ঠিক ৪ অগ্রাহন, ১৪২০ ভোরে কলকাতায় ফেরাগেল কলাবতী মুদ্রার সদস্য এবং বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও
বস্ত্র শিল্পী সঙ্ঘের সম্পাদক মধুমঙ্গল মালাকারের বাড়ির কার্তিক পুজা শেষ করে।
পুজা শেষ হল সংক্রান্তির দিন। বিসর্জন হল ২ তারিখ। বাংলার পারম্পরিক শিল্প সমাজের অন্যতম ধারক বাহক
বাংলার শোলা শিল্পের কর্ণধার মালাকার সমাজ। মধুমঙ্গল সেই মালাকার সমাজের অন্যতম
পরিচিত প্রতিনিধি। তার নিজস্ব কৃতিতে বিগত ৩০ বছর ধরে বাংলার পারম্পরিক শিল্পী
সমাজের নেতৃত্বভার অর্জন করেছেন মধুমঙ্গল। তিনি তার সমাজ, দেশের প্রতিনিধি হয়ে
বহুবার বাংলা, ভারত এবং
বিদেশে নিজের, দশের এবং
দেশের শিল্পকৃতি, প্রযুক্তি
এবং দক্ষতা উপস্থাপন করেছেন। অতীতে এই পত্রিকায় আমরা মধুমঙ্গলের জীবনের, সংগঠন প্রতিভার নানান দিক
আলোচনা করেছি।
বিগত ৩৫ বছর ধরে মধুমঙ্গল তাদের পারিবারিক
পুজা অনুষ্ঠিত করছেন স্বকীয় স্বাতন্ত্রে। এই তিনদিন তার পরিবারের পুজা মণ্ডপে
বিভিন্ন গ্রামীণ অভিকর শিল্পীরা তাদের হুনর প্রদর্শন করতেন। এবছর একটি পারিবারিক
দুর্ঘটনায় এই অনুষ্ঠানটি মধুমঙ্গল আয়োজন করে উঠতে পারেন নি। মধুমঙ্গলের সঙ্গে তার
পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও এই উতসবে যুক্ত হন। এছাড়াও আরও তিনটি তুতো ভাই পরিবার
একই সঙ্গে একটু আলাদা আলাদা ধরনের কার্তিক পুজা করে থাকেন।
মুস্কিপুরের মালাকার
পরিবারের কার্তিক পুজা ভারতের বহু বিচিত্র, বহু বর্নিল সংস্কৃতির একটি সুসংস্কৃত প্রবাহমান রূপ। স্বাধীন
ধর্মাচরনের এ এক অপুর্ব রূপ। কেননা মধুমঙ্গলের বাড়ির কার্তিকের সঙ্গে থাকেন
লক্ষ্মী, সরস্বতী
এবং সসর্প মনসা দেবী। এছাড়াও কার্তিকের মেড়ের ওপরে থাকেন শিব। বাংলার যে সব অঞ্চলে
কার্তিক পুজিত হন, সেখানে সাধারনতঃ থাকেন শুধু কার্তিক। কিন্তু এখানে, মুস্কিপুর
গ্রামে মালাকার পরিবারে কার্তিক পুজিত হন এক অপুর্ব রূপে। পাশেই এক তুতো ভাইয়ের
বাড়িতে লক্ষ্মী, সরস্বতীর বদলে থাকেন জয়া বিজয়া। মধুমঙ্গল জানালেন বেশ কয়েক দশক
পুর্বে কার্তিকের সঙ্গে পুজিত হতেন ১৪ দেবতা। শিবের সঙ্গে থাকতেন ব্রহ্মা এবং
বিষ্ণুও। এবং এই বহুত্ববাদী দর্শন আজও ভারতের গ্রামে গঞ্জে বহন করে আসছেন ভারতের
গ্রামীণেরা।
গ্রামীণ ভারত এখনও কেন
ইয়োরোপীয় দর্শনে, খ্রিস্ট
ধর্মে পুরোপুরি সম্পৃক্ত হয়ে পড়েনি, তার অন্যতম উজ্জ্বল নিদর্শন মুস্কিপুরের মালাকার পরিবারের কার্তিক
পুজা। আজও, এই
হিন্দুত্বের বজ্রনির্ঘোষ সত্বেও বিচিত্র দেশজ সংস্কৃতির বহুরূপ তার নিজস্বতাতেই
ভাস্বর। এক জাতি, এক ধর্ম, এক ভাষার নেসন স্টেট গড়ে
তোলার অদম্য উতসাহে হিন্দুত্ববাদীরা ভারতের নানান প্রবাহমান সংস্কৃতিকে হিন্দু
সংস্কৃতি হিসেবে মানতে নারাজ। ইওরোপের দেখাদেখি, তাদের ধর্মসংস্কার নকল করে বড় অক্ষরের
জি ওয়ালা গড এবং ধর্মীয় নিদান হিসেবে বাইবেলের দেখাদেখি কেউ বেদ, কেউবা গীতাকে
সর্বজমান্য করতে চাইছেন। অষ্টাদশ, উনবিংশ, বিংশ শতকে যে ধর্ম সংস্কারের ঢেউ উঠেছিল
ইয়োরোপীয়দের ভারতীয় ধর্ম সংস্কারের উদ্যমে, ঠিক সেই উদ্যমেই হিন্দুত্ব বাদীরা নতুন
করে ভারতকে তাদের মত করে ধর্মীয় ডোরে বাঁধতে চলেছেন। কিন্তু ভারতের আপামর জনগনের
একটি বিশাল অংশ তাদের নির্দেশ শুনতে রাজি নন। তাই আজও ভারতের গ্রামগুলোয়
হিন্দুত্বের জোরদার আওয়াজ, ধর্মীয় লড়াই, দাঙ্গা, রাজনীতি, ক্ষমতায় আসীন হওয়া
সত্বেও ভাজপা, স্বয়ং স্ববক সঙ্ঘ, বানর সেনা, দুর্গা বাহিনীসহ হাজারও আর্থিক সঙ্গতি
সম্পন্ন রাস্ট্রবাদী ধর্ম ব্যবসায়ী দলগুলির গ্রহন যোগ্যতা প্রায় শূন্য। এ বিষয়ে বিশদে
এই ব্লগে আমরা দেখেছি, কিভাবে ধর্ম সংস্কারের নামে, নবজাগরনের নামে ভারতের
বহুত্ববাদী ধর্ম, সংস্কৃতির দীর্ঘ, পরীক্ষিত, সহনশীলতাকে ছেঁটে ফেলা হচ্ছে। সেই
বিতর্ক আবারও যদি আলোচনায় ফিরিয়ে আনি তাহলে নিশ্চই পাঠক ক্ষুব্ধ হবেন না। তার আগে মধুমঙ্গলের
বাড়ির পূজার কিছু ছবি। তার পরে আলোচনা।
No comments:
Post a Comment