অদম্য বৃন্দাবন আজও বয়ে চলেছেন কয়েক হাজার বছরের বাঙলার প্রাচীণ শিল্পধারা,
হয়ত স্বরস্বতী-মহেঞ্জোদাড়োর সভ্যতা রেশের অন্যতম শেষ
প্রতিভূ তিনি। আর কত দিন পারবেন কে জানে। যে ব্যস্তানুপাতিক হারে অনুপানগুলির দাম বাড়ছে আর শিল্পদ্রব্যের দাম আর
বাজারের ওপর শিল্পীর পকড় কমছে গুণোত্তর প্রগতিতে, তাতে শুধু বৃন্দাবনেদেরমত
শিল্পনৈপুণ্যধারী পরিবারের বেঁচে থাকার আশংকা দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হচ্ছে। বাংলার ইতিহাস অথবা সংস্কৃতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা
হাজারো পারম্পরিক কারু, বয়ন ও অভিকর শিল্পের সঙ্গে যাঁরা হাতেকলমে যুক্ত,
তাঁদের প্রত্যেক পরিবারের সম্বন্ধে একই
কথা বলা যায়। পারম্পরিক হাট-বাজারের নাগাল চলে যাচ্ছে বৃন্দাবনেদের
হাত ছাড়িয়ে অভঙ্গুর প্লাস্টিকের পুতুল ব্যবসায়ীদের হাতে,
মাটির তলার তেল ব্যবসায়ী আর প্রশাসকদের
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অদৃশ্য পরিকল্পনায়। বৃন্দাবনদেরমত প্রজন্ম শেষ হয়ে যাওয়ার মধ্যে দিয়েই কী শেষ
হয়ে যাবে বাঙলার আর এক বিশ্ববরেণ্য প্রযুক্তি আর শিল্প-উদ্যম, গালার পুতুলাদি!
গালার পুতুল অথবা সাজনের দ্রব্য আদতে পোড়ামাটির ওপর রঙিন গালার কাজ।
উদ্যমউইএর ঢিবির মাটিতে পুতুল তৈরি হয়। এই মাটিতে কাঁকর থাকে না, আর মাটি মসৃণ আর আঠালো হয় - চিট ধরে। মাটির পুতুল তৈরি করে পোড়ানোর পর
মসৃণতার ধর্মের জন্য যদৃচ্ছভাবে গালা লাগানো চলে। প্রায় সারা বছর
এই মাটি সংগ্রহ করা গেলেও বছরের বর্ষার সময় এই মাটি বেশি পরিমানে সংগৃহীত হয়। বড় পাত্রে এই মাটি নিয়ে জল মিশিয়ে দু-তিনদিন রেখে তাল তৈরি করে কাঠের পাটাতনে মাটিকে ডলে ডলে মিহি করা হয়, রসগোল্লা অথবা সন্দেশের জন্য ছানা তৈরির
কারিগরীতে। এর পর হাত দিয়ে টিপে গণেশ, লক্ষ্মী, ত্রিনাথ, নানান ধরনের পশু, কচ্ছপ,ডাইনোসর, পাখি, গলার হারের লকেটসহ নানান ধরনের ব্যবহার্য তৈরি করা হয়। পুতুলের বর্ধিত অংশে সরু লোহার তার ঢোকানো হয়,
তার স্থায়িত্ব দেওয়ার জন্য। শিল্পদ্রব্য
গড়ে দিন-তিনেক ছায়ায় রেখে, বেশ দু-তিন দিন রোদ খাওয়ানো চলে। মোট সাতদিনের ছায়া-সূর্যের
খেলা চলে।
শুকনো পুতুল ভাটিতে দেওয়ার কাজ শুরু হয়। ভাটি হয় আড়াই ফুট থেকে তিন ফুট উঁচু। ভাটির নিচের
থেকে কিছু ওপরে লোহার রড দিয়ে ঘুঁটে সাজানোর পর আনুভূমিকস্তরে কিছু পুতুল রেখে আবার ঘুঁটে সাজানো হয়, এরপর স্তরে স্তরে ১৫০টি পুতুল-ঘুঁটে সজ্জার পর আগুণ দেওয়া হয়।যতক্ষননা ওপরের স্তরের ঘুঁটে পুরো পুড়ে না যাচ্ছে, ততক্ষণ পোড়ানো চলে। সাধারণতঃ সকালে আগুণ লাগালে বিকেলে পোড়া পুতুল ভাটি থেকে বার করা হয়।
শিরিষ আর কুসুম গাছের বর্জ গালা – কিন্তু আজকাল শিল্পীরা বড়বাজার থেকেই গালা কেনেন।
পুতুল তৈরির মতই গালার সুতো আর খড়ি তৈরির পদ্ধতিও বেশ সময়-দক্ষতাসাধ্য প্রক্রিয়া।বাঁশের দুটো কঞ্চির দণ্ড নিয়ে সেটিকে গরম করে
দুটি দণ্ডের মুণ্ড দিয়ে গরম গালা চটকে চটকেসুতো তৈরি হয় অলঙ্করণের জন্য আর গালার খড়ি তৈরি হয় সাধারণ রং করার জন্য। হলুদ হরিতাল
সর্বঘটে কাঁঠালি কলা। পুতুলে রং করার জন্য প্রথমে একটি পাত্রে(প্রতিবেদকের দেখা,বাতিল আর্ধেক ভেঙে কলসির মুখ মাটিতে বন্ধ করে, মুখটি মেঝের
দিকে রেখে,
আধখোলা কলসির পেটে জ্বালানো হয় কাঠকয়লা) কাঠকয়লা ধিকিধিকি করে জ্বেলে দুটি একটি পুতুল গরম করা হয়, এরপর পুতুলের নিচের দিকে ফুটোতে লোহা অথবা বাঁশের দণ্ড আটকে দন্ডটিতে আটকানো পুতুলকে আগুনের ওপরে ধরে, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্রয়োজনীয় রং আর অলঙ্করণ হয়।
এই কাজে বড় অনুপান, গালা। দাম বাড়ছে শশীকলাপ্রায়। অথচ পুতুলের অথবা গয়নার দাম বাড়ালে ক্রেতার ভ্রুকুটি। ঠান্ডাপানীয়ের, শহুরে ছবির দাম আকাশ ছুঁলে সেই
বাড়বাড়ন্ত নতমস্তকে মান্য, পারম্পরিক
শিল্পদ্রব্যের কয়েক টাকা দাম বাড়লে, ব্যাটারা লুঠে নিল, গরীব তবু খাঁই কম নয় জাতীয় মন্তব্য হামেশাই ভেসে আসে। তবুও তার মধ্যে বৃন্দাবনেরা বেঁচে থাকার আশ্বাস খোঁজেন নিজেদের ভাবনায়,
সাথী মধ্যবিত্তের কিছু শিল্প দরদী মানুষের হাত ধরে।
No comments:
Post a Comment