মেয়েটির নাম দিল্লি সরকার।
সবার প্রার্থনা কীভাবে
এবারটি কাজে লেগে গিয়েছিল(আদতে ততদিনে ভারত সরকারের মদতে আর স্পন্সরশিপে দেশিয়
চিকিৎসাবিদ্যার গঙ্গা প্রাপ্তি ঘটেছে। আরও অনেক বিদেশি ধারকরা ভাবনার মত বড় পুঁজির
অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা একমাত্র চিকিৎসাব্যবস্থার মর্যাদা পেয়েছে। আর সকলে গ্রাম্ভারি
নামে দুয়ো রানিমাত্র। কিন্তু দেশিয় চিকিৎসাবিদ্যা অর্থে আজকের দিনে সরকারি ভাষায়
মান্যতাপ্রাপ্ত শুধুই আয়ুষের কথা বলছিনা, দেশিয় গ্রামীণ লৌকিক চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা বলছি।
পরে পড়ে দেখেছি, আয়ুর্বেদও ক্ষমতার বাইরে থাকা দেশিয় গ্রামীণ চিকিৎসাবিদ্যাকে
দুচ্ছাই করে আজও। আয়ুর্বেদ তখন অ্যালোপ্যাথির আক্রমণে নাভিশ্বাস(অগ্নিশ্বর সিনেমাটি মনে করুন, অ্যালোপ্যাথি মানেই বিজ্ঞান আর সব ঝাড়ফুঁক, তন্ত্রমন্ত্র, জলপড়া।)। আয়ুর্বেদ ডাক্তারেরা আজও অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা করেন। আয়ুর্বেদের যখন নাভিস্বাস তখন তার পাশে দাঁড়াবার জন্য কেউ নেই, কেননা তত দিনে অ্যালোপ্যাথি আর আয়ুর্বেদের যৌথ-আক্রমণে লৌকিক চিকিৎসা মুখ লুকিয়েছে।)। সমবেত প্রার্থনায় দিল্লি শুধু বাঁচল না, ক্রমশঃ বড়ও হয়ে উঠল।
সবার মুখে ছাই দিয়ে তার বিয়ে হল, সন্তানও প্রসব করল। দিল্লির তখন ভরা সংসার।
অন্যান্য রাজবংশী মেয়েদের মত সেও বুনতে ওস্তাদ হয়ে উঠল। অঞ্চলের একদা ডাকসাইটে
কাঠের মুখা শিল্পী প্রয়াত আজিত সারকারের হাত ধরে অন্যান্য ঢোকড়া (ঢোকড়া সংস্কৃতি
সম্বন্ধে বিশদে জানতে http://lokfolk.blogspot.in/2012/08/blog-post_14.html) শিল্পীদের সঙ্গে (ঢোকড়া তাঁতের
চেহারা দেখার জন্য এই লিঙ্কটা
http://lokfolk.blogspot.in/2012/04/dokra-weavers-at-work.html দেখুন। কলকাতায় শিক্ষিতরা এই তাঁতকে মণিপুরী তাঁত বলেন।
কেন? তারাই জানেন) কলকাতায়
মেলায়ও এসেছে(২০০৯এ কলকাতা মেলায় দিল্লির ছবি। সেখানেই
তার সঙ্গে আলাপ। পরে দেখেছি দিল্লি সেই আলাপ ভুলে গিয়েছে। কিন্তু তার নামের জন্যই
হোক বা তার অত্যন্ত আদুরে ভাবে তার কাজ দেখানোর জন্যই হোক, বা কাজের গুনমানেই হোক, দিল্লিকে আমার মনে থেকে
গিয়েছে।
ছোটবেলায় তিন সন্তানের
মৃত্যুর পর পিসি নতুন মেয়েটির নাম রাখলেন দিল্লি। তত্ব হল দিল্লি বহু দূর।
সন্তানের এই নামটি রাখলে যদি সন্তানটি বাঁচে(তখন ভারত সরকার অথবা দেশি, বিদেশি দাতা সংস্থার দেওয়া
অর্থে তখন স্বেচ্ছাসেবীরা
কন্যা ভ্রূণ হত্যা বিরোধী প্রকল্প রচনা করেছিলেন কিনা সে তথ্য লোকফোকের কাছে
নেই, কিন্তু দিনাজপুরের{তখন রাজনৈতিকভাবে পশ্চিম উপসর্গযুক্ত জেলা} এক অজ পাড়াগাঁয়ে, আজকের মানুষ আর জনগণের
ভালকরা রাজনীতির ভাষায়, প্রায়
সহায়-সম্বলহীন এক আদিবাসী, রাজবংশী
পরিবারের মাথারা কন্যা শিশুকে মুখে নুন দিয়ে মেরে ফেলতে চাননি। প্রাণপণে চেষ্টা করে গেছেন কীভাবে মেয়েদের বাঁচিয়ে রাখাযায়। কে জানে শহরের
মানুষেরা কাদের কথা বলেন, কাদের কথা ভেবে প্রকল্প রচনা করেন!)।
চান্দোল মেলা আয়োজন করছিল
সঙ্ঘের দিনাজপুর জেলা কমিটি। তাদের যোগাযোগেই দিল্লি চান্দোল মেলায় এসেছেন অংশ
নিতে। সঙ্গে আরও কয়েকজন শিল্পী। দিল্লিকে মেলার শেষেরদিকে পুরনো ঘটনাটা বলেছিলাম।
গ্রামের কর্মঠ মহিলাদের মত সে চোখেমুখে বিস্ময় ফুটিয়ে শুধুই হেসেছিল। অন্যদের মত, প্রথমে সে মেলা দেখে হতাশ হয়েছিল। যদিও শহুরে
বা স্থানীয় রাজনীতি করা কারু শিল্পীদের মত উচ্চৈঃস্বরে বলেনি, কিন্তু তার মনে,
হাটে তার মাল বিক্রি নিয়ে বেশ দ্বিধায় ছিল। পাড়াগাঁয়ের অনপনীয় ভদ্রতায় সে মুখবুজে
সব মেনে নিয়েছে। কিন্তু সে শুধু নয়, তার পরিবারও যে তাঁকে মেলায় আসতে বারন করেছিল,
তার প্রমান পেলাম শেষের আগের দিনের রাতের মিটিঙে।
মেলা উদ্বোধন করলেন স্থানীয় বিধায়ক অমল আচার্য মহাশয়। ছিলেন স্বপন
সারকার এবং আশিম ঘোষ। উদ্বোধনের বিশদ বিবরণ কয়েক মাস আগের পোস্টে পাওয়া যাবে। আজ
আর সেই গালগল্পে যাচ্ছি না। যাই হোক, প্রথম দিনই প্রায় সকলের বউনি হল, দু একজনের
বাদে। আরও অনেকের সঙ্গে, দিল্লির বিক্রি হল প্রায় পাঁচ হাজার টাকার। ব্যাপারটা খুব
একটা ছোট করে আমরা দেখলাম না। আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে সবাইকে জিজ্ঞেস করে রোজের
বিক্রির হিসেব রাখতাম। ব্যাপারটা খুব কম দাঁড়াল না। প্রথম দিনেই আমরা বেশ
উত্তেজিত। একে অজ পাড়াগাঁয়ে মেলা। তারপরে প্রচার নেই। বাংলাদেশের দুই শিল্পী এসেই চলে গেছেন। তাঁরা বললেন আমাদের এত দামী কাপড় এখানে বিক্রি হবে না(বলা
ভাল মেলার যায়গা দেখে পালিয়ে গিয়েছে। কলকাতার, নিদেন পক্ষে জেলা সদর ছাড়া, সরকারি-বেসরকারি প্রচারে এটি যেন আজ প্রমাণিত, গ্রামে শিল্প দ্রব্যের বাজার নেই, কারোর শিল্পবোধ নেই। স্থানীয় মালগার কার্পেট শিল্পী আবু
তাহের[সে আবার মালগা পঞ্চায়েত প্রধান। কংগ্রেস করে] বলল দাদা কোন ভাগাড়ে এনে
ফেললেন!!! অথচ তাকে চান্দোল মেলায় ডাকার জন্য পি এন রায় পর্যন্ত আমাদের কাছে দরবার
করেছেন। আবুর বিক্ষোভে আমরা প্রায় মুহ্যমান। আবু কংগ্রেস করে, উদ্বোধন এবং
অন্যান্য সাহায্য করছে তৃণমূল আর সঙ্ঘের জেলা সম্পাদক সিপিএম। গোলযোগ লাগলেই
চিত্তির। এত দিনের সব পরিশ্রম ভেস্তে যাবে। কোনও বিতর্কে না গিয়ে আবুর সামনে হাত
জড়ো করে তাকে সামাল দিই। মনে খচখচানিতো ছিলই। সবাই এত খারাপ বলছে। মেলা খারাপ হলে
কেউ আস্ত রাখবে না)। আবুর কার্পেট বিক্রি হল প্রত্যাশার তুলনায় শুধু ভাল নয়, বেশ
ভাল, এত ভাল বোধহয় কলকাতাতেও হয় নি। উদ্বোধনী মেলা শেষে তার গাল ভরা, কান এঁটো করা হাসি। পরের দিনই তার একটা
দোকান চারটা হল।
তো শেষের আগের রাতে মুখ খুলল দিল্লি। আমরা ত পেরিয়ে থ, থ পেরিয়ে দ। বর
আর ছেলে তাকে মেলায় আসতে দিতে চায়নি। বলেছিল এই দিনাজপুর জেলার চান্দোল হাটে কে
তার ঢোকড়া কিনবে? সপ্তাহে, স্থানীয় এলাকার পাঁচ ছটা হাটে ট্রাক বোঝাই করে
ঢোকড়া চালান যায়। আর প্রত্যেকের বাড়িতেই তিন চারটের বেশি ঢোকড়া আছে। এতগুলো
বিক্রিতো হবেই না। সে গাঁয়ের লোক হাসাবে। কিন্তু দিল্লি জেদ ধরেছিল, মেলায় সে যাবেই। তাকে মেলায়
পাঠিয়েছিল জেলা শিল্প দপ্তর, আমাদের অনুরোধে। তাই তার বর খুব একটা জোর ফলাতে পারে
নি। প্রথমদিন তার ৫ হাজার বিক্রি হতেই প্রায় হতভম্ভ দিল্লি প্রথমে তার বরকে ফোন
করে। বর বিশ্বাস করেনি। ছেলে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। এখন লিখতে লিখতে মনে পড়ল, সেই
রাতে দিল্লি সবার সঙ্গে ছিল না। সে আমাদের বলেই বাড়ি গেল। আমরা একটু বিরক্তই
হয়েছিলাম। ইস্কুল বাড়িতে সবার সঙ্গে থাকার ইচ্ছে হলনা বলে পেছনে বেশ নিজেদের মধ্যে তার প্রতি কটুক্তি করেছিলাম। শেষদিন পর্যন্ত সে বেশ ভাল টাকার ঢোকড়া এবং বাতিল শাড়ি থেকে হাতপাখা, পাটের
তৈরি জলের বোতল বয়ে নিয়ে যাওয়ার জালসহ অনেক কিছু বিক্রি করল। সে বাড়িতে মাত্র
একটা ঢোকড়া ফিরিয়ে নিয়ে গেল। খালি হাতে কোনও বিবাহিত মেয়ের শ্বশুরবাড়ি বাড়ি ফিরতে
নেই।
দিল্লির বরেরমত আমরা মেলায় বিক্রি নিয়ে সন্দিগ্ধ ছিলাম না ঠিকই, কেননা আমরা সন্দেহ কাঁটাকে পাত্তা
দিই নি। এই মেলা আসলে দিল্লিরমত শিল্পীদের শুধুই নিজেদের চিনতে সাহায্য করেছে তাই
নয়, তাদের কাছের বাজারকে নতুন চোখে দেখতেও সাহায্য করেছে। দিল্লি এখন তার এলাকায়
রোজ মিটিং করতে ডাকে। তাঁকে জানিয়েছি আমরা পঞ্চায়েত ভোটের পর যাব।
No comments:
Post a Comment