কুনরের পোড়ামাটির কাজ দু ধরণের সমাজ করেন, একটি
পালেরা পরম্পরা আর বাংলার ঐতিহ্য মেনে। আর বেশকিছু রাজবংশী ঘরও মাটির কাজ করেন।
কয়েক বছর আগেও এই দুই সম্প্রদায় অন্য ধরণের সামগ্রী উৎপাদন করতেন, সম্প্রতি
কলকাতার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নতুন ধরণের নানান জিনিসপত্র তৈরি করতে শিখিয়েছেন।
সেগুলি আদৌ বেশিদিন বাজারে চলবে কি না তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহল সন্দিহান।
এছাড়াও রায়গঞ্জের লাগোয়া সুভাষগঞ্জএও মাটির কাজ
হয়। সুদৃশ্য হাঁড়ি, কলসি, বড় ফুলদানি ইত্যাদি তৈরি করছেন তাঁরা।
ধোকড়া
দিনাজপুরের আরও আকর্ষণ ধোকড়া। রাজবংশী
সম্প্রদায়ের মেয়েরা করেন। মহানন্দার অববাহিকা জুড়ে যে পাট উতপন্ন হয় সেই সোনালী
পাটে একমাত্র রাজবংশী মেয়েরা ছোট্ট মণিপুরি তাঁতে শহুরে ভাষায় জুট ম্যাট বা ধোকড়া
বানান। দেড় ফুট চওড়া আর পাঁচফুট লম্বা পাটের বুননকে বলে ফাটি। তিনটি ফাটি একসঙ্গে
জুড়ে তৈরি হয় ধোকড়া। রাজবংশী সমাজে ধোকড়ার ব্যবহার বহুবিধ। বাঘ পালানো
মাঘের শীতে গায়ে দেওয়া থেকে জিনিসপত্র শোকানো থেকে অতিথি এলে
পেতে বসতে দেওয়াসহ নানান কাজে ব্যবহার হয় ধোকড়া। প্রত্যেক
রাজবংশী মহিলা ধোকড়া বুনতে জানেন। পুরুষেরা তাঁতে হাত দেন না। বোনাতে মহিলাদের
একচ্ছত্র অধিকার।
ইটাহার-খুনিয়াডাঙ্গি-ফতেপুর-কালিয়াগঞ্জ রাস্তায়
মহিষবাথান একাকায় রাজবংশী মেয়েরা একজোট হয়ে তৈরি করেছেন স্বনির্ভর গোষ্ঠী। এঁরা
সক্কলে বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সঙ্ঘের সদস্য। এদের নিজেদের ৬টা
চিত্তরঞ্জন তাঁত রয়েছে, আর রয়েছে পারম্পরিক ঠকঠকি তাঁতও। এদের সঙ্গে রয়েছেন প্রায়
এক হাজার দক্ষ বুনকর নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রৌঢ়া আকুলবালা সরকার আর যশোদা সরকার এবং
আকুলবালার জামাই মাধব। আকুলবালা নিজে দারুন খন শিল্পীও বটে। মাধব নিজে খুব ভাল
মুখোশ শিল্পী।
পরম্পরা বজায় রেখে এঁরা তৈরি করছেন নানান ধরণের
পরিধান দ্রব্য এবং নতুন ধরণের খেস – যা শান্তিনিকেতনের আঙ্গিক থেকে এক্কেবারে
আলাদা, নিজেদের ঐতিহ্যে দাঁড়িয়ে থেকে কী করে নতুনকে বরণ করতে হয় তা দেখিয়েদিলেন
আকুলবালাদের স্বনির্ভর দল। ধোকড়ার শান্তিনিকেতনী থলে তৈরিতে এঁরা
মাহির হলেও এঁরা কয়েক বছর ধরে তৈরি করছেন পাটের জ্যাকেট, পশমের
চাদর, রেশমের নানান জিনিস ইত্যাদি।
একটু অন্য ধরণের পাটের কাজ করছেন --- সত্যেন আর
তাঁর স্ত্রী। সঙ্ঘ একবার গ্রামীণ বাজারের অবস্থা বুঝতে সাত দিনের মেলা আয়োজন
করেছিল দিনাজপুরের ফতেপুরের চান্দোল হাটে। সেই মেলায় রবাহূতের মত এসে হাজির
হয়েছিলেন এই দম্পতি। তাঁর পর থেকে সঙ্ঘের নানান কাজে এঁরা জড়িয়ে পড়েছেন নিজেদের
সামর্থ্যে। পরম্পরার নানা পাটের কাজের সঙ্গে বাজার বুঝে নিজেরা তৈরি করছেন নতুন
নতুন জিনিস। প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। প্রচুর শিল্পী তৈরি করছেন। একটা দারুন জিনিস তৈরি
করেছেন সেটি হল পাটের সুতলির জ্যাকেট। দুর্দান্ত দেখতে, বেশ ভাল পরতেও।
কলাগাছের তন্তুর দ্রব্য
ফতেপুরের ক্ষীরোদাবালা সরকার তৈরি করছেন কলা
গাছের আঁশ দিয়ে তৈরি নানান ধরণের থলে। ক্ষীরোদার মেয়েও একবেলা স্থানীয় একটি
বেসরকারি বিদ্যালয়ে কাজ করে সেই কাজে হাত পাকিয়েছে। কেরলের শিল্পীরা আড়াই ফুটের
বেশি তন্তু তৈরি করতে পারেন না, কিন্তু ক্ষীরোদার নেতৃত্বে বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু
ও বস্ত্র শিল্পী সঙ্ঘের শিল্পীরা যত বড় গাছ তত বড় তন্তু তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।
দাম বেশি। তাঁরা চাইছেন আরো বেশি ক্রেতা তাহলে আরোবেশি উৎপাদন হয়, দামটা আরও একটু
কমে।
রাজবংশী পুরুষেরা অপূর্ব কাঠ আর বাঁশের কাজ
করেন। প্রত্যেক রাজবংশীরা যেন মায়ের পেট
থেকে পড়েই যেন দক্ষ তক্ষণ শিল্পী হয়ে ওঠেন। উষাহরণ, কুশমণ্ডি, হরিরামপুর,
কালিয়াগঞ্জ ইত্যাদি ব্লকে কয়েক হাজার রাজবংশী সারা দেশে চড়িয়ে রয়েছেন শুধু বাঁশ আর
কাঠের কাজের দক্ষতার জন্য। কলকাতায় নানান পুজো মণ্ডপে এই এলাকার কয়েক শ মানুষ কাজ
করেন নানান ধরণের শৈল্পিক বাঁশের কাজের জন্য। জোট বেঁধে প্রচুর পুরষ্কারও পেয়েছেন।
বিশেষ করে দার্জিলিং আর জল্পাইগুড়ি এলাকার মোটা বাঁশ দিয়ে এঁরা নানান জিনিসের
মধ্যে তৈরি করছেন বাতিদানি, মুখোশ ইত্যাদি। তবে শিল্প রসিকদের আনুরোধ করব এলাকায়
গেলে অবশ্যই কিন্তু রাজবংশীদের চিড়ে কোটা ঢেঁকি সংগ্রহ করবেন। অপূর্ব তার নির্মাণ
শৈলী। অপূর্ব তার দর্শনী।
No comments:
Post a Comment