কোচবিহার
পুরোনো বাংলা বললে যে কটি এলাকা মানসচক্ষে ভেসে ওঠে,
তাঁর মধ্যে কোচবিহার অন্যতম। মোগল আমলে কোচবিহার যেহেতু সীমান্ত রাজ্য ছিল, তাই
অন্যান্য সীমান্ত রাজ্যের মত কোচবিহারকে মোগল সাম্রাজ্যে কোনও কর দিতে হত না। এটি
চলে আসে বাংলার নবাবী আমল পর্যন্ত। কোচবিহার নিজের মত করে মোটামুটি বহুকাল নিজস্ব
স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে এসেছে। এক সময় সে সর্বভারতীয় সংবাদে এসেছে যখন সুনীতি
দেবীর কন্যা গায়ত্রী দেবী রাজস্থানের রাণী হয়ে যান এবং ইন্দিরা গান্ধীর সময় দুই
ব্যক্তিত্বময়ী নারীর সঙ্ঘাত বাধে।
কিন্তু বাংলায় কোচবিহারের প্রখ্যাতি মূলত শীতলপাটির জন্য। মেদিনীপুরের মাদুরের মতই চিনের
প্লাসটিকের মাদুর খুবই কম দাম হওয়ায় প্রাথমিকভাবে কয়েক বছর আগে এটির বিক্রি বেশ
মার খেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যে কারণে মাদুরের বিক্রি বেড়েছে, ঠিক সেই কারণে
শীতলপাটির হারানো বাজার নতুন করে আবার ফিরে আসছে।
এমনিতেই শহরের ভোগ্যপণ্যের কেনার অভ্যেসে সাধারণতঃ
বিদেশি বা কর্পোরেট উৎপাদনের পাশে থাকে। তার তুলনায় গ্রাম বাংলা অনেক বেশি গ্রামীণ
উতপাদনএর পাশে আজও দাঁড়িয়ে। তাই, মাঝে মাঝে বাজারে নানান কারণে সঙ্কট এলে, বড়
পুঁজির আক্রমণ বা প্রতিযোগিতায় পড়লেও যেহেতু গ্রাম বাংলার মানুষেরা, বিশেষ করে
যারা খুব বেশি ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত নয়, তাঁরা কিন্তু দেশি শিল্পের পাশে থেকে
তাকে টিকিয়ে রাখার কাজ করে গিয়েছেন। এ শুধু শীতলপাটির ক্ষেত্রেই নয় বাংলার প্রায় সব কটি
গ্রাম শিল্পের ক্ষেত্রে একই ব্যাপার ঘটেছে। উত্তরবঙ্গের প্রান্ত উত্তরের জেলাগুলোয়
বিয়েতে অবশ্যই নকশি পাটি দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। আর কোচবিহারের প্রায় প্রত্যেক
মাটির বাড়িতে কিন্তু শীতলপাটি রয়েইছে। অবশ্যই শহুরে পাকা বাড়িতে কিন্তু সেই
প্রবণতা কমছে।
আপনারা খেয়াল করে দেখবেন শীতলপাটি শিল্পীরা কিন্তু খুব বেশি
হস্ত শিল্প মেলায় অংশগ্রহণ করেন না। আদতে এই বাংলাতেই শীতলপাটির বাজার এত বেশি যে
তাঁকে নিজের এলাকার বাইরে খুব বেশি তাকাতে হয় না। যেমন তাকাতে হয় না ধোকড়া বোনা
রাজবংশী মেয়েদের। যদিও কয়েক হাজার পরিবার এই চাষ আর উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত, তবুও
এখনও বাজার খুব শিল্পীদের বিনিয়োগ করা অর্থ ফেরত দিচ্ছে।
কোচবিহার শহর থেকে তোর্সা আর হরণচওড়া লেভেল ক্রসিং পেরিয়ে
মাত্র চার কিমি দূরত্বে শীতলপাটির প্রখ্যাত গ্রাম ঘুঘুমারি। এ ছাড়াও বড় কোদালি, নাক্কাটি-পুষনাডাঙ্গা, দেওয়ানহাট ইত্যাদি অঞ্চলেও শীতলপাটি তৈরি হয়।
অন্যান্য গ্রাম শিল্পের তুলনায় শীতলপাটি শিল্পীরা
বাজারের সঙ্গে জোঝেন কী করে? অন্যান্য শিল্পের মূল উপাদান যেখানে কিনতে হয় সেখানে
মোটামুটি প্রত্যেক শিল্পী শীতলপাটির বেত চাষ করেন। ফলে কাঁচামালটি তাঁরা নিজেরা
নিজের শ্রম দিয়ে তৈরি করে নেন – শুধু জমিটি থাকলেই হল। এক বিঘা জমিতে প্রচুর বেত গাছ চাষ করা যায়। এই পরিমান ফসলে সারা বছর একটি
পরিবারের স্বচ্ছন্দে মোটা ভাত কাপড়ের যোগান হয়ে যায়। অসুবিধে একটাই যে মাটিতে
শীতলপাটির বেতের গাছ হবে সেই মাটিতে কিন্তু আর অন্য গাছ হবে না। কিন্তু একজন
গ্রামীণের কাছে এটা অভিশাপ হলেও একজন শিতলপাটি শিল্পীর কাছে এটি আশীর্বাদ, কেননা
একবার বুনলে মোটামুটি তিন চার বছরের কারু শিল্পী তাঁর কাঁচামালের জন্য নিশ্চিন্তি।
এই বেতকে মুক্তা বেত বলা হয়। কেউ বলেন মুর্তা বেত কেউ
বলেন নলখাগড়া। দেওয়ানহাটের পাটি দম্পতি জ্যোতস্না-সন্তোষ দে বলেছিলেন এর ফুল
মুক্তার মত সাদা বলে এর নাম মুক্তা বেত।
এই নামটা আবার আমাদেরও খুব পছন্দ হয়েছে।
প্রাথমিকভাবে বেত গাছটি কিন্তু কটকটে সবুজ দেখতে হয়।
সেগুলি কেটে এনে ওপরের ছাল ছাড়িয়ে তারপর ছুলে যেতে হয়। এভাবেই পাটির এক একটা ছালা
- বেতি বের হয়। বাড়ির মেয়েরা বেতি ছাড়ায়। ভাতের মাড় আর জল মিশিয়ে বেতিগুলো জ্বাল
দেওয়া হয়। এই মিশ্রণের সঙ্গে একটু টক মিশিয়ে দিলে বেতিগুলো বেশ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আর
মসৃণতাও বাড়ে।
অন্যান্য শিল্পের মত বাড়ির প্রায় সক্কলেই পাটি বুনতে
পারেন। প্রত্যেকে অবসর সময়ে পাটি বোনেন। কুচবিহারের আধিকাংশ
শিল্পীই বাংলাদেশ থেকে আসা। তাদের বক্তব্য এই শিল্পটাই নাকি বাংলাদেশের। কিন্তু আতীতে
এই অঞ্চলে পাটি বোনার ইতিহাস রয়েছে।
সাধারণ একরঙা পাটির সঙ্গে বোনা হয় জামদানি পাটি।
অন্যান্য তন্তু বোনার মত জামদানি বুনতে খুব অঙ্ক করতে হয়। তাই এটি বুনতে বেশ
দক্ষতা লাগে। এ বাংলায় খুব বেশি জামদানি পাটি বোনা হয় না। বছর পাঁচের আগে
দেখেছিলাম ঘুঘুমারির জুরান দের বাড়ি মীনা দেকে জামদানি বুনতে। পাটি বুনকরদের
সংগঠনের নেতৃত্বরা জানিয়েছিলেন নবম শ্রেণীতে উঠে মীনা পড়া ছেড়ে দিয়েছে। এমনকি
জাতীয় পুরষ্কার পাওয়া টগর দেবীও জামদানি পাটি বুনতে পারেন না।
তবে বাজার এত ভাল বলে, নিশ্চিন্তে বসে নেই শীতলপাটি
শিল্পীরা। তাঁরা জানেন গ্রাম তাঁর পাশে রয়েছে। কিন্তু শহরের বাজার ধরতে তাঁরা শীতলপাটির
নানান ব্যবহার্য জিনিস বানাচ্ছেন, বিশেষ করে মেয়েদের থলে বা ব্যাগের বেশ চাহিদা
হয়েছে। ছেলেদের আপিস যাওয়ার ব্যাগেরও বেশ দাম সত্ত্বেও তাঁর চাহিদা কমেনি। ল্যাপটপ
ব্যাগও শিল্পীরা বানিয়ে ফেলেছেন। শীতলপাটি আর নানান ধরণের প্রাকৃতিক তন্তু দিয়েও
মিলিয়ে মিশিয়ে তাঁরা ব্যাগ বানাচ্ছেন। এগুলিও বিভিন্ন আপিসে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন
আলোচনা সভা, কর্মশালা ইত্যাদি অনুষ্ঠানে দেয় হিসেবে। ইংরেজি শিক্ষিত পরিবারের
পরিকাঠামো লক্ষ্য করে, তাদের বাড়ির নানান চাহিদা মেলে নানান জিনিস বানাচ্ছন তাঁরা।
টি কোস্টার, টেবল ম্যাট, লেফাফা রাখার জন্য লেটার/ম্যাগাজিন হোল্ডার, মোবাইল কেস,
পার্স ইত্যাদি বেশ ভাল বিকোচ্ছে।
নতুন করে ভাবতে পারেন, বাড়ির স্কার্টিংএ বা মেঝেয় কার্পেটের
বদলে শীতলপাটি ব্যবহার অথবা বাড়ি আপিসে কাজের যায়গায় বা দোকানে যদি নকল ছাদ তৈরি
করান তাহলে শীতলপাটি ব্যবহারের পরিকল্পনা করতে পারেন খরচ কম হবে দেখতে সুন্দর হবে।
আর আপনার ভালবাসা যে দেশের গ্রাম শিল্পে রয়েছে, আপনার রুচি পছন্দ অন্যদের থেকে বেশ
আলাদা, এমন এক নিরুচ্চার বক্তব্যও প্রকাশ পাবে।
No comments:
Post a Comment