বাঁকুড়া
বাঁকুড়া মানেই মল্লভূম রাজাদের রাজধানী বিষ্ণুপুর,
বাঁকুড়া মানেই বাংলার ধাতু শিল্পের মহাবলদের বাসভূমি, বাঁকুড়া মানেই সাংস্কৃতিক
ঐতিহ্যমণ্ডিত পিছুটান, যে টানে বারবার ছুটে যেতে হয় নিজের পূর্বজদের কৃতিকে সম্মান
জানাতে, নিজের শেকড়ের পায়ে মাথা ছোঁয়াতে, নিজের পূর্বজদের আনপনেয় আত্মসম্মানের
প্রতি নিজেদের প্রণত করতে।
যে ঘোড়া দৌড়য় না
বাঁকুড়া মানেই আপ্রতিদ্বন্দ্বী পোড়ামাটির কাজ। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের
কাজে পোড়ামাটির শিল্পসামগ্রীর বিচারে প্রাচীন সভ্যতার কাল নির্ণয়ের প্রথা চলে আসছে। কারণ মৃৎশিল্পের বিশ্বজনীনকে আবেদনকে হস্তশিল্পের কাব্য মনে করা হয়। যদিও ধর্মীয় প্রথা ও অনুষ্ঠানের সঙ্গে এর সম্পর্কের আরও গভীরতর গুরুত্ব রয়েছে। ভারতে পোড়ামাটির শিল্পদ্রব্যের ঐতিহ্য বহু প্রাচীন। মুসলমান
ধর্মের পীরের
থান বা আদিবাসীদের জাহের থানে বিপুলাকৃতি ছোড়া, হাতিসহ নানান পশু-পাখির ছলন মূর্তি(রূপক
মূর্তি – ভবিষ্যতে সম্পাদক লিখতে দিলে শুধু বাংলার নানান একালার ছলন মূর্তি নিয়েই
একটা প্রবন্ধ লেখা যায়) আধুনিক কালে অবশ্য বাণিজ্যিকভাবে বিশ্ববাজারে স্থান পেতে মৃৎশিল্পীরা ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ বিমূর্ত শিল্পচেতনার সঙ্গে শহুরে রুচির মিলন ঘটিয়ে
থাকেন।
বাঁকুড়ার পোড়ামাটির ঘোড়া ও হাতি নির্মাণের প্রধান শিল্পকেন্দ্রগুলি হল পাঁচমুড়া, রাজগ্রাম, সোনামুখী ও হামিরপুর। প্রত্যেক শিল্পকেন্দ্রের নিজস্ব স্থানীয় ধাঁচ ও শৈলী রয়েছে। এগুলির মধ্যে পাঁচমুড়ার ঘোড়াগুলিকে চারটি ধাঁচের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম বলে মনে করা হয়
কেননা কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়ের হাতে পড়ে এটি এখন কেন্দ্রীয় হস্তশিল্প
প্রদর্শনশালার প্রতীক হয়েছে ফলে এটির স্থান হয়েছে বাঙালি মধ্যবিত্তের ঘরে। আমি
একজন ছাত্রকে জানতাম, যে শুধু কলকাতায় তার পড়ার খরচ চালাতে পাঁচমুড়াত ঘোড়া কলকাতায়
এনে পাইকারিভাবে বিক্রি করত। এত এর চাহিদা।
বাঁকুড়ার ঘোড়াগুলির ভিতরের অংশ ফাঁপা হয়। এর বিভিন্ন অংশ আলাদা আলাদাভাবে কুমোরের চাকে
তৈরি হয়।ঘোড়ার চারটে পা ও দীর্ঘ গলার দুটি অংশ আর মাথা
- মোট সাতটি অংশ তৈরি করে
পুড়িয়ে সেগুলিকে এক সঙ্গে জোড়া দেওয়া হয়। অনেক সময় ফাটা অংশগুলি ঢাকতে বাড়তি মাটি দেওয়া হয়।পাতার মত আকৃতিবিশিষ্ট কান ও লেজ কাঁচামাটি দিয়ে তৈরি করা হয়। পরে এগুলি মূল ঘোড়ার দেহের তিনটি গর্তে স্থাপন করা হয়। মূল মাটির ঘোড়াগুলি রোদে ফেলে শুকানো হয়। খানিকটা শুকানোর পরে বিভিন্ন অঙ্গ ঠিক ভাবে ঘোড়ার দেহে বসানোর জন্য দেহের ভিতরের ও বাইরের অংশের গর্তগুলি তৈরি করা হয়। এর উদ্দেশ্য হল, উভয় অংশকে সমভাবে শুকানো।উভয় অংশ সমভাবে না শুকালে ঘোড়ার দেহে ফাটল দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্রথম দিকে ছয়-সাত দিন বন্ধ ঘরে শুকানোর পর এগুলিকে রোদে শুকানো হয়। শেষে এগুলিকে আগুনে পোড়ানো হয়।
বাঁকুড়ার পোড়ামাটির ঘোড়াগুলি সাধারণত দুই প্রকার রঙের হয়ে থাকে - লাল ও কালো। ঘোড়াগুলির ফাঁপা শরীর উনুনের মতো ব্যবহার করে এগুলি পোড়ানো হয়। অনেক সময় ঘোড়ার গায়ে ছিদ্র রাখা থাকে, যাতে পোড়ানোর সময় ধোঁয়া বাইরে বেরোতে পারে। এইভাবে পোড়ালে ঘোড়ার গায়ের রঙ হয় লাল। কিন্তু এই গর্তগুলির মুখ আটকে দিয়ে পোড়ালে ঘোড়াগুলি কালো রঙের হয়ে যায়।
তবে আমার অনুরোধ রইল,
যারা বাঁকুড়ার সঙ্গে বিষ্ণুপুর যান বা ঘুরতে যেতে চান, তাঁরা অবশ্যই সোনামুখী
যবেন। সেখানের ঘোড়া পাঁচমুড়ার থেকে বেশ আলাদা, যেমন হামীরপুর, যেমন রাজগ্রামের
ঘোড়া আর হাতি। বাঁকুড়া-বর্ধমান রাস্তায় সোনামুখীর অবস্থান। গেলে ক্ষীরের
সিঙ্গাড়া খাবেন আর ক্ষেত্রীয় গান্ধী আশ্রমের রেশমের থান কিনবেন কেননা একদা বাংলার
যে ২২টি স্থানে মসলিন তৈরি হত সেগুলোর মধ্যে সোনামুখী অন্যতম ছিল, এখানে প্রায়
ব্রিটিশ, ডাচ আর ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ফ্যাক্টরি বা কারখানা আর গুদাম
খুলেছিলেন।
No comments:
Post a Comment