইকবরকন্দাজ নিহত হয়। শেষপর্যন্ত এক ইংরেজের নেতৃত্ব একদল সেনা গারো পাহাড়ে স্থায়ীভাবে
স্বাধীণতা সংগ্রামদমনে রাখাহয়। আবার গারোসমাজ
কিছু দিনের জন্য শান্তবাব ধারণ করে। ১৮৭০এ ইংরেজরা
পাহাড় জমিপের কাজে কর্মচারীদের ওপর আক্রমণ করেন। পুলিশ গারো গ্রমে ঢুকে অত্যাচার চালালে গারোদের সঙ্গে পুলিশের লড়াই বাধে। ইতোমধ্যে একটি গারো গ্রামজ্বালিয়ে স্বাধীণ গারো অঞ্চলের অস্তিত্ব লোপ
করারও সিদ্ধান্ত হল। পাঁচশ পুলিশ তিনশ সেনা নিয়ে
গারোঅঞ্চল অভিযান করে সরকার। অনেক
সফলতা-বিফলতারপর গারোরা আত্মসমর্পণ করেন। ১৮৭০-৭০এ
অগম্য গারো পাহাড়ে রাস্তাঘাট তৈরি করা শুরু হয়। ইংরেজরা প্রায় বিনা পারিশ্রমিকে সকল শ্রমিককে কাজ করাতে অভ্যস্ত হয়ে
গিয়েছিলেন। গারোশ্রমিকদের ওপর অত্যাচারে
১৮৮২সালে, ১৮টি গ্রামের গারো শ্রমিক কাজ বন্ধ করেদেয়। শেষপর্ষন্ত ১৮টি গ্রাম ভষ্মীভূত করে শেষ গারো স্বাধীণতা সংগ্রাম দমন করতে
পারল ইংরেজ সরকার।
ফরাজি স্বাধীণতা সংগ্রাম
১৮৩৩এর তিতুমীরের ওয়াহবি আন্দোলনের সঙ্গে ১৮৩৮এ শুরু হওয়া ফরাজি আন্দোলনের
বাহ্যত গভীর মিল থাকলেও মূলগত অমিলছিল যথেষ্টই। ফরাজি আর ওয়াহবি ধর্মসংস্কারের মধ্যে গভীর পার্থক্যছিল, সেই আলোচনা এই
পুস্তকের বিষয় নয়। ঢাকা-ফরিদপুর অঞ্চলে হাজি শরিয়তুল্লা
এই ধর্মান্দোলনে অগ্রসর হন ১৮২০তে মক্কাথেকে ফিরে আসার পর। তিনি একজন ডাকাতকে তাঁর ধর্মমতের শিক্ষাদেন এবং ঢাকার নয়াবাড়ি অঞ্চলে
এঁরা ঘুরে ঘুরে ধর্মমত প্রচার করতে থাকে। নানান
বাধাবিপত্তি অগ্রাহ্যকরে তিনি তাঁর ধর্মমত প্রচারে নিয়োজিত থাকলে প্রচুর সাধারণ
মুলমান চাষী তাঁর ধর্মমতে আকৃষ্ট হন এবং গোঁড়া ধনী মুসলমান জমিদারেরা শরিয়তুল্লার
ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে ঢাকা থেকে বহিস্কার করেন। এরপর ফরিদপুরে তিনি নিজের জন্মস্থানে ধর্ম প্রচারে ব্রতী হন। ধর্মমতের সরল সাধারণতম মূল কথা অত্যাচারের বিনাশ।
শরিয়াতুল্লারপর তাঁর পুত্র সাধারণের ভাষায় দুদুমিঞা
পিতার অসমাপ্ত কাজ নিজের কাঁধে তুলে নেন। ১৮১৯এ
দুদুমিঞার জন্ম। পিতার ধর্মসংস্কারের থেতে একপা এগিয়ে
তিনি ইংরেজ শাসন উচ্ছেদকরে স্বাধীণ রাজ্য স্থাপনের উদ্যোগ নেন। ফরিদপুরের ঘরেঘরে ঘুরে প্রচার করতে থাকেন আর নিজের প্রশাসনিক ব্যবস্থা
তৈরি করতে উদ্যোগী হন। গ্রামে গ্রামে বিচারালয় স্থাপন করে
গ্রামেই বিচার করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রয়োজনে
অত্যাচরিত শিষ্যদের রক্ষাকরতে লাঠিয়াল পর্যন্ত পাঠাতেন। ক্রমশঃ জমিদার আর বিদেশি নীলকরদের প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত
করতে থাকেন তিনি। শশীভূষণ চৌধুরী সিভিলডিসওবিডিয়েন্স
ইন ইন্ডিয়া, ১৭৬৫-১৮৫৭তে বলছেন, শুধু মুসনমানই নন, অন্য ধর্মের চাষীরাও এই
আন্দোলনে সামিল হতে থাকেন। ফরিদপুর,
বিক্রমপুর, খুলনা এমনকী ২৪ পরগণায়ও প্রভাব বিস্তার করতে থাকে এই জমিদার আর
অত্যাচার বিরোধী আন্দোলন। প্রত্যেক অঞ্চলে তনি একজম খলিফা
নিযুক্ত করেন। এই খলিখারাই ছিল সেই অঞ্চলের
ফরাজিদের প্রধান, তাদের হতেই ছিল প্রজাদের সুখদুঃখ দেখার অধিকার। খলিখারা জমিদারদের সম্পত্তিও ধংস করত। ক্রমশঃ নীলকর আর জমিদারেরা দুদুমিঞার বিরুদ্ধে জোট তৈরি করলেন। ফরাজি রায়তদের ওপর নীলকর আর জমিদাদের প্রবল অত্যাচার নেমে এল। তিনি জমিদারদের কর নেওয়া বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলেন। শিষ্যদের সরকারি খাস জমিতে বসবাসের নির্দেশ দেন। কৃষক-জমিদারদের সংঘর্ষ শুরু হল। ক্রমশঃ
জমিদার-ইংরেজদের বহু লাঠিয়াল আহত-নিহত হওয়ায় ইংরেজ সরকার আর চুপচাপ বসে থাকতে পারল
না। পুলিশ-জমিদারবাহিনীর সঙ্গে কৃষকদের নতুন করে সংঘর্য
বাধে। ১৮৩৮এ এই সংঘর্ষ চরমরূপ ধারণ করায় ঢাকা থেকে সেনা
বাহিনী তলব করতে হয়। বছরটির শেষদিকে বহুগ্রাম জ্বালিয়ে
দুদুমিঞাকে গ্রেফতার করে জেলে পোরা হল। শেষে তিনি
মুক্তিলাভ করলেন। ১৮৪৪এ আবার তাঁকে গ্রেফতার করা হল। আবারও তিনি ছাড়া পেলেন। দুদুমিঞার
গুপ্তচর সারাএলাকা ঘুরে সংবাদ সংগ্রহ করে আনত এবং সেই সংবাদ ভিত্তি করে তিনি
শিষ্যদের নানান সাহায়তা দান করতেন।
১৮৪৬এ ৫ ডিসেম্বর পাঁচশ কৃষক পাঁচচরের অত্যাচারী ডানলপের
নীলকুঠি আক্রমণ করে ধংসকরে দেয়। পাশের গ্রামের
ডানলপের বন্ধু জমিদারের কাছারি আক্রমণ করে সম্পত্তি ধংস করেন স্বাধীণতা সংগ্রামীরা। এরপর যথেচ্ছ সামরিক আক্রমণ নেমে আসে। দুদুমিঞাকে কারাগারেও পোরা হয়।
আক্রমণ-প্রতিআক্রমণের সঙ্গেই ১৮৪৭ থেকে ফরিদপুরের আদালতে দুদুমিঞার বিচার চলতে
থাকে। নানান উত্পীড়নের মধ্যে ১৮৬০এর ২৪ ডিসেম্বর
ভগ্নস্বাস্থ্য দুদুমিঞার জীবনাবসান হয়। এরপর
ছোটখাটভাবে সংঘর্য চললেও ক্রমশঃ ফরাজি আন্দোলন স্তমিত হতে থাকে।
ত্রিপুরার কৃষক স্বাধীণতা সংগ্রাম
তিপ্রা স্বাধীণতা সংগ্রাম
১৮৫০এ ত্রিপুরায় চন্দ্রমাণিক্য ত্রিপুরার সিংহাসনে আসীন হলে প্রিয় বলরাম
হাজরিকাকে দেওয়ান পদে দায়িত্ব অর্পণ করলে তার প্রধাণ সহকারীহন শ্রীদাম হাজরিকা। এই দুই ভাইএর অত্যাচারে ত্রিপুরাবাসী অতিষ্ঠহয়ে উঠলে রাজারসামনে প্রতিবাদ
জানায়। এই প্রতিবাদে ফল না হলে নিজেরাই
নিবারণের পথ করে নিতে শুরু করে। নেতৃত্বপদে
আবির্ভূতহন পরীক্ষিত আর কীর্তি, দুই ত্রিপুরী সর্দার। কীর্তি আর পরীক্ষিত এক বাহিনী তৈরির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ত্রিপুরা রাজমালা অনুসারে, একগভীর রাতে দুই ভাই বাহিনী নিয়ে বলরাম আর
শ্রীদামএর সুরক্ষিত প্রাসাদ আক্রমণ করলে বলরাম পালিয়ে যেতে সক্ষম হন আর শ্রীদাম
নিহত হয়। এরপরে অত্যাচার স্তিমিত হয়। বলরাম রাজপরিবারে চক্রান্ত করতেগিয়ে রাজ্যথেকে নির্বাসিত হয়।
জামাতিয়া স্বাধীণতা সংগ্রাম
ত্রিপুরা রাজ্যের জামাতিয়ারাও রাজকর্মচারীদের অত্যাচারের মুখোমুখি হতেন। রাজদরবারে আবেদন নিবেদন বিফল হওয়াতে প্রথমে ত্রিপুরা রাজের খাজনা বন্ধ
করল, তারপর নিজেরা তিপ্রাদেরমতই স্বাধীণতা সংগ্রামের সিদ্ধান্ত নেয়। নেতা জামাতিয়া নেতা পরীক্ষিত জামাতিয়া। ১৮৬৩তে রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য উদয়পুরে এলে জামাতিয়ারা তাঁকে আক্রমণ করেন,
রাজা কোনও রকমে প্রাণ হাতে করে পালাতে সমর্থ হন। আগরতলার পৌঁছেই রাজ বাহিনীকে জামাতিয়াদের ওপর আক্রমণের নির্দেশ দিলে
জামাতিয়াদের সঙ্গে রাজবাহিনীর যুদ্ধে, রাজবাহিনী চরমভাবে পর্যুদস্ত হয়। পরাজিত রাজা কুকিদের সাহায্যে জামাতিয়াদের স্বাধীণতা সংগ্রাম দমন করেন। কুকিরা জামাতিয়া গ্রামগুলি আক্রমণ করলে প্রচন্ড যুদ্ধ হয়, কুকিরা প্রায়
দুশ জামাতিয়ার মুন্ডু কেটে নেন, পরীক্ষিতকে গ্রেপ্তার করে আর বালিকাদের ধরে আনে
আগরতলায়।
কুকি স্বাধীনতা সংগ্রাম
পাহাড়িয়াদের মধ্যে কুকি সমাজ চিরকালই রাজকর্মচারীদের অত্যাচারেরমুখে
পড়েছে। কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ
প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৮৬০এ
ছাগলাইনা থানার মুনসিরখিল গ্রামে রাজ কর্মচারীদের চারপাঁচশ সশস্ত্র কুকি আর রিয়াং
আক্রমণ করেন। কুকিরা গ্রামের ধনীদের পরিবার লুঠ
করে গ্রামে পালিয়ে যায়। ১৭৬১তে ত্রিপুরা রাজধানী উদয়পুর
আক্রমণ করে কুকি আর রিয়াংরা। পাঁচশ সেনা
কুকি আক্রমণের সংবাদ পেয়ে সেনাছাউনির অস্ত্রশস্ত্রছেড়ে পালিয়ে যায়। কুকিরা সেই সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র দখল করে, রাজ্য লুঠ করে, ফেরার সময় চাকমা
রানী কালিন্দীর গ্রাম অগ্নিদগ্ধ করে সরকারি সেনার সঙ্গে লড়াই করতে করতে জঙ্গলে
পালিয়ে যায়। এই লড়াই ঘোরতর আকার ধারণ করে। কুকিরা কযেকটি গ্রাম পুড়িয়ে দিয়ে জঙ্গলে পালিয়ে যায়, ইংরেজরা কুকিদের
পনেরশমন ধান পুড়িয়ে দিয়ে প্রতিশেধ নেয়। কুকিরা
বরাবরেরমত গুপ্ত আক্রমনে যথেষ্ট পারদর্শিতা দেখিয়ে ছিল। সরকারি সেনা কখোনো তাদের সম্মুখ সমরে পায়নি। যুদ্ধে পারদর্শী কুকিদের দমনের ইচ্ছে ত্যাগ করে সরকার সন্ধিস্থাপন করে
সর্দার রতন পুঁইয়ার সঙ্গে। ঠিক হল এই
সীমান্ত প্রদেশে শান্তিরক্ষার জন্য সরকার পুঁইয়াদের ৪০০টাকা, হাউলংদের ৮০০ টাকা আর
সাইলোদের ৮০০টাকা নজরানা দেবে।
এই শান্তিচুক্তি পাঁচবছরমাত্র টিঁকেছিল। ১৮৬৭তে আবার নতুন করে অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে কুকি স্বাধীণতা সংগ্রাম শুরু
হয়। ছোটলাট গ্রে আবার সৈন্য পাঠানোর প্রস্তাব দিলে তা খারিজ
হয়ে যায় বড়লাট মে-র প্রতিবাদে। ইংরেজরা নানান
কৌশলে কুকি সর্দার রতন পুঁইয়াকে বশ করার চেষ্টা করলেও কাছাড়, শ্রীহট্ট আর
ত্রিপুরার নানান এলাকায় আক্রমণ করতে থাকে। রাজমালা
অনুসারো অতি অল্প সময়ে এত বেশী আক্রমণ আর
কখনও হয় নাই। ১৮৭১এ কুকিদের দমন করতে ভারি অস্ত্রশস্ত্রসহ আক্রমণ করা হয়, সেনাদের
নির্দেশ দেওয়া ছিল আত্মসমর্পণ না করলে গ্রাম, শষ্যাগার, শস্যক্ষেত্র পুড়িয়ে দিতে
হবে। এবার রতন পুঁইয়া ইংরেজদের সহায়তা করতে সম্মতহয়। ইংরেজ সৈন্য বিস্তীর্ণ শষ্যক্ষেত্র, গ্রামে আগুনলাগিয়ে কুকিদের বশ্যতা
স্বীকারে বাধ্য করে। এরপর কুকি রাজ্যকে বাঙলা প্রদেশ থেকে
বার করে লুসাই অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত করেন। এরপর ত্রিপুরা
আর লুসাই পাহাড়ে নজর রাখার জন্য আগরতলায় একজন রাজনৈতিক দালাল(পলিটিক্যাল এজেন্ট)
নিযুক্ত করে। এর হাতেই কুকি অঞ্চলের শাসনভার
অর্পিত হয়। এরপর কুকি রাজ্য ভেঙে উত্তর লুসাই আর
দক্ষিণ লুসাই দুটে জেলা তৈরি হয়। আবার ১৮৭৫
অনীবৃষ্টির জন্য মন্বন্তরের পর মহাজন, ইংরেজরা প্রবেশ করে আবার নতুন করে শেষণের
রাজত্ব শুরু হয়। ১৮৭৯ থেকে নতুন করে কুকিদের
এলাকাগুলোতে অসন্তোষ ঘনিয়ে ওঠে। নিয়মিত আক্রমণ
শুরু হয়।
No comments:
Post a Comment