আবিভক্ত দিনাজপুর
মোটামুটি পুরনো বাংলার পুণ্ড্রবর্ধন হিসেবে যে
অঞ্চলটি আমরা জানি সেটির একটি অংশ হল দিনাজপুর। বাংলার পুরনো যে কটি জনপদ রয়েছে,
যার জন্য বাংলা আজ গর্ব করতে পারে, তা হল পুণ্ড্রবর্ধন আজকের দিনাজপুর। একদা
কালিদাসের বিরহী যক্ষ যখন উড়ে যাচ্ছিল মেঘের রূপ ধরে তখন এই বাংলায় দেখেছিল মেয়েরা
আখের রস বার করে সেই রসের গুড় জাল দিচ্ছে সেই গুড়ের নামে গৌড়ি যদিও, কিন্তু এই
আখকে সারা ভারত আজও যে নামে চেনে, সেটি হল পুণ্ডী আখ। বিপুলাকৃতি সব দিঘী রয়েছে এএ
জেলায়। রায়গঞ্জের সাংবাদিক সুনীল চন্দ বলেছিলেন, রাজবংশী শব্দভাণ্ডারে ইটা শব্দের
অর্থ দীঘি আর হার মানে মালা। গোটা দিনাজপুর জুড়ে বিপুলা সব দিঘী। স্থানীয় মানুষেরা
৪০-৫০ বিঘার জলা ভূমিকে দিঘী বলেন না। এই এলাকাই পাল পাজ বংশের এলাকা। এখানেই
রয়েছে মহীপাল দিঘী। কিচ্ছু নেই, একটি ঘাট আর কচুরিপানাওয়ালা একটি মস্ত জলাশয় ছাড়া,
কিন্তু এখানেই ঘটেছিল পাল রাজাদের আমলে কৈবর্ত বিদ্রোহ – ভীম আর দিব্যোক লড়ে
হেরেছিলেন পাল রাজবংশের কাছে।
প্রাচীন পুন্ড্রবর্ধন ছিল উত্তরবঙ্গ তথা বাংলার এক প্রাচীন নগরী। শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতির দিক দিয়ে এই নগরী প্রাচীন বিদিশা ও শ্রাবস্তীর চেয়ে কোন অংশেই কম ছিল না। করতোয়া নদীর তীরবর্ত্তী এই নগরীর তীর্থ মাহাত্ম্য ছিল। পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এই নগরীর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। অধুনা বাংলাদেশের বগুড়ার নিকটবর্তী মহাস্থানগড়ই ছিল এই সুপ্রাচীন পুন্ড্রবর্ধন নগরী। কোটিবর্ষ ছিল প্রাচীন পুন্ড্রবর্ধনের অন্তর্গত প্রসিদ্ধ নগর। এই কোটিবর্ষেরই অন্য নাম ‘বানগড়’। বর্তমানে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলর পুনর্ভবা নদীর তীরবর্তী গঙ্গারামপুর থানার (বর্তমানে গঙ্গারামপুর একটি মহকুমা) বানগড়ই সেই প্রাচীন কোটিবর্ষ। মুসলমান শাসনকালে এর পরিচিতি ছিল
‘দেবীকোট’ নামে। সুপ্রাচীন কোটিবর্ষের শিক্ষা, সাহিত্য, কৃষ্টি-কালচারের খ্যাতি ও মর্যাদা কৌশাম্বী, প্রয়াগ, মথুরা, উজ্জয়নী, কান্যকুব্জ ও পাটলীপুত্রের চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না। এই ‘বানগড়কে’ ঘিরে বহু কাহিনী প্রচলিত আছে।
কুনরের পড়ামাটি
দিনাজপুরের রায়গঞ্জ থেকে ইটাহারের দিকে এসে
দুর্গাপুর হয়ে কুনর আর রায়গঞ্জ কালিয়াগঞ্জ হয়ে কুনুর যাওয়া যায়। গ্রামে গেলে নতুন
ধরণের পোড়া মাটির কাজ দেখতে পাবেন। কুনরের কারুকার্যময় মাটির ঘোড়া আর হাতি এককালে
খুব কলকাতায় বিক্রি হয়েছে। এখন আর সেই অপূর্ব সুন্দর মাটির ঘোড়া কোনও কুমোর তৈরি
করেন না। অথচ পীরের দরগায় মানতেরর জন্য ছলন ঘোড়া কিন্তু ভালই বিক্রি হয়। স্থানীয়
এলাকায় আছেন জন্ডি পীর, ঘটা পীর, এন্ডিয়া পীর, মাণিক পীর। হিন্দু মুসলামান উভয়ের
আরাধ্য পীরবাবারা। ধনকৈল হাটে ঘোড়া বিক্রি করতে যাওয়ার আগে পীরের দরগায় ঘোড়া চড়িয়ে
যান কুনরের শিল্পীরা। ইতিহাস বলছে সম্ভবত বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয় স্মরণীয় করতে
এই ঘোড়া তৈরির কাজ শুরু। গবেষক শিশির কুমার মজুমদারের ভাষায়
ঘোড়াগুলি ত্রিভূজাকৃতি। সাম্নের পা আআর বুকে রক্ষণশীল ভঙ্গী। বুকের মধ্যে যেন কোনও
আদিমতা লুকিয়ে রয়েছে।
একই সঙ্গে খোদাই করা পিরিচ আর পেয়ালা বেশ বিকোয়। এ ছাড়াও নানান
ধরণের মাটির আলোসাজ, আপূর্ব পিদিমদানিও রয়েছে। বাজার বুঝে কেউ কেউ গয়নার কাজ
করছেন। ১৯৮২ সালে প্রয়াত লক্ষ্মীকান্ত রায় জাতীয় পুরস্কার পান। এছাড়াও মা-মেয়ে
পুতুল, পেচি(তেল রাখার পাত্র) ধুনুচি, বরুয়া(দুধ দোয়ার পাত্র) ইত্যাদি তৈরি করেন।
স্থানীয় হাটে মেয়েরাই উৎপাদন বিপণনের জন্য নিয়ে যান।
No comments:
Post a Comment