ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়
(জন্ম জুলাই ১৭৮৭ – মৃত্যু ২০
অক্টোবর, ১৮৪৮) ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ পত্রিকার
সম্পাদক ও বাংলা সাহিত্যের প্রথম
কথাসাহিত্যিক। বর্ধমান জেলার উখড়ার
নারায়ণপুর গ্রামে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম। পিতা রামজয় বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার কলুটোলা
অঞ্চলে বসবাস করতেন। ছেলেবেলার পিতার তত্ত্বাবধানে নানা বিষয় এবং বাংলা, সংস্কৃত, ফারসি ও ইংরেজি ভাষা
শিক্ষা করেন। ১৬ বছর বয়স
থেকে তিনি ডাকেট কোম্পানিতে সরকার পদে ১১ বছর ধরে চাকরি করেন। ১৮২১এ তিনি উইলিয়াম
কেরির সঙ্গে ভাগ্যান্বেষনে মিরাটে যান। এই মিরাটেই সেনাবাহিনীতে ছিলেন উত্তরপাড়ার
ভাবি জমিদার জয়কৃষ্ণ এবং তার পিতা।
কেরি কলকাতায় কলকাতার দুর্গের মেজর জেনারেল
হয়ে ফিরে এলে তিনি তার অধীনস্থ কর্মচারীরূপে কাজ করতে থাকেন। এরপর কেরি লন্ডনের
উদ্যেশ্যে রওয়ানা হয়ে যান। ভবানীচরণ নিজ
যোগ্যতায় বিভিন্ন ইউরোপীয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও বিশপ মিডল্টন ও রেজিনাল্ড প্রমুখ ইউরোপীয়ের অধীনে কর্ম করেন। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যর হেনরি ব্লাপেটের সহকারীও হন। সুপ্রিম
কোর্টের প্রধান বিচারপতি বিশপ হেবার তার সম্বন্ধে Narrative of a
Journey Through the Upper Provinces of India, from Calcutta to Bombay
(1824–25) পুস্তকে লেখেন, “...the most
conspicuous-a tall fine looking man, in a white
muslin dress, speaking good English, and the editor of a Bengali
newspaper, who appeared with a large silken and embroidered purse full of silver coins, and presented it
to us....it was the relic of the ancient Eastern custom of never approaching a
superior without a present.. ...a shrewd fellow, well acquainted with the
country...his account of the tenure of lands very closely corresponded with
what I had previously heard from others.”। পরে তিনি কর দপ্তরে প্রধান হিসেবে কাজ করেন। হিস্ট্রি অব শ্রীরামপুর
মিশনে জে সি মাশম্যান লিখছেন, “...Bhobany Churun, a Brahmin of great
intelligence and considerable learning though no pundit, but remarkable for his
tact and energy, which gave him great ascendency among his
fellow-countrymen...”।
৪ ডিসেম্বর ১৮২১ সালে সমাচার কৌমুদী পত্রিকা প্রকাশ করেন। মালিক রামমোহন
রায়। কিন্তু নাম প্রকাশ হত ভবানীচরনের। রামমোহনের সঙ্গে মত পার্থক্যে তিনি সমাচার চন্দ্রিকা পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৮২৮ সালে
প্রভাবশালী সমাজপতি হিসাবে জুরি নিযুক্ত হন। ১৮৩০ সালে রাজা
রামমোহন রায়ের সংস্কার আন্দোলনের বিরুদ্ধে রাধাকান্ত দেবের
নেতৃত্বে ধর্মসভা গঠিত হলে তিনি তার সম্পাদক নিযুক্ত হন। সতীদাহ প্রথা রদ, ভারতের
অর্থনীতিতে বিদেশি বিনিয়োগ ও বিদেশি ধাঁচে সংস্কার প্রবর্তনের তীব্র
বিরোধিতা করেন এবং দেশে বিদেশি অর্থনৈতিক উপনিবেশ স্থাপন রোধে জমিদারদের
দেশীয় সম্পদ উন্নয়নের প্রস্তাব করেন। তাঁর রচিত সাহিত্যগ্রন্থগুলি
তৎকালীন সমাজের দুর্নীতির আবরণ উন্মোচন করে দিয়েছিল। যদিও তাকে গোঁড়া হিন্দু রূপে দাগিয়ে দিতে
মেকলের পুত্রকন্যাদের বিন্দুমাত্র বাধেনি, তবুও বলাযাক, তিনি সামাজিক নানান অবিধান
রোধে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি কোনোদিন সরাসরি সতীর পক্ষে
কথা বলেন নি।
১৮২১ সালে সাপ্তাহিক সংবাদ কৌমুদি পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন
ভবানীচরণ। পরে রামমোহন রায়ের
সঙ্গে ধর্মমত নিয়ে বিরোধ বাধায় তিনি এই কাজ ত্যাগ করেন। ১৮২২ সালের ৫ মার্চ কলুটোলায় নিজে প্রেস স্থাপন করে
প্রকাশ করেন ‘সমাচার চন্দ্রিকা’। রক্ষণশীল হিন্দুসমাজের মুখপত্র হিসাবে পত্রিকাটি সপ্তাহে দুই দিন প্রকাশিত হত। শ্রীরামপুরের সমাচার দর্পনে তার
পত্রিকা প্রকাশের বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেন ভবানীচরন। তবে সম্পাদকীয় অধিকার নিয়ে
হরিহার দত্তর সঙ্গে তার বিবাদ হয়। ক্যালকাটা জার্নালে এক বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে হরিহর
দত্ত ভবানির সম্পাদক হবার দাবি খারিজ করেন। তার জীবনচরিতে তিনি এবিষয়য়ে বিশদে লিখেছেন।কলিকাতা কমলালয় (১৮২৩) ও নববাবুবিলাস (১৮২৫) গ্রন্থদুটিতে তাঁর আক্রমণের লক্ষ্য ছিল কলকাতার বাবু কালচার ও নব্যোদ্ভূত ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী। এছাড়া দূতীবিলাস নামে একটি কাব্য (১৮২৫) ও নববাবুবিলাস-এর দ্বিতীয় পর্ব নববিবিবিলাস (১৮৩১) উল্লেখযোগ্য। এছাড়া শ্রীশ্রীগয়াতীর্থ বিস্তার (১৮৩১), আশ্চর্য্য উপাখ্যান (১৮৩৫) ও পুরুষোত্তম চন্দ্রিকা (১৮৪৪) নামে তিনটি গ্রন্থ রচনা ও হাস্যার্ণব (১৮২২), শ্রীমদ্ভাগবত (১৮৩০), প্রবোধ চন্দ্রোদয় নাটকং (১৮৩৩), মনুসংহিতা (১৮৩৩), উনবিংশ সংহিতা (১৮৩৩), শ্রীভগবদ্গীতা(১৮৩৫) ও রঘুনন্দন ভট্টাচার্য কৃত অষ্টাবিংশতি তত্ত্ব নব্য স্মৃতি (১৮৪৮) সম্পাদনা করেন।
সংস্কার বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব হওয়ায় নবজাগরণের
পরবর্তী পর্যায় থেকেই ভবানীচরণ সমালোচিত ও নিন্দিত হতে
থাকেন। তাঁর সাহিত্যের অশ্লীলতার মোড়কে নীতিবাক্য প্রচারের অভিযোগ
ওঠে। ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের তাঁর
রচনা সম্পর্কে বলেছেন, “‘বাবুর উপাখ্যান’ বা ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের
ব্যঙ্গ আখ্যানগুলি অর্ধশিক্ষিত ধনী সন্তানদের কুৎসিত আমোদ-প্রমোদের
কথা সাধুভাষায় বলা হলেও উদ্দেশ্যটি তত সাধু ছিল না। বাইরের দিক
থেকে এসব নকশায় রঙ্গকৌতুক, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও গল্পের আমেজ থাকলেও ভিতরে ছিল
‘পর্নো’ (porno)-কেচ্ছা-কেলেংকারি। সমাজের কুরীতি দেখিয়ে
সভ্যভব্য মানসিকতা সৃষ্টি, এই জন্যই ভবানীচরণ ও অন্যান্য
নকশাকারেরা কলম ধরেছিলেন; কিন্তু রোগের চেয়ে ঔষধই হয়েছিল প্রাণঘাতী।”
No comments:
Post a Comment