ভাগীরথী, ময়ূরাক্ষী, অজয়, দামোদর ভল্লুকা বিধৌত বর্ধমান, বাঁকুড়া, বীরভূম আর মুর্শিদাবাদ জেলায় ধর্মঠাকুরের প্রভাব অতুলনীয় । এর মধ্যে বর্ধমানের দাবি বোধ হয় সমধিক । জেলাটির শতাধিক গ্রামেই ধর্মঠাকুরের অবস্থান যেমন লক্ষ্যনীয় তেমনি তার বৈচিত্রও সমধিক। এগুলি কোথাও বারোয়ারি কোথাওবা পারিবারিক দেবতারূপে পুজিত । এই শতাধিক ধর্মঠাকুরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে পঞ্চাশটারও বেশি বাত্সরিক মোলা বা গাজন উত্সব ।
বলা যায়, রাঢ় বাংলায় যে ধর্মরাজের বিবর্তন ঘটেছে, সে দেবতা আদতে এক মিশ্র দেবতা – ব্রাহ্ণণ্য-অব্রাহ্ণণ্য-আর্য-অনার্য-বৌদ্ধ-লৌকিক দেবতা-তান্ত্রিকতার প্রভাব স্পষ্ট ধর্মরাজের শরীরে, পুজোয়, উত্সবে । রাঢ়ের পরিবর্তিত সংস্কৃতির সঙ্গে খাপখাইয়ে তিনি সদাই জনগণেশের সঙ্গে থাকতে পেরেছেন । পণ্ডিতদের কারোর মতে তিনি বৌদ্ধ দেবতা - শূণ্যমূর্তি, কারোর মতে বৈদিক যম, সূর্য ও বরুণ দেবতা, কারোর মতে বিষ্ণুর শালগ্রামশিলার আর্য প্রাধাণ্য বর্তমান । ঘনরাম বলছেন ধর্ম হলেন কৃষ্ণ । অনাবৃষ্টির দেবতা রূপেও তিনি কোনো কোনো গ্রামে পূজিত ।
ধর্মের পুজোয় নানান আচারে জড়িত থাকেন সাধারণতঃ সেবাইত, পণ্ডিত, দেয়াসি, পুজারি হন ডোম পণ্ডিত, বাগদী, জেলে, তন্তুবায় ইত্যাদি সমাজের মানুষেরা - তবে সময়কালে ব্রাহ্ণণেরাও কোথাও কোথাও পুজারি হিসেবেও নিয়োজিত রয়েছেন।
ধর্মরাজের বাত্সরিক পুজো বা গাজন সাধারণতঃ বৈশাখী পূর্ণিমা, জৈষ্ঠ পূর্ণিমা, আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা পৌষ সংক্রান্তি অথবা যে কোনও নির্দিষ্ট দিনে যা আপালার বা হুজুকে গাজন মানে পরিচিত । বর্ধমানে কিন্তু বৈশাখী পূর্ণিমা, জৈষ্ঠ পূর্ণিমায় বেশি ধর্মরাজের গাজন বা বাত্সরিক উত্সব মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে । উত্তর বর্ধমানে তিনি শৈবদেবতা রূপে পুজিত। কোথাও মনসা বা অন্যান্য দেবীর শক্তি কল্পনা করে পুজো হয়ে থাকে – বলিদানেরও পরিকল্পনা হয় । শিবের গাজনের অনুসরনে বাণফোঁড়া, কাঁটা ঝাঁপ, ধূনোপোড়া, বঁটি ঝাঁপ, কুড়মুনে বা পলাশীতে চৈত্রমাসে কালকে পাতারি নাচ, আগুণ সন্ন্যাসও অনুষ্ঠিত হয় । রামচন্দ্রপুরে একসঙ্গে নয়টি ছাগ বলিও হয় । বাঁকুড়া বা হুগলিতে কামিন্যার সঙ্গে যুক্ত ধর্মরাজ ।
কিংবদন্তী হিসেবে শিবলিঙ্গের বা ধর্মরাজের মাথায় গোয়ালার গাভীর বাঁট থেকে দুধ ঝরে পড়ার কাহিনী, পুকুর সংস্কার করতে গিয়ে ধর্মঠাকুরের অস্তিত্ব, কোথাও স্বপ্নে পাওয়া, কোথাও গ্রাম দেবতা বা বা বাস্তু দেবতারূপে ঠাঁই বয়েছে ধর্মরাজের ।
মূর্তির বৈচিত্রও লক্ষ্যনীয় । কোথাও গোলাকার, কোথাও চ্যাপটা, কোথাও কুর্ম মূর্তি, কোথাও চৌকো, কোথাওবা কাঁকড়াকৃতি, কোথাও তিনমাথা বিশিষ্ট পাথর, কোথাও কচ্ছপ, কোথাও সাপের ফণাযুক্ত, কোথাও শুধু একটি কৌটো বিদ্যমান যা খুলে দেখা নিষিদ্ধ ।
একটি উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট হবে - বর্ধমানের জমালপুরের বুড়োরাজের মূর্তিটি অনাদিলিঙ্গ শিবমূর্তি । বুড়োশিবের বুড়ো আর ধর্মরাজের রাজ এই নিয়েই বুড়োরাজ । পুজো উত্সব বৈশাখী পূর্ণিমায় অথচ সাধারণতঃ সবস্থানেই গাজন হয় চৈত্র সংক্রান্তিতে। এখানে একসময় কোনো মন্দির ছিলনা । দেবতা প্রতিষ্ঠায় গাভীর দুধ দেওনের গল্প প্রচারিত । প্রদেয় নৈবেদ্য অর্ধেক শিবের অর্ধেক ধর্মরাজের। শিবের কাছে পাঁছা বলি হয় না কিন্তু ধর্মের নামে কিন্তু পাঁঠা উত্সর্গ হয় - মুসলমান ধর্মাবলম্বীরাও এই মানত করেন। হাড়িরা শুকর বলি দেন । বুদ্ধপূর্ণিমার দিন ৮ হাজারেরও বেশি পাঁঠা বলি হয় । হয় পাঁঠা কাড়াকাড়ি খেলা । বহু গবেষক প্রায় ১০০টির অনেক বেশি নামের উল্লেখ করেছেন - কালুরায়, বনরায়, সুন্দর রায় বা সুন্দরনারায়ণ, কাটারায়, কালাচাঁদ, মামদোরাজ, বুড়োরাজ, ময়নারায়, মেঘরায়, অনাদিনাথ ইত্যাদি।
বর্ধমানের ধর্মরাজের উত্সব হয় এমন কয়েকটি থানার স্থাননামের উল্লেখ করা গেল
বর্ধমান সদর – সুজারি, বড়শুল, শুকুর
ভাতার – এরুয়ার, আড়রা, বেলডাঙা, ডামরা, দেবপুর
মঙ্গলকোট – মাঝিগ্রাম, ঝিলু, পালিগ্রাম, শ্যামবাজার
কাটোয়া – গোয়ালপাড়া, কসিগ্রাম, পনশোনা, শ্রীখণ্ড, চুরপুনি, দেকুণ্ড
কালনা – খেদগাছি, রাণীবন্দ, মাণিকহার
মেমারি – বড়োঁয়া, দাদপুর, বোহার, জারকা, মল্লিকাপুর,
মন্তেশ্বর – ইচুভাগরা
পূর্বস্থলী – জামালপুর
কেতুগ্রাম – বেলুটি, গঙ্গাটিকুরি, কুমোরপুর, ফাঁদরা, পাণ্ডুগ্রাম, শ্রীপুর
জামালপুর – পাঁচড়া, জারগ্রাম, আঙ্গটপাড়া
আউসগ্রাম – বনকুল, বেলুটি, দিগনগর, ধারাপাড়া
খণ্ডঘোষ – গোপীনাথপুর, তেরকোণা, নাসিকা, সড়গাই, গোপালবেড়া
রায়না – তিরাণ্ডুল, সাঁকটিয়া
আসানসোল – নিত্যানন্দপুর
অণ্ডাল – দক্ষিণখণ্ড
জামুরিয়া – হিজলগড়া, জামুরিয়া, কালুডাঙা, সাঁকতোরিয়া, সত্তোর
ফরিদপুর – ফরিদপুর, মেজেদি
রাণীগঞ্জ – নারায়ণকুড়ি, ডামরা
No comments:
Post a Comment