(ঋণ স্বীকার - ধনঞ্জয় রায়)
উত্তরবঙ্গের লৌকিক মানুষজনের শিল্পকৃতির অন্যতম প্রধান বাহন ধোকড়া বয়ন শিল্প বা মোটা কাপড়। এর একটি সংস্কৃত প্রতিশব্দ রয়েছে - ধোতকট। কবিকঙ্কনে দেখি – সদাগর আচ্ছাদন না ছাড়ে ধোকড়ি। এক সময়ে বাংলার জনসমষ্টি অঙ্গে দুফালি বস্ত্র পরার যে আচার ছিল হাজার হাজার বছর ধরে, সেই আচার এখোনো ধরে রেখেছেন রাজবংশী জনসাধারণ অসাধারণ শিল্পসুষমায় ঢোকড়া শিল্পের মাধ্যমে।
উত্তরবঙ্গের লৌকিক মানুষজনের শিল্পকৃতির অন্যতম প্রধান বাহন ধোকড়া বয়ন শিল্প বা মোটা কাপড়। এর একটি সংস্কৃত প্রতিশব্দ রয়েছে - ধোতকট। কবিকঙ্কনে দেখি – সদাগর আচ্ছাদন না ছাড়ে ধোকড়ি। এক সময়ে বাংলার জনসমষ্টি অঙ্গে দুফালি বস্ত্র পরার যে আচার ছিল হাজার হাজার বছর ধরে, সেই আচার এখোনো ধরে রেখেছেন রাজবংশী জনসাধারণ অসাধারণ শিল্পসুষমায় ঢোকড়া শিল্পের মাধ্যমে।
উত্তরবঙ্গে রাজবংশী সমাজে ধোকড়া শব্দটি বিকল্প বস্তু হিসেবে পরিচিত – যেমন ধোকড় বাপ – বিকল্প বাপ। দিনাজপুরের লোক কথায় চাল-চিঁড়ে-চট-গুড় এই নিয়ে দিনাজপুর- এখানে চট অর্থে ধোকড়া। সাধারণ বাড়িতে এই ধোকড়া বিছিয়েই যেমন অতিথিদের বসতে দেওয়া হয় তেমনি এতে করে ফসল রোদে শুকোতে দেওয়া হয়।
প্রায় দুশতক পূর্বে দিনাজপুরের সুজানগর আর মাহীনগর পরগণায় তাঁত শিল্পীদের বসবাল ছিল। এছাড়াও মথুরাপুর, দেলওয়ারপুর, বাজিতপুর, রাধাবল্লভপুর, কান্তনগর, রাজানগর পরগণার অধীনে বালুরঘাট, কুমারগঞ্জ, তপন, গঙ্গারামপুর, রায়গঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ, বংশীহারি, হেমতাবাদ, ইটাহার, কুশমন্ডি এলাকায়ও তাঁতিরা শিল্পকর্ম করতেন। বাংলার অন্যান্য তাঁতিদের সঙ্গে এই অঞ্চলের তাঁতিদের বিদ্রোহ ইতিহাসের অমর গাথা রচনা করেছে।
উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় ছিলেন রাজবংশী জনগোষ্ঠী। এ অঞ্চলে প্রচুর কার্পাসগাছ জন্মাত যার নাম – বাঙ্গার এই বাঙ্গারের চাষ করতেন রাজবংশীরাই যুগে যুগে।
রাজবংশীদের পাট থেকে সুতো তৈরির করে বয়ন করার এই পদ্ধতি সারা বিশ্বের হস্ত তাঁত শিল্পের এক প্রাচীণ বয়ণ পদ্ধতি হিসেবে পরিচিত। এই বয়ন পদ্ধতিতে খুব বেশি স্থান প্রয়োজন হয় না। শুধু প্রয়োজন দুটি খুঁটি – যা অক্ষদণ্ড রূপে ব্যবহৃত – রাজবংশী ভাষায় তাঁতপোই। কোচবিহার, পশ্চিম দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, মালদহের গাজোল থানায় ধোকড়া শিল্পে নিযুক্ত রয়েছেন – বর্মণ, রায়, দেবশর্মা উপাধিধারী মহিলারা। জনশ্রুতি এই সমাজে পুরুষের তাঁত বোনা নিষিদ্ধ ছিল – পুরুষেরা তাঁত বুনলে তাঁদের পুরুষত্বে হানি হয়। অর্থাত্ মহিলা শাসিত সমাজের যে বিধিনিষেধ তাও আজও সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে এক্কেবারে মিলিয়ে যায়নি – আজও এ অঞ্চলের প্রায় প্রত্যেক হাটে ধোকড়া বিক্রি করেন মেয়েরাই। আর সুন্দর মননশীল ধোকড়া বোনার ওপর নির্ভর করে এই সমাজে মেয়েদের বিয়ের সিদ্ধান্ত।
উত্তরবঙ্গে অন্যান্য এলাকার তুলনায় পশ্চিম দিনাজপুরে এই কাজের প্রবণতা আর উতপাদন ক্ষমতা অনেক বেশি। আজ এই এলাকায় ৩৩ হাজার শিল্পীর নাম সরকারি তালিকাভূক্ত। তবে স্থানীয় শিল্পীদের-মানুষের বিশ্বাস এই ভৌগোলিক এলাকায় অন্ততঃ এক লক্ষ মানুষ এই বয়নশিল্পকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
প্রযুক্তি
জলে ভেজা পাট থেকে ছাল ছাড়িয়ে তাঁশ বা খোয়াগুলোকে চিরে লাছি তৈরি হয়। লাছি নাচো(টাকু)র সাহায্যে পাকিয়ে সুতো তৈরি হয়। পাটের গোড়া অংশ ফোতা আর মাথার অংশটি পাইন নামে পরিচিত। ফোতা হয় মোটা আর পাইন হয় সরু। একটি তাঁতপোইতে দেড় হাত চওড়া আর পাঁচহাত লম্বা একটি ফাটি তৈরি হয়। এরকম তিনটি ফাটি জোড়া দিলে তৈরি হয় একটি ধোকড়া।
তাঁতপোই
তাঁতপোইএর প্রত্যেক অংশ টুকরো টুকরো। তাঁতপোইএর জন্য দুটি বাঁশেক খুঁটি দুহাত দুরত্বে মাটিতে পোঁতা থাকে। দুটি খুঁটির সঙ্গে সমাম্তরাল বাঁধাথাকে দুটি বাঁশ - তাছলা। তাছলার ওপরে একটি কাঠি এবং নিচে একটি বাঁশের কাঠি বাঁধা থাকে। এটি নাম দণ্ডর। নিচের দিকে আরও যে কয়েকটি কাঠি পরপর সাজানো থাকে তাকে বলে জালো কাঠি, পিঁপড়ি কাঠি, কোপনি কাঠি। বোলার সময় প্রথম টান পড়বে কোপনি কাঠির। কোপনি কাঠিটি টানা থাকে দুটি ছোট খোঁটার সাহায্যে। একে বলে। টাকুর সঙ্গে সুতো যখন মাকুতে যায় তখন তাকে বলে কান্তা। এবারে তৈরি হয় এক একটি ফাটি। যে ফাটি চওড়া হয় তাকে বলে পেটোয়ান। তখনই ধোকড়ার ওপর নকশার কাজ শুরু হয়। মোটা সুতো গাঁথার জন্য অর্ধচন্দ্রকার মোটা ও চওড়া লাঠি বেওন দরকার। সরু সুতোর কাঠিকে বলে আলনি। রাজবংশী বয়নী মজবুত ও ঘন জালের একটি অংশ কোমরে পেছনে বেঁধে বোনার কাজ শুরু করেন। এর নাম নেত্তুরং। ফাটি জোড়া দেওয়ার জন্য এমন সুতো তৈরি করেন যেন মনে হয় যন্ত্রে বোনা।
সম্পূর্ণ পশ্চিমি যন্ত্র ব্যতীত হাতে তৈরি ধোকড়া শিল্পের রংও পুরোপুরি ঐতিহ্যশালী পদ্ধতিতে করা হয়। ঝিমুল, জিগা, ভেরেণ্ডা, আমের কুষি, বসনবৈর প্রভৃতি গাছের পাতা, ফল, ছালের রসে সোড়া, লবন জলে মিশিয়ে সিদ্ধ করে কালো, খয়েরি, লাল রং করা বের করা হয়।
সম্পূর্ণ পশ্চিমি যন্ত্র ব্যতীত হাতে তৈরি ধোকড়া শিল্পের রংও পুরোপুরি ঐতিহ্যশালী পদ্ধতিতে করা হয়। ঝিমুল, জিগা, ভেরেণ্ডা, আমের কুষি, বসনবৈর প্রভৃতি গাছের পাতা, ফল, ছালের রসে সোড়া, লবন জলে মিশিয়ে সিদ্ধ করে কালো, খয়েরি, লাল রং করা বের করা হয়।
ধোকড়ার হাট বসে পশ্চিম দিনাজপুরের বংশীহারি থানার সরাই, ইটাহারের পাতিরাজ, কালিয়াগঞ্জ থানার ধনকৈল আর কুনোর, করণদিঘির রসখোয়া, দার্জিলিংএর নকশালবাড়ি, মাটিগড়া। প্রতি বছর ধোকড়ার বাজার হল ২ কোটি ৮৫ লক্ষ ১২ হাজার টাকা।
No comments:
Post a Comment