জাগ গান
উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় মদনকাম পুজোর সময় জাগ গান অনুষ্ঠিত হয়। রাজবংশী অধ্যুষিত এলাকায় বসন্তকালে ব্যাপক ভাবে বাঁশ পুজো করা হত। এখনও এই পুজোর রেশ চলে আসছে। চৈত্র মাসের মদন চতুর্দশীর তিথিতে কামেরদেবতা মদনকামদেব পুজো হয়। এ উপলক্ষে লম্বা লম্বা বাঁশের মাথায় চামর বেঁধে বাঁশগুলোকে লাল শালু দিয়ে মুড়ে তুলসী তলায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। বাঁশ হাতে নিয়ে চলে নৃত্যগীত। কামকে জাগানোর জন্য বা কামসংক্রান্ত কথা বা অঙ্গভঙ্গীর প্রচলন আছে বলেই এই গানের নাম জাগ গান। গানে ঘট সৃজন, কামদেব সৃজন, প্রভৃতি বর্ণনা আছে। বহু পূর্বসূরী গবেষক এ ধরনের গানকে অশ্লীল, আশ্রাব্য ইত্যাদি অভিধায় অভিহিত করেছেন - যারা এক কথায় বলা চলে ভিক্টোরিয় সংস্কৃতির প্রতিভূ – দেশজ সংস্কৃতির মূল বিষয় নিয়ে যাঁদের কোনো মাথা ব্যাথা নেই।
জাগ গানের দুটি রূপ – পালা গান আর মাঙনের গান বা ছুট গান। কামদেবের গান ও বাঁশ পুজার গানকে জাগ গানের দুই অঙ্গ হিসেবে বর্ণনা করা যায়। অনেকে বলেন পালাগানগুলির ছুটগান পরবর্তী কালে ভাওয়াইয়া-চটকা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। মনেরাখতে হবে তথাকথিত কলকাত্তাই বা শিষ্ট বাংলার সঙ্গে এ অঞ্চলের কামরূপী ভাষার একটি মৌল প্রভেদ রয়েছে। যে সব বাগরীতি সাধুভাযায় মেলে, সে বাগরীতি কামরূপীতে পাওয়া যায়। এখানে একটি তাত্বিক কথা স্পষ্ট করে পরিষ্কার করা দরকার - কলাবতী মুদ্রা এখানে কামরূপী ভাযাকে কলকাতার পণ্ডিত সমাজে প্রচলিত একটি শব্দবন্ধ - বাংলার অন্যতম কামরূপী উপভাষা বলার প্রবণতা থেকে আলাদা করছে।
এই ভাযায় রচিত কামদেবের কয়েকটি গান – কামদেবের জন্মগীত, বাঁশ সৃজন ও পুজোর গান, কামদেব বন্দনা প্রভৃতি। বহুকাল আগে রংপুর সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় যাদবেশ্বর তর্করত্নসহ কয়েকজন সংগ্রাহক জাগ গান প্রকাশ করেন। এই প্রবন্ধে রাধার শাক তোলা, কৃষ্ণের বঁড়শিতে মাছ ধরা, রাস, কুলটা রমনীক উপপতি বর্ণনা, কৃষ্ণের বংশী সৃজন প্রভৃতি প্রকাশ পায়। এগুলি লীলা ধেমালি নামে পরিচিত। মনেরাখতে হবে রংপুর সাহিত্য পরিষদ পত্রিকার সন্পাদক ছিলেন কোচবিহার জেলার রাজনৈতিক ও সামাজির ব্যক্তিত্ব ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা। এই মানুযটি রাজবংশী ক্ষত্রিয় মহামিলন আন্দেলনের পুরোধা, সেই তত্বের উদ্গাতা ছিলেন রতিরাম দাস। ১৭৮১-৮২তে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলা লুঠের সময়ে গুডল্যান্ড সাহেবের ইজারাদার দেবী সিংএর অত্যাচারের বর্ণনা পাওয়া যায় রতিরামের জাগ গানে। জমিদার শিবচন্দ্র আর জয়দুর্গা দেবীচৌধুরানীর প্রতিবাদ আন্দেলনও সেই সাহিত্যে ঠাঁই পায় –
শিবচন্দ্রের হুকুমেতে সব প্রজা খেপে।
হাজার হাজার প্রজা যায় এর ক্ষ্যাপে।।
নাঠি নিল খল্তি নিল নিল কাচি দাও।
আপত্য করিতে আর থাকিলনা কাও।।
ঘাড়েতে বাকুয়া নিল হালের জোয়াল।
জাঙলা বলিয়া সব চলিল কাঙাল।।
এবং সবশেষে -
খিড়কি দুয়ার দিয়া পালাইল দেবী সিং।
No comments:
Post a Comment